জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা- ৪/ শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-৪

শুভদীপ বসু
 
উচ্চারণ কিছু কথা: দ্বিতীয় অধ্যায়

'শ','স','ষ'-বর্ণের উচ্চারণ:

বাংলায় তিনটে 'শ' রয়েছে একটি তালব্য একটি দন্ত ও অন্যটি মূর্ধন্য। সংস্কৃত বর্ণমালায় এই তিনটে ছিল।

তালব্য-শ=এটি উচ্চারণ করা হয় জিভের আগের ফলা অংশটা তালু(palate) বা অগ্রতালু (pre-palate)সঙ্গে আলতো ভাবে ঠেকিয়ে।এরমধ্যে থেকে যে বাতাস জোরে বেরোয় শ্- শ্ আওয়াজ হয়। এর ইংরেজি নামPalatalবা pre-palatal। ইংরেজিতে 'Sh'দিয়ে এর উচ্চারণ বোঝানো যায়।
দন্ত্য-স =এর নাম দন্ত্য হলেও দাঁতের সাথে এর উচ্চারণের সম্পর্ক সেরকম নেই। সংস্কৃতে এর উচ্চারণ ছিল ইংরেজি 'S' এর উচ্চারণের মত। জীবের ফলার আগের অংশটা উপরের দাঁতের পেছনে ঢিবির মত যে অংশ রয়েছে যাকে আমরা দন্তমূল বলি ইংরেজিতে alveolum বলে, সেখানে চেপে ধরে। যখন তার মাঝখান দিয়ে বাতাস জোরে বের হতে থাকে তখন ওই স্ -স্ আওয়াজ হয়।বাংলায় মেদিনীপুর ও পুরুলিয়া জেলায় আঞ্চলিক ভাষায় এই স এর প্রাদুর্ভাব রয়েছে।

মূর্ধন্য-ষ=অগ্র তালুর একটু পেছনে মুখের ছাদটা যেখানে সবচেয়ে বেশি গর্ত সেখানেই মূর্ধা আর এখানেই মূর্ধন্য-ষ এর উচ্চারণ স্থান। এখানেই জিভ উল্টে গিয়ে চেপে ধরে আর তার ভেতর দিয়ে বাতাস শোঁ শোঁ করে বেরোয়। জিভের উল্টে যাওয়া থেকে এর নাম retroflex's'

মৌখিক বাংলায় শ,স, ষ এর উচ্চারণ
১।শ্-জাতীয় ধ্বনির পর কেবল ট,ঠ ধ্বনি এলে আমরা মূর্ধন্য-ষ উচ্চারণ করতে বাধ্য হই‌। যেমন- মিষ্টি , আঁশটে, হাঁসটা।
২। যুক্ত ব্যঞ্জন এর প্রথমে ত,থ,ন,র,ল এর সাথে যুক্ত হয়ে 'শ'-'স' মতো উচ্চারণ হয়। যেমন স্তব,স্তুতি, শ্রবণ, স্রোত।
৩। ক,খ,প,ফ,ম এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রথমে স্ থাকলে কেবল শব্দের গোড়ায় স্ উচ্চারণ হয়।শব্দের গোড়ায় না থাকলে শ্
উচ্চারণ হয়। যেমন স্পন্দ স্পৃহা স্ফূর্তি কিন্তু পুরস্কার, আস্ফালন শুচিস্মিতা।
৪।আর সর্বত্র বাংলায় শুধু 'শ'।এই 'শ'-ই বাংলার মৌলিক শিস্-ধ্বনি বা ফোনিম। নানা প্রতিবেশে তার নানা রূপভেদ-'ষ''স'।

প্রসঙ্গ 'র'ও'ড়'এর উচ্চারণ:

র-এর উচ্চারণ=এর উচ্চারণ স্থান দন্তমূল।বাধার প্রকৃতি হল রোণিত। কম্পন বা রণন ব্যাপারটি বোঝানোর জন্য প্রলম্বিত র্ র্ র্ উচ্চারণ করে দেখানো যেতে পারে পরে প্রলম্বিত উচ্চারণটি কমিয়ে একমাত্রিক র-তে দাঁড়িয়ে এই বর্ণের উচ্চারণ ক্রিয়া জানা যায়।

'ড়'এর উচ্চারণ=স্থান হল মূর্ধা।বাধার প্রকৃতি হল জিহ্বার প্রতিবেষ্টিত অবস্থায় তাড়না। শিক্ষার্থীকে জিহ্বার আগের অংশ টিকে  মূর্ধায়রেখে' ড'উচ্চারণ করতে বলা হলে, সে স্পৃষ্ট ধ্বনি উচ্চারণ স্থান বুঝতে পারবে ও পরবর্তী সময়'ড' থেকে ধীরে ধীরে'ড়' উচ্চারণ করতে পারবে।

এক্ষেত্রে সুকুমার রায়ের খাই খাই কাব্যগ্রন্থের দাঁড়ের কবিতাটি শিক্ষার্থী অভ্যাস করলে 'র'ও'ড়'এর উচ্চারণ ঠিক হতে পারে।
ম,ল,হ,ব,ক্ষ,র,ঞ-৭ জীবনের বিশেষ উচ্চারণ:
ম এর উচ্চারণ=
১) যখন অন্য বর্ণের সঙ্গে মিলে ম ফলা হয় তখন শব্দের প্রথমে অনুচ্চারিত থাকে যেমন শ্মশান(শশান)
২) যখন মাঝে বা শেষে থাকে তখন যে যে বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয় তার দ্বিত্ব হয়। যেমন লক্ষ্মী(লোখ্খী)
৩) কোথাও কোথাও একটি আনুনাসিক ধ্বনি থাকে। যেমন মহাত্মা (মহাত্তাঁ)
ল- এর উচ্চারণ=
১) ল কার যুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ দ্বিত্ব হয়।যেমন-বিপ্লব (বিপ্ প্লব)
হ এর উচ্চারণ=
১) য- ফলার সঙ্গে যুক্ত হলে 'জঝ' মতো উচ্চারিত হয়।বাহ্য(বাজ্ ঝো)
ব এর উচ্চারণ=
১) কোন ব্যঞ্জন বর্ণের পরে বসে সংযুক্ত ব্যঞ্জন বর্ণ গঠন করলে উচ্চারণ হয় না,শুধু আগের ব্যঞ্জনবর্ণের দিত্ব হয়।অন্বয়(অন্নয়)
২) প্রথম অক্ষরে থাকলে উচ্চারণ হয় না। দ্বিত্ব(দিত্ তো)
৩) হ ধ্বনি প্রভাবে পরবর্তী ব মহাপ্রানিত হয়ে 'ভ'এরউচ্চারণ হয়। জিহ্বা (জিউভা), আহ্বান (আওভান)
ক্ষ-এর উচ্চারণ=
১) শব্দের মধ্যে বা শেষে  থাকলে 'খ' বা'কখ' এর মত উচ্চারণ হয়।লক্ষ(লোক্ খো)
২) শব্দের প্রথমে থাকলে খ-এর মতো উচ্চারণ হয়।ক্ষণিক(খোনিক)।
র এর উচ্চারণ=
১) র ফলা যোগে সংযুক্ত উচ্চারণ দ্বিত্ব হয়। নম্র (নম্ ম্র)
ঞ এর উচ্চারণ=
১) এর উচ্চারণ এখন 'ন' এর মত। অঞ্জন (অনজন)।
২) অন্যত্র 'য়ঁ' মত।মিঞা(মিয়াঁ)।

 উচ্চারণে ত্রুটি:
১) শব্দের ভুল উচ্চারণ।
২) কথা খেয়ে ফেলা বা বাদ পড়ে যাওয়া।
৩) হ্রস্ব স্বর বা দীর্ঘস্বর এর উচ্চারণের পার্থক্য না করা।
৪) তিনটি স এর উচ্চারণ।
৫) র, ড় এর উচ্চারণ।
৬) নাসিক্য বর্ণের উচ্চারণ।
৭) র-ফলা, রেফ,
ঋ-কার উচ্চারণ না হওয়া।
৮) অ,ও এর সঠিক উচ্চারণ।
৯) অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন উচ্চারণ।
১০) চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলার অভ্যাস।
১১) অতি দ্রুত উচ্চারণ।
১২) বিশেষ কয়েকটি যুক্তাক্ষর উচ্চারণে অক্ষমতা।
কেন এই ত্রুটি
১) অসাবধানতা অমনোযোগ ও অবহেলা।
২) জিভের জড়তা জিভও ঠোঁটের অসতর্ক ব্যবহার।
৩) নকল দাঁত অথবা মুখের হাঁ অস্বাভাবিক ছোট হওয়া।
৪) দ্রুতগতিতে কথা বলা।
৫) অভিধানের সাথে যোগ না থাকা।
৬)ভুল শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ,গলা ও চোয়ালের মাংসপেশির কাঠিন্য।
৭) পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডল।

কিছু Tongue Twister যা অভ্যাস করলে সঠিক উচ্চারণে সুবিধা হবে:
১) লালুর লড়াই রাবড়ি লড়েন।
২) বালির লরি লরির বালি।
৩) পাপিয়া পাখি পাকা পেঁপে খায়।
৪) বড় বাড় বেড়েছো, আর বেড়না।
৫) গড়ের মাঠে গরুর গাড়ি গড়গড়িয়ে যায়।
৬) কে কোনে কাঁটা পোঁতে, কানা কোনে কাঁটা পোঁতে।
৭) তেলে চুল তাজা,জলে চুন তাজা।
৮) বারো হাঁড়ি রাবড়ি বড় বাড়াবাড়ি।
৯) মাসি মারে মশা,মেসো মারে মাছি।
১০) টাকে কাক, তাকে কাপ।
১১) বাবলা গাছে বাঘ বসেছে।
১২) সুঁচে সুতো ছাতে ছুঁচো।
১৩) কাঁচা গাব পাকা গাব।
১৪) লিনা নিল নিলা লিলা নিল না।
১৫)শ্যাম বাজারের শশী বাবু সকাল বেলায় সাইকেলে চড়ে শসা খেতে খেতে স্বশরীরে স্বর্গে গেলেন।
১৬) পাখি কাঁদে ফাঁদে পাপীকাঁদে ফাঁকে।
১৭) দুর্যোধন জর্দা খেয়ে দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়।
১৮) কাকেরা কা-কা করিয়া কাকে কাকা কইছে?
১৯) রণে রানি লড়ে ,লনে নারী নড়ে।
২০) পাতে পটল পড়লেও পড়তে পারে।
২১) বাঘার বাড়ি বাবার গাড়ি।
২২) মালির মাথায় মালার ডালা মার হাতে মালির মালা।
২৩) মিতা আটা হাতে আতা কাটে।
২৪) The sixth sick Sheikh's sixth sheep's sick.
২৫)She sells seashells on the seashore.The shells she sells are seashells,I am sure.

(ক্রমশ...)
জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. আজকের পর্বটিও দুর্দান্ত। বিশেষ করে যারা নতুন তাদের এই পর্বটি খুব ভালো অনুশীলন করলে উপকার হবেই হবে। শুধু পড়লে হবে না নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে।

    ReplyDelete