জ্বলদর্চি

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য-৩/ গৌতম বাড়ই

   অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য   


ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য

 গৌ ত ম  বা ড় ই

 (পর্ব-৩)

ঘোড়াডিহি থানার ডিউটি অফিসার অনুজ শীল আমাদের সব কথা মন দিয়ে শুনলেন আগে।তারপর ওনার চোখা চোখা প্রশ্ন আমাদের দিকে।পুলিশের চোখে তো সবাই অপরাধী এ পৃথিবীর।আর পৃথিবীর চোখে সব পুলিশ অফিসার-ই একই গোত্রের।প্রাথমিক ভাবে।

তা তিনদিন হয়ে গেলো আপনারা মিসিং ডায়েরী করেন নি কেন?

আমরা আগের অভিজ্ঞতা আর সালতামামির চরিত্রের কিছুটা বললাম।পুলিশ অফিসার এবারে সোজাসুজি আমার দিকে প্রশ্ন করলেন।

দেখুন এরমধ্যে কোনো লাফরা নেই তো?আমি তো একটা ত্রিকোণ প্রেমের ছায়া দেখছি।আপনি সেই তৃতীয় চরিত্র কি?আপনাদের এই নামগুলো এই রিলেশন সব কেমন যেন গোলমেলে। আপনাদের এই ইনফরমেশন নোট করতেই আমার খটমট লাগতে শুরু করেছে। দেখুন ব্রাদার কেঁচো খুঁড়তে যেন কেউটে বেরিয়ে না আসে।

সন্দেহ আর অনুসন্ধান করা আপনার ব্যপার।আমাদের মিসিং ডায়েরীটা নিন আগে।আমি ভেগে যাব না আর পালিয়ে যাব না।

রাখুন মশাই ওসব ভদ্দরলোকী কথা।আপনার পরিচয় দিন।মুখে নয় শুধু,কাগজেও।ম্যাডাম এ ব্যপারে আপনি কিছু বলতে যাবেন না।এ পুলিশের ডিউটি।

খুব দরদ!ম্যাডাম!মহিলা দেখলেই যেন সস্তার দরদ উথলে পড়ে।আমি না পেরে আমার পরিচয় পত্র বের করে দিলাম।মনযোগের সাথে কিছুক্ষণ দেখে বললেন-তা ঠিক আছে।তবে এই পুলিশের ডিউটি কাউকেই বিশ্বাস করে না।আপনি সাংবাদিক আর সংবাদপত্রে যখন আছেন একটা খবর তৈরী করছেন না কেন?এই মুহূর্তে তো ই-মিডিয়ার সাথে প্রিন্ট মিডিয়াও তো চলছে আবার।

সে আপনাকে বলে দিতে হবে না আশা করি।আর মনে মনে বললাম তোর বাপকে বিশ্বাস করিস তো?

বলে বেরিয়ে এলাম ঘোড়াডিহি থানা থেকে
মিসিং ডায়েরী করে। মোবাইলে দেখলাম রাত নটা চল্লিশের মতন।কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম সালতাকে ফোনে পেতে।তারপর মেঘকে নিয়ে যখন ওদের এপার্টমেন্টের কাছে পৌঁছালাম দেখি দুজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে আর সিকিউরিটি গার্ড -এর  সাথে কথা বলছে।আমি ভেবেছিলাম একেবারে মেঘকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে যাবো।বাইক থেকে নামতেই সিকিউরিটি গার্ড ছেলেটি  আমার দিকে এগিয়ে এলেন। হঠাৎ কি মনে হলো দাদা থেকে স্যার সম্বোধন করে বললেন-স্যার আপনি আজকে আর এই এপার্টমেন্টের ভেতর ঢুকবেন না।

আমার বিশেষ প্রয়োজনেই ঢুকেছি।আমার নিজের লোকের ভীষণ বিপদে।ওনারা কি এই এপার্টমেন্টের হর্তাকর্ত্তা?

হাঁ স্যার।ওনারাই আপনাকে কাল থেকে এখানে আসা যাওয়া করতে দেখছেন খুব বেশি করে তাই।এখন আনলক-১ চললেও লক ডাউন পুরোপুরি উঠে যায়নি।তাই কিছু বিধিনিষেধও আছে।

বুঝলাম ঐ দুটো মাতব্বর গোছের লোকের শেখানো কথা বলছে এ সিকিউরিটি গার্ড ছেলেটি।
তাই মেঘকে বললাম যা এগিয়ে যা।দরকার পড়লে ফোন করিস।

ঠিক আছে বলে মেঘ এগিয়ে যায়।আমি বাইক ঘোরাতে যাবো এমন সময় ঐ এপার্টমেন্টের ভদ্রলোক দুটি আমায় গলা হাঁকিয়ে একটু দাঁড়াতে বললেন।আমার সামনে এগিয়ে এলেন।মাস্ক পড়া নেই। কিছু বলবেন।আমিও মনে মনে বেজায় তৈরী হয়ে নিলাম।

এগোবেন না আর। স্বাস্থ্যবিধি মানুন। মুখে মাস্ক নেই কেন?বলুন কি বলতে চাইছেন।

আমার গলার আওয়াজে এপার্টমেন্টের গেটে মেঘ দাঁড়িয়ে গেলো।লোকদুটি একটু হলেও আচমকা এই কথাতে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন।

বললেন- আপনি অযথা এখানে আসবেন না।বিশেষ করে এখন যা পরিস্থিতি।দরকার পড়লে ওনাকে কমপ্লেক্সের মেইন গেটে ডেকে নেবেন।

আমি সজোরে বাইক স্ট্যান্ড করে এগিয়ে গেলাম ওনাদের দিকে।

অযথা বলতে কি বলতে চাইছেন?আপনারা জানেন গত দুদিনে আপনাদের প্রতিবেশি একজন মহিলা একা কী ভয়ানক বিপদের মধ্যে পড়েছেন?আপনাদের মেয়ে মানুষ দেখলে চুলকানির গল্প শুধু মনে পড়ে?একটা একলা অসহায় মহিলাকে মাঝে মাঝে মানুষ ও ভাবতে হয়।যেমন নিজের ঘরের মেয়ে বা বৌ বা মাকেও তো ভাবেন।আমার এখানে দরকার আছে।আর আমি আসবোই।আপনারা জানেন উনি আমার কে?

জোরে বললাম-মেঘ তুই ঘরে যা।আমি এক্ষুণি বেরিয়ে যাবো।

ভদ্রলোক দুজন জানতে চাইলেন মেঘের সাথে আমার কী সম্পর্ক।আমি ব্যক্ত করলাম না।সজোরে বাইক চালিয়ে বেরিয়ে এলাম ওখান থেকে। মোবাইলে মেঘকে বললাম-দাপটে থাক।বিরক্ত করলে বলে দিবি পুলিশে খবর দেবো।যা কথা কাল সকালে হবে। আমার মন পড়ে রয়েছে সালতার ডায়েরীতে।দ্রুত চললাম ঘরের দিকে।

(আমাদের কিছু কথা)

সালতামামি মেঘরোদহাসি আর আমার বন্ধুত্ব কলেজ জীবন থেকে। সালতামামি উত্তরবঙ্গ থেকে এসেছিলো।মেঘরোদহাসি সোদপুর থেকে।আমি বেলেঘাটার। সালতামামি খোদ শিলিগুড়ি শহরেরও নয়। শিলিগুড়ি মহকুমার নকশালবাড়ি থানার একটি গ্রাম সুবলভিটা ওর বাড়ি। জঙ্গল ঠেলে চা সমুদ্র পেরিয়ে ছোট্ট একটা নদীর পাড়ে ওদের বাড়ি। পাহাড়ী নদী।এমনি সময় তিরতিরে জল বয়ে চলে।শুনেছি বর্ষায় ভয়ংকর।চৈত্রে দুখুর বৌয়ের মতন শুকনো বুকে বালি নুড়ি চিকচিকে।হাতি আসে ধান খেতে।চিতাও কখনো।শেয়ালের চোখ অন্ধকারে জ্বলজ্বল।হাতিঘিসা পাহাড়গুমিয়া বাতাসী এইসব জনপদ।সেইসব জনপদে তখনও কিছু কিংবদন্তী নকশাল নেতা কানু সান্যাল জঙ্গল সাঁওতাল এদের বাস।তাদের দেখতে গিয়ে অবাক হয়েছি। মানুষকে ভালবেসেছিলো আর একটা আদর্শ নিয়ে তারা রাজনীতি করতে এসেছিলেন অন্ততঃ তাদের সেই সময়ের জীবনযাত্রা দেখে বুঝেছিলাম।আমার আর মেঘের চোখ খুলে দিয়েছিলো সালতামামি।একটা চেতনা একটা জীবনবোধ শুধু বইপড়ে মহানগরে থেকে হয় না।সে জীবনধারা রপ্ত করতে হয়। অন্ততঃ জীবনের কাছে নিজেকে সৎ থাকতে হয়।সেখানে বর্ণ ধর্ম কিছু নেই।মেকী লোকেদের, ভণ্ড রাজনৈতিক নেতাদের ঐ রঙচঙে জামা পড়ে বহুরূপী সাজতে হয় নাটক করতে হয়।আমার ঘোড়াডিহির ডায়েরীর ছেঁড়াপাতার লেখাগুলি শোনানোর ফাঁকে সালতার টুকরো কথা না বললে এ লেখাটি সার্থক হবে না।আমরা তিনজন হয়ে উঠলাম ভয়ংকর রকমের বন্ধু এবং এখনও তাই।

আজ বাড়িতে ঢুকবার মুখে দেখলাম মেজো বৌদি দাঁড়িয়ে আছে এক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ নিয়ে আমার ঘরে ঢোকার গেটের কাছে।আমি একটা হালকা হাসি দিয়ে বৌদির মুখের দিকে চাইলাম।বৌদি প্রত্যুত্তরে হাসলো না।আমার দিকে সরাসরি চেয়ে বললেন--দেখ ছোটো তুই কি কোনো ঝামেলায় পড়েছিস?আমি তোকে সবসময় পাশে না দেখতে পেলেও তোর সব গতিবিধির কিন্তু খেয়াল করি।গত দুদিন ধরে বিশেষ করে এই বাজে সময়ে এবং সর্বনাশের মারণ একটা সময়ে তুই তোর পেশাগত জীবনের বাইরে অন্য কোন কিছুতে ব্যস্ত আছিস বোধ হয়?তোর সময় আর অসময়ে এই ঘরে ঢোকা থেকে বুঝি।কাল সারারাত তোর ঘরে আলো জ্বলেছিলো।তেমন কিছু হলে আমায় শেয়ার করতে পারিস।আমি যখন বৌ হয়ে এই বাড়িতে আসি তুই তখন বলতে গেলে অনেক ছোটো।আজ বড় হয়েছিস অনেক।বিয়ে কেন করলি না?আমি এমন ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে কোনদিনও যাইনি। শুধু বলতে চাইছি জীবনের সব মানসিক বোঝা একাই নিস না।মা দিদি কেউ নেই এখন তোর কাছে পাশে।আমি তো আছি রে ছোটো!


আমি অবাক হয়ে মেজোর দিকে তাকালাম।আজ এতো রাতে মেজোকে আমার একটা প্রণাম করতে ইচ্ছে করলো।যা কখনো আমার কাউকে দেখে মনেই আসে না।আসলে আমরা প্রত্যেকেই বিচ্ছিন্ন এক একটা দ্বীপ।যখন একটা সুনামির ছোঁয়া লাগে, আমরা নিজস্ব ভাব ভঙ্গীতে কেমন যেন এক হয়ে যাই।আমি মেজোর দিকে তাকিয়ে বললাম-মেজোবৌদি তোমায় কাল সময় করে অবশ্যই বলবো সকালে।যদি না কোন কারণে হুট করে বেরিয়ে পড়তে হয়।তাহলে অন্য সময়ে সময় করে।
মেজোবৌদি একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে জিগ্গেস করলেন খাওয়া হয়েছে কিনা।আমি অন্যসময় হলে ঘাড় কাত করে বলতাম হাঁ, কিন্তু আজ আর পারলাম না।মেজো বললে-ফ্রেশ হয়ে নে।আমি পিকলুকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।তুই আজ রাতে আর কিছু করতে যাস না। 



আমি খেয়েদেয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সালতামামির ডায়েরী পড়তে লাগলাম। ডায়েরীটা আজ হাজার কাজের মাঝে ব্যাগেই পড়েছিল।মেঘকে আর দেওয়া হয়নি।হিজিবিজি অনেক কিছু লেখা ওর।তবে তার মাঝে কোথাও কোথাও সময় তারিখ আর ডেটলাইন দিয়ে সেদিনের ডায়েরী লেখা।মাঝে মাঝে ছেঁড়াপাতা, ভাঁজকরা পাতা।মেঘ আর সালতা কী ডায়েরী নিয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তী করতো?জানিনা।তবে ওরা আমার ভীষণ জিগরি দোস্ত।আমরা তিনজন নিজেদের কোন সময় বিচ্ছিন্ন ভাবি না।মনে আছে সালতা যেদিন হাইস্কুলের মাষ্টারীটা পেলো পরপর সাতদিন কী বেজায় স্ফূর্তি আর মজা করেছিলাম আমরা।আমরা কখনও কারও এমন কী নিজেদের ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকি না।ডায়েরীর পাতা ওলটাতে ওলটাতে একটা জায়গায় এসে থমকে গেলাম। খুব বড় করে লেখা আছে ----আজ ভালোবাসার নামে পরপর তিনটি রসগোল্লা খেলাম।
ভালোবাসা শব্দটি সালতামামির হাতে খুব কম ঘোরাফেরা করে।ও এই সময়ে যে সব কবি বা লেখক লিখছে ভালো তাদের মধ্যে ব্যতিক্রমী একজন সালতামামি।আমার চোখ ডায়েরীর এই পাতায় আটকে গেলো।মাঝে মেঘ ফোন করেছিলো বললো--শোন নো টেনশন!ওরা তোর কথার জোরেই ঘাবড়ে গ্যাছে।তাই কেউ-ই আর আসেনি।এবার আমাদের সালতাকে নিয়ে আমরা ঘুমোই চল।

তুই ঘুমো।গুড নাইট।সকালটা নিজে সামলা। আমি সালতার ডায়েরী নিয়ে বসেছি।ওটা তো তোকে দিয়ে আসা হলো না ব্যাগেই থেকে গিয়েছিল।ঠিক আছে।কালকে আবার কথা হবে।

এরপর চতুর্থ পর্বে। 

Post a Comment

1 Comments

  1. Enjoy korchi. Kindly shob khando gulo amake forward/tag kore deben. Shob episode onek shomoy khuje pai na.

    ReplyDelete