জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-২/শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-২

শুভদীপ বসু
অলংকরণ: ঈশিতা দাস

কবিতা-কবি ও আবৃত্তিকার

ক্রৌঞ্চমিথুন একটি ব্যাধের তীর নিক্ষেপে আহত হলে আদি কবি বাল্মীকির মনে যে করুনার উদ্বেল হয়েছিল তাই বাণীবদ্ধ আদি কবিতার ছন্দ বদ্ধ শ্লোক রূপে-
"মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ/যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনা দেকমবধীঃ কামমোহিতম্ ।।"
বস্তু বিশ্ব তথা ইন্দ্রিয় বেদ্য জগতের রূপ-রস- শব্দ-ঘ্রাণ-স্পর্শ যখন কবি মনের কল্পনা মাধুরীতে জারিত হয়ে ছন্দবদ্ধ ও শিল্পসম্মত অবয়ব লাভ করে তখন কবিতার জন্ম হয়।

কবিতা কাকে বলে এমন প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দেওয়া অসম্ভব। স্যামুয়েল জনসন কবিতাকে বলেছেন' merical composition'. জন স্টুয়ার্ট মিল জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে কবিতার অন্তঃসার ছুঁতে চেয়েছেন এইভাবে-'what is poetry but the thought and words in which emotion spontaneously embodies itself?' কবিতা বলতে আমরা সেই শিল্পকে বুঝি যেখানে শব্দ এমন ভাবে ব্যবহৃত হয় যাতে পাঠকের কল্পনা লোকে ওই শব্দরাজি একটি চিত্রিত সৌন্দর্যের বিশ্ব উন্মুক্ত করে দিতে পারে, চিত্রকর রং দিয়ে যা করেন কবি করেন শব্দের মাধ্যমে। ওয়ার্ডর্সওয়ার্থ কবিতাকে একটি স্মরণীয় সংজ্ঞা দিয়েছিলেন'poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings'তাঁর কাছে কবি কথালাপি মনুষ্য কণ্ঠ 'a man speaking to men'কোলরিজের কাছে কবিতা' best words in the best order' অগাস্টাইন এর কথায়-'if not asked I know : if you ask me,I know not'

 সংস্কৃত কাব্যতত্ত্ব অলংকার শাস্ত্রে কাব্যের সংজ্ঞা ও লক্ষণ নিয়ে মতান্তর আছে। ভামহ শব্দ ও অর্থের সাহিত্যকেই কাব্য বলেছেন। দন্ডির মতে  ইষ্টার্থব্যবচ্ছিন্ন পদই কাব্য। সাহিত্যদর্পন রচয়িতা  শ্রী বিশ্বনাথ কাব্য কে দেখেছেন 'রসাত্মক বাক্য' রূপে।এসব থেকে বোঝা যায় শব্দ ও অর্থের সংশ্লেষে নির্মিত হয় কাব্য কবিতার স্বরূপ। কুন্তক একে বললেন 'পরস্পর স্পর্ধা' অর্থাৎ কবিতা হচ্ছে এমন রচনা যাতে শব্দ অর্থ ধ্বনি ও ব্যঞ্জনার ঘটে এক সাহসী দ্বান্দ্বিক সংশ্লেষ। এ কারণে কালিদাসের কাছে কবিতা 'অর্ধনারীশ্বর' যার পার্বতী হোল শব্দ আর শিব ব্যঞ্জনা। কবিতার স্বরূপ নির্ণয় রবি ঠাকুরের পংক্তিগুলি রহস্য লোকের চাবিকাঠি-'অন্তর হতে আহরি বচন /আনন্দলোকে করি বিচরণ /গীতরসধারা  করি সিঞ্চন/সংসার ধূলি জালে'
অতীতে আবৃত্তি

আবৃত্তি দেশের দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি। যখন মুদ্রণযন্ত্র ছিল না, ছাপাখানা, বই ছিলনা তখন এই আবৃত্তিশিল্পীরা এই কথকঠাকুররা ই oral tradition এর মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে মহাকাব্য গীতিকাব্য কাহিনী কাব্য পৌঁছে দিয়েছেন।আটচালায়, চণ্ডীমণ্ডপে, মন্দির প্রাঙ্গণে, গ্রামের সভায়, নগরে শতশত মানুষ বসে তাদের কবিতা শুনতেন কথা শুনতেন আর চিত্ত ভরে উঠত মানসিক প্রসাদে।যখন দূরদর্শন, বেতার, টেপ ,মোবাইল কিছু ছিল না -তখনকার দিনে এই বাচিক শিল্পী ছিলেন এঁরাই।মহাকাব্য কাহিনীকাব্য এঁরাই পরিবেশন করতেন আর মানুষ শুনতেন, আলোকিত হতেন। কবিতা যখন উচ্চারিত হয় তখন একটা ধ্বনি তরঙ্গ ওঠে। ধ্বনি তরঙ্গের উচ্চারিত মায়া মাধুর্য আমাদের কানের ভেতর দিয়ে হৃদয় প্রবেশ করে। 'কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো /আকুল করিল মোর প্রাণ'
 স্মৃতি শ্রুতির দেশ ভারতবর্ষ। পূজা পাঠ, বিয়ের মন্ত্র,আজানের উচ্চারণে, কথকতার মধ্য দিয়ে জীবন ও সমাজে বহমান ধারা ক্রমে গভীরে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। পাঁচালি- তরজায় বলার ঢঙে,বাকভঙ্গিতে কতনা বৈচিত্র ধরা আছে। চতুরানন ব্রহ্মাই বেদের প্রথম আবৃত্তিকার। তাইতো বেদের অপর নাম শ্রুতি।গুরু তাঁর শিষ্যদের বিষয়ের ভাবানুযায়ী কণ্ঠস্বরের আশ্চর্য ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলতেন।তাঁদের কন্ঠ ব্যঞ্জনায় বিষয়বস্তু শ্রুতি বাঙ্ময় হয়ে উঠত। মুখে মুখে আবৃত্তির মাধ্যমে মনে রাখতে হোত তাই 'আবৃত্তি সর্বশাস্ত্রানাং বোধদপি গরীয়সী।'
ধীরে ধীরে এসবের যোগ্য উত্তরাধিকারী হয়েছেন আমাদের মা- ঠাকুরমারা। সন্ধ্যার প্রদীপের নিভু নিভু আলোয় তাদের কণ্ঠে ঘুমপাড়ানি ছড়া বা পুজোর আসনে ব্রত কথা পাঠ এসবের মধ্যে আবৃত্তিশিল্পের বীজ লুকিয়ে রয়েছে।
 আর্য যুগের যে চৌষট্টি কলার চর্চা করতে হতো তার মধ্যে দুটি কলার নাম 'সংপাঠ্য' ও 'মানসী কাব্যক্রিয়া'। সংপাঠ্য হোল পাঠ করার উপযুক্ত বিষয়। আধুনিক শিল্পকলায় এই 'সংপাঠ্য'আবৃত্তি নামে পরিচিত।

আবৃত্তি কী কবিতা শিল্পের Extention না স্বতন্ত্র শিল্প?

একটা বহুল প্রচারিত অতি শিক্ষিত ধারণা সকলেরই রয়েছে যে আবৃত্তি বলতে কবি তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে যা বলতে চেয়েছেন সেটাই ঠিক মত বুঝে নিয়ে, কবিতাটা বলার মধ্যে দিয়ে সেই ভাবটাকে ফুটিয়ে তোলাতে হবে। কিন্তু তাই কি সম্ভব? আবৃত্তিকার একজন রক্তমাংসের মানুষ তার নিজস্ব আবেগ, অনুভব ,বোধ, মেধা, মানসিকতা এসব তিনি কোথায় সরিয়ে রাখবেন? তিনিতো রোবট নয়, কলের পুতুল নয়, তিনি একজন শিল্পী।যে শিল্পী তার নিজস্ব অনুভবের প্রকাশ না ঘটিয়ে অন্যের অনুভব প্রকাশের জন্যই শিল্প রচনা করেন, তার কি কোন নিজস্ব সত্ত্বা থাকে?

কথার কথাই বলি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন বিরল মানসিকতার মানুষ। তার তুল্য আভিজাত্য, ব্যক্তিত্ব, ঔদার্য, অনুভব, কল্পনাশক্তি আমার মত কি একজন সাধারন মানুষের সম্ভব? আমরা সচরাচর সাধারণ মেধা প্রতিভার মানুষজন কিভাবে রবীন্দ্রনাথের মানসিকতায়  পৌঁছতে পারবো? তাহলে কি আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করব না?

 একজন আবৃত্তিকার জীবন জগৎ আর পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে সংবেদনশীল।এই সংবেদন তার শিল্পে সঞ্চারিত হওয়া চাই। মনে রাখতে হবে আবৃত্তিকারের হাতে সময় বড় কম। শ্রোতা সমষ্টিকে তিনি একবারই পাবেন খুবই স্বল্প সময়ের জন্য। শিল্পীর করণীয় যা কিছু তা তার কন্ঠস্বর আর বাচনিক দক্ষতায় সেই সময়টুকুর মধ্যে একক প্রচেষ্টায় করতে হবে। কবিদের মতো বা চিত্রকরের মতো লিখে আবার বদল করার এঁকে আবার মুছে ফেলার সুযোগ নেই। এমনকি সংগীত শিল্পীর মতো একই সুর দ্বিতীয়বার প্রক্ষেপণ করে উন্নততর প্রকাশের সুযোগ নেই। মঞ্চে তাঁর প্রতিটি মুহুর্ত-প্রতিটি প্রক্ষেপণ অব্যর্থ ও অমোঘ না হলে তার সাফল্য আসে না।

তাই আবৃত্তি কবিতা শিল্পের extention নয়।আবৃত্তি একটি নিজস্ব স্বতন্ত্র শিল্প।
(ক্রমশ...)
জ্বলদর্চি পেজ-এ লাইক দিন।👇


আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments