জ্বলদর্চি

ব্রহ্মদৈত্য’ : হ্যালোইনের হুজুগে গা ছমছমে বাঙালি ভূতের গপ্পো /রাকেশ সিংহ দেব

'ব্রহ্মদৈত্য’ : হ্যালোইনের হুজুগে গা ছমছমে বাঙালী ভূতের গপ্পো

পরিচালক- অভিরূপ ঘোষ
অভিনয়ে- সায়নী ঘোষ, রুদ্রনীল ঘোষ, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, সৌরভ সাহা, সৌমন বোস। 
মুক্তি – ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০, হইচই। 
রেটিং – 3/5 

আগে বাঙালীর শৈশব কাটত ঠাকুমা-দিদিমাদের থেকে পিশাচ, ব্রহ্মদৈত্য, মামদো, শাঁকচুন্নির গল্প শুনে। কিন্তু এখন যুগ  বদলেছে। বাঙালীর জীবন থেকে ক্রমশ ছিন্ন হয়েছে তার নস্টালজিয়ার যোগসূত্রগুলি। বিশ্বায়নের দাপটে বাঙালী মনন থেকে দ্রুত লুপ্ত হচ্ছে মামাদো, শাঁকচুন্নি, পেতনী, স্কন্ধকাটা, মেছোভূত, ব্রহ্মদৈত্য এর মতো নিপাট বঙ্গ ভূতেরা। তাদের জায়গা দখল করছে ড্রাকুলা, ভ্যাম্পায়ারের মতো পাশ্চাত্যের ভূত! ‘ঠাকুমার ঝুলি’, ‘ভূত চতুর্দশী’ এখন অতীত, নতুন প্রজন্ম মেতে রয়েছে ‘হ্যালোইন’ মার্কা পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে। কিন্তু বাঙালীর সাথে তার ভূতেদের সম্পর্ক কি তাহলে এভাবেই অবহেলায় চুকেবুকে যাবে? বোধহয় না। রিভিউয়ের শুরুতেই এই বিষয়গুলি নিয়ে কথা বলা জরুরী। কারণ, গত ১১ সেপ্টেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘হইচই’-তে মুক্তি পেয়েছে এক অন্যধারার বাংলা ছবি যার পরিচালক বাংলা লোকগাথার কালজয়ী অশরীরী চরিত্র ব্রহ্মদৈত্যকে নিয়ে ছবির গল্প বেঁধেছেন। 

ছবির গল্পের মূল চরিত্র সায়ন্তিকা (সায়নী ঘোষ)। সে এক পত্রিকা অফিসে চাকরি করে। চরিত্রের দিকে থেকে ইন্ট্রোভার্ট, সহজেই কারও সঙ্গে মিশতে পারেন না সায়ন্তিকা। জীবনের শুরু থেকেই বাবা-মা, স্কুলের বন্ধুরা এমনকী পরবর্তীতে অফিসের সহকর্মীদের কাছেও নির্মম ভাবে হেনস্থা ও অবহেলার শিকার সায়ন্তিকা। অফিসের সিনিয়রের নির্দেশে একটি অ্যাসাইনমেন্ট পায় সায়ন্তিকা, যেখানে তাদের পত্রিকার বিশেষ হ্যালোইন সংখ্যার জন্য বাংলার অতিপ্রাকৃত বা আধিদৈবিক গল্পগুলি নিয়ে আর্টিকেল লিখতে হবে তাকে। যাতে বর্তনাম বাঙালী যুবসমাজ বাংলার পুরনো গল্পকথার ভৌতিক চরিত্রদের সঙ্গে নিজের যোগ তৈরি করতে পারে। কিন্তু আজকের প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে এমন কোনও বিষয় খুঁজেই পায়না। যখন প্রায় ভেবেই ফেলেছেন যে এই কাজ তার আর করা হবেনা, ঠিক সেই সময়ই একটি রহস্যজনক ও অদ্ভুত ই-মেল পায় সায়ন্তিকা, তাতেএকটি ওয়েবসাইটের লিঙ্ক পাওয়া যায়। 'বাইআঘোস্ট ডট কম' নামের অনলাইন একটি সাইট অতিপ্রাকৃত নানা ধরনের জিনিস বিক্রি করে। যেমন, কোনও মরা সাধুর কঙ্কাল কিংবা কোনও মরা মানুষের পোশাক। সেখানেই সেল চলাকালীন ডিসকাউন্টে একটি উচ্চমানের ও পুরনো 'ব্রহ্মদৈত্য' কেনার খোঁজ পায় সায়ন্তিকা। পুরো বিষয়টাকেই একটা মজা মনে করে, অর্ডার দিয়ে ফেলে সায়ন্তিকা। পরদিন সকালেই একটি পুরনো ধাতব ট্রাঙ্ক ডেলিভারি হয় তার বাড়িতে। এর পরই শুরু হতে থাকে নানা কাণ্ড-কারখানা। বাড়িতে নিজের অস্বিত্বের জানান দিতে শুরু করে 'ব্রহ্মদৈত্য'। তবে এখানেই শেষ নয়, গল্পের নতুন মোড় এখানেই শুরু। নানা ধরনের ভয়ানক অভিজ্ঞতা ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে শুরু করে সায়ন্তিকা। 

আজকের প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে সমসাময়িক প্রেক্ষাপটেই ‘ব্রহ্মদৈত্য’র বুনন করেছে পরিচালক অভিরূপ। সাসপেন্স, হরর, থ্রিলের পাশাপাশি এই ছবিতে রয়েছে এক ইমোশনাল জার্নির গল্প। কখনও কখনও শিশুদের পাশাপাশি বড়দেরও যে বুলিংয়ের শিকার হতে হয়, পরিচালক সায়নী ঘোষের চরিত্রের মধ্য দিয়ে সেই বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। মূল চরিত্র সায়নী ঘোষের পাশাপাশি স্বল্প সময়ে তান্ত্রিকের চরিত্রে নজর কেড়েছেন রুদ্রনীল ঘোষও। এক কথায় ঠাকুমার ঝুলির রেফারেন্স নিয়ে,সেটাকে যথেষ্ট মস্তিষ্কের কেরামতিতে হরর,কমেডি এবং টেকনিক্যালিটির একটা পারফেক্ট ব্লেন্ড। প্রত্যেক দৃশ্যেই কয়েকটা চমক দেওয়া এলিমেন্ট চোখে পড়বে। নায়িকার আয়না, ভূত আনার বাক্স, টেপ রেকর্ডারের ক্যাসেটে রেকর্ডেড ভূত আটকে রাখার টোটকা কিছুই নর্মাল নয়। হরর মুভিতে জাম্প স্ক্যেয়ার দিয়ে ভয় দেখানো খুব সহজ, কিন্তু গাড়ির উপর মানুষের নাড়ি ভুঁড়ি ছুঁড়ে ভয় দেওয়া বোধহয় বাংলা মুভিতে এই প্রথম। ছোট্ট একটা কাহিনী কিন্তু কি বীভৎস টানটান। ছবির সিনেম্যাটোগ্রাফি করেছেন অঙ্কিত সেনগুপ্তা। এডিটিং যিষ্ণু সেন। মিউজিকের দায়িত্বে ছিলেন মেঘ বন্দ্যোপাধ্যায়। নতুন স্বাদের এই বাংলা ছবি মিস করবেন না। পরিচালক অভিরূপ ঘোষের এই প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাতেই হয়, যিনি বাঙালীর শৈশবের পাতা থেকে ‘ব্রহ্মদৈত্য’কে তুলে এনে দর্শককে গা ছমছমে অনুভূতি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সিনেমা দেখতে দেখতে মাথায় যতই অবাস্তব, অতিপ্রাকৃতিক চিন্তাভাবনা ভিড় করুক না কেন, এটা কিন্তু অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই।


রেটিং
5 অসাধারণ
4 বেশ ভালো
3 ভালো
2 দেখতে পারেন
1 না দেখলেও চলবে

 আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments