ছোটোবেলা || ২য় সংখ্যা
প্রকাশিত হল দ্বিতীয় সংখ্যা। আমরা চাই শিশুকিশোরকিশোরী-র লেখা ও ছবিতে ভরে উঠুক এই বিভাগ। হয়তো অনেকে দ্বিধায় পড়েছেন -- লেখা, ছবি পাঠাবো! না জানি কেমন হয়েছে! আমাদের অভিমত, ছোটোরা যা লেখে যা আঁকে তাই-ই সুন্দর। আশা করি অভিভাবকরা তাদের একটু উৎসাহ দেবেন। ইউনিকোড-এ মেল করতে সহযোগিতা করবেন।
মেল - jaladarchi@yahoo.in
এবার থাকলো স্বনামধন্য ফোটোগ্রাফার সৈয়দ স্নেহাংশু-র একটি ফোটোগ্রাফি।
মজার রাজা
প্রিয়তাংশু দত্ত (চতুর্থ শ্রেণি)
এমন এক রাজা
তার পেছনে নেই প্রজা!
এমন মজার দেশ
যেখানে, প্রজা চালায় দেশ!
আর রাজা চালায় কেস!
ফুর্তি করে রাজা
ক্ষুধায় মরে প্রজা!
করোনা
অঙ্কিতা মাইতি (অষ্টম শ্রেণি)
এসেছে করোনা, তা বলে
ভয় পেয়োনা ভাই।
সাবধানে থাকতে হবে
মূল কথাটা এই।
হবে না তো নিজে থাকলে সুস্থ
তাদের কথাও ভাবো
যারা গরীব ভীষণ দুস্থ।
তোমার ঘরে মজুত কর
চাল ডাল আলু
পায় না খেতে পাড়ার ছেলে
অসহায় লালু।
স্বাস্থ্যবিধি দূরের কথা
গায়ে জোটে না জামা
করোনা,লক্ষীটি আমার
তাকে করো ক্ষমা।
আরো কত দুঃস্থ মানুষ
আছে এই পৃথিবীতে
ভাই করোনা,তোমার ভয়ে
পারছে না রোজগারে যেতে।
করজোড়ে তাই প্রার্থনা করি
দুঃস্থ যারা গরীব যারা
সবাই মিলে বাঁচতে যেন পারি।
আসবে কবে দুর্গা ঠাকুর
পরমার্থ দে (শ্রেণি- সপ্তম)
আশ্বিন এলেই ভেবেই আকুল
আসবে কবে দুর্গা ঠাকুর।
ক্যালেন্ডার আর পঞ্জিকাতে
খুজছি বসে দিনে রাতে।
সাদা মেঘের ভাসছে ভেলা
মনে আমার দিচ্ছে দোলা।
ধানের শীষে শিশির মেশে
আনন্দে আজ উঠছি হেসে।
আসবে কবে দুর্গা ঠাকুর
ঢাক বাজবে ঢ্যাম কুড়াকুড়।
নতুন জামা নতুন জুতো
দুঃখ মনের রইবে নাতো।
দেখবো ঠাকুর সবাই মিলে
পাড়ার পুজোর সেই প্যান্ডেলে।
আমন্ত্রিত লেখা
---------------
দুটি ছড়া
পী যূ ষ প্র তি হা র
পাজি বাছুর
বুধি গাইয়ের ঐ যে বাছুর ছানা
সারাদিন মা খেলেই বেড়ায়
ছুটোছুটি এদিক সেদিক শুধু
ওর কি মা কিচ্ছুতে নেই মানা?
আমি যদি একটু বেশি ছুটি
ধুলো মাখি কিম্বা কাদায় খেলি
তুমি কেন বকুনি দাও বলো?
বুধি কেন বলেনা কিচ্ছুটি?
তুমি আমায় অনেক ভালোবাসো?
ওর ছানাকে ভালোবাসেনা বুধি?
কেন তুমি চুপটি করে থাকো,
বলোনা মা, কেন শুধু হাসো?
খেলা
চু কিৎ কিৎ খেলছে মেয়ে
উঠোন জুড়ে ধুলো
কোথায় যেন হারিয়ে গেছে
এমন খেলা গুলো।
মাংস চুরি, কুমীর ডাঙা,
লুকোচুরি খেলা,
কত খেলা কত মজা
পুরানো ছেলেবেলা।
এখন শুধু মোবাইলে
আঙুল ছুঁয়ে খেলা
আর কি ফিরে আসবে সেদিন
সেসব খেলাধুলা!
