জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে /তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব /৩১তম পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে              
তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব      
৩১তম পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী      


যাদবগন শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে কুশস্থলীতে এসে বসবাস করতে শুরু করলেন। সৌরাষ্ট্রের সমুদ্র উপকূলবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে যাদবরা বসতি স্থাপন করলেন এবং তাদের এই বসতি এলাকা পোরবন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত হল। এই অঞ্চলগুলি সমষ্টিগতভাবে মূল দ্বারকা নামে পরিচিত। এর আয়তন ত্রিশ যোজন। কংস বধের পরে মথুরার বাতাবরণে যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল এবার বুঝি তার অবসান ঘটে গেল। বেশিরভাগ যাদব ইতিমধ্যে নতুন উপনিবেশ দ্বারাবতীতে চলে এসেছেন। দীর্ঘ পাঁচ বৎসর ধরে শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরাম মথুরা থেকে আগত যাদবদের নিয়ে দ্বারাবতী নগরীকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তুলেছেন।অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করে এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন তাঁরা। সমুদ্রবেষ্টিত নগরীতে একাধিক বসতি স্থাপিত হয়েছে। যাদব বণিকদের চেষ্টায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন করায়ত্ত শুরু হয়েছে। রৈবতকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য দুর্গ নির্মাণ সমাপ্ত করেছেন শ্রীকৃষ্ণ। নারায়ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা করে এক বিরাট নারায়নী সৈন্যদল গঠন করেছেন শ্রীকৃষ্ণ। এই সৈন্যরা বৃন্দাবন থেকে আগত আভীর গোপ সম্প্রদায়ের যুবক। তৈরী হয়েছে একাধিক অতিথি শালা। বহিরাগতদের জন্য স্থাপিত হয়েছে অনুমতিপত্রের কেন্দ্র। ইন্দ্রের দেবসভা তুল্য একটি সভাগৃহ নির্মাণ করা হয়েছে। উগ্রসেনকে যাদব প্রধান হিসেবে বরণ করা হয়েছে। যদুবংশের আটটি শাখা থেকে দশজন প্রবীণ যাদব প্রধানকে নিয়ে মন্ত্রীমণ্ডলী গঠিত হয়েছে। এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে সুশাসন ঢেলে সাজিয়ে দিয়েছেন। দ্বারাবতী নগরীতে নাগরিকদের মধ্যে জাতিভেদের কোন কঠোরতা ছিল না। নগর পত্তনের আগে যেসব অনার্যেরা সেখানে বসবাস করতেন তাদেরও সাদরে বরণ করা হলো। শ্রীকৃষ্ণ দ্বারাবতীর জনগণকে কর্মের ভিত্তিতে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন। যারা যজন-যাজন কাজে ব্যাপৃত থাকতেন তারা হলেন ব্রাহ্মণ। রাজ রক্ষীর কাজে যারা ছিলেন বা সৈন্যদলে যারা রাজ্যরক্ষার কাজে নিযুক্ত ছিলেন তারা হলেন ক্ষত্রিয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এক শ্রেণীর সৃষ্টি হল তারা হলেন বৈশ্য। সমাজের সকল শ্রেণীর লোকেদের যারা সেবা করবেন তারা হলেন শূদ্র। এইভাবেই শ্রীকৃষ্ণ সমাজ বিবর্তনের ধারাটিকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তুললেন। দ্বারাবতীর নাগরিকেরা কিছুদিনের মধ্যেই মথুরা ত্যাগের দুঃখ ভুলে গেলেন। দ্বারাবতীর সমস্ত মানুষ দৈহিক মানসিক এবং রাজনৈতিক নিরাপত্তা লাভ করলেন। শ্রীকৃষ্ণ নিজে অমিত শক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কোন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেন না। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে শ্রীকৃষ্ণ গণতান্ত্রিক বিচার ব্যবস্থার প্রতি কতখানি আস্থাশীল ছিলেন।

🍂

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের নিজের পরিবার বৃদ্ধি পেল। ফলে বসবাসের জন্য আরো জায়গার প্রয়োজন হয়। শ্রীকৃষ্ণ তখন সমুদ্র দেবতার কাছ থেকে বারো যোজন জায়গা প্রার্থনা করলেন। সমুদ্র দেবতা অত্যন্ত খুশী মনে শ্রীকৃষ্ণের অনুরোধ রক্ষা করলেন। সমুদ্রতটে সেই জমির উপর স্বয়ং বিশ্বকর্মা একটি সুরম্য নগরী নির্মাণ করে দিলেন। বিষ্ণুপুরাণে এই ঘটনার উল্লেখ হয়েছে এইভাবে " ইতি সচ্চিত্য গোবিন্দো, যোজনানাং মহোদধিম্/ যযাচে দ্বাদশপুরীং দ্বারকাং তত্র নির্মমে"। এছাড়াও শ্রী মদ্ভাগবত পুরানের মতে " ইতি সন্মন্যয় ভগবান্ দুর্গং দ্বাদশ যোজনম্/ অন্তঃ সমুদ্রে নগরং কৃতস্নাদ্বুতমচীকরত্"। এভাবেই বিভিন্ন পুরানে দ্বারকা নগরী নির্মাণের প্রসঙ্গ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের উদ্যোগে দ্বারকা নগরী নির্মিত হবার পরে এই স্থান তাঁর গতিবিধির প্রধান কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। এখান থেকেই অনেক মহত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদন করেন তিনি। কখনোবা কোন বিশেষ কাজে দ্বারকা ছেড়ে স্থানান্তরেও গেছেন। এখান থেকেই রুক্মিণী হরণ তথা বিবাহ, স্যামন্তক মনি সম্বন্ধীয় ঘটনাবলী, জাম্ববতী, রোহিনী, সত্যভামা, কালিন্দী, মিত্রবিন্দা, সত্যা, সুশীলা এবং লক্ষ্মনার সহিত বিবাহ হয়েছিল। এখান থেকেই প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা নরকাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করে তাকে বধ করে তার কাছে আটক ১৬ হাজার নারীকে মুক্ত করে তাদের পানিগ্রহণ করেছিলেন। এখান থেকেই সত্যভামার জন্য পারিজাত হরণ পর্ব, বাণাসুর বিজয়, উষা অনিরুদ্ধের বিবাহ, দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা, শিশুপাল বধ, মহাভারতের যুদ্ধে অংশগ্রহণ, যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ উপলক্ষে হস্তিনাপুর গমন প্রভৃতি জীবনের মুখ্য ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মগুলি তিনি সম্পাদন করেছিলেন।

বৃন্দাবন থেকে আসার সময় শ্রীকৃষ্ণ তাঁর হাতের মোহনমুরলী বাঁশী ছেড়েছিলেন। মথুরায় এসে দন্ড হাতে তুলে নিয়েছিলেন কিন্তু তিনি রাজা হননি। রাজা করেছিলেন উগ্রসেনকে। মথুরা থেকে যখন সকলে দ্বারকাতে চলে এলেন সেখানেও গোষ্ঠীর বয়োবৃদ্ধ হিসাবে উগ্রসেনকেই রাজসিংহাসনে অভিষিক্ত করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের চিন্তাধারা ছিল অনন্য, ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা যেন তিনি আগের থেকে জানতে পারতেন। রাজাকে সাহায্য করার জন্য তিনি একটি গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন এবং যাদবগনের মধ্যে যারা শৌর্যেবীর্যে অগ্রণী ছিলেন তাঁদের নিয়ে তিনি একটি গোষ্ঠী তৈরী করে দিয়েছিলেন। তাঁরাই শাসনব্যবস্থার প্রতিটি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে আলোচনা করে রাজাকে তাদের মতামত ব্যক্ত করতেন এবং রাজা সেই ভাবে রাজ্য শাসন করতেন। এই গোষ্ঠীর প্রত্যেক সদস্যই সমান ক্ষমতা সম্পন্ন ছিলেন। কিন্তু যতই গোষ্ঠী তৈরি করে দিন না কেন শ্রীকৃষ্ণ যাদবগনের মধ্যে বুদ্ধি ও বীরত্বে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। অলিখিতভাবে সকলেই তাঁকে নেতা বলে মানতেন এবং তাঁর জনপ্রিয়তা কোন মাপকাঠিতেই বিচার করা যায় না। শ্রীকৃষ্ণের অগ্রজ বলরাম এবং কৃতবর্মা ছাড়াও অন্য বয়োজ্যেষ্ঠ যাদবেরা কৃষ্ণের পরামর্শ মেনে চলতেন। শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত যাদবদের মঙ্গল কামনা করতেন। অনেক রাজ্য জয় করে প্রভূত ধন সম্পত্তি হস্তগত করেছিলেন কিন্তু এই ধনসম্পত্তি তিনি একা ভোগ করেননি। সকলের মধ্যে বন্টন করে দিতেন যার ফলে তাঁকে সকলেই ভীষণ ভালবাসতেন। কিন্তু ভালোবাসলেও স্বার্থের দিক দিয়ে যাদবরা অত্যন্ত নিম্নরুচির পরিচয় দিতেন যার ফলে কৃষ্ণের মতো অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব তাঁর জ্ঞাতিবর্গের আচরণে অত্যন্ত দুঃখ পেতেন। দেবর্ষি নারদের কাছে কৃষ্ণ তাঁর এই মনোবেদনার কথা বলেছিলেন। নারদের কাছ থেকে ভীষ্ম সেই কথা জানতে পেরেছিলেন এবং যুধিষ্ঠিরের কাছে ব্যক্ত করেছিলেন। মহাভারতের শান্তিপর্বে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন "জ্ঞাতিদিগকে ঐশ্বর্যের অর্ধাংশ প্রদান ও তাহাদিগের কটু বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহাদিগের দাসের ন্যায় অবস্থান করিতেছি"। এই প্রসঙ্গে স্যামন্তক মণির ঘটনাটি উল্লেখ করা  প্রয়োজন বলে উল্লেখ করছি।                       
                                             পরবর্তী অংশ ৩২তম পর্বে...............

Post a Comment

0 Comments