জ্বলদর্চি

পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং বোসন পরিবার / পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ― ০৫

পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং বোসন পরিবার 

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


একবার দিল্লি বেড়াতে এসেছেন বিজ্ঞানী সুব্রক্ষণ্যম চন্দ্রশেখর। তার আগেই 'চন্দ্রশেখর লিমিট' আবিষ্কারের জন্য তিনি বেশ বিখ্যাত। তথাকথিত মাঝারি থেকে ছোট নক্ষত্র ব্ল্যাকহোলে পরিণত হলে প্রয়োজনীয় ব্যাসের মাপ কত হওয়া বাঞ্ছনীয়, সেটার গণনালব্ধ মানই চন্দ্রশেখর লিমিট। তো, দিল্লি এসে এক বিচিত্র ঘটনার সাক্ষী হলেন তিনি। একদিন কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড রিসার্চ-এর ডিরেক্টরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ করার কথা। সেদিন অফিসে পৌঁছে তিনি দেখেন আরও একজন মহান ব্যক্তি ডিরেক্টরের সাক্ষাৎপ্রার্থী। এমন একজন যশস্বী ব্যক্তিকে বসিয়ে রেখে চন্দ্রশেখরকে ডাকা হল ঘরে। চন্দ্রশেখর মনে মনে হাসলেন এবং সেদিনই বুঝে গেলেন, ভারতে প্রতিভার কদর নেই; বরং অধিক গুরুত্ব পায় কে কার কতটা প্রিয়! তারপর ইন্দিরা গাঁন্ধীর বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও আমেরিকা ছেড়ে ভারতে ফিরতে সম্মত হননি চন্দ্রশেখর। এখন প্রশ্ন হল, কে সেই মহান ব্যক্তি? যাঁর প্রতি বঞ্চনার দৃশ্য স্মরণ করে ভারতে না-ফেরার পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন চন্দ্রশেখর!

   আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের শুভলগ্নের সূচনাকাল ধরা হয় উনবিংশ শতাব্দীর নয়ের দশক। এই কালজয়ী সময়ে আবিষ্কার হয়েছিল একগুচ্ছ বৈজ্ঞানিক ঘটনা― এক্স-রশ্মি (১৮৯৫), তেজস্ক্রিয়তা (১৮৯৬), প্রথম মৌলিক কণিকা ইলেকট্রন (১৮৯৭)। ঠিক তার পূর্ব মূহুর্তে ব্রিটিশ শাসনাধীন ক্যালকাটার (অধুনা কলকাতা) আকাশ আলো করে আবির্ভাব ঘটেছিল অখণ্ড বাংলা ও বাঙালির এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক― পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, উপরে উল্লেখিত সেদিনের বঞ্চিত নায়ক। আসলে সারাটা জীবন তিনি ছিলেন 'বঞ্চিতের, হতাশের দলে'। কেননা, তাঁর আবিষ্কারের সূত্র ধরে একের পর এক পণ্ডিত পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেল, অথচ তাঁর ভাগ্যে জুটল কি-না হরি-মটর!

   বাঙালি কায়স্থ পরিবারে এ হেন মানুষটির জন্ম ১-লা জানুয়ারি ১৮৯৪ সালে, উত্তর কলকাতার গোয়াবাগান অঞ্চলে স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলের পাশে ২২ নম্বর ঈশ্বর মিত্র লেনে। পিতা সুরেন্দ্রনাথ বসু ইষ্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের হিসাবরক্ষক। মাতা আমোদিনী দেবী ছিলেন আলিপুরের খ্যাতনামা উকিল মতিলাল রায়চৌধুরীর কন্যা। পিতামাতার সাত সন্তানের সবচেয়ে বড় একমাত্র পুত্র সন্তান তিনি। অবশ্য তাদের আদি পৈত্রিক ভিটা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত নদিয়া জেলার বড়োজাগুলিয়া গ্রামে। শৈশবের প্রথম অধ্যায় ধূলি ধূসরিত পল্লীর সোনার মৃত্তিকায় অতিবাহিত হয়। গ্রামে বাড়ির কাছে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে আর পাঁচটা সাধারণ বাড়ির ছেলের মতো নর্মাল স্কুলে তাঁর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। অব্যাহতি পরে সপরিবার কলকাতার গোয়াবাগানে স্থানান্তরিত হয়। পুনরায় ছোট্ট সত্যেনকে 'দ্য নিউ ইন্ডিয়ান স্কুল'-এ ভর্তি করানো হয়। সেখান থেকে শেষ বছরে বিখ্যাত হিন্দু স্কুলে ভর্তি করা হল। ছোটবেলা থেকেই তীক্ষ্ম বুদ্ধির অধিকারী। বিশেষ করে গণিতে তাঁর তীব্র মেধার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। স্কুলের পরীক্ষায় একবার তাঁর শিক্ষক উপেন্দ্রনাথ বক্সী তাকে ১০০-র মধ্যে ১১০ দিয়েছিলেন অঙ্কে। তীব্র মেধাবী সত্যেন হিন্দু স্কুল থেকে ১৯০৯ সালে পঞ্চম স্থান পেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের অন্তর্বর্তীকালীন বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে আই. এস. সি. পাশ করেন প্রথম হয়ে।

