জ্বলদর্চি

২০২১ নতুন বছর নতুন লেখা (দুটি অণুগল্প) /সন্দীপ দত্ত

২০২১ নতুন বছর নতুন লেখা 
দুটি অণুগল্প 
সন্দীপ দত্ত

ভুল রাস্তা

ড্রাইভার গাড়ির কাচ তুলে দিতেই পল্লবের দিকে তাকালেন অমরেন্দ্র। দু'চোখে উৎকন্ঠা নিয়ে বললেন, "আমরা ঠিক সময় পৌঁছোতে পারবতো? ঘন্টা খানেকের বেশি লাগবার তো কথা নয়! আমার একটা হিসেব থাকে। অলরেডি পনেরো মিনিট লেট হয়ে গেছে। ওখানকার মানুষগুলো অধৈর্য হয়ে গেছে বোধহয়।"
ড্রাইভার গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, "রাস্তার ওপর দিয়ে মোষের লম্বা লাইন চলে গেলে দেরি তো একটু হবেই স্যার। আমি তো ওদের বুকের ওপর দিয়ে গাড়ি চালাতে পারিনা। ওরা অবলা।"
শার্সিতে ড্রাইভারকে বিরক্তমুখে এক পলক দেখে পল্লবের দিকে তাকালেন অমরেন্দ্র। "কি ব্যাপার পল্লব, এ পথে তো মোষ থাকার কথা নয়! আজ তিন মাস ধরে এ রাস্তার কাজ হচ্ছে। এই পথ ঝকঝকে তকতকে তো অনেকদিন ধরে। সেটা একমাত্র আমরাই জানি, আর কেউ নয়। মানুষ অতো বোঝেনা। ওরা ভেবেছে রাস্তা'টা নতুন তৈরি করেছি। তারই উদ্বোধনে আসছি এখানে। কিন্তু  সেটা তো শুধুমাত্র আমাদের পার্টির ভেতরের লোকগুলো জানবে। বাইরে আউট হবেনা। তাই বলছিলাম, এই মোষগুলো কেন? রাস্তার খাতে খরচ করার পুরো টাকাটাই তো আমি তোমাদের সকলের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছি। অস্বীকার করতে পারবে লভ্যাংশ পাওনি? তেলা মাথায় আর কত তেল দেব তোমাদের? মোষগুলোকে দমিয়ে রাখা তোমাদের কর্তব্য ছিলনা? জানতে না মসৃণ রাস্তায় আমার চলতে সুবিধে হয়? মিডিয়ার সামনে শুধু  তো একবার বলা দীর্ঘদিনের মানুষের চাহিদা পূরণ করতে সমস্যাবহুল পথটাকে চলার সুউপযক্ত করা হয়েছে যেটা, আজ তারই উদ্বোধন করলাম। ব্যস, তাহলেই তো হয়ে গেল। ভয় তো সংবাদমাধ্যমগুলোকেই। সামনে ইলেকশন। মানুষকে আমি ভয় পাইনা। মানুষকে বোকা বানানো খুব সহজ.....
     অমরেন্দ্র'র কথা শেষ হয়না, গাড়ি এসে দাঁড়ায় পিচ ওটা এবড়োখেবড়ো এক রাস্তায়। যেখানে উদ্বোধনের কোনো সুদৃশ্য ম্যারাপ বাঁধা মঞ্চ নেই, রয়েছে শুধু দঙ্গল দঙ্গল মানুষের আগুনঝরা চোখ। বিক্ষোভ প্রদর্শনের নানাবিধ ভঙ্গি।
    অমরেন্দ্র আবার তাকালেন ড্রাইভারের দিকে। তাকালেন পল্লবের দিকেও। "আরে আরে থামো! এ আমায় কোথায় নিয়ে এলে? এখানে আসবার কথা তো ছিল না। উদ্বোধনের মঞ্চ কোথায়? কোথায় মসৃণতা? এ তো ভুল রাস্তা!"
     পল্লব মুখ খোলার আগেই উত্তেজিত জনতা মারমুখি হয়ে ছুটে এল অমরেন্দ্র'র গাড়িকে লক্ষ্য করে। গাড়ির কাচ ভেঙে দিতে চাইল ওরা। অমরেন্দ্র'র গায়ে হাত তুলতে চাইল।
     ভয় পেয়ে যাওয়া অমরেন্দ্র তবু পল্লবের চোখে চোখ রাখলেন। "এসবের মানে কী?"
পল্লব বলে,"আপনার এইখানেই আসার কথা ছিল স্যার। এই রাস্তাটাই আপনার উদ্বোধনের কথা ছিল।"
নিজের দেশের মানষগুলোর অভাবী মুখের কাছে হেরে গিয়ে লভ্যাংশের টাকা বিন্দুমাত্র খরচ না করে গর্জে ওঠা ড্রাইভার বলল বাকি অংশ'টা।
"এটা যেমন ভুল রাস্তা, আপনার প্ল্যানের বাইরে, মানুষকে বোকা বানিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে মুচকি হেসে এগোনোটাও আর এক ভুল পথের সন্ধান দেবে আপনাকে। পরিত্রাণ পেতে গেলে এদের কাছে আগে নিজের ভুল স্বীকার করুন। দ্রুত রাস্তা তৈরির প্রতিশ্রুতি দিন। সামনে ভোট, কথাটা মাথায় রাখুন।"
     অগত্যা অমরেন্দ্র জনতার উদ্দেশ্যে হাতজোড় করবার জন্য তৈরি হলেন।

কর্কট

নিওনের আলো মেখে অভ্যস্ত যশোধরা এখন মোমের আলোর সামনে বসে আছে। চোখ টানা দামি সুর্মায়, বিলাসিতার রঙে রাঙানো দু'ঠোঁট। সুখেনের কথামতো সে আজ এখানে এসেছে। সুখেনের কথামতো বসেওছে। কিন্তু  সুখেনের মনের মতো কথা বলতে পারল না। যশোধরা এমন কিছু বেহায়াপনা দেখাতে পারল না, যেটা তার অন্তরকে কলুষিত করে। নিজের বুকের জমিয়ে রাখা কথার শুধুমাত্র একটা আঘাত দিল সে। একটাই। তাতেই মুখ নামিয়ে নিল সুখেন।
যশোধরা বলল, "ফেসবুক প্রোফাইলে আপনি নিজেকে বিবাহিত লিখেছেন। তা, স্ত্রী থাকতে আমাকে কাছে পেতে চান কেন?"
"না মানে, আসলে....." সুখেন বলতে গিয়েও থমকে যায়।
নিরুত্তর সুখেনের মুখ খোলার জন্য নিরুপায় যশোধরাকে আবার কথা বলতে হল।
"আপনার স্ত্রী তো মনে হয় যথেষ্ট সুন্দরী।"
"কী করে বুঝলেন?" সুখেন অবাক হয়ে জানতে চায়।
"গেস করলাম। আপনার মতো হ্যান্ডসামের স্ত্রী তো সুন্দরী হবেই। কিন্তু  আমার উত্তর যে পেলাম না।"
"হ্যাঁ, খুব সুন্দরী। বিয়ের আগে মডেলিং করত।" সুখেন বলে। বলতে বলতে যশোধরাকে আবার একবার ভাল করে দেখে। অবিকল সেই রূপ। যা সে ফোনের মধ্যে দেখেছে। সেই চোখ। যা তাকে এই চার মাস বিনিদ্র রেখেছে। পাগল করে দিয়েছে তার ভেতরটা।
"এই উত্তর'টা চাইনি আমি। আপনি আসলের পর কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেছেন। কী বলতে চেয়েছিলেন? স্ত্রী আপনাকে ভালবাসেনা?" যশোধরা বলে।
"না, ঠিক তা নয়।"
"তাহলে?"
"ওর ক্যান্সার হয়েছে। সেকেন্ড স্টেজ।"
"তো?"
সুখেন আবার নিশ্চুপ। নিশ্চুপ হয়েই গলে যাওয়া মোমের জায়গায় আবার একটা মোমবাতি ধরায়। নতুন আলোর তেজে যশোধরাকে আরও উজ্জ্বল লাগে।
"নিজের অসুস্থ স্ত্রীকে এড়িয়ে তাই আপনি আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছেন?"
সুখেন মুখ নামিয়ে নেয়। 
"কেমো চলছে নিশ্চয়ই?"
সুখেন অস্ফূট হ্যাঁ বলে।
"স্ত্রীর শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে, তাই কি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট? আপনারা মশাই পুরুষগুলো সবাই এক। সুন্দরী মহিলা দেখলেই বেছে বেছে তাদের.....। আপনার পেজ ঘেঁটে ডেট অফ বার্থ'টা পেলাম। একটু আধটু জ্যোতিষচর্চা করি আমি। খুব ভুল না হলে আপনি কর্কট রাশির জাতক। ঠিক বললাম তো?"
সুখেন বলল, "হ্যাঁ।" বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা।
"এ বছরটা আপনার কেমন কাটবে, জানেন?"
"স্ত্রী বিয়োগ এবং নতুন সম্পর্কে জড়ানো।"
"কার কাছে জেনেছেন?"
"পত্রিকা স্টল থেকে। পত্রিকাতে যা লেখা আছে।"
সুখেনের কথা শুনে হেসে ফেলল যশোধরা। "ওসব ফালতু। পুরোটাই ভুল। কর্কট রাশির বিবাহিত জাতকদের এবছর প্রিয় মানুষদের কঠিন ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ রয়েছে। সঙ্গে বিবাহিত জীবনের অটুট বন্ধন।"
সুখেন চোখ মেলে তাকাল যশোধরার দিকে।
যশোধরা বলল, "শুনতে অবাক লাগল সুখেনবাবু, তাই না? আমিও ঠিক এরকমই অবাক হয়েছিলাম, যখন আপনি আমায় বন্ধুত্বের জন্য আহ্বান জানান এবং মেসেঞ্জারে লেখেন 'অপরূপা সুন্দরী, আপনার সাথে সাক্ষাতে আলাপ করতে চাই।'  আমার স্বামীর কথামতোই আমি যেমন আপনার পাঠানো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেছি, ওর কথামতো আজ এসেওছি এখানে। আচ্ছা সুখেনবাবু, আপনার স্ত্রী কোন্ ডক্টরের আন্ডারে আছে বলুন তো?"
"ডা. পিনাক বন্দ্যোপাধ্যায়। চেনেন?" সুখেন বলে।
হাসে যশোধরা। "আমার হাজব্যান্ড। ফোনে আপনার ছবি দেখে এবং আপনার স্ত্রীর নাম পেয়ে পিনাককে দেখাতে ওই আমাকে পরিচালনা করে।.....সুখেনবাবু, আমার স্বামীর হয়ে আপাকে আমি অনুরোধ করছি, স্ত্রীকে ভাল বাসুন। তাকে যত্নে রাখুন। মনে সাহস দিন। আপনার ভালবাসা আর সাহসই আপনার স্ত্রীকে সুস্থ করে তুলবে। বেশির ভাগ ক্যান্সার পেশেন্ট' রা এগুলো থেকেই বঞ্চিত হয়।"
      টানা ঘন্টাখানেকের লোডশেডিং কেটে যায়। আলোয় আলো হয়ে ওঠে রুম। সুখেনের মুখে এসে লাগে সেই ছটা।
জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments