জ্বলদর্চি

গ্রীনল্যান্ড (এস্কিমো)-এর লোকগল্প। ইঁদুর কুমারির বর/ চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প  

আজ, গ্রীনল্যান্ড (এস্কিমো)- র লোকগল্প
Folklore of Greenland (Eskimo)

চিন্ময় দাশ

ইঁদুর কুমারির বর 

একটা গর্তে থাকে তিনটা ইঁদুর। বাবা মা আর তাদের মেয়ে। দারুণ সুন্দরী হয়ে উঠেছে মেয়েটা। যেমন চেহারা, তেমনি দেখতে। আর গুণও কত! খাবার-দাবার চুরি করতে যেমন ওস্তাদ, গর্ত খোঁড়ার কাজেও জুড়ি নাই তার। সরু সুতাে বেয়েও উঠে যেতে পারে তরতর করে। এমন গুণবতী মেয়ের জন্য ভারি গর্ব মা-বাবার।

ইঁদুরদের পাড়ায় হুড়ােহুড়ি পড়ে গেল। সবাই বিয়ে করে ঘরে নিয়ে যেতে চায় এমন মেয়েকে। যুবক ইদুররা আসতে লাগল দল বেঁধে। তাদের মা-বাবারাও। কিন্তু সবাইকেই ফিরিয়ে দেয় মেয়েটার মা-বাবা। 
এবার এল পাড়ার সবচেয়ে সেরা যুবক ইঁদুরটি। সুন্দর সুঠাম চেহারা তার। বয়সেও একেবারে মানানসই। বড়সড় সুন্দর গর্ত আছে তার নিজের। বিশেষ করে পাথর কাটতে ভারি ওস্তাদ সে। 

মেয়েটার মা-বাবা বলল- না বাছা, তুমি ফিরে যাও। কোনও ইঁদুরের সাথে আমাদের মেয়ের বিয়ে দেব না। তার বিয়ে হবে দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাবানের সাথে।
কিন্তু বললেই তাে আর হলনা। সেরা ক্ষমতাবানটি কে? সে থাকেই বা কোথায় ? অনেক ভেবে মা-বাবা ঠিক করল, সূর্যই গােটা দুনিয়ার কর্তা। সে-ই সবার চেয়ে বড়। তাকেই বিয়ে দেব আমাদের মেয়ের সাথে। 
পুটলি বেঁধে খাবার দাবার নিয়ে তিনজনে চলল সূর্যের বাড়ি। মেয়েটাকে দেখে সূর্যের তাে ভারি আহ্লাদ। মা-বাবা বলল-- পেন্নাম হই, ঠাকুর। তুমিই তাে জগতের সবচেয়ে বড়। আমরা তােমার সাথেই মেয়েটার বিয়ে দেব, ঠিক করেছি। তুমি বিয়ের আয়ােজন কর।
সূর্য বলল-- বড়-র কথা যখন তুললে, তাহলে বলি। আমার চেয়েও বড় আছে দুনিয়ায়।

ইঁদুররা তাে অবাক। বলল-- বলাে কী ? তােমার চেয়েও বড়! কে সেই বীর ?
-- কেন, মেঘ! মুখ গােমড়া করে বলল সূর্য-- বীর আর বড় না হলে, যখন তখন আমাকে ঢেকে দেয় কী করে? তােমরা বাপু তার কাছেই যাও। তিনজনে মিলে মেঘের বাড়ি এসে হাজির হােল। বলল-- আমরা জেনেছি, তুমি দুনিয়ায় সবচেয়ে বড়। তােমার শক্তি সবার চেয়ে বেশি। তুমিই এই মেয়েকে বিয়ে করার যােগ্য লােক।
মেঘ বলল-- কথাটা ঠিকই বলেছ। মেয়েটাও তােমাদের ভারি সুন্দরী। কিন্তু, কথা হল...
-- এর মধ্যে আবার কিন্তুর কী আছে ? কথাটাই বা কী? অবাক হয়ে গেল তিনজনে।
মেঘ বলল-- আমার চেয়েও বড় আছে একজন। সে হল বাতাস। সাদা মেঘ, কালাে মেঘ; পেঁজা মেঘ, ঘণ মেঘ; ছােট মেঘ, বড় মেঘ- কাউকেই রেয়াৎ করে না সে। যখন এসে হাজির হয়, আমাকে একেবারে উড়িয়েই নিয়ে চলে যায়। এমনই দাপট তার। তাহলে বুঝলে, সে আমার চেয়েও বড়।

মেঘের জবাব শুনে, বাতাসের বাড়ি চলল তিনজনে।
বাতাস তখন একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে। চারদিক শুনসান। গাছের পাতাটিও নড়ছে না। হঠাৎ তিনজনকে সামনে দেখে, একটু অবাক হল সে। মেয়েটার থেকে চোখ ফেরাতে পারল না। মা-বাবা বলল-- দুনিয়ার সেরা বলবানের সাথে মেয়ের বিয়ে দেব বলে, তােমার কাছে এসেছি। তুমি একে বিয়ে কর।

বাতাস নড়েচড়ে বসল একথা শুনে। কিন্তু তার জবাব অন্যরকম-- “আমি কী করে বিয়ে করি ? আমার চেয়েও যে বড় আছে দুনিয়ায়।
-- কে সে? কোথায় থাকে ?
-- কেন, পাহাড়! যত জোরই থাকুক আমার, তাকে টলাতে পারি না আমি। তার গায়ে ধাক্কা খেয়ে, আমাকেই পাশ কাটিয়ে বয়ে যেতে হয় তখন। সে গ্রাহ্যই করে না আমাকে। তাহলে তাে সে-ই বড়। তাই না?

বাতাসের জবাবে তিনজনের মনে হল, ঠিক কথা। এতদিনে সবচেয়ে বড়র খোঁজ পাওয়া গেছে।
পাহাড়টা তাে তাদের পাড়ারই কাছাকাছি। তিনজনে ফিরে আসবার পথ ধরল এবার। পাহাড়ের কাছে এসে তাকে বলল সব কথা। পাহাড় হেসে বলল-- অনেকের কথা শুনে শুনে, তবে আমার কাছে এসেছ তােমরা। এবার আমার কথা শােন। মেয়েটাকে বিয়ে করতে আমারও মন চাইছে। ভারি সুন্দর মেয়ে তােমাদের। কিন্তু দুনিয়ায় আর একজন আছে, যে আমার চেয়েও বড়।
-- তােমার চেয়েও বড়! আছে নাকি এমন কেউ এই দুনিয়ায় ?
পাহাড় হেসে বলল-- একথা ঠিক, আমার বিশাল চেহারা। যুগের পর যুগ বয়সও হল আমার। কিন্তু একজন আছে, বয়সে বা চেহারায় আমার কাছে সে একেবারে চুনােপুটি। কিন্তু তার ভারি তেজ। ভারি ক্ষমতা তার, তেমনি তার সাহস। আমাকে গ্রাহ্যই করে না একেবারে।
তিনজনে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাহাড়ের ওপর-- বলাে, বলাে কে সেই সাহসী বলবান! কোথায় থাকে সে। 

খুব একচোট হাসল পাহাড়। তারপর বলল-- এক পাড়াতেই থাকো। অথচ খোঁজও রাখো না। তোমাদের পাড়াতেই তাে তার বাস গাে। এক যুবক ইঁদুর। কী তার রূপ! তেমনি বয়স। আর দাঁতের কী ধার। আমারই গােড়ার দিকে চেয়ে দেখ। পাথর কেটে কেটে গর্ত বানিয়েছে কেমন। ভিতরে পঁচ মহলা প্রাসাদ। একেবারে রাজার বাড়ি যেন। বিয়ের পর নতুন বউকে এনে তুলবে সে বাড়িতে। তােমরাই বল, যে আমাকেও কেটে ফেলতে পারে, সে নিশ্চয়ই আমার চেয়েও বড়!
তাতে সাথেই তিন জনের মনে পড়ে গেল যুবক ইঁদুরটির কথা। তাকেই তো ক'দিন আগে ফিরিয়ে দিয়েছে তারা। রইল পড়ে পাহাড়ের কথার জবাব দেওয়া। তাড়াহুড়াে করে পাড়ায় ফিরে এল তিনজনে। আর দেরি করা নয়। সােজা যুবক ইঁদুরটার বাড়ি গিয়ে বিয়ের কথা পাড়ল। মেয়েটার মা-বাবা বলল-- তুমি আমাদের মেয়েকে বিয়ে কর, বাছা। তােমাকেই জামাই করতে চাই আমরা। গোটা দুনিয়া ঘুরে যাচাই করে এলাম। তোমার চেয়ে বড় আর কেউ নাই জগতে।
দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বীর এই যুবক ইঁদুর। সবাই মেনে নিয়েছে একথা। একথা শুনে, বেশ গর্ব হল যুবক ইঁদুরটির। শুধু ক্ষমতায় বড় নয়, তার মনও বড়। একদিন এরাই ফিরিয়ে দিয়েছিল তাকে, সেই পুরাণাে কথা সে মনে আনল না। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দিল বিয়েতে। আসল কথা হােল, মেয়েটাকে ভারি মনে ধরেছে তার। 

ধুমধাম করে দুজনের বিয়ের আয়ােজন শুরু হল। মেয়েটার বাবা চলল সূর্য, মেঘ, বাতাস আর পাহাড়কে নেমন্তন্ন করতে। তারা এতটা ভাল, তাই এমন ভাল বিয়েটা হচ্ছে তাদের মেয়ের। নেমন্তন্ন তাে করতেই হবে।
--------------
আরও পড়ুন
দক্ষিণ আফ্রিকা-জুলু উপজাতি-র লোকগল্প : উবুন্তু। 
চি ন্ম য়  দা শ।


Post a Comment

0 Comments