   এই প্রেসিডেন্সি কলেজে তখন বিরাজ করছেন খ্যাতনামা সব অধ্যাপকগণ― স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সারদা প্রসন্ন দাস, নমন শর্মা প্রমুখ। এমন সব খ্যাতিমান অধ্যাপকগণের সান্নিধ্য কিশোর সত্যেন্দ্রনাথকে বিজ্ঞানের প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত করে তোলে। শুধু তাই নয়, এখানে বিজ্ঞানের আরেক নক্ষত্র মেঘনাদ সাহাকে সহপাঠী হিসেবে কাছে পেলেন। আজীবনকাল তাঁদের সে-বন্ধুত্ব অটুট ছিল। বিজ্ঞানের প্রতি অসম্ভব টান থেকেই প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে মিশ্র (ফলিত) গণিতে ১৯১৩ সালে প্রথম স্থানসহ গ্র্যাজুয়েশন পাস করেন তিনি, দ্বিতীয় মেঘনাদ সাহা। শুধু তাই নয়, মাস্টার ডিগ্রির পরীক্ষায় দুজনের এমন ফলাফল আবার পুনরাবৃত্ত হয়। গ্র্যাজুয়েটে সফল হবার পর মাস্টার ডিগ্রিতে ভর্তি হলেন ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী সত্যেন্দ্রনাথ। সেখানেও মিশ্র (ফলিত) গণিতে প্রথম স্থান নিয়ে মাস্টার ডিগ্রির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন ১৯১৫ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের M.Sc. বিভাগে তার প্রাপ্ত নম্বর ইতিহাস তৈরি করে যা আজ পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ। 
           
   এই সময়ে বাংলা নবজাগরণের এক পথিকৃৎ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতার রাজাবাজারে 'ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্স'-এর ভিত্তিস্থাপন করেন ১৯১৪ সালের ২৭-শে মার্চ। বর্তমানে এই কলেজ রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ নামে অধিক পরিচিত। লক্ষ্য ছিল আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের তত্ত্বাবধানে রসায়ন শাস্ত্র পঠন গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলা। কিন্তু সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহার মতো সেসময়ের বেশ খ্যাতনামা কিছু তরুণ ছাত্র আর্জি ধরলেন সেখানে বিজ্ঞানের অন্যান্য সব বিষয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণী খুলতে হবে। এর মাঝে ১৯১৫ সালে মেঘনাদ সাহার সঙ্গে সত্যেন বসু বিজ্ঞান কলেজে মিশ্র গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা শুরু করেছেন। মাসিক বৃত্তি ১২৫ টাকা। তাদের সম্মিলিত আবদারে কাজ হল। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় একদিন ওই ছাত্রদের ডেকে বললেন, 'তোরা কি পড়াতে পারবি?' গবেষণার পাশাপাশি স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করার অঙ্গীকার করল তারা। এক বছরের মধ্যে নিজেদের তৈরি করার জন্য মেঘনাদের উপর ভার পড়ল কোয়ান্টাম বাদ দিয়ে পড়াশোনার আর সত্যেন্দ্রনাথ পড়াবেন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব।

   ১৯১৭ থেকে শুরু হল রসায়ন ছাড়াও মিশ্র গণিতের স্নাতকোত্তর ক্লাস। ততদিনে ড. দেবেন্দ্রমোহন বসু যোগ দিয়েছেন বিজ্ঞান কলেজে। অত্যুৎসাহী সত্যেন বসুকে তিনি কিছু বই পড়তে দিলেন। সমস্যা দেখা দিল, অধিকাংশ বই হয় জার্মান নতুবা ফরাসি ভাষায় লেখা। অনোন্যপায় হয়ে সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ দুজনে শুরু করলেন জার্মান ও ফরাসি ভাষা চর্চা। অল্প দিনে পারদর্শী হয়ে উঠলেন তাতে। এবার জার্মান ভাষায় লেখা প্রবন্ধগুলি সরাসরি ইংরেজিতে অনুবাদ করতে চাইলেন ছাত্রদের স্বার্থে। তখন আইনস্টাইন ও মিঙ্কোয়াস্কির জার্মান প্রবন্ধগুলোর ইংরেজি অনুবাদের কপিরাইট ছিল ইংল্যান্ডের মিথুয়েন কোম্পানির হাতে। তারা অনুবাদের অনুমতি দিল না। অগত্যা আইনস্টাইনকে চিঠি লিখলেন শ্রীবসু। একটি শর্তে মিলল সে-অনুমতি― অনুদিত প্রবন্ধটির প্রচার কেবল ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সেই মোতাবেক সত্যেন্দ্রনাথের ইংরেজি অনুবাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাপে ছোট্ট পুস্তিকা আকারে, ভূমিকা লিখলেন অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ। স্নাতকোত্তরে অধ্যাপনার পাশাপাশি চলল তাঁর গবেষণা।

   এভাবে ১৯১৮ সালে মেঘনাদ সাহার সঙ্গে মিলিতভাবে তিনি লন্ডনের বিখ্যাত জার্নাল 'ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিন'-এ একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন 'On the Influence of the finite volume of molecules on the equation of state'। গ্যাসের আয়তন, চাপ ও উষ্ণতার মধ্যে যে সম্পর্ক, তা কীভাবে গ্যাসের আয়তন দ্বারা প্রভাবিত হয় এই ছিল বিষয়। এ হেন সম্পর্কটি পরবর্তীকালে 'সাহা-বসু ইক্যুয়েশন অব স্টেট' নামে পরিচিত হয়। ১৯২০-তে ওই ম্যাগাজিন কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভিত্তিতে বর্ণালী বিশ্লেষণের ওপর আরও একটি আর্টিকেল ছাপে তাঁর।
              এই সময়ে শ্রীবসুর জীবনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ১৯২১ সালে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। অক্সফোর্ড-কেমব্রিজের আদলে। এ হেন প্রতিষ্ঠানের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর সুদক্ষ শাসক ও প্রকৃত গুণগ্রাহী ফিলিপ জোসেফ হার্টগ। বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম সারিতে উন্নীত করতে গুণী শিক্ষকের খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করে দিয়েছেন হার্টগ সাহেব। সেজন্য এসেছেন কলকাতায়। তখন ছাত্রদের মুখে মুখে ঘুরছে সত্যেন বসুর পড়ানোর সুখ্যাতি। হার্টগ সাহেব ডেকে পাঠালেন সত্যেন্দ্রনাথকে। এর মাঝে অনেক জল বয়ে গেছে হুগলি নদীর বুক চিরে। ১৯২০-তে 'সাহা আয়নন সূত্র' আবিষ্কার করে মেঘনাদ সাহা তখন রীতিমত বিখ্যাত। সেদিক থেকে তিনি খানিকটা অখ্যাত। তাছাড়া এতদিন তিনি কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজও করেননি যেমন মেঘনাদ সাহা করেছেন। একদিকে উন্নত মানের কাজের হাতছানি ও অন্যদিকে বিদেশে গবেষণা করার তীব্র ইচ্ছা― এ দুয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় 'পালিত বৃত্তি'র জন্য আবেদন জানালেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। বিবাহিত হওয়ার কারণে তার আবেদন নাকচ হয়ে যায়। অনেক আগে ১৯১৪ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে সত্যেন্দ্রনাথ এগারো বছরের কিশোরী উষাবতী ঘোষকে বিয়ে করে ফেলেছেন। তাই সে-যাত্রায় বিদেশে যাওয়া হল না। তবে হার্টগ সাহেবের নেকনজরে থেকে বিদেশ যাত্রার অতি ক্ষীণ সুপ্ত আশা নিয়ে ১৯২১ সালের মে মাসে ঢাকায় এলেন সত্যেন্দ্রনাথ। ইউনিভার্সিটির রিডার পদে নিযুক্ত হলেন। প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে উঠে শুরু হল কঠিন অধ্যাবসায়। তার-ই ফসল চার পাতার একটি প্রবন্ধ 'Planck's Law and Light Quantum Hypothesis'। পাঠিয়ে দিলেন ইংল্যান্ডের ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে। সেখান থেকে কোনও মন্তব্য এল না। অগত্যা নিবন্ধটি অ-দৃষ্ট আইনস্টাইনকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯২৪ সালের ৪-ঠা জুন।
           

   প্রবন্ধটি পড়ে তার গুণগত মান উপলব্ধি করলেন আইনস্টাইন। অসাধারণ বৈভবপূর্ণ আর্টিকেলটি তিনি প্রথমে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। তারপর নিজের একটি ফুটনোটসহ সেটি ছাপতে পাঠিয়ে দেন বিখ্যাত 'Zeitschrift fur Physik' সাময়িকীতে, সে-বছর জুলাই মাসে। প্রবন্ধটি প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তেজস্ক্রিয়তা নীতি ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়াই প্রতিপাদন করে এবং সদৃশ আলোক কণার সাহায্যে দশার সংখ্যা গণনার একটি চমৎকার উপায় উদ্ভাবন করে। আইনস্টাইন আলোককণার বদলে ওই সংখ্যায়ন প্রয়োগ করেন পদার্থকণায় যাকে এখন বসু গ্যাস বলা হয়। এ হেন পরিসংখ্যানই পরবর্তীকালে 'বসু-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন' নামে পরিচিতি লাভ করে। সত্যেন্দ্রনাথের আবিষ্কৃত প্রবন্ধের রেস ধরে আইনস্টাইন আরও দুটি আর্টিকেল লেখেন।

বসু-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন (Bose Einstein Statistics) কী?

   কোন সময়ে একটি কণার অবস্থান, তা থেকে তার গতিবেগ, ভরবেগ ও কণার সঞ্চারপথ জানা যায় নিউটনীয় বলবিদ্যার সাহায্যে। কিন্তু যেখানে বহুসংখ্যক কণার সমাবেশ, সেখানে তাদের সবার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করা নিউটনীয় বলবিদ্যায় অসম্ভব। তার জন্য চাই সংখ্যায়নিক পদ্ধতি। সংখ্যায়নিক পদ্ধতি হল বহুসংখ্যক কণিকা সমাবেশে তাদের আচরণ নির্ধারণ করা এবং বহুসংখ্যক শক্তিস্তরে তাদের নীতি ভিত্তিক বন্টন বা বিন্যাস। যেমন ধরা যাক, তিনটি শক্তিকক্ষে দুটি কণার সম্ভাব্য বিন্যাস কেমন হবে? কণাদুটির প্রকৃতির উপর নির্ভর করে বন্টন সংখ্যা। কণাদুটি সদৃশ (Identical) হলে এবং আর কোনও শর্ত আরোপিত না হলে বিন্যাস সংখ্যা হবে ছয়। কীভাবে? মনে করি, দুটি কণা a এবং b। a ও b কণাদুটি একসঙ্গে একবার প্রথম কক্ষে (তখন দ্বিতীয় ও তৃতীয় কক্ষদুটি ফাঁকা থাকে), তারপর দ্বিতীয় কক্ষে (তখন প্রথম ও তৃতীয় কক্ষ ফাঁকা) ও শেষে তৃতীয় কক্ষে (তখন প্রথম ও দ্বিতীয় কক্ষ ফাঁকা) থাকতে পারে। এখানে বিন্যাস সংখ্যা হল তিন। আবার, a কণাটি প্রথম কক্ষে ও b কণাটি দ্বিতীয় কক্ষে (তখন তৃতীয় কক্ষ ফাঁকা); a কণাটি প্রথম কক্ষে ও b কণাটি তৃতীয় কক্ষে (তখন দ্বিতীয় কক্ষ ফাঁকা); a কণাটি দ্বিতীয় কক্ষে ও b কণাটি তৃতীয় কক্ষে (তখন প্রথম কক্ষ ফাঁকা) অবস্থান করলে বিন্যাস সংখ্যা হবে তিন। এখন কণাদুটি সদৃশ (অর্থাৎ দুটোই যদি a ও a হয়) হওয়ায় উপরের নিয়মে তিনটি শক্তিস্তরে দুটি পারটিকেলের মোট বিন্যাস সংখ্যা হবে ৬। কণাদুটি অ-সদৃশ হলে বন্টন সংখ্যা হত ১২। কক্ষ ও কণাসংখ্যা বাড়লে বিন্যাস আরও জটিল ও কঠিন আকার ধারণ করে। সুতরাং একটি সংস্থার বিভিন্ন কোয়ান্টাম শক্তি স্তরে এ রকম বহুসংখ্যক সদৃশ কণিকার বিন্যাস হল বসু-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন (B.E. Statistics)। বিশ্বজগতের যে কণাগুলির স্পিন পূর্ণসংখ্যা (০, ১, ২, ৩ ইত্যাদি), তারা বসু-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন নীতি মেনে চলে। স্পিন হল গতির অভিমুখে বা তার বিপরীত দিকে নিজ অক্ষের চারদিকে একটি কণার আবর্তন। এ হেন পূর্ণসংখ্যার স্পিন কণিকাগুলিকে শ্রীবসুর নামে বিজ্ঞানী পল ডিরাক নামকরণ করেন 'বোসন'। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ বিনিময়কারী কণা ফোটন; মহাকর্ষ তরঙ্গের কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটন; তীব্র নিউক্লিয় বল সংযোগকারী গ্লুয়ন কণা; মৃদুবল অদলবদলের জন্য দায়ী তিনটি কণা ডব্লিউ প্লাস, ডব্লিউ মাইনাস ও জেড জিরো হল বোসন গ্রুপের কণা। এছাড়াও বোসন কণার উদাহরণ হল পাই-মেসন বা পায়ন (পাই প্লাস, পাই মাইনাস, নিউট্রাল পাই), কে-মেসন বা কেয়নস (নেগেটিভ কেয়ন, নিউট্রাল কেয়ন), ইটা-জিরো মেসন ইত্যাদি এবং তাদের অ্যান্টিপারটিক্যাল। 

   বসু-আইনস্টাইন সংখ্যায়নের এই ধারণাটি আইনস্টাইন প্রয়োগ করলেন পরমাণুতে। প্রতিপাদ্য হিসাবে উদ্ভব হল নতুন প্রপঞ্চ যা বসু-আইনস্টাইন ঘনীভবন (Bose Einstein Compensate) নামে পরিচিত। এটি আসলে বোসন কণিকার একটি ঘনীভূত স্যুপ। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে এক পরীক্ষায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। 
            
বসু-আইনস্টাইন ঘনীভবন কী? কেমন সেই অবস্থা?

   বহুসংখ্যক কণা সমন্বিত একটি সংস্থার শক্তিকক্ষের সংখ্যা, তত্ত্বগতভাবে, অসীম। সাধারণ ঘরের তাপমাত্রায় (২৭℃ বা ৩০০ °K) তাপীয় উত্তেজনার জন্য একটি ভৌম শক্তিস্তরে (Ground Energy Level যা সর্বনিম্ন শক্তিস্তর) বা উদ্দীপ্ত কক্ষে (Excited State) এক বা তার বেশি বোসন কণা অবস্থান করতে পারে। আবার কোন কক্ষ ফাঁকা থাকতেও পারে। শক্তি বেশি হলে বোসনগুলি উচ্চ শক্তিস্তরে থাকবে; নতুবা শক্তি কম হলে নিম্ন শক্তিস্তরে অবস্থান করবে। এখন উষ্ণতা ক্রমাগত হ্রাস করলে বোসনগুলির শক্তিও ক্রমশ কমতে থাকে। তারা তখন উচ্চ শক্তি স্তর থেকে লাফ দিয়ে তুলনামূলক নিম্ন শক্তি কক্ষে অবস্থান করতে বাধ্য হয়। 
           
   বসু-আইনস্টাইন ঘনীভবন অবস্থা হল পদার্থের একটি অবস্থা যখন তরলীভূত বোসন গ্যাস পরম শূন্য তাপমাত্রার খুব কাছাকাছি তাপমাত্রায় (অর্থাৎ ০°K বা –২৭৩.১৫ ℃ উষ্ণতার খুব কাছে) ঠাণ্ডা করা হয়। এই অবস্থায় বোসনের একটি বৃহৎ অংশ সর্বনিম্ন কোয়ান্টাম অবস্থা (Ground State) দখল করে, এবং এই মূহুর্তে ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম ঘটনা (যেমন আয়তন, চাপ, উষ্ণতা, এনট্রপি ইত্যাদি) স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত লঘু ঘনত্বের গ্যাসকে (সাধারণ গ্যাসের ঘনত্বের এক শত-সহস্রাংশ) অতি কম তাপমাত্রায় ঠাণ্ডা করে এটি তৈরি করা হয়। এ হেন বসু-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন ও বসু-আইনস্টাইন ঘনীভবন বিশ্বের প্রতিটি কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে বছরের পর বছর পড়ানো হচ্ছে।

   শুধু তাই নয়, বসু-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন, বসু-আইনস্টাইন ঘনীভবন ও বোসনের উপর গবেষণা করে বিভিন্ন বিজ্ঞানী পদার্থবিজ্ঞানে সাত সাত বার নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে কার্লো রুবিয়া ও সাইমন ভ্যান ডার মির; ১৯৯৬ সালে ডেভিড লি, ডগলাস ওসেরফ ও রবার্ট রিচার্ডসন; ১৯৯৯ সালে মার্টিনাস ভেল্টম্যান ও জেরার্দাস হফ্ট; ২০০১ সালে এরিক অ্যালিন করনেল, কার্ল এডুইন উইম্যান ও উল্ফগ্যাঙ্গ কেটার্লে; ২০১৩ সালে পিটার হিগস, কিপ থর্ন ও এ্যংলার্ট; আরও অনেকে। অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি রয়ে গেলেন নোবেলের বাইরে। আরও অবাক হতে হয় যখন দেখি ১৯৫৬, ১৯৫৯, ১৯৬২-তে তাঁর নাম নোবেলের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল, অথচ যখন আইনস্টাইন নোবেল কমিটির সদস্য, তখন সদস্য থাকাকালীন এক বারের জন্যও শ্রীবসুর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য তিনি সুপারিশ করেনি!

   অবশ্য কোনকালেই শ্রীবসু স্বীকৃতির প্রত্যাশা করেননি। বরং শুধু বাঙালি বা ভারতবাসী নয়, সমগ্র বিশ্ববাসী এখন একবাক্যে তাঁর কৃতিত্ব স্বীকার করে। এমনকি নোবেল কমিটিও তাঁর মৃত্যুর পর তাদের ভুল বুঝতে পেরে স্বীকার করেছে শ্রীবসুকে নোবেল পুরস্কার না-দেওয়া তাদের চরম ব্যর্থতা ছিল। 

   তবে একটি বিষয়ে আইনস্টাইনকে কৃতিত্ব দিতেই হবে। কেননা, তাঁর সহায়তা ছাড়া পরিসংখ্যান বিষয়ক আর্টিকেল জার্মানির পত্রিকায় প্রকাশ পেত না। উক্ত প্রবন্ধটিই বসুকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দেয়। পাশ্চাত্য দেশ, বিশেষত ইউরোপ ভ্রমণের তাঁর দীর্ঘদিনের সুপ্ত দরজাও খুলে যায়। ছুটি মঞ্জুর করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২৪ সালের শেষার্ধে তিনি ইউরোপ পাড়ি দিলেন। সেখানে প্রথম এক বছর দু'বার নোবেল জয়ী ম্যারি কুরীর সঙ্গে ফ্রান্সে কাজ শুরু করেন। কুরীর ল্যাবরেটরিতে কাজ করার স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা সুখের হয়নি, তাকে তার ভবিষ্যৎ কাজের অনুপ্রেরণা জোগায়নি। বরং হতোদ্যমই করেছে বলা যায়। তা নাহলে তিনি কেন বললেন, 'I was not really in Science any more'! 

