জ্বলদর্চি

চের্নোবিল (Chernobyl) : ইতিহাসকে বাস্তবায়িত করার দুরন্ত প্রয়াস/অনিমেষ দত্ত

চের্নোবিল (Chernobyl) : ইতিহাসকে বাস্তবায়িত করার দুরন্ত প্রয়াস

অনিমেষ দত্ত

চের্নোবিল (Chernobyl)এইচবিও মিনি সিরিজ
পরিচালক : জোহান রেংক
অভিনয় : জ্যারেড হ্যারিস, স্টালিন স্কারসগার্ড,এমিলি ওয়াটসন,পল রিটার প্রমুখ।
মুক্তি – 6 May 2019 (এইচবিও)
IMDb রেটিং : 9.4/10

১৯৮৬ সালের ২৬ মে, চেরনোবিল, সোভিয়েত রাশিয়া, সময় রাত ১টা ২৩ মিনিট ৪০ সেকেন্ড।

হঠাৎ একটা কানফাটানো শব্দে সব লন্ড ভন্ড হয়ে গেল। হঠাৎ কি বলা যায়? না হঠাৎ বলা যায় না।কারণ একটা পরীক্ষার জন্য এই বিস্ফোরণ আর এই দুর্ঘটনা ঘটে। 
যখন চের্নোবিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অপারেটররা বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যাকআপ বন্ধ হয়ে গেলে সে অবস্থায় কীভাবে পারমাণবিক চুল্লী চালানো যায় তা পরীক্ষার জন্য একটি  টেস্ট করছিলেন, তখন। কোনো সিস্টেমের মধ্যে কৃত্রিম জরুরি অবস্থা তৈরি করে ভবিষ্যতে তা কীভাবে মোকাবেলা করা হবে সেটা পরীক্ষা করা। পরীক্ষা শুরুর সময়ে কিছু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই কেন্দ্রের চারটি পারমাণবিক চুল্লীর মধ্যে একটি চুল্লীতে অনিয়ন্ত্রিত বিক্রিয়া শুরু হয় যার কারণে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

সেই সময়ের সোভিয়েত কমিউনিস্ট সরকারের মতে তাৎক্ষণিক ভাবে ৩১ জন মারা যায়। যদিও পরে সেই সংখ্যাটা কয়েক লাখে পৌছোয়। 

রেডিয়েশনের কারনে ২০ হাজার বছরের জন্যে বসবাসের অনুপোযোগী ঘোষণা করা হয় চের্নোবিল ও তার আশেপাশের শহরগুলিকে। ক্ষতিগ্রস্থ হয় প্রায় ৭০-৮০ লাখ মানুষ! হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয় ক্যান্সারে। অসংখ্য শিশু জন্ম থেকেই বয়ে আনে রেডিয়েশনের ক্যান্সার সহ রোগে।
এইচবিও মিনিসিরিজ চের্নোবিল ২০১৯ এ মুক্তি পায়। পুরোপুরি বাস্তবঘটনার উপর ভিত্তি করে বানানো এই সিরিজে কি দেখানো হবে তার সব আগে থেকে জানা।তারপরেও এই সিরিজটিতে যেভাবে সিনেম্যাটিক ভাবে তুলে ধরতে গিয়ে পরিচালক জোহান রেংক অসাধারণত্বের পরিচয় দিয়েছেন। সিরিজটি লিখেছেন ক্রেইগ মাজিন। ধোঁয়াশা ভরা কালার প্ল্যালেট দিয়ে সমস্ত দৃশ্য দেখানো হয়েছে যা বেশ আকর্ষণীয়।
পাঁচটি পর্বের এই সিরিজ ইতিহাসকে জীবন্ত করবার একটি প্রয়াস।

সেরা দুই সিরিজ 'গেম অব থ্রোনস' ও 'ব্রেকিং ব্যাড' কেও রেটিং -এর দিক থেকে পেছনে ফেলে দিয়েছে চের্নোবিল।

সিরিজে দেখা যায় নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে কোর বিস্ফোরণের পর প্রাথমিকভাবে সারা বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করা হয়। একপ্রকার সবকিছু গোপন করার চেষ্টা। সাময়িকভাবে কিছু দমকল কর্মীকে দিয়ে জল দিয়ে আগুন নেভানোর কাজ করা হয়। কিন্তু সেভাবে কোন ফল পাওয়া যায় না ও দমকল কর্মীরা আক্রান্ত হন ও তাদেরকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়।যদিও দুদিন পর হাজার কিমি দূরে সুইডেনের পাওয়ার প্ল্যান্টে  বাতাসে রেডিয়েশনের ফলে সেখানকার অ্যালাম বাজতে থাকে। পৃথিবীর সবাই জানতে পারে এই বিপর্যয়ের কথা। আস্তে আস্তে সেখানকার মানুষজনকে সরানোর কাজ যেমন চলতে থাকে তেমনি ছাদের উপর থেকে গ্রাফাইট সরানোর জন্যে মানুষদের কাজে লাগানো।

রেডিয়েশন যাতে জলে ছড়িয়ে না যায় তার জন্য সুড়ঙ্গ খোঁড়া ও তারজন্য শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া সবকিছু দেখানো হয়েছে। যেন চোখের সামনেই সব ঘটে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি কিছু নতুন চরিত্র তৈরি করে গল্পের বুননকে আরও সাবলীল করেছেন সিরিজের লেখক।
তাছাড়া আদালতে বিচারাধীন সময়টিকেও খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিজ্ঞান না জেনেও কিভাবে প্ল্যান্ট কাজ করে তা বোঝা যায় সিরিজটি দেখে রোমহর্ষক ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, গল্পবলার ধরণ, সেট, মেকাপ সবই অসাধারণ বললে কম বলা হবে। রেডিয়েশনের মাত্রা বাড়লে বিশেষ এক শব্দ যা সিরিজ শেষেও কানে বাজে। ইতিহাস যেমন তুলে ধরা হয়েছে তেমনি সিরিজ শেষে বাস্তব চরিত্রের নাম, ছবি, ভিডিও ক্লিপ ও বর্তমান অবস্থারও বর্ণনা করা হয়েছে।

এখনও পর্যন্ত পৃথিবীতে দুটি পারমাণবিক দুর্ঘটনাকে সর্বোচ্চ মাত্রার বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর একটি ঘটেছে চের্নোবিলে, আরেকটি ২০১১ সালে জাপানের ফুকুসিমা দাইচির পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। চের্নোবিলে ঘটে যাওয়া পারমাণবিক বিস্ফোরণটি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে ফেলা পারমানবিক বোমার থেকেও প্রায় ৪০০ গুণ বেশী।

সিরিজের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে গতি থাকলেও মাঝের দুটি পর্ব একটু শ্লথ তবুও পরিচালক তাঁর দৃষ্টিতে দেখতে গিয়ে সবকিছুকে ভুলিয়ে দেন। কেবল 
ইতিহাস জানার জন্য নয় বাস্তবের সাথে ইতিহাস কিভাবে মিশে যায় তা দেখার জন্য সিরিজটি দেখা উচিত।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


 আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments