জ্বলদর্চি

বুদ্ধদেব বসু/ঋত্বিক ত্রিপাঠী

বুদ্ধদেব বসু

ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

আধুনিক বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ বুদ্ধদেব বসু। সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তাঁর অবাধ বিচরণ। সার্থক ভাবেই। সম্পাদনা করেছেন 'কবিতা' পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি লরেন্স- ব্রাউনিং-সুইনবার্ণ প্রমুখের প্রেরণা তাঁকে ঋদ্ধ করেছিল। শরীরী প্রেম যথেষ্ট সাহস অবলম্বন করে নানা মাত্রায় আলােকিত হয়েছে। কামনার তীব্রতা যেখানে নির্মম, সেখানে সুন্দরের চিরায়ত স্বপ্ন রূপবদলে সচেষ্ট। স্বাভাবিক কারণেই তিনি রবীন্দ্র-অনুসারী এবং রবীন্দ্র-বিরােধী। অবশ্য এই দুই ধর্ম কখনও উচ্চকিত নয়। তাঁর অধিকাংশ গল্পের বিষয়ও প্রেম। উপন্যাস কাব্যধর্মী ও অভিনব। বহু ভাষাজ্ঞান তাঁর আয়ত্তে ছিল। তাঁর অনুবাদ তাই সৃজনশীল। শিশুসাহিত্য চর্চাও উল্লেখযোগ্য। শিশু সাহিত্যে বুদ্ধদেবের ছিল সুগভীর মনস্তত্ত্ব-সহানুভূতি। ভারতীয় ও গ্রীক পুরাণ প্রসঙ্গে তাঁর আগ্রহ ছিল। 'অনাম্নী অঙ্গনা', 'সংক্রান্তি', 'তপস্বী ও তরঙ্গিণী' ইত্যাদি নাটকে রয়েছে ভারতীয় পুরাণ। 'কলকাতার ইলেকট্রা’-য় ব্যবহৃত হয়েছে গ্রীক পুরাণের ইলেকট্রা-কাহিনি।

প্রথম দিকের অতি রােমান্টিক মনােভাব মিথ-আশ্রয়ী হয়ে পরবর্তী সময়ে তিনি সংযত। চিত্রকল্পেও এসেছে এক সংহতি। ফরাসী কবি পল রেভাদি-র মতে চিত্রকল্প পূর্ণভাবে একজন কবির সৃজনশীল মানসক্রিয়ার ফসল। এজরা পাউন্ডের চিত্রকল্পবাদীতে বিশ্বাসী হয়েও বুদ্ধদেব ইমেজ সৃষ্টিতে স্বদেশী রূপ-প্রকরণকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। 

গদ্য ও কথ্য রীতিতে তাঁর সাধনা ও সাফল্য। রােমান্টিকতা ও নিজস্ব চৈতন্যবােধের আশ্চর্য মিলন ঘটলেও সমকাল প্রায় উপেক্ষিত। কিন্তু নিজের কাব্যবৈশিষ্ট্যে তিনি যেভাবে প্রত্যয়ী তা যেমন অভিনব তেমনি দুর্লভ --সেকালে। একালেও বটে।

গদ্যে তাঁর নিজস্ব যুক্তি ও আত্মবিশ্লেষণ তৈরি করে আপাত বিরােধ। পাণ্ডিত্য প্রকাশের অহমিকা নয়, ব্যাকরণের বাঁধা নিয়ম নয়, অন্তরঙ্গ কথকতা প্রকাশই তাঁর মূল লক্ষ্য। প্রকাশের শৃঙ্খলকে সংযত করেছে যতিচিহ্নের ব্যবহার। প্রবন্ধে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গুরুত্ব পেয়েছে বাংলা সাহিত্য সমালােচনা।

আজ, যখন আমরা আধুনিক কবিতা ছাড়িয়ে নতুন কবিতার অনুসন্ধানে, তখন মনে রাখতেই হয়, আধুনিক বাংলা কবিতার রূপনির্মাণের প্রধান স্রষ্টা বুদ্ধদেব বসু। নিজের সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সাহিত্যকর্মীও। তাঁর কবিতা পত্রিকা দীর্ঘ পঁচিশ বছর বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। কবিতা সংকলন প্রকাশে তাঁর নিষ্ঠা আমাদের আজও মুগ্ধ করে। কবিতাকে সর্বশ্রেণির পাঠকমুখী করে তুলতে সুলভ মূল্যে বই ছাপার পরিকল্পনা সম্ভবত তিনিই প্রথম ভেবেছেন। এসব মিলিয়েই আবিষ্কার করা যায় কর্মপ্রিয় বুদ্ধদেব বসুকে। তিনি ছিলেন চির-অতৃপ্ত। আর এই স্বভাব প্রকৃত সৃজনশীল মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

আমাদের বড় প্রাপ্তি এই যে, তিনিই প্রথম লিটল ম্যাগাজিনের সংজ্ঞা নির্ণয় করে সৎ নিরপেক্ষ সাহিত্যচর্চার পথ নির্দেশ করেছেন। দিয়েছেন লিটল ম্যাগাজিনের দার্শনিক চেতনা।

বুদ্ধদেব বসুর জন্ম ৩০ নভেম্বর ১৯০৮ বাংলাদেশের কুমিল্লায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম.এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। ১৯৩১ সালে স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে আসেন। দেশে বিদেশে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে করেছেন অধ্যাপনা। 'তপস্বী ও তরঙ্গিণী' -র জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার(১৯৬৭)। ১৯৭০ সালে পেয়েছেন জাতীয় সম্মান 'পদ্মভূষণ'। 'স্বাগত বিদায়' কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কার। ১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চ প্রয়াণ ঘটে।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

3 Comments

  1. পড়লাম আর এই সংক্ষেপের মধ্যেই আলোকিত একটি পথের উন্মোচন। কিছু কিছু ফলক সবসময় দিকনির্দেশনা করে। শ্রদ্ধাবনত চিত্তে জানাই , বুদ্ধদেব বসুও তাই।ভালো লাগল আপনার এইভাবে দিনটিকে স্মরণ করানোয় । প্রণাম ও শ্রদ্ধা এই প্রণম্যকে। কবিতা কবিতা ভবন সারাটা জীবন কবিতায় ভরিয়ে রাখলেন তিনি নিজেকে, যদিও সাহিত্যের সবকটি পথেই তাঁর অবাধ বিচরণ। ঋত্বিকবাবুকেও অনেক শুভেচ্ছা জানাই এই লেখার জন্য।

    ReplyDelete