জ্বলদর্চি

আফ্রিকার লোকগল্প / চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লােকগল্প (আফ্রিকা- জুলু উপজাতি)

হাতির হাঁচি 
চিন্ময় দাশ

জগতে হাতিই একমাত্র প্রাণী, যার মুখে জুড়ে আছে ইয়াব্বড় একখানা নাক। কথায় বলে না, মাথা থেকে পা পর্যন্ত, এক্কেবারে সেই অবস্থা হাতির নাকটার। মাথা থেকে বেরিয়ে, ঝুলতে ঝুলতে পায়ের কাছে, মাটিতে এসে ঠেকেছে সেটা। এই নাকটাকেই শুঁড় বলা হয়। 
কিন্তু বিধাতা পুরুষ যখন হাতি সৃষ্টি করেছিলেন, সেসময় তিনিই এমনটা করে দিয়েছিলেন, তা কিন্তু নয়। আগেকার দিনে হাতির ছিল ছােট্ট আর ভারি সুন্দর দেখতে একখানা নাক। তাহলে এখন কী করে এমনটা হল ? পৃথিবীর দেশে দেশে নানান গল্প আছে তাই নিয়ে। ভারি সুন্দর সুন্দর গল্প সেসব। আফ্রিকা থেকে তারই একটা গল্প আজ সবাইকে শােনাই।

অনেক অনেক কাল আগের কথা। তখন ভারি সুন্দর আর মানানসই নাক ছিল হাতিদের। যেমন ছােট, তেমনি ঝকঝকে। তবে একটা বদ অভ্যাসও ছিল তাদের। বনের কোন একটা পশু হয়ত তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, হাতিরা অমনি নাক সিঁটকে মাথাটা আকাশের দিকে তুলে ধরবে উঁচু করে, আর ঘনঘণ নিঃশ্বাস ফেলতে থাকবে। যেন ভীষণ ঘেন্নার বা যাচ্ছেতাই কিছু একটা ব্যাপার ঘটেছে। 
এতে সবারই খারাপ লাগে। সবারই রাগ হয়। কিন্তু করার কিছু নাই কারও। যা বিশাল একখানা করে বপু হাতিদের। তাদের চটানাে ঠিক নয়। এমনকি বাঘ বা সিংহও সহজে হাতিকে চটাতে চায় না।

কিন্তু এমনটা তাে বেশি দিন সওয়া যায় না। একদিন সিংহ ভাবল, কিছু একটা করা দরকার। সিংহ হল বনের রাজা। যা করবার, তাকেই করতে হবে। 
খুব গােপনে একটা সভা ডাকল সিংহ। বনের খুব গভীরে সব প্রাণী এসে জড়াে হল রাজার ডাক পেয়ে। সিংহ বলল-- হাতি সবাইকে এমন হতচ্ছেদ্দা করবে, এটা তাে মানা যায় না। কিছু একটা করা দরকার। সবাইকে দেখেই ব্যাটারা নাক সিঁটকাবে, এটা আমি আর সইতে পারছিনা।

সিংহের কথায় সবাই একমত। কিন্তু কেউই আগ বাড়িয়ে নিজে থেকে কিছু করতে রাজি নয়। মাথা নাড়ল বটে, এগিয়ে এল না কেউ। 
একটা হনুমান ছিল সেই সভায়। চুপচাপ একটা গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসে ছিল হনুমানটা। সে বলল-- ঠিক আছে, রাজামশাই। হাতির নাকের ভার আপনি আমার ওপর ছেড়ে দিন। এমন শিক্ষা দেব, যে জন্ম জন্ম ধরে মনে রাখবে বাছাধনরা।

সেই বনের ভেতরেই ছিল ছােটমতন একটা পাহাড়। তার মাথায় থাকে এক সাধু। হনুমান সেই সাধুর কাছে গিয়ে হাজির হল। সব কথা জানিয়ে সে সাধুকে বলল-- মহারাজ, হাতিদের এই নাকের গুমােরটা কাটানাে যায় কী করে? সেই সাথে তাদের এই বদ অভ্যাসটাও। সাধু হেসে বলল-- আমার কাছে এক জাদু-পিপুলের গুঁড়াে আছে। এক চিমটে গুঁড়ােতেই কাজ হাসিল হয়ে যাবে। হাতিদের নাকের চেহারা বদলে দেওয়াটা তাে এক লহমার ব্যাপার। 
শুনে হনুমানের খুব আনন্দ হল। সে বলল-- তাহলে আর দেরি কেন, গুরুদেব? শুভস্য শীঘ্রম।

সাধু হেসে বলল-- কিন্তু বাছা, হাতিরা তাে আমার কোন অপকার করেনি। আমি কেন তার অপকার করব ? তাছাড়া, সত্যি বলতে কী, হাতিদের নাকখানা কিন্তু দেখতে ভারি সুন্দর। 
এদিকে হনুমানও নাছােড়বান্দা। যতই সাধু মাথা নাড়ে, ততই সে বায়না ধরতে থাকে। অনেক কাকুতি মিনতি করেও, টলানাে গেল না সাধুকে। কিন্তু হনুমান দমবার পাত্র নয়। তার ভীষণ গোঁ। সে সাধুর ডেরা থেকে বেরিয়ে, একটা গাছের ডালে গিয়ে বসে রইল চুপটি করে।

একসময় সাধু গেল নদীতে স্নান করতে। অমনি টুক করে তার ঘরে ঢুকে পড়ল হনুমান। কুলুঙ্গিতে একটা পুঁটলিতে ছিল পিপুলের গুঁড়ো। এক মুঠো গুঁড়াে নিয়ে, সেখান থেকে সরে পড়ল হনুমান। বড় বড় লাফে পাহাড় থেকে নেমে, একেবারে বনের গভীরে।

অনেকখানা পথ যাওয়া-আসা করতে হয়েছে। হাঁফ ধরে গেছে হনুমানের। জল খেতে চলল হনুমানটা।

জলাশয়ের কাছে এসে দেখল, হাতিরাও এসেছে জল খেতে। বিশাল এক হাতির পাল। সবাই মুখ ডুবিয়ে জল খাচ্ছে। পিপুলের গুঁড়ো এনেছে বটে, কিন্তু হনুমান তাে জানে না, গুঁড়োগুলাে নিয়ে কী করতে হবে। তবে, সাধু অবশ্য বলেছিল, এক চিমটেতেই কাজ হাসিল। হনুমান করল কী, মুঠোভর্তি গুঁড়ােই দিল জলে মিশিয়ে।

এদিকে হাতিরা তাে এসব কিছু জানে না। তারা জানতেই পারল না, পিপুলের গঁড়াে মেশানাে জলই চোঁ চোঁ করে খেয়ে যাচ্ছে সবাই।

তাতেই যা কাজ হওয়ার, হয়ে গেল। জল ছেড় সবে ওপরে উঠেছে, অমনি নাক সুড়সুড়িয়ে হাঁচি শুরু হল হাতিদের। হাঁচি বলে হাঁচি। পেটের সব নাড়িভুড়ি যেন বাইরে বেরিয়ে আসবে তাদের। তার সাথে হােল কী, হাঁচির চোটে একবার মাথা ঝাঁকাচ্ছে, আর নাকটা বেড়ে যাচ্ছে একটু করে। সবারই এক অবস্থা। হ্যাঁচ্চো- হ্যাঁচ্চো-- হেঁচেই চলেছে বনের যত হাতি। প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় তাদের। 
সেই বিকট হাঁচির শব্দে সারা বন তােলপাড়। কান পাতা দায়। সব প্রাণীরা এসে জুটতে লাগল জলাশয়টার আশপাশে। ব্যাপারটা কী?

সিংহও বেরিয়ে এল তার ডেরা থেকে। হাতিরা এমন বিকট ভাবে হাঁচে কেন? তাদের নাকগুলােও বা এমন বিদঘুটে বড় হয়ে যাচ্ছে কী জন্য ?

সিংহকে দেখে লম্বা করে একটা পেন্নাম ঠুকে দিল হনুমান। বলল-- চুপচাপ মজাটা দেখে যান, রাজামশাই। খেল খতম করে দিয়েছি ব্যাটাদের।

ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে সব প্রাণী। সবাই হাঁ করে দেখতে লাগল ব্যাপারটা। হাতিরা হাঁচছে, আর একটু একটু করে লম্বা হচ্ছে তাদের নাকগুলাে।

ততক্ষণে মাথা ছেড়ে পেটের কাছে চলে এসেছে নাকটা। হাঁচি আর নাকের বাড়-- কিছুরই যেন বিরাম নাই। বিকেল নাগাদ মাটি ছুঁয়ে ফেলল নাকগুলাে। যার নাক মাটি ছুঁল, হাঁচি থমে যেতে লাগল তার। একসময় দেখা গেল, সবগুলো হাতিরই নাক মাটি ছুঁয়ে ফেলল বাড়তে বাড়তে।

কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে হাতিগুলাে। কেন এমন ব্যাপারটা হল, বা এমন বিদঘুটে একটা নাক নিয়ে তারা এখন করবেটা কী-- কিছুই বুঝতে পারছে না হাতিরা।

প্রথম হেসে উঠল হনুমানটা। তারপর একে একে সবাই। এমনকি রাজামশাই সিংহও চুপ করে থাকতে পারল না আর। এত বড় এক একটা প্রাণী। পাঁচ-ছ'হাত হাত লম্বা একটা নাক মাটি পর্যন্ত ঝুলে আছে। হাতিদের এমন দুর্দশা কে কবে দেখেছে। হােলই বা রাজা! সিংহও হাসতে লাগল। এবার সারা বন তােলপাড় হয়ে যেতে লাগল সকলের হাসির আওয়াজে।

প্রথমে বিকট হাঁচি আর তারপরে তুমুল সেই হাসির আওয়াজ বন ছাড়িয়ে পাহাড়ের মাথায়ও এসে পৌঁছল। ডেরায় বসে সাধু ভাবল-- ব্যাপারটা কী! যাই একবার দেখে আসি।

নীচে এসে কিছুই বুঝতে বাকি রইল না তার। হনুমানকে বেদম বকাঝকা করল সাধু, চুরি করার জন্য।

হাতিরা সাধুকে ধরে পড়ল-- কিন্তু আমাদের কী হবে, মহারাজ ?

সাধু বলল-- আমার জাদু গুঁড়োর কাজ তাে বদলাবে না কোনমতেই। তবে দুটো ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। জগতের সব প্রাণীরই একটা করে নাক আছে। কিন্তু কেউ তাদের নাক নাড়াতে পারে না। তােমরাই কেবল ইচ্ছে মতন এদিক ওদিক ঘােরাতে পারবে নাকটাকে। আর একটা সুবিধা হল, তােমাদের এই লম্বা নাকটা ভয়াণক শক্তিশালী হবে। শক্তও হবে একেবারে গাছের গুঁড়ির মত। এই নাক দিয়ে শত্রূর মােকাবিলা করতে পারবে তােমরা। জড়িয়ে ধরে ফেলতে পারবে, আঘাতও করতে পারবে এটা দিয়ে। আর সেই আঘাত সইতে পারে, এমন কেউ নাই এই দুনিয়ায়।

শুনে হাতিদের তাে ভারি আনন্দ। বদমাশ হনুমানকে মাপই করে দিল হাতিরা।

সিংহ ভাবল, ফারি ফ্যাসাদ হল দেখছি। হাতিকে আর ঘাঁটানো যাবে না। এবার থেকে বরং একটু সমঝে চলাই ভাল। হতভাগা হনুমানটার জন্যই এমনটা হল। 
রাগে গরগর করতে করতে হনুমানের দিকে তেড়ে গেল সিংহ। অমনি এক লাফে গাছের ডগায় চড়ে পড়ল হনুমান। সেই থেকে হনুমান কোনদিন রাজার সামনে যায় না। 
এদিকে, শক্তপােক্ত আর বড়সড় এমন একটা নাক পেয়ে গিয়ে, বেশ গর্ব হতে লাগল হাতিদের। আনন্দে চিৎকার করে উঠল তারা। সবাই একসাথে। সেই গর্জনে আবার একবার কেঁপে উঠল সারা বনভূমি।
-----
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments