জ্বলদর্চি

দিল্লি দর্পণ -১৩ / কালীপদ চক্রবর্ত্তী

দিল্লি দর্পণ 
পর্ব -১৩

কা লী প দ  চ ক্র ব র্ত্তী  

দিল্লির সুস্বাদু কিছু খাবার 

দিল্লিতে বাঙালি পাড়াগুলোতে অর্থাৎ চিত্তরঞ্জন পার্ক, নিবেদিতা এনক্লেভ, মহাবীর এনক্লেভ ইত্যাদি জায়গায় বাঙালিদের মোটামুটি প্রায় সব জিনিসই পাওয়া যায়। শুক্তো থেকে চাটনি, মাছ, মাংস, হাসের ডিম সবই পেয়ে যাবেন এই বাজার গুলোতে। এমনকি মোয়া, নাড়ু, থেকে মোগলাই পরটা, বিভিন্ন ধরনের চপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি এসব বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। তাই দিল্লির বাঙালিরা বাংলার খাওয়ার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় না, যদিও দামগুলো স্বাভাবিক ভাবেই একটু বেশি। এখানে মোচা, মুড়ি, ঝালমুড়ির সাথে সাথে কলকাতার ফুচকাও পাবেন। 

তবে দিল্লিতে প্রধাণতঃ পাঞ্জাবিদের বা উত্তর ভারতের খাবার আপনি একবার খেলে আপনাকে তারিফ করতেই হবে। দিল্লিতে যেসব খাবার খুব সুস্বাদু তারমধ্যে কয়েকটির উল্লেখ করছি। আপনারা অনেকেই হয়তো ইতিমধ্যেই কিছু খাবারের স্বাদ আস্বাদন করেছেন। আমি দিল্লির বাইরে গিয়েও এই খাবারগুলো খেয়েছি কিন্তু দিল্লির মত স্বাদ খুঁজে পাইনি। যেমন কলকাতার রসগোল্লা বা মিষ্টির স্বাদ আপনি বাংলার বাইরে যেখানেই খান না কেন সে স্বাদ পাবেন না। যদিও কলকাতার কারিগররা আজকাল দিল্লিতে আসাতে আমরা দিল্লি বাসীরা তার কিছুটা রস-আস্বাদন করতে পারি। 

প্রথমেই আসি ‘পরোটা’-র কথায়। এখানকার স্থানীয় লোকেরা যখন উচ্চারণ করেন তখন ‘পরোঠা’-র মত শোনায়। এই পরোটা দিল্লিতে খুবই প্রচলিত একটি খাবার। অনেক লোকই এই পরোটা দিয়ে তাদের সকালের জল-খাবার সারেন। এখানে বিভিন্ন ধরণের পরোটা পাওয়া যায়, প্লেন পরোটা থেকে শুরু করে  আলুর, ফুলকপির,মুলোর, ডিমের, ডালের ইত্যাদির হয়। সে পরোটা একবার খেলে আপনার মুখে সে স্বাদ লেগে থাকবে। পুরাতন দিল্লিতে ‘পরোঠাওয়ালা গলি’ খুবই বিখ্যাত ছিল এক সময়ে। আজও সেখানে দেশী ঘিয়ের সাথে বহু ব্যাঞ্জনসাথে পরোটা পাওয়া যায়, তবে আগেকার কত স্বাদ আমার মত অনেকেই খুঁজে পান না। কোথাও পড়েছিলাম কাশ্মীরের মহারাজা, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার একসময় সেখানে পরোটা খেতে যেতেন। দিল্লিতে এলে লাচ্ছা পরোটা অবশ্যই একবার চেখে দেখবেন। ভাঁজে ভাঁজে বা পরতে পরতে দেশি ঘি দিয়ে বানানো এই পরটা আপনার বহুদিন মনে থাকবে।
শোনা যায়, মুলচাঁদ ব্রিজের কাছে যে বিখ্যাত পরোটা-ওয়ালা পরোটা বিক্রি করেন, তার কাছে শারুখ খানও পরোটা খেতে যেতেন। 

দিল্লির আরেকটি সুস্বাদু খাবার হল, চাট। এই চাট-ওয়ালাদের কাছে পাবেন, আলুর টিক্কি,দহিভাল্লা, পাপড়ি চাট, গোলগাপ্পা (ফুচকা / পানিপুরি)। দিল্লিতে স্ট্রীট ফুডের মধ্যে চাট হল একটি জনপ্রিয় খাবার। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি চাঁদনিচকের স্ট্রীট ফুড খুব বিখ্যাত। যারা দিল্লির চাট খেয়েছেন তারা জানেন যে দিল্লির চাটের স্বাদ অতুলনীয়। এ স্বাদ দিল্লির বাইরে আপনি কোথাও পাবেন না। সুস্বাদু আলুর টিক্কি সব জায়গায় পাওয়া গেলেও চাঁদনিচকের নটরাজ কাফে এর জন্য খুবই বিখ্যাত।

দিল্লির কয়েকটি জায়গা চাটের জন্য বিখ্যাত, যেমন ইউ পি এস সি-র কাছে অর্থাৎ শাহজাহান রোডে, বিট্টূ টিক্কিওয়ালা করোল বাগে, দৌলত কি চাট চাঁদনিচকে এবং নটরাজ দহিভাল্লেওয়ালা চাঁদনিচকে।  

আপনি যদি আমিষাশী হয়ে থাকেন তবে দিল্লির ‘বাটার চিকেন’-এর স্বাদ নিতে ভুলবেন না। দরিয়াগঞ্জের মতিমহল রেস্টুরেন্ট ১৯৫০ সাল থেকে আজও তার নাম অক্ষুণ্ণ রেখেছে। সেখানকার তন্দুরি চিকেনেরও খুব সুনাম আছে। আপনি এই খাবার পাণ্ডারা রোডের ‘হ্যাভ মোর’ নামক দোকানেও পেয়ে যাবেন। আজকাল অবশ্য আপনি দিল্লির প্রায় সব জায়গাতেই রাস্তার ধারে বা বাজারগুলোতে এধরনের খাবারগুলো পেয়ে যাবেন। সাধারণত: ভাত বা নান দিয়েই পরিবেশন করা হয়।

দিল্লিতে যেহেতু মোঘলরা রাজত্ব করেছে একসময় তাই তাদের কিছু কিছু খাবার আজও দিল্লিতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে সুস্বাদু একটি খাবার হল ‘কাবাব’।পাঠার মাংস বা মুরগির মাংস বা মাছ দিয়ে বিভিন্ন সুগন্ধিজাত মশলা দিয়ে ম্যারিনেট করে গ্রিলড করে বানানো হয় এই কাবাব। অপূর্ব এর স্বাদ। আজকাল দেখেছি বহু জায়গায় পনীরের কাবাবও পাওয়া যায়। এক খাবারগুলোও আজকাল প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যায়, তবে রামকৃষ্ণ পুরমের আল কা কোরি, লাল কুঁয়ার ওস্তাদ মইউদ্দিন কাবাব, নিজামুদ্দিনের গালিব কাবাব কর্নার, খান মার্কেটের সেলিমের কাবাব এবং সফদরজঙ্গ ডেভেলপমেন্ট এলাকার আপ কি খাতির খুবই বিখ্যাত।

দিল্লির আর একটি নামকরা খাবার হল ছোলে বটুরে (ভটুরে)।  এটি খুবই মুখরোচক, মশলাযুক্ত এবং তৈলাক্ত খাবার। দিল্লির মত ছোলে বটুরে আপনি এই রাজ্যের বাইরে কোথাও পাবেন না এটা আমি জোর গলায় বলতে পারি। তাই দিল্লিতে এলে প্রাতরাশের তালিকায় এটিকে রাখতে ভুলবেন না। আজকাল দিল্লির সব জায়গাতেই এটি পেয়ে যাবেন, তবে জায়গা বুঝে স্বাদের তারতম্য হবে তাই ভাল কোনও জায়গা থেকেই খাওয়া ভাল। সাধারণত: এর সাথে লস্যি পরিবেশন করা হয়। পাহাড়গঞ্জের সীতারাম দিওয়ানচাঁদ বা কমলা নগর-এর চাচা দি হাট্টী ছোলে বটুরে খুব বিখ্যাত। তবে আপনি যদি সস্তায় টিফিন সারতে চান তাহলে আছে কুলচে-ছোলে। এটিও উত্তর ভারতে একটি জনপ্রিয় খাবার।

