অবসাদ
গৌতম বাড়ই
চশমার ফ্রেমটা খুলে কাঁচটা মুছলেন শাড়ীর আঁচলের খুঁট দিয়ে।অলোকার আজকাল সারাদিন কেটে যায়,পুরোনো দিনের স্মৃতি চারণা করতে করতে।বাবার মৃত্যুর পরে গোটা বাড়িটাই এখন জনশূন্য প্রায়।একটা জন মানবহীন ঘর সারাদিন গিলে গিলে খায় অলোকাদেবীকে। শুধুমাত্র একজন আছেন যিনি সমস্ত কিছু এই সংসারের ভার নিয়ে সব দেখভাল করে, এমন কী এই দোতলা বাড়িটারও প্রত্যেকটা কুঠরীর। অলোকার কাছে বসে দুদন্ড কথা বলবার সে সময় আজকাল পান না।তিনি পান্না,আজ প্রায় দশ বছর হলো সেই শান্তিপুর থেকে স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে এখানে এসে উঠেছিলেন এক শীতের রাতে ,আজ এই বাড়ির সবচেয়ে অপরিহার্য হলো পান্না।বালীগন্জের এই মুখার্জী বাড়িটার শেষের অস্তিত্বটুকু টিকে আছে তার ওপর ভর করে।রাত নটার পর পান্নার সাথে মামুলী দুচারটে কথা হবার পর অলোকা শুয়ে পড়েন,রাতের ঘুমের জন্য।এটা প্রায় অভ্যেস করে ফেলেছেন।আজ দশটা বাজে এখনো শোননি।পান্না এসে জিগ্গেস করে,ও দিদি তুমি ঘুমাও নি কেন?শরীর খারাপ?
পান্না তোর কাজ সারা হয়ে গেছে?পান্না বলে,হাঁ,দিদি।
তাহলে তুই বোস এখানে।
মা তো সেই কবেই মারা গিয়েছিলেন।তখন অলোকার বয়স কতো! এগারো বছর।বাবা অলোকার জন্য আর বিয়ে করেননি।অতো ছোট্টো মেয়েটার কি হবে ভেবে।অথচ ভীষণভাবে দরকার ছিলো।অলোকা তাই মনে করে।ঐ বয়সে মেয়েদের অনেক অসুবিধে থাকে,অনেক মনের কথা থাকে,আরও অনেক অনেক চাপা কষ্ট থাকে যা মা ছাড়া আর কাউকে বলা যায় না।হতো সৎ মা তো কি হয়েছে?অলোকা ঐ মাকে ঠিক আপন করে নিতো।নিজের বন্ধু বানিয়ে নিতো।মায়ের অনন্তকালের এই বিষাদমাখা স্মৃতি নিয়ে চলতে হতো না।যে কারণে বাবার এই ত্যাগের জন্য নিজেও বিয়ে করে বাড়ির বাইরে যেতে পারেনি।তখনকার বাবারা মেয়েদের বুকের ভেতরের কষ্টটা এতোটা বুঝতো না। এখনকার মেয়েরা যেমন ছেলেদের বুকের ভেতরের কষ্টটা বোঝে না।সব চাওয়া পাওয়া অলোকার মনের,শরীরের ,এই বালিগঞ্জের ঘরের দেওয়ালে আঠা হয়ে লেগে আছে,যা ক্রমশঃ শুকিয়ে আসছে মনে হয়।
পান্না তুই সত্যি কথা বলতো এই জীবনটা একলা একলা টেনে নিয়ে যেতে পারবি শেষ পর্যন্ত?
-----ও দিদি এ তুমি কি বলছো গো?কেন পারবো না।তুমি আমি মিলে ঠিক চালিয়ে নেবো।
পান্না আমি তোর থেকে অনেকটা বড়,আমি তোকে ছেড়ে অনেকটা দিন আগেই চলে যাবো।তখন?
-------এ দিদি,রাম রাম,ও রকম কথা মুখে এনো না গো,মুখে এনো না।
তুই মাঝে মধ্যে হঠাৎ করে কারো কাছে তো যাস। কিছু সময়ের জন্য।সে যদি ভালো লোক হয় তো একদিন নিয়ে আসিস।আমি দেখবো তাকে।তোরা দুজনে বিয়ে করে আমার এখানেই থাকবি। এখন যেমন হচ্ছে বৃদ্ধ- বৃদ্ধাদের খুন করে ফেলা,তা করিস না যেন!
-----ছি ছি দিদি। তুমি না থাকলে কবেই আমি রেললাইনে গলা দিতাম,শেয়াল কুকুরে খেতো।নাহলে বেশ্যা হতাম গো,বেশ্যা।পথের ভিখিরিনী হতাম হয়তো বা। তুমি একথা বোলো না গো দিদি।
তোদের দুটো বিবাহিত জীবনের মাঝে একটি অবিবাহিত দীর্ঘ জীবন বেঁচে থাকবার জন্য সাঁতার কেটে যাবে,না হয় কিছুদিন,কিছু বছর।
আরও পড়ুন।
আজকের দিন।
0 Comments