জ্বলদর্চি

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য-১০/গৌতম বাড়ই

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য

গৌতম বাড়ই
পর্ব-১০



আরে কী কাণ্ড দেখেছিস মেঘ!
কী রে?
আমায় মেজবৌদি বলেছিল-তুই ঘোড়াডিহি পৌছে আমায় একটা খবর দিস যে পৌঁছে গেছি।তাহলেই হবে।
তো দিয়ে দে।এমন কী রাত!সাড়ে বারোটা।

আমি ফোন করে বৌদিকে খবরটা দিলাম।বৌদি বলল ঠিক আছে ছোটো সাবধানে থাকিস।এই সাবধানে থাকিস, ভালো থাকিস,দেখে শুনে যাস,খবর দিস-এই শব্দগুলো শোনানোর মতন লোক যখন বয়স বাড়ার সঙ্গে ক্রমেই কমতে থাকে তখন মনে এদের হারানোর ব্যথাটা বাজে খুব বেশি করে।জানিনা কেন মেজবৌদি এই দু একটা দিনেই আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে এসে জননী হয়ে বাসা বাঁধছে।একটা সময় মেজবৌদি সত্যি এমন কিছু ছিলো।তখন মা বাবা বোন ঘরভর্তি লোকজন।তারপর বড় হয়ে কী করে যেন আমি মেজকে হারাতেই থাকি।হারাতে হারাতে দূরে সরে যেতে থাকি।অথচ আমি যদি একটু বিশ্লেষণ করতাম দেখতেই পেতাম মেজবৌদি প্রতিটি মুহূর্তে আমার খাওয়া দাওয়া ঘরে ফেরা ভালো থাকবার খবর নিয়ে গিয়েছে।আমার সেই অন্তর্মুখী চোখটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।একটু আদ্র হচ্ছে ভেতর মেজবৌদির কথা ভেবে।এই কোভিড-১৯ এত খারাপের মাঝেও আমায় আমার মেজবৌদিকে আগের মতন ফিরিয়ে দিয়েছে বা দিচ্ছে আমার কাছে।এটাই আমার কাছে ভালো।

কী এত্তো ভাবছিস রে বুদ্ধু?নে পড়তে শুরু কর।


লেখাটা এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি।কড়া লক ডাউন চলছে তখন।সবাই গৃহ বন্দী।টিভির খবরে উপচে পড়ছে সবাই।দেশজুড়ে আতঙ্ক।করোনা আক্রান্ত আর মৃত্যুর মহামারি পৃথিবী জুড়ে।পড়তে শুরু করি পাশে গালে হাত দিয়ে বসে পড়লো মেঘ।

১৭-ই এপ্রিল
রাত দুটো

একটা দেশ কতটা বিজ্ঞানকে ঝেড়ে ফেলে অন্ধ কুসংস্কার ধর্মীয় গোঁড়ামির দ্বারা পেছনে ফিরে চলতে পারে এই দেশ তার প্রমাণ।আমার বাবাকেও দেখতাম কীর্তন আর পালাগানের নেশায় এখানে ওখানে গিয়ে রাতভোর করে ফিরতো।আমি বলতাম-তুমি এতে কতটা সুখ পাও মনে?বাবা বলতেন-অনেক।তোর চিন্তাধারায় সেখানে ছুঁতেও পারবি না।তোদের দু-ভাইয়ের মধ্যে তুই ছোটবেলা থেকেই ব্যতিক্রম,তুই কী জানিস তোকে বলে বকাঝকা দিয়ে আমরা সরস্বতী দেবীর পুজোয় কোনদিন অঞ্জলী দেওয়াতে পারিনি।অথচ তোর দাদা ঘন শীতের মধ্যেও সাত সকালে চান করে সুবলভিটা প্রাইমারি স্কুলে যাবার জন্য তৈরী।তবে তা স্বত্ত্বেও তুই সরস্বতী মায়ের অশেষ  আশীর্বাদ পেয়েছিস। জানিনা কেন!আমি মনে মনে বললাম ছাই পেয়েছি।কী পেয়েছি অচিরেই জানবে।সেই বাবাটা আমি যখন কলকাতা পড়তে এলাম আমার হোস্টেল খরচ থাকা খাওয়া মেটাতে গিয়ে ভেতরে ভেতরে নিজেকে এতো নিঃস্ব করে ফেলেছিলো একবার বাড়ি গিয়ে জানতে পারলাম।সুবল ভিটার রাস্তার ধারে একটা পাঁচ কাঠার মতন  জমি ছিলো।চাষবাস হতো।শস্য কখনও শশা কুমড়োর ফলন।একবার গিয়ে দেখি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।দাদা বলল-বাবা তোর পড়াশোনার খরচে ওসব বেচে দিয়েছেন।আমি বাড়ি ফিরে এসে বাবাকে বলেছিলাম-আমার জন্য তোমার এই গোটা পরিবার নিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া আমি আর চাইনা।আমার খরচ আমি নিজেই এটাওটা করে চালাবো।আশা করি কলকাতা শহরে সে রোজগারের জন্য কোন অসুবিধা হবে না।তারপর এখানে ওখানে লেখালেখি প্রেসে রাতে প্রুফ দেখা এইসব শুরু করি।বাবা বলেছিলেন-দেখিস সায়ন্তন তোর পড়াশোনাটায় যেন ঐ জন্য ব্যাঘাত না ঘটে।বাবার অপার স্নেহ আমার চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিল সেদিন।তারপর এই কোভিড-১৯ এর এই অবস্থায় অসংখ্য মৃত্যুর খবরের মাঝে দেখি যখন সেই মৃতদেহ বড্ডো একাকী প্লাস্টিকে মুড়ে একরাশ ঘৃণার সাথে শ্মশানে গোরস্থানে চালান হচ্ছে,ভাবি মানুষ এতটা মনুষত্বহীন হয়ে উঠতে পারে।মৃত্যু! সেই মৃত্যু তো গ্রাস করবেই পৃথিবীর সবাইকে একদিন।আগের মহামারী বা অতিমারির মতন তো এই করোনা গ্রামকে গ্রাম বা শহর কে শহর মৃত্যুর মিছিলে ভরিয়ে দেয়নি বা ছারখার করে দেয়নি।তবে?এও কী মনুষত্ব ধ্বংসকারী কর্পোরেটের দান।কোথাও একটা বাড়িতে একজনের হয়েছে বাদবাকি কারও হয়নি আবার কোথাও সবার হয়েছে অথচ কেউ মারা যায়নি। বেসরকারী হাসপাতালগুলো মুনাফা লুটছে একে পুঁজি করে।কেউ কিছু বলতেই পারছে না।কোথাও ঘনবসতিতে এই কোভিড এসেছে,যারা পনেরটি পরিবার মিলে একটি টয়লেট ব্যবহার করে অথচ লাখো লাখো লোক মারা যায়নি কোভিডে।তাহলে এর রহস্য কোথায়?মানুষ প্রতিদিন বে-রোজগেরে হয়ে পড়ছে।এর শেষ কোথায়?আমার শয়ে শয়ে প্রশ্ন জাগছে মনে।একদিন রাস্তায় নেমেই পড়বো এইসব নিয়ে।তেতলার ভদ্রলোকটি কী যেন নাম? মিত্র বাবু বলেই জানি।আমায় সিঁড়ির প্যাসাজে দেখতে পেয়ে এমন পাশ কাটিয়ে গেল যেন আমার সারা গায়ে গতরে কোভিড-১৯ রেণু মাখা।
মেঘ ঘুমোচ্ছে নাক ডাকিয়ে।ওর জন্য একটা কষ্ট হয় আজকাল যখন ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে থাকি।আমার সেই সেল্ফ মেড ম্যান হয়ে উঠবার দিনে ওর প্রচুর অবদান আছে।আমার রোজগার একটু আধটু হচ্ছে আমায় টাকা দিয়ে হেল্প করেছে মেঘ।আমি নিতে চাইনি।ঝগড়া হয়েছে এ নিয়ে অনেক।আমি ঠিক করেছিলাম একবেলাই খাবো প্রথম কমাস তারপর নিশ্চয় দুবেলা খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে যাবে।মেসের বেড ভাড়াও মিটিয়ে দিতে পারছিলাম।মেঘ ধরে ফেলতো আর বুদ্ধ।বুদ্ধ কতদিন ওর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছে। আমরা আজও আছি তাই তিনজন মিলেই অভিন্ন এক বন্ধু।বুদ্ধ এলে আমরা তিনজন মিলে এক খাটেই ঘুমোই।আমার জীবনে এত এত বিচ্ছেদ আছে যে আমি বিচ্ছেদটাকে খুব স্বাভাবিক মনে করি।বাবা একদিন শূন্য হয়ে যেতেই মায়েরও সেই শূন্যতায় মিশে যেতে বেশি সময় লাগেনি।আমি দীর্ঘদিন এক মানসিক ট্রমায় পড়েছিলাম। জানিনা সেই ট্রমা আবার ফিরে আসবে কিনা?

লে হালুয়া আরে মহাপুরুষটি আমাদের জীবনের সব কথাই লিখে গিয়েছে দেখছি।এবার তুই পড় আমি শুনি।এই বলে আমি মেঘের মুখের দিকে তাকালাম মেঘের চোখ বেয়ে বৃষ্টিধারা নামছে।
আমি উঠে গিয়ে খোলা জানলায় দাঁড়ালাম।জানি এখন মেঘ গেয়ে উঠবে সালতামামির প্রিয় সেই রবীন্দ্র সংগীতটি--যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙ্গলো ঝড়ে।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা।আরও কিছুক্ষণ আমরা সালতার লেখালেখি পড়লাম তারপর কোন এক সময়।ভোর রাতে তখনও অন্ধকার গায়ে মেখে প্রকৃতি। রাতের শেষে বৃষ্টি হওয়ায় ভিজে বাতাসের ভোরে মোবাইল বেজে উঠলো।গলাটা তাই এই ভোরের  ঠাণ্ডা লেগে ভারী হয়েছিলো।


আমি ঘোড়াডিহি থানা থেকে সাব-ইন্সপেক্টর অংশুমান বলছি।

বলুন।আমি বললাম।

আপনার বন্ধু সালতামামির নিজস্ব বাড়ি তো নকশালবাড়িতে?

হাঁ।কেন? বলুন প্লীজ।

বলবার জন্যই তো ফোন করলাম।গতকাল সন্ধ্যায় নকশালবাড়ির কোন এক জায়গায় সম্ভবত সালতামামিকে দেখা গিয়েছে।

কী বলছেন কী!আমি লাফিয়ে মোবাইল হাতে খাট থেকে নামলাম।ইজ ইট ট্রু?দেখলাম আর এক ধারে শুয়ে ছিলো মেঘ সেও আমার গলার আওয়াজে বিছানায় বসে  আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

দেখুন জাস্ট একটা খবর এই ভোর রাতে নকশালবাড়ি থানা থেকে জানালো।আমি তমাল স্যারকে খবরটা পেয়েই দিয়েছি।উনি আপনাকে জানিয়ে দিতে বললেন।এখন জাস্ট ওয়েট এন্ড সি!
ম্যাডামকে খবরটি জানিয়ে দেবেন।অংশুমান ফোনটি এই বলে রেখে দিলেন। মেঘ কখন যেন এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে।

বললে-কী রে?এত ভোরে নিশ্চয় থানা থেকেই ফোন করেছে।

হাঁ।

কোন খারাপ খবর নয় তো?

না রে।কাল রাতের দিকে নকশালবাড়িতে সালতামামিকে দেখা গেছে।জাস্ট এই খবরটা পেয়েই অংশুমান আমাদের ফোন করে জানালো।
দেখি বেলা একটু বাড়ুক।সঠিক খবরটি পাই তবেই ভাববো।

মেঘ বললে- হাঁ।আমার আবার এই সব খবরে বিশ্বাস হয় না। মোবাইল সুইচড অফ করে সে নকশালবাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে।নাহ্ এ হতেই পারে না।দেখবি।

তুই চা করে আনবি ?না আমি করবো?

আমি আনছি।

চা খেতে খেতে নিজেদের দুশ্চিন্তা নিজেদের মনের ভেতর রেখেই আমরা এটা ওটা কথায় সময় কাটাচ্ছিলাম।সকাল তখন আটটা মতন বাজে।এর আগে যাদের খুব সকালে খবরের কাগজ পড়া অভ্যেস বিশেষত আমাদের সার্কুলেশনটি তাদের থেকেই একটা দুটো করে ফোন আসতে শুরু করেছে।সবাই ঘনিষ্ঠ জন।সকাল আটটার পরে ইন্সপেক্টর তমাল দত্তের ফোন এলো।

হাঁ আমি তমাল বলছি---

(এরপর পরের পর্বে)

Post a Comment

0 Comments