জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২১/ শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২১

শ্যামল জানা

ভোর্টিসিজম

এই ইজমটি এমনই এক ইজম্, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয় ১৯১৪ সালে, তখনই এর প্রকাশ ঘটেছিল ৷ আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই এই আন্দোলনের সমাপ্তিও ঘটেছিল৷ আধুনিক চিত্রকলার ইংরেজ আঁভাগার্দ আন্দোলন হিসেবে এই ভোর্টিসিজম-এর সূত্রপাত হয় লন্ডন-এ৷ বিশিষ্ট ব্রিটিশ শিল্পী ওয়াইন্ডহ্যাম লেউইস-এর নেতৃত্বে কয়েকজন শিল্পী-সাহিত্যিক মিলে এই আন্দোলন গড়ে তোলেন৷ এর নামকরণ করেছিলেন গ্রুপের সদস্য পৃথিবী বিখ্যাত আমেরিকান কবি এজরা পাউন্ড৷ Vortices বা Vortex মানে ঘূর্ণি বা আবর্ত৷ লেউইস সাংবাদিকদের ব্যাখ্যা করে বলেন এভাবে— প্রকৃতিতে যখন ঘূর্ণাবর্ত শুরু হয়, তখন সেই ঘূর্ণাবর্ত যা কিছু সব টেনে এনে তার কেন্দ্রে নিয়ে আসে৷ সমস্ত শক্তি তখন ঘূর্ণাবর্তের কেন্দ্রে ঘনীভূত হয়৷ আমরা প্রকৃতির এই প্রাসঙ্গিক ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আমাদের গ্রুপের নামকরণ করেছি ভোর্টিসিজম(VORTICISM)৷ এখান থেকেই ভোর্টিসিজম কথাটির উৎপত্তি৷

    ১৯১৪ সালে লেউইস লন্ডনে শিল্পীদের মিটিং করার জন্য একটি আর্ট সেন্টার তৈরি করেছিলেন৷ তার নাম দিয়েছিলেন ‘Rebel Art Centre’৷ লেউইস চেয়েছিলেন এই সেন্টারটিকে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করতে৷ যেন, শিল্পীরা একেবারে খোলামনে তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারেন, আলোচনা করতে পারেন৷ এইখান থেকেই ভোর্টিসিজম-এর সূত্রপাত হয়৷ কিন্তু দুঃখের বিষয়, অন্তর্নিহিত কোনো কারণে কয়েক মাসের মধ্যেই সেটি বন্ধ হয়ে যায়!

    লেউইস-এর এই আন্দোলনের একটি মুখপত্র বা পত্রিকা ছিল৷ যার নাম “ব্লাস্ট”৷ সেখানে লেউইস যুদ্ধংদেহি একটি ইস্তাহার(Manifesto) লিখেছিলেন৷ সেখানে তিনি ব্রিটিশ শিল্প-সংস্কৃতির যে অবক্ষয়, তার সরাসরি সমালোচনা করেছিলেন ও পাশাপাশি শিল্পের সেই সৌন্দর্যের কথা বলেছিলেন, যে সৌন্দর্যের মধ্যে যথাযথভাবে বর্তমান সময়ের প্রতিফলন থাকবে৷ তিনি ‘The New Vortex’ শিরোনামে লিখেছিলেন— এই সময়ের হৃদয়ে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়ে আমরা জন্ম দিতে চাই এক নতুন জীবন্ত বিমূর্ততা(plunges to the heart of the Present – we produce a New Living Abstraction)৷ এই শিল্প-বিপ্লবের ফলে মানুষের জীবনে যে অভিনবত্ব, যে নগরায়ন, তার পক্ষে গুণগান গাইল ভোর্টিসিস্টরা৷ আর সরাসরি বাতিল করে দিল বৃটিশ শিল্পকলার ঐতিহ্য৷ বিশেষ করে গ্রাম্য ল্যান্ডস্কেপ, মনুষ্য শরীরের নগ্নতা৷ সেই আধুনিক সময়কে চুম্বক করে “ব্লাস্ট” পত্রিকার সামগ্রিক ডিজাইন প্রস্তুত করা হয়েছিল৷ যার প্রচ্ছদ ছিল উজ্জ্বল গোলাপী রঙের৷ সেখানে পত্রিকার নাম ছাড়া কোনো কর্মসূচি বা আর অন্য কিচ্ছু লেখা ছিল না! আর পত্রিকার নামটিও ছিল ব্যাঁকা করে সাজানো৷

    প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে৷ এর ঠিক একটু আগে জুন মাসে “ব্লাস্ট”-এর প্রথম সংখ্যা বেরয়৷ দ্বিতীয়টি আরও জাঁকজমকভাবে বিশেষ “যুদ্ধ সংখ্যা” হিসেবে প্রকাশ পায় ১৯১৫ সালের জুলাই মাসে৷
এই যে এতকিছু, তা সত্ত্বেও বলা যায় মূলত ফিউচারিজম্ ও পোস্ট ইম্প্রেশনিজম-এর বিরুদ্ধে আন্দোলনস্বরূপই এই ভোর্টিসিজম্-এর জন্ম হয়েছিল৷ এদের সম্পর্কে তখন বলা হত— প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মানুষের দ্বারা মানুষের যে আকস্মিক চরম সর্বনাশ ঘটানো হল, তার নগ্ন রূপের দৃশ্যত সাক্ষীস্বরূপ এই ভোর্টিসিজম৷ সে জন্যই এঁরা এঁদের ছবিতে প্রাকৃতিক দৃশ্য (Landscape)ও নগ্নতা (Nudity) পরিহার করেছিলেন৷ এই ভোর্টিসিজম্-এর উদ্দেশ্য ছিল— শিল্প বিপ্লবের ফলে যে নতুন ও শক্তিশালী আধুনিক বিশ্ব গড়ে উঠল, সেই নতুন শক্তিকে ছবির মাধ্যমে ধরা৷ যন্ত্র উৎপাদিত যে পণ্য, তাকে প্রশংসা করা, ও তার ফলে যে নতুন নগরায়ন, তাকে উদযাপন করা৷ এঁদের ছবির বৈশিষ্টচিহ্ন হল— তীক্ষ্ণ বিমূর্ত রূপের মধ্যে উপস্থিত সাধারণভাবে অস্পষ্ট এবং যন্ত্রবৎ মনুষ্যশরীর৷ তবে এর শৈলী বা আঙ্গিক কিন্তু মৌলিক নয়৷ মূলত কিউবিজম্ ও এক্সপ্রেশনিজম-এর মেলবন্ধনই ভোর্টিসিজম-এর আঙ্গিক বলা যায়৷ এদের সম্পর্কে তখন বলা হত— এরা কিউবিজম, ফিউচারিজম, ও এক্সপ্রেশনিজম্-এর বিকল্প অথচ একটি স্বাধীন ইজম্৷

    তখন মহাদেশীয় ইয়োরোপে(Continental Europe) কিউবইজম-এর যে আধিপত্য, তার দ্বারা আংশিকভাবে হলেও অনুপ্রাণিত হয়েছিল এই ভোর্টিসিজম৷ শুধু তাইই নয়, যে ফিউচারিজমকে নিন্দা ও সমালেচনা করেছিল স্বয়ং ওয়াইন্ডহ্যাম লেউইস, যিনি এই ফিউচারিজম-এর বিকল্প দর্শন হিসেবে ভোর্টিসিজম-এর জন্ম দিয়েছিলেন বাধ্যতামূলকভাবে, সেই ফিউচারিজম-এরও কিছু বৈশিষ্ট ভোর্টিসিজম-এর ছবিতে থেকে গেছিল! এই সব মিলিয়ে তাঁরা ছবি আঁকার একটি নির্দিষ্ট শৈলী বা প্রকরণ তৈরি করেছিল৷ সেটি হল— দুঃসাহসিক রং(Bold colours), কর্কশ লাইন, ও তীক্ষ্ণ বা ধারালো কোণ! এগুলির সাহায্যে তাঁরা সম্পূর্ণ একটি জ্যামিতিক ছাঁদের ছবির জন্ম দিত (ছবি-২)৷

 যা কিনা অনেকটাই বিমূর্ত ছবি হিসেবেও গণ্য করা যায়! এবং কিউবিস্টরা যেমন বাস্তবতাকে কিউবের মাধ্যমে ভেঙে খণ্ডিত করে দেখাতো, এরাও ছবিতে সেইভাবে বাস্তবতাকে খণ্ডিত করত জ্যামিতিক গঠনের মাধ্যমে৷ আর বিষয়ের দিক থেকে বলতে গেলে— একটি বৃহৎ বস্তুর তলায়, ঠিক কেন্দ্রস্থলে, একটি পিন রেখে যেভাবে ওই বৃহৎ বস্তুকে ব্যালান্সে ঘোরানো যায়, ঠিক সেভাবে ভোর্টিসিজম-এর আঁকার উদ্দেশ্যের তলদেশে পিনের মতো কাজ করেছিল নতুন শিল্পবিশ্বের যান্ত্রিক যুগ!  (ক্রমশ)


আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. ভোর্টিসিজম আর এক অধ্যায়।
    চিত্র শিল্পের এই ভুলভুলাইয়াতে
    শ্যামল জানা যেন গাইডের মতো
    কাজ করে চলেছে। পড়ছি মুগ্ধ
    বিস্ময়ে। অনুধাবন করার চেষ্টা
    করছি, এই সামগ্রিক লেখাটিই
    যখন অনিসন্ধিৎসু শিল্পীর হাতে
    পড়বে তার বিশ্ব-দর্শন ঘটবে।
    অসাধ্য সাধন করে চলেছেন লেখক।

    ReplyDelete