জ্বলদর্চি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : ইতিহাসের অলিগলিতে /প্রশান্ত ভৌমিক

Sunil Gangopadhyay

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : ইতিহাসের অলিগলিতে

প্র শা ন্ত  ভৌ মি ক

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’ এবং ‘পূর্ব পশ্চিম’ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এই তিনটি উপন্যাসকে একত্রে সুনীলের ‘টাইম ট্রিলজি’ বলা হয়। বিশেষত কবি সুনীলের পাশাপাশি এই উপন্যাসগুলোর জন্যেও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিশেষভাবে সমাদৃত হন।

উল্লেখ্য যে, এই ট্রিলজির নায়ক হচ্ছে সময়। ব্যাপারটির খুব সুন্দর ব্যাখ্যা দেয়া আছে ‘সেই সময়’ উপন্যাসের ফ্ল্যাপে।  “একটি বিশেষ সময়ই এই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র। নাটকের শুরুতে যেমন দেওয়া থাকে পাত্রপাত্রীদের নাম এবং পরিচয়, তেমনভাবে যদি গোড়াতেই দেওয়া থাকত এই বিপুল বর্ণাঢ্য উপন্যাসের চরিত্রাবলীর নাম, সত্যিই বিস্ময়কর মনে হত সেই তালিকা। মাইকেল, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও, হেয়ার সাহেব, দেবেন ঠাকুর-কে নেই! সমস্ত উনবিংশ শতাব্দীই এই উপন্যাসে যেন নানান চরিত্র হয়ে চোখের সামনে জীবন্ত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বহু পরিশ্রমে, ধূলিমলিন পৃষ্ঠা ঘেঁটে প্রায় গবেষকের মতোই হাজির করেছেন সেই সময়কে। শুধু যেটুকু তফাৎ তা হল, গবেষকের রচনার মধ্যে প্রাণ থাকে না, তিনি সেই প্রাণটি প্রতিষ্ঠা করেছেন।”

প্রথমে ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ‘সেই সময়’ উপন্যাসটি। পরবর্তীতে কলকাতার ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ ১৯৮১ সালে দুই খন্ডে উপন্যাসটি প্রকাশ করে। একই প্রকাশনী থেকে উপন্যাসের অখণ্ড সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। ১৯৮৩ সালে উপন্যাসটি বঙ্কিম পুরস্কার এবং ১৯৮৫ সালে আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হয়।

‘সেই সময়’ উপন্যাসের উপজীব্য ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ শাসনামলের বিকাশমান কলকাতা নগরীর সমাজ এবং মানুষ। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জমিদারপুত্র নবীনকুমার। নবীনকুমার চরিত্রটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচনা করেছিলেন ঐতিহাসিক চরিত্র কালীপ্রসন্ন সিংহের অবলম্বনে। নবীনকুমার চরিত্রটি সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, “আমার কাহিনীর পটভূমিকা ১৮৪০ থেকে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ। এবং এই কাহিনীর মূল নায়কের নাম সময়। … সময়কে রক্ত-মাংসে জীবিত করতে হলে অন্তত একটি প্রতীক চরিত্র গ্রহণ করতে হয়। নবীনকুমার সেই সময়ের প্রতীক। তার জন্মকাহিনী থেকে তার জীবনের নানা ঘটনার বৈপরীত্য, শেষ দিকে এক অচেনা যুবতীর মধ্যে মাতৃরূপ দর্শন এবং অদ্ভুত ধরণের মৃত্যু, সবই যে সেই প্রতীকের ধারাবাহিকতা, আশা করি তা আর বিশদভাবে এখানে বলবার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনীয় কথা শুধু এই যে, নবীনকুমারের চরিত্রে এক অকাল-মৃত অসাধারণ ঐতিহাসিক যুবকের কিছুটা আদল আছে। অন্য কোনো প্রসিদ্ধ পুরুষের নাম বা জীবনকাহিনী আমি বদল করিনি…।”

যেখানে ‘সেই সময়’-এর কাহিনি শেষ হয়েছে, সেখান থেকেই শুরু হয়েছে ‘প্রথম আলো’র কাহিনি। ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসটি ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী কালে ‘আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড’ থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই বইটির ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয় অক্সফোর্ড থেকে।

সুদীর্ঘ এই উপন্যাসটির শুরু হয় ত্রিপুরার রাজপরিবারের কাহিনি দিয়ে। তারপরে তা ক্রমশ জমাট বাঁধে কলকাতায় ঠাকুর পরিবারে এবং তৎকালীন অন্যান্য বিশিষ্ট সব মানুষদের নিয়ে। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলি সবই প্রায় বাস্তব ঐতিহাসিক চরিত্র। যেমন রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ পরমহংস, নটী বিনোদিনী, গিরিশচন্দ্র প্রভৃতি।

এই ট্রিলজির শেষ উপন্যাস ‘পূর্ব-পশ্চিম’। এই উপন্যাসটিও ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। উপন্যাসটিতে ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের সময়কার পরিস্থিতি, দেশত্যাগ, উদ্বাস্তুদের জীবন, নতুন প্রজন্মের চিন্তাধারা, পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলন, এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ স্থান পেয়েছে। ফ্ল্যাপ থেকে- “দুই বাংলার দুই পরিবারকে কেন্দ্র করে রচিত এই উপন্যাসে বিশেষ কোন চরিত্রকে মুল চরিত্র বলা যাবে না। একই সঙ্গে অনেকগুলো প্রধান চরিত্র। এইসব চরিত্রের কেউ-কেউ আবার পূর্ব বা পশ্চিম বাংলার গণ্ডিতেই আবর্তিত নয়, ইউরোপ-আমেরিকাতেও গেছে। ফলে, কলকাতার কফি হাউসের পাশাপাশি কখনও আবার আমেরিকার চোখ-ধাঁধানো শহরের কথা এই উপন্যাসে।”

‘পূর্ব-পশ্চিম’ মানে শুধু পূর্ব কিংবা পশ্চিম বাংলা নয়। পূর্ব গোলার্ধ ও পশ্চিম গোলার্ধের বৃহত্তর পটভূমিও এর অন্তর্গত। আবার মানুষের জীবন ও মনে যে পূর্ব ও পশ্চিম, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও উত্থান-পতন, সূচনা ও দিনাবসান- তাও যেন প্রতিফলিত এই নামকরণে।

ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, লেখক সুনীলকে উপলব্ধি করতে হলে পড়তে হবে অন্তত এই তিনটি উপন্যাস। লেখকের সাথে ভ্রমণ করতে হবে ইতিহাসের পথ ধরে। তুলে আনতে হবে সময়ের ঝরাপাতাগুলো।
-------------------------------------------------------
প্রতি শুক্রবার প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিক। 
আপনাদের অভিমত পেলে ভালো হয়। 
jaladarchi@yahoo.in     


Post a Comment

0 Comments