   তারপর ১৯২৫-এর শেষে আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর বহু প্রতিক্ষিত সাক্ষাৎ ঘটল। তিনি খুব 'Excited'। সেই ছাত্রাবস্থা থেকে চিঠিতে (এমনকি সাক্ষাতেও) আইনস্টাইনকে তিনি 'শ্রদ্ধেয় শিক্ষক' সম্বোধনে আপ্যায়িত করেছেন। আইনস্টাইনের সঙ্গে একসাথে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এতদসত্ত্বেও এত তাড়াতাড়ি তিনি হারিয়ে গেলেন কেন? বসু-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন, কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি, স্পিন ধারণা― মাত্র এই ক'টা ক্ষেত্রে অবদানের পর আর কোনও মৌলিক গবেষণা বা আবিষ্কার তাঁর হাত ধরে কেন এল না?
          
   পাশ্চাত্য বিজ্ঞানী মহলের সংকীর্ণ মানসিকতার স্থুল বহিঃপ্রকাশ, এমনকি তাঁর সঙ্গে আইনস্টাইনের একসঙ্গে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ বসুকে ভীষণভাবে হতাশাগ্রস্থ করে দিয়েছিল। এই হতাশাই তাঁর বাকি জীবনকে নিস্ক্রিয় করে রেখে দেয়। অথচ বসুর প্রতিভা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ দিতে পারতেন আইনস্টাইন।

   একরাশ খারাপ অভিজ্ঞতা নিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে ১৯২৬-এ সত্যেন বসু ভারতে ফিরে এলেন। দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের দিকে মনোনিবেশ করলেন। ১৯৪৫ সাল অব্দি এখানে কাটিয়ে দেশভাগ আসন্ন হওয়ায় কলকাতায় ফিরে এলেন। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৬ সাল অবধি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'খয়রা' অধ্যাপক হয়ে, হয়েছিলেন বিজ্ঞান বিভাগের 'ডিন'। ১৯৫৮ সালে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি অবশেষে তাঁকে ফেলো নির্বাচিত করল।
             

   ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি ১৯৫৬ ― ১৯৫৮ পর্যন্ত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ অলংকৃত করেন। ভারত সরকার ১৯৫৯ সালে তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করে। ১৯২৯-এ ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের পদার্থবিজ্ঞান শাখার সভাপতি এবং ১৯৪৪ সালে ঐ কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দেশীকোত্তম ও ভারত সরকার পদ্মবিভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে।

   আক্ষরিক অর্থে, তিনি ছিলেন 'ডায়নামিক'। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। শ্রীবসু বাঙালির প্রিয় 'আড্ডা' মারতে খুব ভালবাসতেন। ২০–২১ বছর বয়স থেকে তিনি ভালো এস্রাজ বাজাতেন, ভালো দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।

   বিভিন্ন বৈপ্লবিক সংগঠন অনুশীলন সমিতি, বয়েজ ওন লাইব্রেরি, দিনমজুরদের নৈশবিদ্যালয় 'ওয়ার্কিং মেনস্ ইনস্টিটিউট', বিপ্লবী অবনী মুখার্জিকে জার্মানিতে টাকা পৌঁছে দেয়া থেকে মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা― সবকিছুর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তিনি। তিনি প্রায়শই বলতেন, ' যাঁরা বলেন বাংলাভাষায় বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব নয়, তাঁরা হয় বাংলা জানেন না, নয় বিজ্ঞান জানেন না'।
              

   বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর নেতৃত্বে কলকাতায় ১৯৪৮ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রথম ভারতীয় প্রয়াস 'বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ' গঠিত হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনে একবারই বিজ্ঞান বিষয়ে একটি পুস্তক রচনা করেছিলেন ১৯৩৭ সালে এবং সেটি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে উৎসর্গ করেছিলেন। ভারত সরকার ১৯৯৪ সালে তাঁর নামে একটি ডাকটিকিট প্রবর্তন করে। সবশেষে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মহান বিজ্ঞানী ১৯৭৪ সালের ৪-ঠা ফেব্রুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। এই মহান বিজ্ঞানীকে আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা, ভূমিষ্ট প্রণাম ও অন্তহীন ভালোবাসা জানাই।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments