জ্বলদর্চি

(পুজোর গল্প) হদিশ / সন্দীপ দত্ত

   ফোটোগ্রাফি- সৈয়দ স্নেহাংশু   


হদিশ 

স ন্দী প  দ ত্ত


ছাইমাখা দাঁতগুলো জলে কুলি করতে গিয়ে মিছিলের লেজটাকে দেখতে পেল বঙ্কিম। লেজই মনে হল তার। মনেহল, কোনো দীর্ঘাকার সাপের মাথাটা তার চোখের আড়াল হয়ে গেছে। মহানগরের পথে এমন মিছিল বহুবার হেঁটে গেছে এর আগে। রোদের ওম গায়ে মাখতে মাখতে, কখনও মেঘের চাদরে সর্বাঙ্গ জড়িয়ে মানুষগুলোর ঐ পা ফেলার মধ্যে শুধুই কি নিরন্তর হেঁটে যাওয়া? কীসের টানে হাঁটে ওরা? বঙ্কিম রাজনীতির 'র' জানে না। কোনোদিন কখনও  কোনো ঝান্ডা নিয়ে কোথাও দাঁড়ায়নি। আজ কী মনে হল, লাইনে দাঁড়িয়ে গেল সে। একমাথা বিবর্ণ উসকোখুসকো চুল আর হপ্তাখানেকের না কাটা খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়িগুলো, যা তাকে নিরুপায় বানিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে চোখের সমস্ত ঔজ্জ্বল্য, বুকভর্তি হতাশাকে ফিরিয়ে দিয়ে।

    লাইনের হাতনাগালে আট থেকে দশজনকে জিগ্যেস করল বঙ্কিম। এক একজন এক একরকম কথা বলে। কেউ বলে, কজহারা মানুষগুলোর নতুন কাজের সন্ধান মিলতে পারে এ মিছিলে। কেউ বলল, পায়ে পা মিলিয়ে চললে দুপুরের ডিমভাত জুটে যাবে। কারও ধারণা, এ মিছিলের মাথার কাছে কোনো এক দলের ঝান্ডা, যারা দলভারি করতে মিছিলের প্রত্যেকের হাতে ভোটের কৌশলস্বরূপ তুলে দেবে তিনশো করে টাকা। উরাটকালে কর্মহীন মানুষগুলোর কাছে যা মহার্ঘ্য।

      বঙ্কিমের কাজের তো একটা দরকার ছিলই। নিউ নর্মাল পৃথিবীতে পিঠে তার ছাঁটাইকর্মীর ছাপ। কিন্তু  এই মুহূর্তে কিছু টাকা দরকার ছিল হাতে। কাল এক বোতল মদ চারজনে ভাগ করে খেয়েছে। সাধ মেটেনি। জম্পেশ করে লাইনে দাঁড়াল সে। পায়ে পায়ে এগোতে লাগল পথ। চোখ ঘুরিয়ে পুলিশ দেখে থুতনির নিচে নামানো মাস্ক ' টা চটজলদি তুলে নিল নাকে।

      এভাবে ঘন্টা দুয়েক। অবশেষে ভুল ভাঙল বঙ্কিমের। বুঝতে পারল, এ কোনো দলের মিছিল নয়। স্বনির্ভরতার উপায় খুঁজে নেওয়ার এক লাইন। স্বামী স্ত্রীর যৌথ প্রয়াস বেঁচে থাকার আনন্দে সামিল হওয়ার সাহসী পদক্ষেপ।

     এতটুকু ইচ্ছে ছিলনা বঙ্কিমের। এতদিন সে নিজে রোজগার করেছে। পৌরুষের অহংকার নিয়ে নিষ্কর্মা বউ পেটানো সহজ ছিল তাই।অর্থহীন জীবনের জ্বালা জুড়োতে কাল রাত্রেও মাতাল হয়ে ঘরে ফিরে আস্ত একটা চেলাকাঠ পিঠে ভেঙেছে শ্যামার। ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে দু হাতের শাঁখা পলা। সেই বউ কিনা এবার তার রোজগারের অংশীদার হবে?

    গোষ্ঠীর লোকদের অঙ্গীকারপত্রের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে বঙ্কিম। স্বাক্ষর করলে তবেই মিলবে কাজ। বিপণনের মাধ্যম নিয়ে আলোচনা করা হবে।
    মিনিটখানেকের বেশি আর সময় দিল না ওরা। চাইলে লাইন থেকে ছিটকে যেতে পারত বঙ্কিম। গেল না। চেলাকাঠটা কাল ঠিকমতো ধরা হয়নি তার। আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে জমেছিল যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে স্বাক্ষরটা করেই দিল নিদিষ্ট জায়গায়। লিখতে হল শ্যামার নাম।

Post a Comment

0 Comments