জ্বলদর্চি

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য-৫/গৌতম বাড়ই

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য

পর্ব-৫

গৌ ত ম  বা ড় ই 


পড়েই চলেছিলাম।কি জানি কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।মোবাইলের রিংটোনে ধড়মড় করে ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখি মোবাইলে সাতটি মিসড্ কল।আমার চোখে তখনও অনেক ঘুম জমে আছে।সব নামবিহীন কল।কি করব ভাবছি।আবার ঘুমিয়ে পড়ব নাকি। সেই তন্দ্রার ঘোরে ভাবছি আর তখুনি আবার মোবাইলটা চিল্লিয়ে উঠলো।এবারে ধরলাম ঝটপট।

হ্যালো।
হাঁ বলুন।
আপনি?
কাকে চাই?
আমি ঘোড়াডিহি থানার সাব ইন্সপেক্টর তমাল দত্ত বলছি।আপনি বুদ্ধদেব মিত্র বলছেন?
বলুন।
আপনাকে এক্ষুণি থানায় আসতে হবে।
কেন?
প্লীজ আপনি চলে আসুন।এলেই জানতে পারবেন।
এই করোনা আবহে রাস্তাঘাট ফাঁকা পাবেন খুব একটা সময় লাগবে না।আপনি তো বাইকে আসবেন?বড়বাবু বলেছেন।

দেখুন খুব তাড়াতাড়ি বলতে আমার এখান থেকে ঘোড়াডিহি মানে পাশের পাড়া কিন্তু না।অন্তত একঘন্টা লাগবে।আর সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর কিছু অবশ্যই করণীয় কাজ থাকে।সেগুলো সেরেই আসবো।তবে যতটা পারি তাড়াতাড়ি আসছি।

সালতামামির কি কুক্ষণে যে বন্ধু হতে গিয়েছিলাম!দিলো তো সকালের ঘুমটার বারোটা বাজিয়ে।যারা গোটা রাতটাকে সকাল ভাবে আর সকালটাকে মধ্যরাত তাদের সকালের এই ঘুম চটকানো ফোন বা ভোরের কোন আগন্তুক কত যে গাল খায় মনে মনে-তা আমি জানি।এই যে আজ আমি দিচ্ছি মন খুলে পুলিশটাকে গাল।আমার প্রাইভেট ফার্মের কাজটা আর মুক্ত সাংবাদিকতার দুটোরই দফারফা ঘটেছে।টাকা না পেলে খাব কী রে ভাই?আগে তবু সালতা ছিল নিয়মিত সরকারি বেতনটুকু তো পেত।ব্যাটা হাওয়া হয়ে গিয়ে আমাদের অনন্ত চিন্তায় ভাসিয়ে দিয়ে গেলো।আরে আমিও তাহলে মানসিক চিন্তাধারায় ঐ সাধারণ মানুষের মতন।ওদের বিপদের সময় নিজের স্বার্থ নিয়ে ভাবছি।আনলক-১ পর্ব চলছে।এ শব্দগুলো কী সুন্দর তৈরী করে রাষ্ট্র আর মানুষের মগজে গেঁথে দেয়।মানুষের আসল যে দুঃখ তা কী সুপরিকল্পিত ঐ সব শব্দে দূর হয় আদৌ?নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি।আমি যে মিডিয়াতে রয়েছি অস্থায়ী চুক্তিতে তারা আমার কাজের ওপর বেতন দেয়।এই কারণে রয়েছি এদের এখনও কিছু নীতিবোধ আদর্শ জড়িয়ে আছে।সবটুকু বিসর্জন দেয়নি।পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরেফেরা আর তাদের অবর্ণনীয় সেই লকডাউন ঐ কঠিন সময়ের দুঃখ কষ্ট মৃত্যুর ওপর আমার ধারাবাহিক তথ্যসমৃদ্ধ খবর ওদের ই-মিডিয়ায় দর্শক সংখ্যা একলাফে অনেকটা বৃদ্ধি করেছে বলে জানি।আর ওদের সহযোগী একটা ইনফরমেটিভ কোম্পানীতে চারঘন্টার চুক্তির কাজ।আমার ইচ্ছেমতন।ওরা আমার যে বিরাট পরিচিতি কলকাতা শহরে আছে সেটা কাজে লাগায়।আমায় তাই আর চটায় না।তবে এই তিনদিনের অনুপস্থিতিতে আর বর্তমান আবহাওয়ায় আমিও রোজগারের ঐ নিশ্চিত জায়গাটার ওপর সন্দিহান হয়ে পড়ছি।কেননা মেঘের বেসরকারি ব্যাঙ্কের চাকরিটা আজ একমাস হতে চললো ভোগে গিয়েছে। ভাল সময়ে মেঘের ওপর ওদের সংস্থার কত আস্থা ছিল।মেঘ ম্যাডাম একাই একশো তখন। তবুও বোম্বের হেড অফিস ওদের ব্রাঞ্চকে আপাতত বন্ধ রেখেছে।

মটরসাইকেলে হর্ণ বাজিয়ে ছুট লাগালাম ঘোড়াডিহির দিকে।জুন মাস হলেও ভোরের বৃষ্টিতে বাইরের আবহাওয়া ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে।নাকি এই ভোরের সাথে আমার সম্পর্ক নেই বলে তাকে বেশি করে নতুন লাগছে। জানিনা।তবে ভাল লাগছে ব্যাস্ ।মেঘকে ফোন করে জেনে নিলাম তাকে ঘোড়াডিহি থানা থেকে ফোন করেছিলো কিনা।মেঘ ও আমার মতন কিছু অজানা অচেনা নাম্বার দেখেছে মিসড্ কল,আবার অজানা অচেনা নাম্বারে ফোন  এসেছে অনেক ধরেনি।এতটা উদ্বেগ উৎকন্ঠা ছিলনা।গতকাল থানায় যাবার পর থেকেই এসেছে তার মনে।ফোন ধরবে কি ধরবে না?এই ভাবতে ভাবতেই আমার এই ফোন পেয়েছে সে।জানাল।

তুই তৈরী হয়ে নে।আমি আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাব।মেঘকে বললাম।বুঝতে পারছি না তবে নিশ্চয় কিছু জরুরী দরকার আছে।
মেঘ ঠিক আছে বলে ফোন রেখে দিল।
আমার ভেতরেও একটা দুশ্চিন্তা তৈরী হল।বাইকের গড়ানোর সাথে আমার ভেতরের চিন্তাগুলো এদিক ওদিক অনেক গড়িয়ে যাচ্ছে।ছুটছি জোরে ব্যস্ত রাস্তা হলেও এই ভোরবেলা সত্যি অনেক ফাঁকা।পুলিশগুলো শহরের সব হালহকিকত জেনে বসে থাকে একদম।

বেরোনোর সময় যেই সবে বাইক বের করে স্টার্ট নেবো,দেখি মেজ দরজা খুলে বেড়িয়ে এসেছে--
যেখানেই যাস, সাবধানে যাবি আর খবরটা দিবি সময় করে ছোট।আমার মনটা আজ কেন জানিনা ঐ সময়ে মায়ের জন্য একমুহূর্ত খারাপ হয়ে এলো। মেজকে দেখে মায়ের কথাটা খুব করে মনে করালো।মেজরাই কি তাহলে পৃথিবীর শেষ মায়েদের প্রতিভূ।আমি সব উৎকন্ঠা ভেতরে চেপে রেখে বললাম
ঠিক আছে মেজবৌদি।চললাম।
মেজবৌদির মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল তার চোখ আমার ভেতরের সব উৎকন্ঠা উদ্বিগ্নতা  দেখতে পারছে।আমি হালকা হেসে বেড়িয়ে পড়েছিলাম।

আবার ফোন বেজে উঠলো।ইয়ারফোন লাগানোই ছিল।হ্যালো বলতেই ওপার থেকে ঘোড়াডিহি থানার সাব-ইন্সপেক্টর তমাল দত্ত বললেন-
ম্যাডামকে ফোনে কিছুতেই ধরতে পারছি না।ম্যাডামকেও থানায় আসতে বলুন।

আমি বললাম-ঠিক আছে।এর বেশি কিছু বললাম না।আমার থানা আর পুলিশ সম্বন্ধে অনেক অভিজ্ঞতা আছে বলে।
আর হাঁ একটু তাড়াতাড়ি করবেন আমরা থানায় রেডি হয়ে বসে আছি।আপনাদের জন্য।
আচ্ছা বলে ফোন ছেড়ে দিলাম ঠিকই কিন্তু  শেষের কথাটি তো মনের দুশ্চিন্তা আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল।আমাদের জন্য রেডি!

ঘোড়াডিহির ঝিলের পাড়ে একটু দূরে এই সকালেও মুখে কাপড় গুঁজে কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে আর কী যেন দেখছে একটু দূরে।বাইক নিয়ে যেতে যেতে এটুকু নজরে এলো।ঝিলের ওপারেই মেঘদের আবাসন।আর ওদের আবাসন ছাড়িয়ে সোজা রাস্তায় হাফ কিলোমিটার গেলেই ঘোড়াডিহি থানা।
বড়রাস্তা থেকেই আবাসনে যাবার জন্য একটা রাস্তা এই কুড়ি মিটারের মতন দীর্ঘ হবে ঢুকে গিয়েছে।রাস্তার দুপাশে বেশ কেয়ারী করা ফুল বাগান গাছগাছালি আছে। আধুনিক জীবন যাপন মানে সেই আরণ্যক মোড়কে হাল্কা করে কিছু পুরানোকে দেওয়া।মেঘ বড় রাস্তায় এসেই দাঁড়িয়েছে আমার অপেক্ষায় দূর থেকেই দেখলাম।সামনে যেতেই ঝুপ করে বসে পড়ল বাইকে।আমায় বলল কী রে কোন খারাপ খবরটবর নয় তো!
আমি বললাম কী জানিরে!চল আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্রকাশ পাবে।

থানায় এসে দাঁড়াতেই পুলিশ অফিসার তমাল দত্ত বললেন-বাইকটি থানায় রেখে আমাদের পুলিশের ভ্যানে চেপে বসুন।
আমরা মুহূর্তে তাই করলাম।ভ্যানে চেপে বসলাম।তমাল দত্ত বললেন-ম্যাডাম ফোনটি ধরবেন তো?আপনার হাজব্যান্ড থুড়ি পার্টনার লিভ-টুগেদার সালতামামি নিরুদ্দেশ আজ চারদিন হলো। আপনাদের ডায়েরির বয়ান অনুযায়ী। সেইজন্য অচেনা অজানা ফোন এলেও আপনার এখন ধরা উচিত।

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ভ্যানটা যেখানে দাঁড়ালো সেটা ঘোড়াডিহির ঝিলের পাড়।বাইক নিয়ে যেতে  গিয়েই যেখানটায় কিছু লোকের জটলা দেখেছিলাম।পুলিশভ্যান দাঁড়াতেই জটলা মুহূর্তে হাল্কা হয়ে গেলো। সাধারণ লোকজন এদিক ওদিক ছড়িয়ে গেল।
ম্যাডাম আপনারা নেমে এসে দেখুন তো ওখানে আজ ভোরে জেলেরা মাছ ধরতে এসে একটি লাশ পেয়েছে শোয়ানো রয়েছে জলের ধারে।আপনাদের বর্ণনা অনুযায়ী কিছুটা মিলে যাচ্ছে সালতামামি বাবুর চেহারার সাথে-সামনে এগিয়ে চলুন।

টের পেলাম রেডি হয়ে থাকার মর্মার্থটা কী।শুনেই কেমন খটকা লেগেছিলো।
মেঘরোদহাসি আমার হাতটা চেপে ধরলো।আমি বললাম-চল যাই সামনে।দেখি গিয়ে-

(লাশটি কার? সালতামামির যদি হয়?জানতে হলে পড়ুন এর পরের পর্ব।)
________________________________________
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments