জ্বলদর্চি

বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্কপর্ব -৯/ অসীম ভুঁইয়া

Bengali grammar and debate
বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক
পর্ব ৯

অসীম ভুঁইয়া

বিশেষ্য - শব্দের ঝাড়বাতি 

আজকের আলোচনায় আরো একটি ঝামেলার বিষয় উঠে আসবে। বিষয়টি আর কিছুই নয়, বিশেষ্যশব্দ মাত্র।

   শব্দ সম্পর্কে কম-বেশি আলোচনা আগেই হয়েছে। তাই এবার পদের প্রাথমিক আলোচনাটা একটু সেরে নিতে চাই। তারপর মূল বিষয়ে ঢুকে যাব। তাহলে দেখা যাক, শব্দ কীভাবে পদে পরিণত হয়। অর্থাৎ শব্দের ধারণা থেকেই আমাদের পদের ধারণা তৈরি হবে।

    বিশ্লেষণ করা যাক। কয়েকটি  শব্দ নিলাম। স্কুল, অনুষ্ঠান, মঞ্চ, শুরু,সে, গা: এই  ৬ টি ধ্বনিসমষ্টির প্রথম পাঁচটি শব্দ এবং শেষটি একটি ধাতু।
 "স্কুলের অনুষ্ঠান মঞ্চে সে শুরুতে গাইল।" 
প্রতিটি শব্দ বা ধাতুর সঙ্গে কিছু না কিছু বিভক্তি যুক্ত হয়েছে। যেমন  স্কুল + এর, অনুষ্ঠান+ শূন্য, মঞ্চ+এ, সে+শূন্য, শুরু+তে, গা + ইল।  বিভক্তিযুক্ত এই শব্দ বা ধাতুই পদ, যা অবশ্যই বাক্যে ব্যবহৃত হয়। 

   একটি বিষয় লক্ষ করার, "অনুষ্ঠান"  ও "সে" শব্দটির সঙ্গে আপাতভাবে কোনো বিভক্তি যুক্ত নেই। কিন্তু শব্দ, বাক্যে ব্যবহৃত হলেই তা বিভক্তিযুক্ত হয়। তাই এক্ষেত্রে শূন্য বিভক্তি কথাটা চালু আছে। আসলে সংস্কৃত বাক্য- গঠনরীতিতে বিভক্তির প্রাধান্য ছিল। বাংলা বাক্য কিছুটা সংস্কৃত অনুসারী হলেও এখন আধুনিক বাংলা অনেক আপডেট হয়েছে। তাই বাংলা বাক্য বিভক্তি ছাড়াও নির্মাণ করা যায়। বরং তা আরও সহজ ও বৈচিত্র্যময় হয়। যেহেতু আপাত বিভক্তিহীন পদের অন্তরালে অদৃশ্যভাবে বিভক্তিরই হাত রয়েছে, তাই বিভক্তি কথাটি বলা হয়ে থাকে। আর তার আগে শূন্য  লাগিয়ে করা হয়, শূন্য বিভক্তি। তবে এই বিভক্তিহীনতাকে বাংলা বাক্য সংগঠনের আপডেট ধরে, শূন্য বিভক্তি না বলে বিভক্তিহীন বলাই সঙ্গত বলে আমরা মনে করি।

   আজ আমরা বিশেষ্যপদ নিয়ে আলোচনা করব। তবে একটি বিষয় বলে নেওয়া ভালো। চালু ব্যাকরণে যাদের আমরা বিশেষ্যপদ, বিশেষণপদ, সর্বনামপদ প্রভৃতি বলে চালাচ্ছি, তারা তো আসলে শব্দই। চালু ব্যাকরণে কেন যে এদের পদ বলে কী জানি? এরা তো বিশেষ্যশব্দ, বিশেষণশব্দ, সর্বনামশব্দ :  এভাবে আলোচিত হতেই পারে। বাক্যে প্রয়োগ না করলে তো তাকে আর পদ বলা যায় না।

   বিশেষ্য, সাধারণত কোনো ব্যক্তি, বস্তু, জাতি, ধর্ম, গুণ, ভাব, সমষ্টি বা কোনো কাজের নামকে বোঝায়। যেমন: রূপসা, বই, দল, ঘুম, প্রভৃতি।

   বিশেষ্য পদের শ্রেণি নির্ণয়  নিয়ে নানাজনে নানা কথা বলেছেন।  বলাটাই স্বাভাবিক। কারণ সুনির্দিষ্টভাবে কোনো এক ধরনের শ্রেণির মধ্যে এদের বিশ্লেষণ করা কঠিন। তবে সাধারণ পাঠকদের সুবিধার জন্য আমরা মোটামুটি এই শ্রেণিটিকেই নিলাম।
 আমরা বিশেষ্য শব্দকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে দেখাতে চাই। এরা হল ১। সংজ্ঞা বাচক বিশেষ্য ২। শ্রেণি বা জাতিবাচক বিশেষ্য ৩।গুণ বা ভাববাচক বিশেষ্য ৪। সমষ্টিবাচক বিশেষ্য ও ৫। ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য।

১: সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য- নির্দিষ্ট করে কোনো নামকে বোঝায়। এই নামগুলি হতে পারে ব্যক্তির নাম- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আইনস্টাইন, বিবেকানন্দ। হতে পারে বস্তুর নাম- বই, কলম, টেবিল, খাতা। স্থানের নাম- কলকাতা, মুম্বাই, খড়গপুর, মেদিনীপুর। দেশের নাম- ভারত, জাপান, আমেরিকা, চিন। নদীর- সমুদ্রের নাম- গঙ্গা, যমুনা, কৃষ্ণা, প্রশান্ত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর। সংখ্যার নাম- একশ, হাজার। পাহাড়- পর্বতের নাম- হিমালয়, আরাবল্লী, এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্যান্য প্রাণীর নাম- বাঘ, সিংহ, তিমি, কাকাতুয়া। দিনের নাম- সোমবার, মঙ্গলবার শুক্রবার। পত্রপত্রিকার নাম- আনন্দবাজার, নবকল্লোল, শুকতারা, তথ্যকেন্দ্র, জ্বলদর্চি, কপালসিরি। রঙের নাম- সাদা, কালো, নীল, লাল।
 তবে মনে রাখতে হয়, এক দুই তিন বা নীল লাল সাদা প্রভৃতি শব্দগুলি সাধারণত বিশেষণ হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে। তবে একথাও ঠিক বাক্যে প্রয়োগ না করে কোনো শব্দের আইডেন্টিটি স্থির করা উচিত না।

   একটি বাক্যে বিশেষ্যশব্দ দেখে নেওয়া যাক। "এক যে ছিল "বিদ্যাসাগর"/ দেমাকধারী ধাত/ "সাহেব" যদি "জুতো" দেখায়/ বদলা তৎক্ষণাৎ।"

   একটি সমস্যা, বই, বস্তুর নাম হিসেবে সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য, কিন্তু নির্দিষ্টকরে কোনো বইয়ের নাম ধরলে "বই " শ্রেণিবাচক বিশেষ্য হওয়ার সম্ভাবনা। যেমন- বিজ্ঞান বই, বাংলা বই প্রভৃতি।

   ২ শ্রেণিবাচক বা  জাতিবাচক বিশেষ্য:  "বাঙালি" নিজেদের বুদ্ধিমান ভাবে "  "জলে "কুমির" ডাঙায় "বাঘ।"
  চিহ্নিত বাঙালি, কুমির, বাঘ এই শব্দগুলি কোনো শ্রেণি বা  জাতির নাম বোঝাচ্ছে। এরাই শ্রেণিবাচক বিশেষ্য। এছাড়াও হিন্দু-মুসলিম- খ্রিস্টান, মানুষ, ছেলে, মেয়ে  প্রভৃতি শ্রেণিবাচক বিশেষ্যের অন্তর্গত।
   এখানে একটি ছোট্ট বিতর্ক রয়েছে। বাঘ, গরু, কুকুর প্রভৃতিকে সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য ধরলে তার শ্রেণিবাচক বিশেষ্য হবে পশু। অন্যদিকে কুকুর বা বাঘের অনেক নাম হয়ে থাকে। যেমন - চিতাবাঘ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার প্রভৃতি। কুকুর- অ্যালসেশিয়ান, স্পেনিয়াল প্রভৃতি। তখন বাঘ বা কুকুরকে  শ্রেণিবাচক বিশেষ্য ধরতে হয়। এরকম আরো কিছু জড়বস্তু বা প্রাণীর ক্ষেত্রেও হতে পারে। ধান, কাঠ প্রভৃতি বস্তু হিসেবে শ্রেণিবাচক হতে পারে। আবার এরা সংজ্ঞাবাচকও হতে পারে অন্য দিক থেকে। তখন তার সংজ্ঞাবাচক হবে শংকর ধান, মুগি ধান প্রভৃতি।
  
  এই সমস্যা সমাধানে আমাদের মত:  এক, কিছু বস্তুবাচক শব্দ নামকে সংজ্ঞাবাচক করতেই হবে। কারণ তাদের শ্রেণি নির্ণয় করা কষ্টকর। যেমন- ছুরি, কাঁচি, চেয়ার-টেবিল, খাতা প্রভৃতি। কাঁচিকে চুলকাটা কাঁচি, কাগজকাটা কাঁচি প্রভৃতি করা হাস্যকর। তাই এরা সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য। 
দুই, কিছু বস্তুবাচক শব্দ শ্রেণিবাচক করা যেতেই পারে। যেমন- মোবাইল, কাঠ, ধান, গম প্রভৃতি। এক্ষেত্রে সাধারণভাবে যাদের প্রচলিত শ্রেণি খুঁজে পাওয়া যাবে শুধু তাদেরই শ্রেণিবাচক করা যেতে পারে । 
তিন, এই ধরনের সমস্যার জন্যই বোধহয় অনেকে বস্তুবাচক বিশেষ্য নামে আরেকটি শ্রেণিনাম করে থাকেন। সেখানে সমস্ত বস্তুকেই এই শ্রেণিতে ফেলা যায়। তবে এক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। পাহাড়-পর্বত বা নদনদীও তো বস্তু। তাহলে এদের কি বস্তুবাচক বলা যায়?  আর যদি তাই বলা যায়, তাহলে এভারেস্ট বা গঙ্গানদীও তো বস্তুবাচক হবে। কিন্তু তা কি সম্ভব?  কারণ এরা নির্দিষ্টভাবে নাম বোঝাচ্ছে। আবার কেউ যদি বলেন সমস্ত জড়বস্তুকে  বস্তুবাচক বিশেষ্য করলে ক্ষতি কী? তাহলে তো কোনো বস্তুরই নির্দিষ্ট নাম দেওয়া যাবেই না। তখন যমুনা নদী বা হিমালয় পর্বতের কী হবে?  তাই বাস্তবে এও  সম্ভব নয়। 
চার, অন্যদিকে বাঘ, সিংহ, কুকুর বা আপেল, কলা, আম প্রভৃতির যে বিভিন্ন নাম বলা হয়, তারা প্রকৃতপক্ষে একটি প্রজাতি বা জাতির নাম। যেমন- শংকর ধান, বা  হিমসাগর আম কোনো নির্দিষ্ট ধান বা আমের নাম নয়, একটি প্রজাতির নাম। সেই হিসেবে মানুষেরও তো অনেক উপজাতি বা শ্রেণি হতে পারে, যেমন- আদিবাসী জাতি, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ জাতি, কোল, মুন্ডা জাতি প্রভৃতি।তাহলে এদের কি শ্রেণিবাচক বিশেষ্য ধরা যায়? 
 পাঁচ, অনেক ক্ষেত্রে টেবিল, কলম মানুষ প্রভৃতি গণনযোগ্য বস্তু ও তেল, চিনি, জল প্রভৃতি পরিমাপযোগ্য বস্তুকে হয়তো শ্রেণিবাচক বা সাধারণ বিশেষ্যের অন্তর্গত ধরা যায়। তবে সবক্ষেত্রে ধরা যাবে না। 
 
   তাই আমাদের মত,  প্রচলিত বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করেই এদের বিচার করতে হবে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে সামান্য কিছু শব্দ যদি দুটো শ্রেণিতেই (সংজ্ঞাবাচক ও শ্রেণিবাচক)  অবস্থান করার যুক্তি পেয়ে যায়, তবে দুটি শ্রেণিতেই  ব্যবহার করা যেতে পারে। আর হ্যাঁ, "প্রচলিত বাস্তবতা" কিন্তু সর্বদা পরিবর্তিতই। 
 
   এবার ৩. ভাববাচক বিশেষ্য-" জীবে "প্রেম" করে যেই জন।"  "মানুষের প্রতি "বিশ্বাস" হারানো পাপ।" 
এই বিশ্বাস, প্রেম প্রভৃতি শব্দগুলো কোনো বিশেষ ভাবকে  প্রকাশ করছে  এগুলোই  ভাববাচক বিশেষ্য। এছাড়াও ব্যথা-বেদনা সন্দেহ, ভাববাচক বিশেষ্যের  অন্তর্গত।  ভাব শব্দটিকে এখানে ব্যাপক অর্থে  গ্রহণ করা হয়েছে। ভাব বলতে সাধারণ অনুভূতি, গুণ অবস্থা বা অবস্থার ভাবকে বুঝিয়েছে। 

   সাধারণভাব- আনন্দ-বেদনা সুখ দুঃখ বিষণ্নতা প্রভৃতি। 
গুণের নাম- স্নেহ ভালোবাসা প্রীতি প্রতিভা সাহস ধৈর্য ক্ষমা প্রভৃতি। অবস্থার ভাব- স্বাধীনতা কম্পন বধিরতা কৈশোর শৈশব  বার্ধক্য মৃত্যু প্রভৃতি।
 
৪. সমষ্টিবাচক বিশেষ্য-  পাখি উড়ে "ঝাঁকে ঝাঁকে"।  
"আমরা যে  রাশি রাশি/ মেঘের পুঞ্জ ভেসে আসি।" 
চিহ্নিত ঝাঁক, রাশি, পুঞ্জ প্রভৃতি শব্দগুলো কোনো না কোনো  সমষ্টিকে বোঝাচ্ছে  তাই এরা সমষ্টিবাচক বিশেষ্য। এছাড়াও পাল, মিছিল, একছড়া প্রভৃতিও হতে পারে। 

   একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, শ্রেণিবাচক বিশেষ্যে কোনো ব্যক্তি, বস্তু প্রভৃতির শ্রেণি বোঝায়, আর সমষ্টিবাচক বিশেষ্য  বিশেষ কোনো শ্রেণি না বুঝিয়ে ওই শ্রেণির দল বা সমষ্টিকে বোঝায়। যেমন- মানুষ- শ্রেণিবাচক বিশেষ্য। মানুষের দল- সমষ্টিবাচক বিশেষ্য। আবার কোকিল- সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য। পাখি- শ্রেণিবাচক বিশেষ্য। আর পাখির ঝাঁক- সমষ্টিবাচক বিশেষ্য। 

   আরেকটি বিষয় মনে হল, সমষ্টিবাচক বিশেষ্য বলতে চালু ব্যাকরণে শ্রেণিবাচক বিশেষ্যের সমষ্টিকে বোঝায়। কিন্তু সবসময় তা নাও হতে পারে। যেমন- পত্রিকা- শ্রেণিবাচক বিশেষ্য। পত্রিকার নাম- কল্লোল, সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য। কল্লোলগোষ্ঠী- সমষ্টিবাচক বিশেষ্য। 

এবার ৫. ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য- "স্বপ্নে দর্শন করেছি।"
পঠন-পাঠন ঠিকঠাক চলছে না কোভিড ১৯ র জন্য। 
এই দর্শন এবং পঠন-পাঠন: এগুলো কোনো কাজ বা ক্রিয়ার নাম বোঝাচ্ছে, তাই এরা ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য।
 
  মনে রাখতে হবে ক্রিয়াপদ কোনো কিছু কাজ করা বোঝায় আর ক্রিয়াবিশেষ্য সেই কাজের নাম বোঝায়। যেমন- ক্রিয়াপদ: যাচ্ছি, যাই।  ক্রিয়াবিশেষ্য: যাওয়া/ গমন। খাচ্ছি, খাই -খাওয়া /ভোজন।  ঘুমাচ্ছি, ঘুমাই : ঘুম/ শয়ন।
 আজ এটুকুই।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments