জ্বলদর্চি

২০২১ নতুন বছর নতুন লেখা (ধুলোমাটির দিন)/ বিশ্বজিৎ অধিকারী

২০২১ নতুন বছর নতুন লেখা 
মুক্তগদ্য
ধুলোমাটির দিন

বিশ্বজিৎ অধিকারী


কবি অজয়কুমার নাগের বাড়ি গ্রামীণ খড়গপুর থানার চমকা গ্রামে, পোষ্টঅফিস মাদপুর। রেলস্টেশন থেকে দক্ষিণে প্রায় চার কিলোমিটার রাস্তা পেরোলে তবে সেই গ্রাম। অজয়বাবু যৌবনে “ধুলোমাটি” নামে একটি ছোটোকাগজ সম্পাদনা করতেন। ছোটোকাগজ ঠিকই, তবে তাতে বহু বড়ো-বড়ো লেখকই লিখেছেন। ছোটোকাগজ লেখা হল কারণ ‘লিটল ম্যাগাজিন’ কথাটা তখনও তেমন জনপ্রিয় হয়নি, অন্তত গ্রামদেশে। তো বলার কথা হল—এই লেখা অজয়বাবুর সেই কাগজ নিয়ে নয়। সুতরাং নামের ব্যাপারে শুরুতেই ঋণস্বীকার। এ লেখা আক্ষরিক অর্থেই ধুলো এবং মাটি নিয়ে। শহর-বাজারের ধুলোবালি নয়, একেবারে আদি অকৃত্রিম গ্রামবাংলার ধুলোমাটি। 

    আগের দিনের গল্প-উপন্যাসে গেঁয়ো পথচারীর কথা থাকলে অবশ্যই তার ধূলিধূসর পদযুগলের বর্ণনা থাকত। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ছেড়ে দিলে, আজ আর তেমনটি হওয়ার জো নেই। কেননা গাঁ-গঞ্জে ধুলোবালি আজকাল কম। শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার প্রধান পথগুলি প্রায় সমস্তই বাঁধানো, পিচ কিংবা কংক্রিট দিয়ে। অন্তঃগ্রাম রাস্তাঘাটও ইদানিং বালি-পাথর দিয়ে ঢালাই করা হচ্ছে। নিদেনপক্ষে মোরামের আস্তরণ তো আছেই। মোরামও একপ্রকার মাটি তবে তা আমাদের এদিকের পরিবেশের পক্ষে বিজাতীয়, কেননা তা রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল কিংবা পশ্চিমের প্রতিবেশী রাজ্যগুলি থেকে আমদানিকৃত। মোটকথা আব্রুহীন নিরাবরণ মাটির পথঘাটের দেখা গাঁঘরে আজ আর সহসা মেলে না। দেখা মেলে না তো মেলে না, তা নিয়ে আর এতো বকবক করারই বা কী আছে? পায়ের কপালে কোনোক্রমে একজোড়া জুতো জুটে গেলে কে আর হোঁচট-ঠোক্কর বা জ্বালাযন্ত্রণাময় নগ্নপদ দিনগুলির জন্য হাহুতাশ করবে। মানুষ ভুলে যেতেই চাইবে দুর্দশার কথা। কিন্তু মানুষ যা ভুলে যেতে চায় তা সহজে ভুলে যেতে পারে না। মনের গভীর তলদেশে জমে ওঠা ঠাণ্ডা পাঁক থেকে স্মৃতির বুড়বুড়ি মাঝেমাঝেই অপ্রাসঙ্গিক ভাবে জেগে ওঠে চেতনার ওপর-তলে। আমারও আজ তেমনই মনে পড়ছে সেই ধুলোমাটি তথা কাদামাটি মাখা জীবনের কথা।
    জ্ঞান হওয়ার পর প্রথম চোখ মেলে দেখেছি একটি খড়োচালের মাটির বাড়ি; না না, বাড়ি নয় কুঁড়ে? আমার দাদু, মানে আমার মায়ের বাবার হাতে বানানো। একটি মাঝারি মাপের ঘর, তার দক্ষিণে আর পূর্বে  দু-ফালি ঢাকা বারান্দা, আমরা বলতাম ভিতর-দুয়ার, দিদা বলত দলিজ (হিন্দি শব্দ দহ্‌লিজ-এর অপভ্রংশ), আর দক্ষিণের ঢাকা বারান্দা থেকে বেরোলে আরও একফালি দাওয়া। মাথায় বাঁশের কাঠ্‌মার (কাঠামো) ওপর ছ-চালা খড়ের আচ্ছাদন। ছ-চালার ব্রেকআপটা এরকম—মূল ঘরটির মাথায় একটি চারচালা, আর দক্ষিণের ও পূর্বের বারান্দাদুটির জন্য আরও দুটো চালা (কল্পনায় একটি আটচালা ঘরের অধস্তন সমকৌণিক দুটি চালা সরিয়ে নিলে হিসেবটা বুঝতে কিছু সুবিধে হবে)। বাড়িটির পূর্বদিকে হাতদশেক তফাতে গোয়ালঘর, মাটিলেপা ছিটাবেড়ার ওপর খড়ের ছাউনি। দাদুর হাতে বানানো বাড়ি মানে দাদুরই হাতে বানানো বাড়ি, সাজাহানের হাতে বানানো তাজমহলের মতো ব্যাপারটা নয়। বাড়ির চারপাশে অনেকখানি খোলা অঙ্গন। সকাল হলে ধবধবে বালিমাটির ওপর এসে ছড়িয়ে পড়ে রৌদ্রের হলুদ রেণু।

    বাড়ির বাইরে ছড়ানো যে গ্রাম তাও মাটি আর মাটির ওপর গজিয়ে ওঠা গাছপালা লতাপাতা দিয়ে তৈরি। অন্যরকম জিনিস বলতে কয়েকটি বাড়ির পাথর ফেলা পুকুরঘাট, দুয়েকজনের পাকা পায়খানা-ঘর, আর গ্রামের একপ্রান্তে একটি পরিত্যক্ত ধানকলের বাঁধানো ফাউন্ডেসন। গ্রামের বাড়িঘরের মাঝে মাঝে কচ্ছপের পিঠের মতো দুটো-একটা অনুচ্চ মাটির ঢিবি, যাকে আমরা বলতাম কাঁথড়া (মাটির দেয়াল বা কাঁথ ভেঙে তৈরি হয় বলেই বোধহয় ওরকম নাম)। কাঁথড়ার মাটিতে মিশে থাকত গুচ্ছের খোলামকুচি। আর খোলামকুচির মতোই মাটির ওপর যত্রতত্র ফুটে ওঠে বলে একধরণের শাকের নাম ছিল খোলামকুচি শাক, কচি তেঁতুলপাতা সহযোগে রান্না করলে যার স্বাদ অমৃতের অধিক। কাঁথড়ার মাটি বেশ উর্বর, তাই সেখানে লাগানো হত লাউ কুমড়ো পুঁই লংকা পেঁপে, কিছু কিছু ফুলের গাছও। তাছাড়া, উঁচু জায়গাটি ছিল বাড়ির পুরুষমানুষদের রোদ্দুরে ধুতি গুটিয়ে বসে তেল মাখার জায়গা। দ্বিপ্রহরে তা হয়ে উঠত বাড়ির মেয়েবউদের অম্লমধুর আড্ডার আসর, যেখানে এসে যোগ দিত প্রতিবেশী রমণীরাও। 

ছেলেমেয়েদের খেলাতেও সেদিন আক্ষরিক অর্থেই মিশে থাকত ধুলো। যেমন একটা খেলা ছিল মাটির ওপর খোলামকুচি দিয়ে দাগ কেটে ঘর বানিয়ে তাতে পাতা লুকিয়ে রাখার খেলা, পাতালুকানি। আরেকটা খেলা ছিল হুঁটাহুঁটি। যার মূল আকর্ষণ ছিল প্রতিপক্ষের গুলির (কাঁচের বা মার্বেলের) মারে দূরে চলে যাওয়া নিজের গুলিটিকে কনুই দিয়ে ঠেলে ঠেলে খেলার কেন্দ্র একটি নারকেল মালা আকারের গর্তের (আমরা বলতাম পিল) কাছে নিয়ে আসা। দিনের পর দিন ওই খেলা খেললে কনুইয়ের কী অবস্থা হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। 

    মাঠে একটাই ফসল, আমন ধান। অঘ্রাণ-পৌষে সে-ফসল চাষির খামারে উঠে গেলে সাত আট মাসের জন্য মাঠ একেবারে খালি। মাঠে তখন গরুছাগল চরে বেড়াবে, এমাথা ওমাথা পড়বে গরুর গাড়ির লিক। লিকে একহাঁটু গেরুয়া ধুলো। লিক বরাবর এপাড়া ওপাড়া দৌড়ে বেড়াবার মজা কেমন তা লিখে বোঝানো যায় না। তখন আমাদের ঘুড়ি ওড়াবার জায়গাও ছিল সেই শীতের ফাঁকা ধানমাঠ। উত্তুরে হাওয়ায় হিহি করে কাঁপতে কাঁপতেও ঘুড়ির লাটাই নিয়ে মেতে গিয়ে শীতের কথা বেমালুম ভুলে থাকতাম আমরা, জুতসই গরম জামাকাপড় তখন কতজনেরই বা ছিল। মাঘের শেষ কি ফাল্গুনের প্রথম দিক থেকে মাঠে শুরু হত উগাল-সামাল (শীতের শেষে প্রথম বৃষ্টিপাতের পর ‘বতর’ হলে মাটি চষার কাজ)। তখন চাষিদের ঘরে-ঘরে জোড়ায় জোড়ায় বলদ, লাঙল আর গাড়ি টানার জন্য। বাড়ির ছেলেমেয়েদের দুধের যোগান দেওয়ার জন্য গাই-বাছুর। সব বাড়িতেই ছোটোবড়ো গোয়ালঘর, ডগাশাল (দিনের বেলা গাই বলদ বেঁধে রাখার জায়গা)। গেরস্থ-ঘরে তখন দুচারজন করে বাঁধা হালুয়া (লাঙল বা হাল চালানোর মুনিশ), আর কমবয়সী অন্তত একটা বখাটে বাগাল। একেকজন বাগাল দিনে দিনে হয়ে উঠত বাড়ির মানুষ। গৃহস্থই আদর করে বাগালের বিয়ে দিয়ে রেখে দিত বাড়িতে (তার পেছনে হয়তো কিছু বৈষয়িক ফন্দিও লুকিয়ে থাকত)। আবার কোনও কোনও বাগাল বিয়ে-শাদি না করে বাবুর বাড়ির এককোণে পড়ে থেকে জীবন কাটিয়ে দিত। গ্রামের বামুনপাড়ায় এমনই এক বাগালকে, তখন তার প্রৌঢ় বয়স, আমি ডাকতাম মামা সম্বোধনে। তার নাম ছিল কানাই বা কানু, আর কী আশ্চর্য কানুমামা সুন্দর আড়বাঁশি বাজাতেও পারত। ওই বাড়ির ছোটো ছেলে শোভন চক্রবর্তী মানে শোভনদার খুব নেওটা ছিলাম আমি আর আমার বয়সের আরও অনেক ছেলে। সেই ধুলোকাদাময় দিনগুলোতে অনড় কুয়াশার মতো কিছু কিছু অস্ফুট গুঞ্জন বছরের পর বছর ভেসে থাকত গ্রামদেশের বাতাসে। একটু বড়ো হয়ে তেমনই এক গুঞ্জনে কান পেতে জেনেছিলাম, শোভনদা ছিল আসলে সেই কানুমামার সন্তান।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments