জ্বলদর্চি

বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক-১ / অসীম ভুঁইয়া


Bengali grammar and debate
বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক

পর্ব ১

অসীম ভুঁইয়া

মাতৃভাষা ও শব্দ গঠনের ললিপপ

"ব্যাকরণ " শব্দটির মধ্যে কোথাও যেন একটা অকারণ ভীতি প্রতিশব্দের মতো স্থিতু হয়ে আছে। আর ব্যাকরণবিদ যেন নির্দিষ্ট নিয়মে বাঁধা এক ভয় ভয় ভাবের গ্রহান্তরের জীব। এধরনের একটা চালু ধারণা প্রবাদের নামান্তর হতে বসেছে। তাই ব্যাকরণ ও ব্যাকরণবিদ দুজনকে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। না জানি কখন কী সব ফুলটুল ধরে বসবে। কিন্তু আদতে কি তাই? এই ভীতি ও প্রবাদকল্পটি কি কোথাও বাধা হয়ে দাঁড়ায় না সৃষ্টিশীলতা তথা ভাষামানতার ক্ষেত্রে? সত্যিই তাই, কিন্তু প্রথাগত ভাবনা থেকে বেরিয়ে গেলে দেখতে পাব "আলাদিনের সেই আশ্চর্য-প্রদীপ"  অথবা রোজ দশটি কবিতা লিখতে না পেরে ঘুম না আসা সেই জনৈক কবিকে। আমরা যারা কথা বলি বা ভাষা বলি, চালু নিয়মে তা কখনও ভুল বা ঠিক, কিন্তু বিষয়টি যে তার অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করে তা ধরিয়ে দিতেই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র। আমরা যা বলি সবই প্রায় অজান্তেই ব্যাকরণ মেনেই বলি, বাংলা  যেহেতু মাতৃভাষা তাই তার একটা ব্যাকরণ শৈশব থেকেই মাথার ভেতরে কাজ করে চলে নীরবে-নিভৃতে। অর্থাৎ ব্যাকরণ বা ভাষা শেখার যন্ত্রটি মাথার ভেতরে বসানো থাকে জন্ম থেকেই। সর্বকালের অন্যতম সেরা ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কি তাই মাথাকে ভাষা শেখার যন্ত্র বা পদ্ধতি বলেছেন। (Language acquisition device or language acquisition system, সংক্ষেপে LAD / LAS)। সেই কারণে ব্যাকরণকে ভয় পাওয়া  বা ভুল বোঝার কিছুই নেই। যেমন শিশু যদি আনমনে বলে ফেলে 'আমার খিদে পেয়েছে' বা 'আমি একটা আইসক্রিম খাব।'  সেক্ষেত্রে সে অজান্তেই ব্যাকরণ মেনেই কথাটি বলল। অর্থাৎ মাতৃভাষার ক্ষেত্রে ব্যাকরণ অনেকটাই সহজাত, শুধু তাকে ধরিয়ে দিতে হয়, নামকরণ করতে হয়, বা কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সামান্য পরিমার্জনও করতে হয়, এইটুকু যা। আবার শিশু যখন একটুখানি বড় হয় তখন তাকে যদি শেখাই, ' আমি বাড়ি যাব।' এই বাক্যটি। শিশু তা অনায়াসে বলতে পারবে এবং তারপর  সে বলতেই পারে, 'বাড়ি যাব আমি। 'বা 'আমি যাব বাড়ি।' অর্থাৎ সে একটা বাক্য থেকে শিখন কৌশল অটোমেটিক রপ্ত করে আরও দুটি বাক্য নিজেই তৈরি করে নিল, তার জন্য তাকে নতুন করে শিখতে হয় না। তার মাথায় যে অলিখিত ব্যাকরণ যন্ত্রটি রয়েছে সেই তাকে এভাবে শিখিয়ে দিচ্ছে। তাই 'সহজাত' শব্দটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যদি আফ্রিকান কোনো শিশুকে, ইংল্যান্ডের কোনো শিশুকে বা অন্য ভাষার কোনো শিশুকে এভাবে বাংলা শেখানো হয় তখন সে অন্য দুটি বাক্য বলতে পারবে কিনা সন্দেহ, অর্থাৎ মাতৃভাষার সহজাত ক্ষমতা অনেকটা পরম্পরায় তৈরি হয়ে যায়। তাই ব্যাকরণের আটপৌরে বাংলা এমন কোনো গ্রহান্তরের আজব বিষয় নয় যে শুনলেই ভয় পেতে হবে। আরেকটি বিষয় শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো। মুখের ভাষা ও লেখার ভাষা কি একই?  উত্তর, অনেক ক্ষেত্রে এক আবার অনেক ক্ষেত্রে এক নয়। কারণ আমরা লেখার ক্ষেত্রে বা গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে যে ভাষা সাধারণত ব্যবহার করি তাকে মান্য বাংলা বলা হয়ে থাকে, যদিও তা বহু বিতর্কিত একটি বিষয়। পরে তা আলোচনা করা যাবে। তবে  মান্য চলিত ভাষাতে আমরা যে সবসময় কথা বলি এমনটা কিন্তু নয়। কারণ নানা উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষাভাষীর মানুষ রয়েছেন যারা তাদের ভাষা অনুযায়ী কথা বলে, যা হয়ত লেখায় খুব ব্যবহৃত হয় না। তবে সংলাপের ক্ষেত্রে এদের চল আছে। আর একটি বিষয় মনে রাখতে হয় প্রথাগত মান্য ভাষা হোক আর না হোক, একটি ভাষার ক্ষেত্রে তার উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব মান্য ভাষা থেকে কোনো দিক থেকেই কম বা বেশি নয়। সাধারণত জনপ্রিয়তা, ক্ষমতা, শিক্ষার হার, লেখার মান, জনসংখ্যা প্রভৃতি নানা দিক থেকে এ ধরনের একটি প্যারামিটার আমরা নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছি। সহজবোধ্যতারও একটা ভূমিকা অবশ্যই রয়েছে সেখানে। তবু আমরা আলোচনার সুবিধার্থে  মান্য চলিত বাংলাকে প্রাধান্য দিয়ে মান্য চলিত ভাষা ও ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা করতে চাই। আর হ্যাঁ, মাতৃভাষা ব্যাপারটিও একটু বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কারণ একটি ভাষার মাতৃভাষা একই ধরনের নাও হতে পারে। যেমন আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি , সার্বিকভাবে দেখতে গেলে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। কিন্তু বিষয়টিকে এত স্থূলভাবে দেখলে চলবে না। কারণ ঝাড়খন্ডি উপভাষার বাংলা রাঢ়ী উপভাষার মানুষ পরিষ্কার বুঝতে পারবে না যদি তার ওই  উপভাষা সম্পর্কে আগের থেকে জ্ঞান না থাকে। আবার বঙ্গালি উপভাষার  সঙ্গে কামরূপীর বিস্তর ফারাক। অন্যদিকে উড়িষ্যা বর্ডারের বাংলা, অসম বর্ডারের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ তো একেবারেই বুঝতে পারবে না। যেমন পুরুলিয়া গ্রামের আঞ্চলিক ভাষা খড়গপুর বা মেদিনীপুর শহরের মানুষ ঠিকঠাক বুঝতে পারে না, যদি কিছুটা পরিচিতি না থাকে। অর্থাৎ একদিকে উপভাষা অন্যদিকে তার অন্তর্গত বিভাষা বা আঞ্চলিক ভাষার নানা বৈচিত্র্য রয়েছে।  তাই মাতৃভাষা বিষয়টি অত সহজ ব্যাপার নয়। কারণ একটি শিশু যদি ঢাকাতে জন্মায় সে যে বাংলায় কথা শিখবে সেটা তার মাতৃভাষা। দাঁতনের শিশু যে বাংলা শিখবে সেটি তার মাতৃভাষা। আবার মেদিনীপুর বা কলকাতার শিশু যে বাংলায় কথা শিখবে সেটি তার মাতৃভাষা। পরবর্তীকালে সে যখন বড় হতে থাকবে লেখার বাংলায় প্রবেশ করবে, মান্য বা প্রমিত বাংলা কী  বুঝতে পারবে তখন সে, ভাষার সেই রূপটি অনুধাবনের চেষ্টা করবে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে তখন তাকেও মাতৃভাষা বলা যেতে পারে। তাই বাংলা মাতৃভাষা মানেই মান্য চলিত বা প্রমিত বাংলা ভাষা নয়। উপভাষা বা আঞ্চলিক রূপ ব্যক্তিবিশেষে মাতৃভাষার গুরুত্ব পায় এবং তা যথেষ্ট মর্যাদারও।
 আজকের সাধারণ আলোচনায় ভাষার অন্যতম প্রাথমিক উপাদান হিসেবে শব্দ গঠন সম্পর্কে একটা প্রাথমিক স্তরের আলোচনা সেরে নিতে  চাই। শব্দ   গঠনের ক্ষেত্রে একটি বা একাধিক বর্ণের সাহায্য নেওয়া হয়। যেমন, ভ, আ, ত নিয়ে 'ভাত।' বর্ণগুলো  একটা নির্দিষ্ট ক্রমে সাজানোর পর অর্থবোধ তৈরি হলেই 'শব্দ।' বর্ণসজ্জা আগে পরে করলেই বিপদ। অর্থাৎ 'ভতা'  লিখলে হবে না।  অর্থবোধের  ক্ষেত্রটা ঠিক থাকা চাই। অর্থবোধ বিষয়টি আবার বেশ মজার। কেউ যদি বলে 'পথমানতা' তো একটি শব্দ।
 আপনি কেন শব্দ নয়  বলছেন? 'পথমানতার' কোনো অর্থ নেই, তাই শব্দ নয়। প্রথাগতভাবে এটির প্রয়োগ ও প্রচারও নেই। কিন্তু কেউ যদি বলে 'চলমানতার' 'মানতা' ও  সঙ্গে 'পথ' শব্দটি বসিয়ে এই শব্দটি নতুন করে নির্মাণ করেছি এবং তার অর্থ ধারাবাহিক পথ চলা বা চলমানতারই এক অন্য রূপ। হ্যাঁ,  তখন তাকে শব্দ বলতেই হয়। অর্থাৎ এভাবে একটি নতুন শব্দ তৈরি হল। যা হয়তো আগে ছিল না, কিন্তু তার যদি অর্থবোধ তৈরি হয়ে যায় তবে তাকে শব্দ বলতে আর দ্বিধা থাকে না। নতুন নতুন শব্দ তো এভাবেই তৈরি হয়। তবে এই সমস্ত শব্দের গ্রহণযোগ্যতা যত বাড়তে থাকে তার প্রচারও ততই বাড়তে থাকে। অন্যরাও এর প্রয়োগ করে। আবার গ্রহণযোগ্যতা না তৈরি হলে তার বিপরীতটা ঘটে যায়। অর্থাৎ শব্দটির গুরুত্ব কমে যায় এবং পরে  হয়তো তা অপ্রচলিত হয়ে যায়। অন্যদিকে একটি বর্ণও শব্দ হাতে পারে। 'এ' একটি বর্ণ। আবার শব্দও। কারণ 'এ' অর্থ প্রকাশের ক্ষমতা রাখে। "এ জীবন এক মায়াকক্ষ"। এখানে 'এ'  নির্দিষ্ট অর্থ বহন  করছে বৈকি! এভাবে এক বা একাধিক বর্ণ শব্দ তৈরি করে। শব্দের প্রয়োগ বৈচিত্র্যও বাংলা ভাষায় প্রচুর। শব্দের অর্থ যেমন তার সময় অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে আবার সমসাময়িক একই শব্দও নানা অর্থে প্রয়োগ হতে পারে। প্রসঙ্গ, প্রয়োজনীয়তা, আভিধানিক ক্ষেত্র ছেড়ে বেরিয়ে আসা প্রভৃতি নানা দিক রয়েছে, যা এই  ব্যাকরণ - ধারাবাহিকে ধীরে ধীরে আলোচিত হবে।(চলবে)

অলংকরণ - শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য। 
-----------
এই ধারাবাহিকটি নিয়মিত প্রকাশিত হবে প্রতি সোমবার। অভিমত জানাতে পারেন। jaladarchi@yahoo.ইন
------------
আরও পড়ুন 

Post a Comment

5 Comments

  1. মানব বললেন মানব না " --- দুই 'মানব' -এর দু'রকম উচ্চারণ

    ReplyDelete
  2. মানব বললেন মানব না " --- দুই 'মানব' -এর দু'রকম উচ্চারণ

    ReplyDelete
  3. ছবিতে 'অলাবু' 'আলাবু' হয়েছে, সংশোধন করো। চম্‌স্কিতে ম-এ হসন্ত থাক। লেখা আরও অনুচ্ছেদ করে আর-একটু সাবলীল করা যায়ল

    ReplyDelete
    Replies
    1. আচ্ছা স্যার। প্রণাম ও ধন্যবাদ

      Delete
    2. ভালো আলোচনা। পবিত্র বাবুর পরামর্শ শিরোধার্য।

      Delete