মোঘলরা আরও একটি খাবার ছেড়ে গেছে, সেটি হল বিরিয়ানি। তবে দিল্লিতে বিভিন্ন জায়গায় বিরিয়ানির স্বাদ আলাদা আলাদা। ধাবার বিরিয়ানির স্বাদ, বড় দোকানের বিরিয়ানির স্বাদ এবং পাঁচতারা হোটেলের বিরিয়ানির স্বাদ স্বাভাবিকভাবেই আলাদা আলাদা হতে বাধ্য। এখানকার বিরিয়ানির বিশেষত্ব হল, এখানে অনেক জায়গাতেই মাটির হাঁড়িতে মুখবন্ধ অবস্থায় বিরিয়ানি পরিবেশন করা হয় যাতে মশলার স্বাদ ও গন্ধ অটুট থাকে। আই টী সি মৌরিয়া (মৌর্য) হোটেলের “দম পুক্তি”-র, রামকৃষ্ণ পুরমের আল কাকরি আল কৌসের, ডিফেন্স কলোনির ডিজ বিরিয়ানি এন্ড কাবাব বিরিয়ানির জন্য বিখ্যাত। 

দিল্লির রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অনেক জায়গায় হয়তো মাংস এবং মশলার ঘ্রাণ আপনার নাকে ভেসে আসবে। এই মাংসের ঝোলকে স্থানীয় ভাষায় নিহারি-ও বলে থাকেন অনেকে। নিহারি নামে এই মাংসের ঝোল নাকি অনেকক্ষণ ধরে জাল দেওয়া হয়। সাধারণত: তন্দুরি রুটি সহযোগে পরিবেশন করা হয়। পুরাতন দিল্লিতে সকাল সকাল রাস্তার ধারে রিকশাওয়ালা, শ্রমিক ইত্যাদিদের ভিড় দেখা যায় এইসব দোকানগুলোর সামনে। জামা মসজিদের সামনে করিমের দোকান এই মাংস বিক্রির জন্য বিখ্যাত। 

যদিও কলকাতা রোলের জন্য বিখ্যাত, দিল্লিতেও বেশ ভাল ভাল হোটেল এবং রেস্টুরেন্টেও এই কাঠিরোল বিক্রি হতে দেখবেন। কর্ণাট প্লেসের নিজাম, খান মার্কেটের খান চাচা এবং সাউথ এক্সটেনশনের কুরেশির কাবাব কর্নারের সুনাম আছে রোল-এর জন্য। তবে এখানে রাস্তার আশেপাশে লেবানীজ মিট ডিস শওরমা (Shawarma ) প্রায় সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। 

মোমোর সম্পর্কেতো আর বলতে হবে না। মনে হয় সারা ভারতবর্ষে আজকাল মোমো ছেয়ে গেছে। অফিস পাড়ায়, জন্মদিনের পার্টিতে এবং ককটেল পার্টিতেও মোমোর উপস্থিতি দেখা যায়। দিল্লির যে কোন অফিস বিল্ডিং এর পাশে বা মার্কেটে গেলে বহু মোমো বিক্রেতাকে দেখতে পাবেন। এখানে আজকাল ভেজ এবং নন-ভেজ ষ্টীম মোমো ছাড়াও পাওয়া যায় ফ্রাইড মোমো,তন্দুরি মোমো, কুড়কুড়ে মোমো ইত্যাদি আরও অনেক ভ্যারাইটি। অবশ্য কমলা মার্কেটের দিল্লি হাটে নাগাল্যান্ড ফুড স্টলের মোমো, পঞ্চশীল মার্গের সিকিম হাউসের মোমো, গ্রেটার কৈলাসের কাফে ব্রাউন সুগার, চানক্যপুরী-র যশোবন্ত কমপ্লেক্স, দিল্লি ইউনিভারসিটির নর্থ ক্যাম্পাসের কাছে মজনু কি টিলা এই মোমো-র জন্য খুবই বিখ্যাত জায়গা। 

দিল্লির লোকেদেরও আমাদের বাঙালিদের মত খাওয়ার শেষে মিষ্টি খাওয়ার একটি অভ্যেস আছে। তাই তাদের বলতে শোনা যায় – খানে কা বাদ কুছ মিঠা হো যায়ে। এখানে বাঙালিদের মত ভাল ছানার মিষ্টি হয়তো সব জায়গায় পাবেন না, তবে দেশী ঘিয়ে ভাজা জিলিপি (জেলেবী), বিভিন্ন ধরনের আইসক্রিম, রাবড়ি ফালুদা, কাস্টার্ড, আম পাঁপড় (আমসত্ত্ব), দেশী ঘি-এর তৈরি মতিচুরের লাড্ডু, গুলাব জামুন (লেডিকেনি-র মত কিন্তু গরম গরম খেতে হয়) ইত্যাদি খেতে খুব বেশি পছন্দ করে। এসবই আপনি পেয়ে যাবেন চাঁদনিচকের গিয়ানি দ্যা হাটটি এবং পুরাতন এবং নতুন জেলাবীওয়ালার দোকানে। কথিত আছে, রাজ কাপুর এবং ইন্দিরা গান্ধিও এই দোকানের জিনিস বেশি পছন্দ করতেন। এছাড়াও লালকুঁয়ার কুরেরিমাল মোহনলাল কুলফি-ওয়ালা, খান মার্কেটের বিগ চিল কাফে, চাঁদনিচকের ঘন্টেওয়ালা হালওয়াই এরাও খুব নামকরা এদের খাবারের জন্য।  

দিল্লিতে আলুর তরকারির সাথে কচুরিও বেশ সুস্বাদু খাবার লোকেদের কাছে। তবে এগুলো সব খাস্তা হিং-এর কচুরির মত। বিশেষ বিশেষ কিছু জায়গা আছে দিল্লিতে যেখানকার কচুরি খেতে বহু দূর থেকেও লোকেদের আসতে দেখেছি। যেমন শেখ সরাই, ফেস-২ এর গুপ্তাজীর কচুরি। এই গুপ্তাজীর বিশেষত্ব হল এটি রেড়িতে করে বিক্রি করা হয়। গুপ্তাজী দুপুর ১২টা নাগাদ তার রেড়ি (চারচাকাওয়ালা ঠ্যালা ) নিয়ে এসে হাজির হয় এবং বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হওয়ার আগেই তার সব কচুরি বিক্রি হয়ে যায়। রীতিমত লাইন লাগে। ইউ টিউবেও কোনও খাদ্য রসিক এই গুপ্তাজীর কচুরির উল্লেখ করেছে চোখে পড়ল। 
দিল্লিতে এসে যদি আপনি কর্ণাটকের বিসি বেলে ভাত খেতে চান তাহলে আপনাকে যেতে হবে রাও তুলা রাম মার্গে, কর্ণাটক সংঘ-র কর্ণাটক ফুড সেন্টার-এ। অন্ধ্র-র ভাল খাবার খেতে হলে চলে যাবেন অন্ধ্র ভবন-এ। সেখানে কমমূল্যে ভাল অন্ধ্রের খাবার পাওয়া যায়। তবে ইডলি, দোসা আপনি দিল্লির সর্বত্রই পাবেন, কারণ দিল্লিতে দক্ষিণ ভারতের লোকও আছে প্রচুর পরিমাণে। 

দিল্লির কয়েকটি মিষ্টির মধ্যে শোন হালুয়া খুব প্রসিদ্ধ। দেশী ঘি, কর্নফ্লাওয়ার, দুধ এবং স্যাফ্রন ইত্যাদি দিয়ে বানানো হয় এই মিষ্টি। এই মিষ্টিটি বেশ সুস্বাদু এবং দামও অন্যান্য মিষ্টির চেয়ে একটু বেশি।  (চলবে)

Post a Comment

8 Comments

  1. মুখে জল চলে এল। সত‍্যিই বেশ কিছু খাবার আছে দিল্লীর যা না খেলে অনুভব করা যাবে না। খুব ভাল লাগলো, এতেই এই বয়সে পেট ভরাতে হবে।

    ReplyDelete
  2. মুখে জল এসে গেল

    ReplyDelete
  3. এই অসাধারণ লেখাটা রেখে দিতে হবে,একটু পরিশ্তিথী ঠিক হলেই খাওয়া র অভিযান শুরু করবো

    ReplyDelete
  4. এই অসাধারণ লেখাটা রেখে দিতে হবে,একটু পরিশ্তিথী ঠিক হলেই খাওয়া র অভিযান শুরু করবো

    ReplyDelete
  5. নানান রকম খাবারের সন্ধান নিয়ে আপনি হাজির। সঙ্গে জানলাম কোথায় কোনটা বিখ্যাত 😋😃

    ReplyDelete
  6. আপনি শুধু সাহিত্য ‌রসিক না, খাদ্য রসিক ও।

    ReplyDelete
  7. আহা, আহা, জবরদস্ত। বাসনার সেরা বাসা রসনায়। এবার কি দিল্লি কা লাড্ডুর সুলুক সন্ধান !!

    ReplyDelete
  8. জিহ্বে জল আসতে বাধ্য অত সমস্ত খাবার , মনে হ্ছে স্ন্মুখে হাজির । বাঃ, অপূর্ব ।

    ReplyDelete