জ্বলদর্চি

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন -১৮ / পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন― ১৮

পর্ব― ১৮

ডার্ক এনার্জি :

সময়টা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক। স্কুলের প্রফেসর-শিক্ষকরা মধ্যমেধার একজন শিক্ষার্থীকে উপদেশ দিচ্ছেন পদার্থবিদ্যায় গবেষণা না-করতে। পদার্থবিদ্যার ঘটনাপুঞ্জ না-কি আলটিমেটলি স্যাচুরেটেড! সম্পৃক্ত হয়ে গেছে ফিজিক্স! উদ্ভাবন বা আবিষ্কার করার মতো কিছু অবশিষ্ট নেই আর। তার চেয়ে বরং ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা করে মন্দায় চলা বাপ-কাকার বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ব্যবসায় হাত পাকাতে। তাতে পরিবারের আর্থিক সুরাহা হবে অনেক বেশি।

অথচ অঙ্ক ও ফিজিক্সে তীব্র প্যাশন ছাত্রটির। দৃঢ় তার প্রত্যয়― একদিন সে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী হবে। হাজার তিরস্কার-অপমানও টলাতে পারল না তার সে-সংকল্প।

তারপর এল সেই কাঙ্ক্ষিত সময়। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ। বিজ্ঞানের একেবারে নতুন শাখার আবির্ভাব ঘটল তার গবেষণার সূত্র ধরে। এত দিন ধরে লালিত ধ্রুপদি পদার্থবিজ্ঞানের চিন্তাভাবনায় জল ঢেলে দিয়ে নূতন নূতন ঘটনা আবিষ্কৃত হচ্ছে তখন। ব্রহ্মাণ্ড, শূন্যস্থান, তারকা নতুন নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে বিজ্ঞানীদের কাছে। সনাতন পদার্থবিজ্ঞানীদের পায়ের নীচ থেকে সরে যাচ্ছে মাটি। দেশ-কালের গণ্ডি পেরিয়ে ধীরে ধীরে পুরো ব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ জানছে মানুষ। কৌতূহল জাগাচ্ছে নতুন নতুন ঘটনার ভবিষ্যৎবাণী― সিঙ্গুলারিটি তত্ত্ব, দেশ-কালের বক্রতা, ব্ল্যাকহোল, হোয়াইটহোল, ওয়র্মহোল, ডার্ক ম্যাটারস ইত্যাদি। তা থেকে বেরিয়ে আসছে আরও গূঢ় তত্ত্ব বা তথ্য। কুয়ো থেকে বাইরে বেরিয়ে সাবালকত্ব হচ্ছে ব্যাঙ ওরফে পদার্থবিজ্ঞান। পুরো জগতটাকে দর্শন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে সে।

আসলে সেদিনের সেই অবাধ্য ছাত্র আর কেউ নয়, আজকের বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। তাঁর আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব আবিষ্কার, বিশেষত সাধারণ অপেক্ষবাদ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের এমন সব অজ্ঞাত ঘটনার উপর দৃঢ়ভাবে আলোকপাত করে; যা এর আগে ধারণা করা শুধু অসম্ভব ছিল না, অবাস্তব প্রতিপন্ন করে মানুষ স্রেফ উড়িয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করত না।

এ হেন সাধারণ অপেক্ষবাদের সম্ভবত শেষ সংকলন 'ডার্ক এনার্জি'। অপেক্ষবাদের ১৬ টি আংশিক অবকল সমীকরণ (Partial Differential Equations) যা বিজ্ঞানের 'ফিল্ড থিওরি'র শাখায় 'আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমীকরণ' বা সংক্ষেপে 'আইনস্টাইনের সমীকরণ' নামে বহুল আলোচিত, এদের ভেতর একটি সমীকরণে আইনস্টাইন কসমোলোজীক্যাল ধ্রুবক আমদানি করেন। ব্রহ্মাণ্ড স্থির নয়, প্রসারণশীল বোঝাতে। 
    এ হেন ধ্রুবক মহাকর্ষীয় সংকোচনের তীব্র বিরোধী। অর্থাৎ মহাকর্ষের বিপরীত বিকর্ষণধর্মী বলের প্রতিভূ এই ধ্রুবক না-কি ব্রহ্মাণ্ডের শুধু প্রসারণ নয়, ত্বরিত প্রসারণের ইঙ্গিতবাহী। যদিও তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী আইনস্টাইন একদা এ হেন ধ্রুবকের অন্তর্ভুক্তিকে তাঁর জীবনের 'মাস্টার ব্লাণ্ডার' (সাংঘাতিক ভুল) আখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর চার দশক পরে ১৯৯০-এর শেষে অবশ্য তাঁর সে-ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। কসমোলোজীক্যাল ধ্রুবকের অন্তর্ভুক্তকরণের পক্ষে জোর সওয়াল করেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। ততদিনে কসমোলোজীক্যাল ধ্রুবকের একটি উপযুক্ত নামও পেয়ে যান তারা। ডার্ক এনার্জি। অন্ধকার শক্তি। নামকরণ (১৯৯৮)-এর সৌজন্যে বিজ্ঞানী মাইকেল টার্নার। এনার্জি হলেও আদপে এটি একটি বিকর্ষণ বল। যে বল মহাবিশ্বের প্রসারণের জন্য দায়ী। শুধু তাই নয়, এর চাপ ঋণাত্মক। এই বলের জন্য ত্বরান্বিত গতিতে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে বলে ধারণা করেন একদল বিজ্ঞানী। ১৯৯৮ সালে। হাবলস স্পেস টেলিস্কোপের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে। 
      এ হেন টেলিস্কোপের তথ্য যাচাই করে অনুমান করা হয় যে ৯ বিলিয়ন বছর আগে এখনকার চেয়ে অনেক কম হারে প্রসারিত হচ্ছিল ব্রহ্মাণ্ড। এই কসমোলোজীক্যাল ধ্রুবকের বর্তমান মান ৭২ km/sec/Mpc থেকে বিশ্বের বয়সও নির্ণয় করেছেন পণ্ডিতগণ। ১৩.৭ বিলিয়ন বছর প্রায়। আর তাই পণ্ডিতগণের স্থির ধারণা ব্রহ্মাণ্ডের ডার্ক এনার্জির আবির্ভাব ৯ বিলিয়ন বছর আগে হয়েছিল। সে-সময় এই শক্তি নিতান্তই নগণ্য ছিল। তারপর থেকে এনার্জির পরিমাণ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। যার পরিণাম বিশ্বের প্রসারণের গতি ক্রমবর্ধমান।

বর্তমানে বিশ্বের পদার্থ-শক্তির তিনের চার ভাগ এই ডার্ক এনার্জির অবদান। প্রায় ৭০%-এর বেশি। বাকি ২৬% ডার্ক ম্যাটারস এবং ৪% দৃশ্যমান শক্তি-ভরের সমন্বয়ে তৈরি এই বিশ্ব।

অবশ্য এর পূর্বে ১৯১৫ সালের অব্যাহতি পরে ১৯২২-এ সাধারণ অপেক্ষবাদ থেকে আলেকজান্ডার ফ্রায়েডম্যান একগুচ্ছ সমীকরণ উদ্ভাবন করেন। সেসব সমীকরণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসরণ করে তিনি প্রথম বলেন 'বিশ্ব প্রসারণশীল'। পরে ১৯২৭ সালে বিজ্ঞানী জর্জ লেমেইটার একটি স্বাধীন গবেষণাপত্রে প্রসারণশীল বিশ্বের তত্ত্বে সিলমোহর দেন। তিনি বিশ্বের দূরতম প্রান্তে অবস্থিত নক্ষত্ররাজির অপসারণ বেগের সঙ্গে পৃথিবী থেকে তাদের সরণের সরল সমানুপাত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করেন এবং সমানুপাতি ধ্রুবকের মান গণনা করে ঠিক করেন। দু'বছর পর ১৯২৯-এ জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী এডুইন হাবল এই ধ্রুবকের মান সংশোধন করেন। সেই থেকে সম্পর্কটি 'হাবল-লেমেইটার সূত্র' হিসাবে এবং ধ্রুবকটি 'হাবলস ধ্রুবক' নামে পরিচিতি লাভ করে। সে-সময় এ ধ্রুবকের মান গণনা করে দেখা হয় ৫০০ km/sec/Mpc বা ১৬০ km/sec প্রতি মিলিয়ন আলোকবর্ষ, যেখানে ১ Mpc = ৩.২৬ মিলিয়ন আলোকবর্ষ প্রায় (Mpc বা মেগা পারসেক হল দূরত্বের বড় একক)। 
          এ হেন ডার্ক এনার্জির উৎস কী? তার সঙ্গে ডার্ক ম্যাটারের-ই বা কী সম্পর্ক? ডার্ক এনার্জির উৎস সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য এখনও অধরা। অজ্ঞাত এই শক্তির সরাসরি কোনও প্রভাব বা কার্য-কারণ আজ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি। তবে দিনকে দিন এর পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। মহাকর্ষের প্রভাব উপেক্ষা করে সে-জন্য দ্রুত হারে প্রসারিত হচ্ছে ব্রহ্মাণ্ড। তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই শক্তি শূন্যস্থানের এক স্পেশাল ধর্ম। প্রসারিত হলে ব্রহ্মাণ্ডের আয়তন বাড়ে। সেই সঙ্গে শূন্যস্থানের আয়তনও বৃদ্ধি পায়। ফলস্বরূপ আঁঠার (Adhesive) মত শূন্যস্থানের সঙ্গে সঙ্গে ডার্ক এনার্জির পরিমাণ অবশ্যই বাড়তে থাকে।

তবে ডার্ক ম্যাটারের সঙ্গে ডার্ক এনার্জির কোনও সামঞ্জস্য একদম নেই; শুধু নামকরণের আদ্যক্ষরে 'ডার্ক' শব্দটির অন্তর্ভুক্তি ছাড়া। তা নাহলে দুটি ঘটনার বৈপরীত্য চোখে পড়ার মতো। ডার্ক ম্যাটারের উৎপত্তি বিগব্যাঙের পরে পরেই, ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে। অথচ ডার্ক এনার্জি ৯ বিলিয়ন বছর আগে আবির্ভূত হয়েছে বলে পণ্ডিতদের ধারণা। ডার্ক ম্যাটারস চায় বিশ্বকে সংকুচিত করে বিগব্যাঙের অনুরূপ বিগক্রানচ দশায় পরিণত করতে। ওদিকে ডার্ক এনার্জি ব্রম্ভাণ্ডের প্রসারণশীলতার স্বপক্ষে এক জোরালো দলিল। যেদিন ডার্ক এনার্জির কণিকা বা বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ জানা যাবে, সেদিন হয়তো আমাদের মহাবিশ্বের যাবতীয় রহস্যের পর্দা উন্মোচিত হবে, ব্রহ্মাণ্ডের বিশ্বরূপ দর্শন সম্পন্ন হবে। (চলবে)
---------------
আরও পড়ুন। 

এবারের বিষয় : বিজ্ঞান। 
জ্বলদর্চি কুইজ -১৪
ক্লিক করে উত্তর দেখে নিন।
নির্মাণ - ঋতরূপ ত্রিপাঠী

Post a Comment

0 Comments