ছোটগল্প
----------
একটি না-চুরির গল্প
দি লী প কু মা র মি স্ত্রী
চাঁদমণি হাইস্কুলে বই চুরি নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, ইসকুলের অন্য কোনও ক্লাসে নয়,শুধুমাত্র ক্লাস এইটের এ সেকসনেই এই ঘটনা ঘটছে মাঝেমধ্যে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, চুরি যাওয়া বই কিছুদিন পর আবার স্কুলেই পাওয়া যাচ্ছে। কখনও তা স্কুলের কাঁঠালতলায়। কখনও বাথরুমে। আবার কখনও ঐ ক্লাসে, কোনো বেঞ্চের নিচে। কিন্তু কিছুতেই বইচোরকে পাকড়াও করা যাচ্ছে না। ছাত্র অভিভাবকদের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাই খুবই চিন্তিত। সবচাইতে চিন্তিত স্কুলের হেডস্যার।
পুরো বছরটা এভাবেই কেটে গেল। বইচোরের টিক্কিও ছোঁয়া গেল না। পুরো গ্রামবাসী হেডস্যারের নামে যা-খুশি-তাই বলে বেড়াচ্ছে। এনিয়ে ছাত্রদের মধ্যে তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলনা। একমাত্র সুজন হাঁসদার মনটা খুব খারাপ। সে কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছে না। তার বেশি কষ্টের কারণ, কিছু করতে না পারার জন্য।
সুজন ক্লাস এইট, এ সেকসনের ছাত্র। লেখাপড়ায় তার খুব মনযোগ। কিন্তু তাদের পরিবারে খুব অভাব। তাই সব বইপত্র তার কেনা হয়না। সেকারণে তার রেজাল্ট যতটা ভালো হওয়ার কথা ততটা হয়না। প্রতিবারই সে থার্ড-ফোর্থ-ফিফথ হয়। সুজনের সবচেয়ে প্রিয়বন্ধু অতনু দাস। অতনুর বাবা আবার তাদের ইসকুলের হেডস্যার। এটাই সুজনের কাছে সবচাইতে বেশি কষ্টের বিষয়।
সরস্বতী পুজোর পরদিন সুজনদের স্কুলের বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান প্রতি বছর হয়ে আসছে। এবারও হচ্ছে আজ। স্কুলের সমস্ত ক্লাসে, বার্ষিক পরীক্ষায় যারা প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় হয়েছে তাদের পুরস্কৃত করা হবে আজ। তাই ছাত্রদের পাশাপাশি অনেক অভিভাবকদের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। ঠিক সন্ধে ছটায় অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল।
প্রারম্ভিক ভাষণে স্কুলের হেডস্যার আবেগতাড়িত কণ্ঠে দীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন। তাঁর বক্তব্যের অনেক অংশ জুড়ে রইল স্কুলের বইচুরির বিষয়টি। এবিষয়ে তাঁর নিজের ব্যর্থতার কথাও তিনি অকপটে স্বীকার করে নিলেন। অভিভাবকদের কাছে দুঃখ প্রকাশও করলেন।
এবার ছাত্রদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবার পর্ব। এক-একজন মঞ্চে উঠে পুরস্কার গ্রহণ করছে। সেইসঙ্গে সংক্ষেপে তাদের অনুভূতির কথা মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বলছে। ক্লাস এইটে এবার যুগ্মভাবে ফার্স্ট হয়েছে অতনু দাস এবং তার প্রিয়বন্ধু সুজন হাঁসদা। প্রথমে অতনু মঞ্চে উঠে পুরস্কার গ্রহণ করে বক্তব্য রাখতে শুরু করল।
সে বলল, ‘আমি আজকে ভীষণ খুশি। কারণ আমার বন্ধুও আমার সঙ্গে প্রথম হয়েছে। আমি তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। কিন্তু পাশাপাশি আমি সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এই কারণে যে স্কুলের বইচোরকে পাকড়াও করতে না পারার জন্য হেডস্যারকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। আসলে এরজন্য আমিই দায়ী। স্কুলের সেই বইচোরটি আমি- অতনু দাস। ক্লাসে সমস্ত ছাত্রদের ব্যাগ সার্চ করা হলেও আমার ব্যাগ কোনদিনই সার্চ করা হয়নি। কারণ আমি হেডস্যারের ছেলে। কিন্তু আমার ব্যাগ সার্চ করলেই বইচোরকে অনেক আগেই পাকড়াও করা যেতো। আজকে এই অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে আমি বলছি, এরজন্য যে শাস্তি আপনারা আমাকে দেবেন, তা আমি মাথা পেতে নেবো।‘
হেডস্যারের ছেলে অতনুর কথা শুনে সবাই স্তম্ভিত। কেউ তার কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ এখন নিশ্চুপ, নীরব। একেবারে পিন-ড্রপ-সাইলেন্ট। এরমধ্যেই ক্লাসের অপর প্রথম ছাত্র সুজন হাঁসদা মঞ্চে উঠে পুরস্কার গ্রহণ করল। মাইক্রোফোনের সামনে তার কথা শুরু হতেই অনুষ্ঠানের নীরবতা ভেঙে গেল। শুরু হল কানাঘুষো।
সে বলল, ’অতনু আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। ওর মতো একজন বন্ধু অনেক তপস্যা করে তবে পাওয়া যায়। আমি ওর জন্য গর্বিত। কিন্তু আসল সত্যিটা হল, স্কুলের সেই বইচোরটি হল এই সুজন হাঁসদা। আমি বই কিনতে পারিনা। তাই আমার জন্য অতনু বন্ধুদের বই লুকিয়ে রাখতো নিজের কাছে। ছুটির সময় তা আমাকে দিয়ে দিতো। ও জানতো, আমার ব্যাগে লুকিয়ে রাখলে ধরা পড়ে যাবো। তাই ও বই নিয়ে নিজের ব্যাগে রাখতো। আর এই বিষয়টিকে সকলের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে দেখাতে ও প্রথম দিন ওর নিজের বই চুরি যাওয়ার গল্প ফেঁদেছিল। ও নিজে চোর সেজে আমার রেজাল্ট ভালো হতে সাহায্য করেছে। অর্থাৎ আসল বইচোর আমি। আপনারা আমাকে কঠিন শাস্তি দিন। প্লিজ, ওকে কোনভাবেই দায়ী করবেন না। আমি তাহলে, খুব কষ্ট পাবো। আমি লেখাপড়াই ছেড়ে দেবো।‘
সুজন মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়ার পরও অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ যেন জন-মানুষ হীন। সবাই নির্বাক দর্শক হয়ে বসে রয়েছে। এবার মঞ্চে উঠলেন স্কুলের পণ্ডিতস্যার। স্কুলের সকল ছাত্রদের অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক এই পণ্ডিতস্যার। তিনি ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক এবং গ্রামবাসীদের মনের অবস্থা বুঝে,সবাইকে অবাক করে বলতে শুরু করলেন।
‘আমার প্রিয় দুই ছাত্র অতনু এবং সুজন, ওদের জন্য আমি অত্যান্ত গর্বিত। আমি জোরের সঙ্গে বলছি, এদের কেউই বই চোর নয়। এদের কোনও দোষ নেই। তাই এদের কোনো শাস্তি দেবার প্রশ্নই নেই। স্কুলে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার জন্য আমরা, শিক্ষক এবং অভিভাবকবৃন্দ সমানভাবে দায়ী। স্কুলের একটি মেধাবী-দুস্থ ছাত্রের হাতে সময়মতো বই তুলে দেবার দায় আমাদেরই ছিল। কিন্তু আমরা কেউই সেই দায়িত্ব সময়মতো, সঠিকভাবে পালন করিনি। সব দোষ তো আমাদের। কিন্তু এমনটি আর যাতে না ঘটে তার ব্যবস্থা করতেই হবে আমাদের। আজ থেকে আমরা স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ সুজনের বই-খাতা,পড়াশোনার সমস্ত দায়িত্ব নিলাম। স্কুলে আর কখনও বইচুরির মতো ঘটনা ঘটবে না, এটা অবশ্যই দেখতে হবে আমাদের সকলকে।‘
পণ্ডিতস্যার একটু সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। চারপাশটা ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন। তারপর অতনু এবং সুজনকে তার কাছে ডেকে নিলেন। দুজনকে তাঁর দুপাশে দাঁড় করিয়ে, নিজের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে দুটি গল্পের বই বের করে তাদের হাতে তুলে দিলেন। তারপর, আবার বলতে লাগলেন।
‘সত্যি কথাই বলছি, বই কখনও চুরি করা যায় না। বিদ্যে চুরি করা যায়। শুধু এরা দুজন নয়, আমরা সবাই বই থেকে বিদ্যে চুরি করি। যে যত বেশি চুরি করতে পারি সে সমাজে তত বড়ো আসন পাই। আর একটি সত্যি কথা, আমাদের স্কুলে বই তো চুরি হয়নি। সব বই তো কদিন পর ফেরৎ এসেছে। তাহলে, আমরা তাকে চুরি বলছি কেন ?
‘সবাই অবাক হচ্ছেন, অতনু এবং সুজনকে বই উপহার দেবার জন্য ? একটি কথা সকলের জানা দরকার, বিদেশে বই চোরকে কখনও শাস্তি দেওয়া হয় না যদি সেই বই চুরি পাঠের জন্য হয়। বরং তাকে পুরস্কৃত করা হয়। আর শাস্তি দেওয়া হয় লাইব্রেরি বা দোকানের মালিককে। শাস্তি মানে আর্থিক জরিমানা। ইউরোপে এমনটি একবার ঘটেছিল। আমি নিজে সে খবর পেপারে পড়েছি।‘
পণ্ডিতস্যারের কথা শেষ হল। কিছুটা সময় দর্শকাসন চুপচাপ। তারপর হঠাৎ করে, সেখান থেকে আকাশ কাঁপিয়ে করতালি বেজে উঠল। সেই সঙ্গে স্কুলের ছাত্রদলের মুহূর্মুহু শ্লোগান চলল, ‘থ্রি চিয়ার্স ফর অতনু-সূজয়- হিপ হিপ হুর-রে!’
1 Comments
ছোটোদের উপযোগী ছোটোদের মনের মতন, সুন্দর ছবি ও ছড়ার সম্ভার।
ReplyDelete