জ্বলদর্চি

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য-৬/ গৌতম বাড়ই

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য

গৌতম বাড়ই

পর্ব-৬

কী এক শূন্যতায় ভেসে আমরা এগিয়ে গেলাম সেই লাশের দিকে। জীবনানন্দকে মনে পড়লো-শোনা গেল লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে-আটবছর আগের একদিন।

বেসিক জিন্সের প্যান্টপড়া গায়ে অলিভ কালারের টি-শার্ট লাশ শায়িত সামনে।এগোচ্ছি আরও স্পষ্ট হল সেই লাশ।লাশের অসাড় দেহেও জাত ধর্ম বর্ণ সব লেগে থাকে। শুধু রক্ত কিডনি চোখ, এইসব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কোন জাত নেই।ব্যবহারিক জীবনের সুবিধা ভোগেও জাত নেই। সুপরিকল্পিত ভাবেই সুচতুর মানুষ এইসব সৃষ্টি করেছে বোঝাই যায়।আমাদের থেকে দু-হাত দূরত্বে এখন সেই লাশ।মেঘ এক ঝলক তাকিয়ে -মা মাগো! বলে উঠল আর চোখ ঢাকল হাত দিয়ে।মেঘকে এইভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি কোনদিন।আমি মুখের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম এ সালতামামি না।আমাদের ডাবল মাস্ক মুখে সাঁটা ছিলো।সব মুখগুলো তো এখন মুখোশ থেকে মুখোশে ঢাকা আরও।যাদের মুখোশ ছিলনা তাদেরও পরিয়ে দিয়েছে পৃথিবী এক মুখ ঢাকা মুখোশ।

ঠিক করে দেখুন।আপনাদের স্টেটমেন্টের ওপর আমরা একে আন-আইডেন্টিফায়েড লিখে দেবো।সোজা মর্গে চালান।তবে দেখছেন না যে জনা পঞ্চাশেক লোকের জটলা ছিল তা আমাদের দেখে কেমন আস্তে আস্তে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।বুঝলেন সবই ঐ করোনার জন্য।অন্যসময় হলে হাজার খানেক লোক এই ঘোড়াডিহির ঝিলের ধারে জমা হয়ে যেত এই সময়ে-সাব ইন্সপেক্টর তমাল দত্ত বললেন।তো চলুন আবার বসুন গিয়ে পুলিশ ভ্যানে।থানায় ফিরে যাই।

আমরা গিয়ে বসলাম।থানায় ঢুকে তমাল দত্ত বললেন-ম্যাডাম আপনি কলকাতায় পড়াশোনা করেছেন তো?
মেঘ ঝিলের ধার থেকে এই এতক্ষণ কিছু বলেনি।চুপ করে চোখে মুখে একরাশ চিন্তায় ডুবে ছিল।আমি যা দু-চারটি কথা বলেছি পুলিশদের সাথে।
মেঘ মাথা উঁচিয়ে আমার দিকে একবার তাকিয়ে তমাল দত্তকে বলল- হ্যাঁ।যাদবপুর।
আর বুদ্ধবাবুও তাই তো?

হ্যাঁ।আমরা তিনজন মানে সালতামামিও তাই।আমরা সবাই ক্লাসমেট।

আজ আপনাদের যদিও এই মুহূর্তে আর পুলিশের কাজে দরকার নেই তবুও চলুন একটু ভেতরে আমার অফিসঘরে বসি।আসুন-

আমি আর মেঘ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে তমাল দত্তকে অনুসরণ করে ওর ঘরে গিয়ে বসলাম।

থানাগুলো এখন বেশ সুসজ্জিত।মুখে মাস্ক ঠিকমতন টেনে টুনে বসলাম।তমাল দত্তকে খেয়াল করছিলাম বয়স মনে হয় আমাদের মতনই।ঐ বছর পঁয়ত্রিশের মধ্যেই।অবশ্য মেঘ আরও ভাল বুঝবে।ও ঠিক চুল মুখ দাঁড়ি যতই রাঙানো হোক ,অনাবৃত জায়গা দেখে পুরুষ মানুষের বয়স ঠিক ঠিক বলে দেয়।এই নিয়ে আমাদের কত মজা আছে। আমিও ওকে বলতাম মেয়েরাও বিউটি পার্লারে যতই পালিশ করুক ঐ গমনে চলনে বলে দেবো তোদের বয়স কত?মেঘ বলেছিল তার কথা আমি জানিনা ও  মেয়েরা জানে! কারণ মেঘ নারী বলে পৃথক সত্ত্বায় আসতে চায়না।এই মুহূর্তের ভাবনায় আবার ফিরে এলাম।দুঃসহ সময় আর একটি ঘটনা আমাদের সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে।প্রথম দুদিন ভেবেছিলাম সালতার পাগলামি। মনেও তখন আনন্দ নষ্ট হয়নি।মেঘরোদহাসিরও।ফোনেও মজা করেছি আমরা।আজ পঞ্চম দিনে সকালের ফোন আর এইসবে মনটাও বিগড়ে আছে।

তমাল দত্ত অফিসে ঢুকেই জোরসে চিল্লিয়ে বললেন-নন্টে তিনকাপ বড় চা ভাল করে আর বড় খাস্তা বেকারীর দিয়ে যা।
ভেতরের থেকে আওয়াজ ভেসে এলো-ঠিক আছে স্যার।
তমাল দত্তের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর ভাবছিলাম কোন উদ্দেশ্যে বসাল এখানে।আবার এত খাতির করে চা বিস্কুট।তবে এক কাপ চায়ের  জন্য মনের ভেতরটা ছটপট করছিলো।হয়ত মেঘেরও তাই।কারণ ইনি আবার মারাত্মক চা-খোর। হঠাৎ করে তমাল দত্তকে দেখে আমার স্মৃতিতে কিছু পুরানো কথা মনে ভেসে উঠলো।ধুস ঐ সব ভেবে এখন লাভ নেই।

আপনারা সায়ন্তন থেকে সালতামামি আর মেঘবর্ণা থেকে এই এত্তোবড় মেঘরোদহাসি হলেন কেন ম্যাডাম?-তমালবাবু এই বললেন মেঘের দিকে তাকিয়ে।

বিষয়টা অত্যন্ত ব্যক্তিগত।আর এই বিধ্বস্ত সময়ে আমি আপনায় এইসব বলতেও পারবো না।তবে একটা মানুষ হাজার বছরের প্রচলিত বোধ আর প্রবহমান  চিন্তাধারা থেকে সরে এলেই এই গেলো গেলো ভাব আমার না পসন্দ।

আমি মেঘের কথায় সতেজ হলাম।না মেঘ তো এখনও অনেক সতেজ তার  বৃষ্টিধারা নিয়ে।ভেতরে মনে মনে বললাম সাব্বাস।পুলিশের এই  ভেতরে ডেকে খোশ গল্প করবার গোড়াতেই একদম চাবুক চালিয়েছে মেঘ।আমি ওকে বেশিটাই ভুল ভেবেছিলাম।আসলে চরিত্রের বাইরে গিয়ে কখনও একটা দুটো বিরূদ্ধাচরণ বা বেসামাল কথায় আমরা একটা মানুষকে মাঝেমাঝেই ভুল বুঝে ফেলি।তবে একটা খটকা থেকেই গেলো তমাল দত্ত আমাদের মিসিং ডায়েরীটা ভালো করেই পড়েছেন।একদম হুবহু সব মনে রেখেছেন।

আর বুদ্ধদেব আপনি কেন বাদ গেলেন এইসব পরিবর্তন থেকে?

আমি মেঘের মতন কড়া জবাব না দিয়ে বললাম-হয়নি ঐ যেমন সবকিছু আর হয়ে ওঠে না।আবার সবাই গায়ে গায়ে লেগে থাকলেও একই জিনিস করতে হবে তার কি কোন মানে আছে?

না তাই বলছি না।আপনারা ভেতরে ডেকে নিয়ে এইসব ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে জিগ্গেস করছি বলে কোন পুলিশি উদ্দেশ্য ভাববেন না।পুলিশ ও তো কারও বন্ধু কারও ভাই  দাদা বাবা সব।সেখানে আপনিও যা আমিও তাই। হাঁ ডিউটি এসে আমাদের কর্তব্য টাই করতে হয়।কাল বড়বাবু অনুজ শীলের কাছ থেকে আপনাদের মিসিং ডায়েরীটা আর এই দায়িত্বটা পেয়েই আমি সব পড়েছি।

মেঘবর্ণা দাশ আপনার বাড়ি তো একসময় সোদপুরে ছিল? বুদ্ধদেব আপনি তো বেলেঘাটায় থাকেন?আর সায়ন্তন থুড়ি সালতামামি বেসিক্যালি উত্তরবঙ্গের মাটিতে বেড়ে ওঠা।তাই না?তমাল দত্ত জিগ্গেস করলেন।

আমি চমকে উঠি।আরে এরমধ্যে এতকিছু জানলো কী করে?এ তো দেখছি অল্পবয়সেই পুলিশের সেই দুঁদে অফিসার কী বলে না-তাই হয়ে উঠেছে, আরও কত কিছু হবে কে জানে রে বাবা!

একদম তাই-মেঘবর্ণা উত্তর দেয়।কিন্তু আবার-

কোন কিন্তু নয়।চা খেতে খেতে গল্প করি চলুন।নিন বুদ্ধদেব শুরু করুন-তমাল দত্ত আমার দিকে চেয়ে বললেন।

আমি চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে দেখি তমাল দত্ত গভীর মনোযোগ সহকারে আমাকে দেখছেন।
আমি চোখ সরিয়ে নিলাম।

(এরপর সপ্তম পর্বে --)

Post a Comment

0 Comments