জ্বলদর্চি

ইউরােপ (অস্ট্রিয়)- র লোকগল্প /চিন্ময় দাশ

Folklore of Europe (Austria) / Chinmoy Das
দূর দেশের লােকগল্প- ইউরােপ (অস্ট্রিয়)

চিন্ময় দাশ

বুড়াে মানুষের ঝােলা

এক গ্রামে বাস করত দুই ভাই। বড়টি যেমন চালাক চতুর, ছােটটি তেমনি সাদা মনের মানুষ। একদিন বড় বলল-- “কত বড়াে এই দুনিয়া। কত গ্রাম, কত শহর, কত মানুষ আছে দুনিয়া জুড়ে। কিছুই তাে দেখলাম না। কী সুখেই বা ঘরে বন্দী হয়ে আছি। চল ভাই, বেরিয়ে পড়ি।”

যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। দেশ দেখে বেড়াবে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল দু'জনে। কিছু খাবার-দাবার ছিল ঘরে। তাই পুঁটলি বেঁধে নিল সাথে।

চলতে চলতে একদিন এক নদীর কাছে এসে হাজির। পাড় ধরে চলেছে, এক বুড়ামানুষের সাথে তাদের দেখা। একমুখ দাড়ি লােকটার। একেবারে বুক পর্যন্ত ঝুলে পড়া। সাদা ধবধবে। দাড়ির আড়ালে মুখটাকে দেখা যায়, কি যায় না। যতটা দেখা যায়, অসংখ্য ভাঁজের আঁকিবুকি কাটা। ছিরিছাঁদ নাই পরণের কাপড়-চোপড়েরও। দু'-একটা তাপ্পিও চোখে পড়ে। একেবারে উলুঝুলু পোশাক।

লােকটার কাধে একটা ভারি ঝােলা। দেখলেই মনে হয়, একেবারে ধুঁকতে ধুঁকতে পথ চলেছে বেচারা। ছেলে দুটোকে দেখে, দাঁড়িয়ে পড়ল বুড়ােটি-- "কোথা থেকে আসছ গাে, বাছারা ?"

বুড়ােটিকে দেখে মােটেই ভাল লাগেনি বড়ছেলেটির। লাগবার কথাও নয়। সে শুকনাে মুখ করে বলল-- “সে অনেক দূরের গ্রাম থেকে। তুমি চিনবে না।"
"তা, যাবে কোথায় ? সে আবার কতদূরের পথ ?
বড়ই জবাব দিল-- “সে আমরাও জানি না। আসলে সুখের খোঁজে বেরিয়েছি দুভাই। যেখানে খোঁজ পাবাে, সেখানেই চলা শেষ।"

বুড়াে বলল-- "বাঃ  বাহ্, খুব ভালো কথা। তা বলছিলাম কী, সামান্য খাবার হবে তােমাদের কাছে? অনেক দিন পেটে কিছু পড়েনি।" 
"আমাদেরই বলে খাবারে টান পড়েছে, মাত্র একবেলার মত খাবার আছে আর।" ছেলেটি বলে উঠল-- "ঝামেলা বাড়িও না তো। নিজের কাজে যাও।" 

ছােটছেলেটি তাে ভালাে মানুষ। তার ভারি দয়া হল বুড়াের কথায়। সে বলল--“দাঁড়াও। চলে যেও না।”
মাত্র একবারের মত খাবারই আছে তাদের পুঁটলিতে। তাই খুলে অর্ধেকটা খাবার বুড়ােকে দিয়ে দিল সে। বড়ভাইকে বলল-- “ভেবাে না কিছু। আমার ভাগটাই দিলাম একে। "
চেটেপুটে খাওয়া শেষ করে, নদীতে নেমে দু’ আঁজলা জল খেল বুড়াে। উঠে এসে দাঁড়াল দুজনের সামনে। বলল-- "সুখের খোঁজে চলেছ তােমরা। আমি কি তােমাদের সাহায্য করতে পারি ?"
দুজনেই জানতে চাইল--“কীভাবে সাহায্য করবে আমাদের ?”
আলখাল্লার ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে, এক মুঠো মােহর বের করল বুড়াে-- "তােমাদের ভিতর কে নিতে চাও এগুলাে ?"
বড়ভাই তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে দিল-- “আমি নেব, আমি নেব।" কথা শেষ না করেই, মােহরগুলাে তুলে নিল সে।
এবার বাম পকেট থেকে একটা মুক্তো বের করল বুড়ােটা। সূর্যের মত ঝলমল করে উঠলাে মুক্তোটা, এমন তার ছটা। বুড়াে বলল-- "এটা কে নিতে চাও?" এবারও বড়ভাইটাই তাড়াহুড়াে করে বলে উঠল-- "আমি চাই, আমি।” 
মুচকি হাসি বুড়াের মুখে। বড়র হাতেই মুক্তোটা তুলে দিল সে। বলল-- “চলি গো, বাছারা। আর খানিকটা গেলেই আমার গ্রাম। এই নদীটার বাঁকের মুখে, ওপারে। তা, আমার এই ঝােলাটা একটু বয়ে দেবে তােমরা ? আর পারছি না।" 
বড় ছেলেটি কোন জবাবই দিল না। যেন শােনেইনি কিছু। সে তখন বাড়ি ফিরে যাওয়ার পথ ধরতে ব্যস্ত। দুনিয়া দেখা নেমে গিয়েছে তার মাথা থেকে। 
ছােটছেলেটি এগিয়ে এসে বলল-- "আমাকে দাও। আমি নিয়ে যাচ্ছি তােমার ঝােলা।"
বড়ভাই ভারি বিরক্ত একথা শুনে। বলল-- "আমি কিন্তু দাঁড়াব না তােমার জন্য। বাড়ি ফিরে যাব।" 
কোন হেলদোল নাই ছােটর। সে বলল-- "ঠিক আছে, তাই যাও।" ঝােলাটা তুলে নিয়ে বুড়ােকে বলল-- “চলগাে, ভালমানুষ। আর দেরি কেন?”
"কে ভালােমানুষ, তার বিচার করবার আমরা কে?” আবারও মুচকি হাসি ফুটে উঠল বুড়াের মুখ জুড়ে-- “হ্যাঁ বাছা, চলাে।”

বুড়াে সামনে। পেছনে চলেছে ছােটভাইটি। ঝােলাটা নেহাৎ কম ভারি নয়। তবে সে নিয়ে কিছু ভাবছে না সে। হাসিমুখেই চলেছে বুড়াের সাথে। মাঝে মাঝে এটা ওটা নিয়ে কথা বলছে বুড়াে। সেও ছােটখাটো জবাব দিয়ে হেঁটে চলেছে পেছন পেছন।
বেশ কিছুটা গিয়ে নদীর বাঁকের মুখে এসে হাজির হল দু'জনে। ছােট নদী। তার উপর একটা নড়বড়ে সাঁকো। সাঁকোর মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল বুড়ােটি। বলল-- "বিদায়, বন্ধু! অনেক ধন্যবাদ। ঐ ওপারেই আমার ডেরা। আর আসতে হবে না তােমাকে। তুমি ফিরে যাও। তােমার উপকার কোনদিন ভুলবনা আমি।
উত্তর না দিয়ে, ছােট তাকিয়ে আছে নড়বড়ে সাঁকোটার দিকে। এই তাে শরীর মানুষটার। তার উপর আবার এই থলে। পার হবে কী করে? পড়ে-টড়ে যায় যদি!
ছােট বলল-- "তুমি পার হতে পারবে না ঝােলা নিয়ে। চলাে, তােমাকে ওপারে রেখে আসি।” 
আবার হাসি খেলে গেল বুড়োর মুখে। বলল-- “ঝােলা সহ আমাকে সাঁকো পার করাতে তােমারও অসুবিধা হবে। এক কাজ করাে বরং। ঝােলাটা এখানে রাখাে। আগে অমাকে পার করে দাও। ঝােলার কথা পরে ভাবা যাবে তখন।"
সাঁকোর গোড়ায় ঝোলা রেখে, সাবধানে হাত ধরে ধরে বুড়ােকে নদীর ওপারে নিয়ে গেল ছােট। বলল-- "একটু দাঁড়াও। আমি গিয়ে ঝােলা এনে দিচ্ছি তােমার।" 
বুড়াের মুখে সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ল আবারও-- "আর মেহনত করতে হবে না তােমাকে। কী এমন আছে আমার ঐ ঝােলায়। ওটা তুমিই রেখে দাও, বাছা। ওটা তােমার।" 
ছেলেটা অবাক হয়ে হাঁ-হাঁ করে উঠল-- "না, না। সে কী কথা? তােমার ঝােলা আমি নেব কেন ?"
-- "আমার তাে দুনিয়া থেকেই যাবার সময় হয়ে এল, বাছা। ঐসব নিয়ে আমি কীই বা করব? কী কাজে লাগবে আমার ? সামনে লম্বা জীবন পড়ে আছে তােমার। রেখে দাও, সুখেই থাকবে।" 
ছােট আবারও বলল-- "না, না। তা হয় না। একটু দাঁড়াও। আমি এখুনি এনে দিচ্ছি ঝােলাটা।”
আর কথা বলতে দিল না বুড়োকে। সাঁকো পার হয়ে এল চটপট। ঝােলা তুলে, ভারি কৌতুহল হল। এক নজর ভিতরে তাকিয়েই, চোখ কপালে উঠে গেল ছেলেটার। হতভম্ব হয়ে গেল একেবারে। দামি দামি মণি-মুক্তো, হীরে-জহরতে ঠাসা ভর্তি ঝােলাটা। আরে, এ কেমন মানুষ ? এত সব দিয়ে দিতে চাইছিল তাকে? কত রকমের মানুষই না আছে এই দুনিয়ায়! আর কার ঝােলায় যে কী থাকে!

ঝােলাটা তুলে, সাঁকোয় উঠতে গেল ছেলেটা। কিন্তু কোথায় সাঁকো। আস্ত সাঁকোটাই গায়েব হয়ে গেছে বেমালুম। তিরতির করে নদী বইছে আপন মনে। আর, বুড়ােটাই বা কোথায় ? নদীর ওপারে যতদূর চোখ যায়, কোথাও দেখা গেল না তাকে। চিহ্নটুকুও নাই মানুষটার।

এত সম্পদ পেয়েছে, সেটা মাথায় নাই ছেলেটার। ভয়াণক অবাক হয়ে সে ভাবতে লাগল, সাদা দাড়ির আড়ালে, বুড়ােটা আসলে কে? এই বিপুল সম্পদ তাকেই বা দিয়ে গেল কেন মানুষটা ? 
অনেক ভেবেও, উত্তর আসছে না ছেলেটার মাথায়।
পাঠকদের কারও জানা আছে এর উত্তর ?

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 


Post a Comment

0 Comments