জ্বলদর্চি

হেনস্তা হতে হয়েছিল কলেরার উৎসসন্ধানকারীকে/দুর্গাপদ মাসান্ত


হেনস্তা হতে হয়েছিল কলেরার উৎসসন্ধানকারীকে

দুর্গাপদ মাসান্ত


লণ্ডন শহরের ৫৪ ফোর্থ স্ট্রিটের চেম্বারে জমিয়ে  রোগী দেখতেন ডাক্তার জন স্নো। কিন্তু ১৮৫৪ সালে আগস্টের মাঝামাঝি হঠাৎ শহরে কলেরা রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বিপত্তি দেখা দিল। ডাক্তার স্নো প্রতি বছরই কমবেশি কলেরা রোগী দেখেন। কারণ ইংল‍্যাণ্ডে কলেরা তো আর নতুন অসুখ নয়। প্রথম ধরা পড়েছিল সেই ১৮৩১ সালে। কারণও সবার জানা ছিল- দূষিত বায়ু। কিন্তু আগস্টের ঘটনায় ডাক্তার স্নো-র অনুসন্ধিৎসু মন বার বার বলছিল বিজ্ঞানের হিসাবটা যেন মিলছে না। নিজেই নিজেকে তিনটি প্রশ্ন করলেন। এক:  হঠাৎ এখন, এই সময়ে এত রোগী কেন?  দুই:  হঠাৎ এই এলাকাতেই বা এত রোগী কেন? তিন:  একটা নয়, দুটো নয়......হঠাৎ একসঙ্গে এত রোগী আসছে কেন?  

   সময়, স্থান, সংখ্যা- এই তিনটি প্রশ্নকে সামনে রেখে  সাজানো চেম্বার ছেড়ে অনুসন্ধান করতে রাস্তায় নামলেন ডাক্তার স্নো। বেশিক্ষণ লাগেনি। ডাক্তারবাবু বুঝে গেলেন গোলমালটা নিকটবর্তী বড স্ট্রিট এলাকায়। ওখানেই তো সব কলেরা রোগীর আবাস। শুরু হল আরও গভীর অনুসন্ধান। এই অনুসন্ধানই তাঁকে টেনে নিয়ে এল ওই এলাকার একটি হ‍্যাণ্ড পাম্প বা হাত-কলের কাছে। ব্রড স্ট্রিটের বহু মানুষের পানীয় জলের উৎস যে ওই কল। আশেপাশের ছোটবড় সব হাসপাতালে আসা কলেরা রোগীর নাম ঠিকানার যাবতীয় তথ‍্য নিয়ে ছুটে গেলেন স্থানীয় নগর আধিকারিকের দফতরে। জানালেন, তথ্য বলছে, কলেরার উৎস ব্রড স্ট্রিটের ওই হ‍্যাণ্ড প‍্যাম্পটি। তাই এক্ষুনি ওই কলের জল সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। না হলে এই রোগ থামানো যাবে না। প্রশাসন সময় নষ্ট করেনি। পরদিনই ভেঙে দেওয়া হয়েছিল কলের হাতল। ফলও হল চমকপ্রদ। বড স্ট্রিট ও সংলগ্ন অঞ্চলে দ্রুত কমে গেল  কলেরা রোগীর সংখ্যা।

মনে রাখতে হবে ডাক্তার স্নো যখন তাঁর প্রথম রিপোর্ট পেশ করেন, তখনও সংক্রমণের মূল কারণ অজানা। পরে জানা যায়, ব্রড স্ট্রিটের ওই হাত-কলের জল আসত এক জলাধার থেকে। সেখানে এক কলেরা আক্রান্ত শিশুর জামা-কাপড় ধুয়েছিলেন তাঁর মা। সেই কলেরা আক্রান্ত শিশুর জামা-কাপড় থেকেই ছড়িয়ে পড়ে রোগের সংক্রমণ। যাবতীয় তথ্য ও অভিজ্ঞতার এই দলিল একত্রে রচনা করে ডাক্তার স্নো পড়লেন লণ্ডনের চিকিৎসকমণ্ডলীর সামনে। যাবতীয় প্রশ্নের উত্তরও দিলেন। কিন্তু তাঁর মতবাদ ও তত্ত্ব খারিজ করল "মেডিক‍্যাল সোসাইটি অব লণ্ডন"। যার মধ্যে অন‍্যতম ছিলেন ইংল‍্যাণ্ডের প্রসিদ্ধ  সংখ্যাতত্ত্ববিদ ডাক্তার উইলিয়াম ফার। তিনি মানলেন না স্নো-র পরিসংখ্যানযুক্ত এই গবেষণা। তাতে নাকি অনেক ফাঁকফোকর, তেমন বৈজ্ঞানভিত্তিও  নয়। তেমনই ধেয়ে এল 'ল‍্যান্সেট' পত্রিকার উপেক্ষাও। আর এতেই স্নো পড়লেন মহাফাঁপরে। কারণ তাঁর কাছে তথ্য আছে কিন্তু কোন প্রমাণ নেই। তবুও নিজের বিশ্বাস আর তথ্যের ভিত্তিতে আরও চার বছর মৃত্যুর আগে পযর্ন্ত তিনি লড়ে গেলেন। বার বার খারিজ করলেন কলেরা এবং দূষিত বায়ূর সম্পর্ক, 'মিয়াসমা থিয়োরি'।

  তবে সত‍্যই সবসময় শেষ হাসি হাসে। ১৮৬৬ সালে স্নো-র মৃত‍্যুর আট বছর পর, তাঁর প্রধান সমালোচক ডাক্তার উইলিয়াম ফার লণ্ডনের ব্রমলি-বাই-বাও অঞ্চলে কলেরা রোগীদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে একই পরিসংখ্যান পেলেন। কলেরার মূল কারণ হিসেবে উঠে এল দূষিত জল। ঠিক ১২ বছর আগে ডাক্তার স্নো যেমনটি বলেছিলেন। স্বীকার করলেন স্নো-র বলে যাওয়া দূষিত জল ও কলেরার সম্পর্কের তত্ত্ব এবং নিজের ভুলও মেনে নিলেন। আরও ১৭ বছর পর, ১৮৮৩ সালে রর্বাট কখ আবিষ্কার করলেন কলেরার জীবাণু 'ভিব্রিও কলেরি'। দূষিত বায়ুর তত্ত্বে এবার চিরতরে যবনিকাপাত ঘটল। অনুসন্ধান, গবেষণা আর তথ্যের উপর অটল বিশ্বাস ডাক্তার জন স্নো-কে আজও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্মরণীয় করে রেখেছে।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. লেখাটা পড়ে সমৃদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete