বাঙালি জীবনে দামোদর ব্রত/বিভাস মণ্ডল

বাঙালি জীবনে দামোদর ব্রত

বিভাস মণ্ডল

পৃথিবীর সকল ধর্মের মধ্যে ভারতের সনাতন ধর্ম নিজ মহিমায় উজ্জ্বল। তা বিভিন্ন শাখায় বিস্তৃত। মূলত আর্য বৈদিক ঋষিদের নিকট থেকে অদ্যাবধি তার অবিরাম বিবর্তনের রূপ আমাদের লক্ষ্যে পড়ে। শৈব- সৌর- শাক্ত- গাণপত্য- বৈষ্ণব তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বৈষ্ণবদের বিভিন্ন শাখা সমগ্র ভারতে ও ভারতের বাইরেও তার বিস্তার রয়েছে। শ্রীমন্মহাপ্রভু সৃষ্ট অর্বাচীন সম্প্রদায় তথা পঞ্চম সম্প্রদায় সর্বোৎকৃষ্ট। যা মূলত ভাগবতকেন্দ্রিক। পরবর্তী সময়ে গোস্বামীদের দ্বারা নানান ভাষ্যে সমৃদ্ধ হয়ে বাঙালি ও ভারতীয়দের লালিত করেছে।
শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের নবম অধ্যায়ে রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের দাম বন্ধন লীলা। মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শেষ মহাপুরাণ শ্রীমদ্ভাগবতে ভগবানের অসংখ্য প্রেমিক ভক্ত ও অবতারের জীবন চিত্র প্রথম স্কন্ধ থেকে নবম স্কন্ধ পর্যন্ত ব্যক্ত রয়েছে। যাদের মধ্যে পঞ্চমবর্ষীয় বালক ভক্ত প্রহ্লাদ বা ধ্রুব যেমন রয়েছেন, তেমনি রাজর্ষি ভরত, অম্বরীষ, পৃথু প্রমুখ অগণিত রাজগণও রয়েছেন। পাশাপাশি মৎস- কূর্ম- বরাহ- নৃসিংহ- বামন- রামচন্দ্রাদি অসংখ্য অবতারের কথার মাঝে চকিতে স্ফুলিঙ্গের মতো উদ্ভাসিত হতে থাকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন মাধুর্য ও ঐশ্বর্য লীলার কথা। তবে দশম স্কন্ধ থেকেই পরিপূর্ণভাবে প্রকাশিত হয় শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব লীলা, বাল্যলীলা, কৈশোরলীলা- পৌগণ্ডলীলা।যা মূলত গোকুল ও বৃন্দাবনকে কেন্দ্র করেই। পরে থাকছে তাঁর মথুরা ও দ্বারকা লীলা।
বাংলার ভক্তপ্রাণ মানুষ মহাপ্রভুর মহাবদান্যায় ফিরে পায় " কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্" কে খুঁজে পেতে। লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণই যে শ্রুতির 'রস বৈ সঃ', তা তিনিই প্রমাণ করে দিয়েছিলেন দাক্ষিণাত্য ভ্রমণকালে। ব্রহ্মসংহিতা গ্রন্থ উদ্ধারের মধ্য দিয়েই আপামোর জগজ্জীবকে জানিয়ে দেন - ষড়ৈশ্বর্যময় ঈশ্বর বলতে শুধুমাত্র কৃষ্ণ ভিন্ন অন্য কেউ নয়। ব্রহ্মসংহিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন- ঈশ্বরপরমকৃষ্ণসচ্চিনানন্দ বিগ্রহ।
অনাদিরাদিগোবিন্দসর্বকারণকারণম্।।
সেই 'গোবিন্দম্ আদিপুরুষম্ ত্বমহং ভজামি' কেই আরাধনার বার্তা দিতেই কৃষ্ণভজনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন শ্রীধাম নবদ্বীপে। শ্রীবাস অঙ্গনে হরিনাম শুরু করে নগর পরিক্রমার মধ্য দিয়েই ঘুমন্ত বাঙালীকে কৃষ্ণ মন্ত্রে জাগরিত করলেন। 
এতদিন লক্ষ লক্ষ বৎসর কঠোর তপস্যা করেও যাঁকে লাভ করা সম্ভব ছিল না, তিনি আজ অতি সাধারণ গৃহ রমণীর প্রেমরজ্জুর বশে বশবর্তী হয়ে বন্ধন দশা প্রাপ্ত হবেন তা সাধন জীবনে বিস্ময় বই কি! 
যে সময়টাতে মা যশোদা দেবী তাঁর পুত্র শ্রীগোপালকে প্রেমরজ্জু বন্ধনে বেঁধেছিলেন তা ছিল কার্তিক মাস। বৈষ্ণব ভক্তদের নিকট দামোদর মাস। 'দাম' কথার অর্থ দড়ি বা বন্ধনরজ্জু, আর 'উদর' কথার অর্থ কোমর বা পেট। বাৎসল্য রসের বশে আজও ভক্তপ্রাণ বাঙালী প্রভুর অমৃতময় লীলাকথা শ্রবণে সারা বৎসর তৎপর থাকেন। বিশেষতঃ এই মাসটিতে শুধু বাংলা নয়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে এমনকি বহির্ভারতের বিভিন্ন রাষ্ট্রেও ভগবানের লীলাকথা শ্রবণে ভাগবতাদি বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ ও কীর্তনে সাড়া পড়ে যায়।

ব্রত উদযাপনের সময়টি ভক্তপ্রাণ বাঙালী বিভিন্ন ভাবে গ্রহণ করেন। কেউ কেউ কার্তিক মাসের শুরু থেকে সংক্রান্তি পর্যন্ত, কেউ বা বিজয়া দশমীর পরদিন একাদশী থেকে একমাস ব্যাপী, কেউ বা আশ্বিনের পূর্ণিমা তিথি থেকে কার্তিকের রাস পূর্ণিমা তিথি সময়কে ধরে অতি নিষ্ঠা সহকারে পালন করেন।
কার্তিক মাসের শুরু থেকে শেষাবধি আকাশদীপ দান করে বাঙালী তার বিগত আত্মীয়দের আত্মার মঙ্গল কামনা করেন। তারা নিত্য তুলসীতলায় সন্ধ্যা দিয়ে আকাশদীপ দান করেন। মন্দিরে মন্দিরে, বিভিন্ন শ্রীপাটে, মঠ-মন্দিরে, গৃহে গৃহে দীপদানের মধ্য দিয়ে প্রভুকে বরণ করে নেয়। গীতা, ভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃত, চৈতন্যভাগবতাদি বিভিন্ন গ্রন্থপাঠে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। আপামোর বাঙালী কৃষ্ণকথারসে আপ্লুত হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রভুর কাছে হৃদয়ের আকুতি জানান। নাম ও লীলা স্মরণ ও মনন, তুলসীসেবা, সাধুসেবা, ধামপরিক্রমা বিশেষতঃ নবদ্বীপ ও বৃন্দাবনবাসে নিমগ্ন হন। প্রতিনিয়ত জীবহিংসা, মিথ্যা কথা বলা, আমিষ আহার বর্জন করে, প্রসাদ সেবনের মধ্য দিয়ে তুলসী পরিক্রমা, নগর পরিক্রমা, সাধু-মহাত্মাদের সেবায় তারা জীবন অতিবাহিত করেন। 
ভারতীয় ভক্তি সাধনার ধারায় শ্রীমন্মহাপ্রভু প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভাবপরিমণ্ডলে আপামোর বাঙালী কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে দান-ধ্যান-সেবা-কর্মে নিজেদের উৎসর্গ করেন। সাধুমুখে হরিকথা শ্রবণ করে যে সম্প্রীতির বাতাবরণ গড়ে ওঠে, মূলত ভাগবত কথাবাসরকে কেন্দ্র করে, তা পার্থিব শত দুঃখ-জ্বালা-যন্ত্রণাকে সহজেই মানুষ ভুলে যান। এই সময়টাই তাদের কাছে পবিত্র মাস।
----------------------------------
লেখক - শিক্ষক, গবেষক। 

আরও পড়ুন 

Comments

Trending Posts

রাষ্ট্রীয় মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি পরিষদ (NAAC) এর মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি: উদ্দেশ্য ও প্রস্তুতি - কলেজ ভিত্তিক অভিজ্ঞতা /সজল কুমার মাইতি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১২৫

শমিত ভঞ্জ (অভিনেতা, তমলুক)/ ভাস্করব্রত পতি

বারুণী স্নান /ভাস্করব্রত পতি

প্রয়াত লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্ত। শ্রদ্ধা ও স্মরণে কলম ধরলেন লেখক শিল্পীরা।

মেদিনীপুর জেলার আনাচে কানাচে বসবাসকারী ডোম ও চাঁড়ালরাই বাংলার প্রাচীন ব্রাহ্মণ /দুর্গাপদ ঘাঁটি

বিস্মৃতপ্রায় কবি ফণিভূষণ আচার্য /নির্মল বর্মন

গায়ত্রী জানা (ব্রতচারী প্রশিক্ষক, সঙ্গীতজ্ঞ, রাধামনি, তমলুক)/ভাস্করব্রত পতি