জ্বলদর্চি

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা /বি ম ল ম ণ্ড ল

Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্য ভাষা 

বি ম ল ম ণ্ড ল     
     
পর্ব-১৪  /তৃতীয় অধ্যায় 
রূপতত্ত্ব(Morphology)

৮. উপসর্গ 
এই জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী  মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায়  উপসর্গ যোগে রূপিমের প্রয়োগ দেখা যায়। চলিত বাংলার মতো এই জেলার উপভাষাতে  তৎসম শব্দের উপসর্গ ছাড়াও  ফারসি,আরবি,  ইংরেজি উপসর্গ হিসেবে বিদেশি উপসর্গের আধিক্য দেখা যায়। যেমন-

৮.১ তৎসম শব্দ যোগে উপসর্গ

চলিত বাংলার প্রভাবে উপ, আ, নি, অতি, প্রতি, সু, প্রভৃতি উপসর্গের ব্যবহার এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় দেখা যায়। যেমন-

আ — আঁড়িয়া (ষাঁড়), আউখ (আখ),আইনা (আয়না) আধাভ্রদ্রা(অর্ধেক আয়ু), আজা (দাদু),আন্না(নুন কম), আড় (পাড়), 

নি— নিখখেপ (ছুঁড়া), নিপাত (মুছে যাক), নিরবাচন(নির্বাচন), নিরদয় (নির্দয়)  

উপ— উপকূল, উপহার, উপনদী, উপদেশ, উপদ্বীপ

অতি — অত্তিকথা (অতিকথা ), অত্তিশয়(অতিশয়), অতিবোল(বেশি খিস্তি), 

প্রতি— প্রতিরধ (প্রতিরোধ), প্রতিগা(প্রতিজ্ঞা), প্রতিবাধ(প্রতিবাদ) 

সু— সুকুঁড়/সুকুড় (এঁটো), সুমা (সেদিকে), সুজাতা, সুজয়, সুতা 


৮.২ এখানে তৎসম ভিন্ন শব্দে  অ, আ, কু, নি, না, বি, স, অনা, ভরা,  প্রভৃতি উপসর্গগুলির প্রয়োগ দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে নঞর্থক ভাব, বৈপরীত্য, অভাব  প্রভৃতি অর্থ প্রকাশিত  হয়। যেমন—

অ— অবড়াখবড়া (উঁচু- নিচু), অসার/অসাড়(চাওড়া), অঘা(বুদ্ধিহীন), অকেজো, অতবা, 
আ— আফুয়া,( মূল্যহীন) , আই (দিদা),আনিজ,(আনাজ) , আঁইঠ (আঁটি)   আঁইশ (আঁশ) 
কু— কুঠ্যা (ধীর সম্পন্ন) , কুমা (কোন দিকে) , কুতকুতাঞি (কাতুকুতু) , কুঁথিকুঁথি (আস্তে আস্তে) , কুষ্টি, কুঁকড়ি (ছোট করা), 

নি— নিচ্ছিঞা(একটা গালি),   নিমুয়া (যাকে দেখলে কোন কাজ হয় না) ,    
না— নাঙ (পরপুরুষ) , ন্যাজ (লেজ), ন্যাড়া (চুলহীন মাথা) , নাঁরান (নারায়ণ) 
বি—বিরি (একপ্রকার ডাল), বিদ্ কুট্যা (বিচ্ছিরি) , বিগড়ি যাওয়া (মাঝ মাঝে বন্ধ হয়ে যাওয়া) ,  বিয়াঞি (বেয়ান) , 
স—সড়ু (শালিকার বর) , সউটি (সেখানে) সল্লা (ঝিঞে), 
অনা— অনামুখো, অন্যাহারে (অনাহারে) 
ভরা— ভরাগাঙ  (ভর্তি সমুদ্র), ভরাজাল (ভর্তি জাল) , ভরানৌকা (ভর্তি নৌকা) 

৮.৩. আরবি উপসর্গ যোগে
 
এই কথ্যভাষার উপভাষায়  বিদেশি উপসর্গের মধ্যে আরবি উপসর্গের প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন-

আম— আমদ্যানি (আমদানি), আমপাড়া, আমলা, 
কার- কারবার, কারচুপি, কারসাজি,

৮.৪ ফরাসি উপসর্গ যোগে
বিদেশি উপসর্গের মধ্যে ফরাসি উপসর্গ এই জেলায় কথ্যভাষায় লক্ষ্য করা যায়। যেমন-

বে- বেচারা, বেবাক, বেপুরুয়া (বেপরোয়া), বেদখল, বেসরকারি, বেহায়া, বেহুঁশ, 
বদ-বদরক্ত, বদমাশ, বদরোগ, বদমেজাজ, বদনাম
ব— বনাম, বদন, 
বাজে—বাজে রোগ, বাজে সময়, বাজে কথা , 
খোশ— খোশগল্প, খোশমেজাজ, 
খাস—খাসজমি, খাসখামার, খাসখবর, খাসদখল 
দর —দরপত্র, দরপুড়া, দরকাঁচা, দরজা, 


৮.৫.ইংরেজি উপসর্গ যোগে

এই জেলায় কথ্যভাষায় অন্যতম আর একটা বিদেশি উপসর্গ হল ইংরেজি উপসর্গ। এই উপসর্গের প্রয়োগ এখানে দেখা যায়।যেমন— 

ডবল— ডবল চাকরি, ডবল ট্রেকার, ডবল ডিম, ডবল কথা, ডবল জামা, ডবল জাল, ডবল নৌকা 
মিনি—     মিনি নৌকা, মিনি জাল, মিনি বাস, মিনি লোক, 
হেড— হেডম্যান, হেডমাস্টুর (হেডমাস্টার) , হেডআপিস (হেডঅফিস) , হেডসেট 
হাফ—হাফপেণ্টুন (হাফপ্যান্ট), হাফপিরান (হাফশার্ট), হাফভাগ, হাফকথা, হাফমোজা  
ফুল— ফুলপেণ্টুন (ফুলপাণ্ট) , ফুলহাতা, ফুলডে,ফুলকপি, ফুলকথা

৯.অনুসর্গ 

এই জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী  মৎস্যজীবীদের  কথ্যভাষায়  ধর্ম, বর্ণ, ছোটো বড়ো সব বয়সের মানুষের কথ্যভাষায় অনুসর্গের যথেষ্ট ব্যবহার রয়েছে। যেমন—

ক. জন্য >যানে/জানে /লাগি /লাগি কি—
i. ঝড় লাগি নৌকাটা বাহারে যায়নি। (  ঝড়ের জন্য নৌকাটা বাইরে যায়নি।) 
ii.তুমার জানে আইজ নৌকা কিনছি। (তোমার জন্য আজ নৌকা কিনেছি।) 
iii.তোর লাগি কি মরব্যা? ( তোর জন্য কি মরবো?) 

খ.মধ্যে> মাজু /মাঝু /মাঝে —

i.বহুত মাছ জালর বিঁধিছি। (প্রচুর মাছ জালের মধ্যে পড়েছে।) 
ii.মাজু গাঙে  নৌকাটা ডুবি যালা (মাঝ নদীতে নৌকাটা ডুবে গেল।) 
iii. তারে বউটা  মাঝু মাঝু  মাছ কুড়াইতে যায়। (তার স্ত্রী মাঝে মাঝে   মাছ বাছতে যায়।) 

গ. থেকে/হইতে>থাকতে /হোতে /হতে —

i.  তার থাকতে তারে টকাটা বই লিছে। (তার থেকে তার ঘরের ছেলেটা বই নিয়ে গেছে।) 
ii.সৌদিননু তোর সাথে দেখা হয়নি। (সেই দিন থেকে  তোর সাথে দেখা হয়নি।) 
iii.নৌকা হোতে লোকটি পড়িয়ালো। (নৌকা হইতে লোকটি পড়ে গেল।) 
iv.হাটনু আইসিয়া গাধটে। (হাট থেকে এসে স্নান করছে।)  

ঘ,. চেয়ে>চাইতে, পাশে>পাশেরো, ধরতে>ধরিকি—

i.নৌকা পাশর বহুত জাল অছি। (নৌকার পাশে অনেক জাল রাখা আছে।) 
ii.তুমার চাইতে অনুপ ভলাকি জাল ফ্যালে। (তোমার চেয়ে অনুপ জাল  ফেলায়।) 
iii. মাছ ধরি ধরিকি বয়স চালি গেলা। (মাছ ধরে ধরে  বয়স চলে গেল।) 

ঙ. ছেড়ে>ছড়ি দিয়, অবধি>,তক, উপরে>পরি, কাছে>কাছনু /পাখর, প্রতি>লাগি
i.  তুমার লাগি মোর বহুত ভালোবাসা অছি। (তোমার প্রতি আমার অনেক ভালোবাসা আছি।) 
ii.  সমুদ্র পাখর মোর ঘর। (সমুদ্রের কাছে আমার বাড়ি।) 

iii.আজ তক লুকোটা নৌকারো আসেনি। (আজ অবধি লোকটা নৌকায় আসে না।) 
iv.নৌকা পরি যন্ত্র বসায়োঁ অছি। (নৌকার উপরে মেসিন বসানো আছে।) 
v.এ বিপদ সময়রো মোর পাখর কউ নাই। (এ বিপদের সময় আমার পাশে কেউ নেই।) 
vi.আমার কাছনু তুই যে টাকা লিয়ালু,তা কি করলু? (আমার কাছ থেকে তুই যে টাকা নিয়ে গেলি তা কি করলি?)

মান্যচলিত বাংলা ভাষা থেকে এই জেলার কথ্যভাষায়    উপসর্গ ও অনুসর্গের যে  পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্য আছে তা পূর্বমেদিনীপুর জেলার কথ্যভাষা উদাহরণ সহ দেখানো হল। পরবর্তী পর্বে এই জেলার মৎসজীবীদের কথ্যভাষায় বিভিন্ন নামপদ আলোচিত হবে।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments