২০২১ নতুন বছর নতুন লেখা
গুচ্ছ কবিতা
জাহ্নবী জাইমা
আঙ্গুলের সূক্ষ্ম কারুকাজ
এ কেমন নিজ দেশ কপট মানুষ ও পতঙ্গ
দুঃখময় করে তোলে উদ্ভিদ মৃত্তিকা সম্পর্কের অমল বিন্যাস।
আঁততায়ীর স্পর্শে মুহূর্তেই দুলে ওঠে ভয়ঙ্কর নীলিমা।
আঁধার করা সর্বনাশা অসত্য অন্ধকার
প্রতারক জল এসে ভেজায় শরীর আর গোপন অহংকার
নগ্ন দু’চোখে খেলা করে পিপাসার ঢেউ কানের কলস
কোথাও লাবণ্য আঙ্গুলের সূক্ষ্ম কারুকাজ
উঠোনে ছড়ানো শস্যবীজ হাঁসের পালক
মধ্যরাতে রক্তের ভেতরে জেগে ওঠা আরণ্যক সুষমা
সুখের তীব্র ঘ্রাণ নিয়ে আসে অশুভ কান্নার রোল
কোথাও বিশ্বাস নেই। অনুতাপ ঝুলে আছে আমাদের
সমস্ত দেয়ালে দেয়ালে কোথায় জলের কলস, পাখির পালক
সারাদিন সন্দেহ ও বিষাদে হেঁয়ে ফেলে বরষার অমল ধ্বনি
পরিত্যাক্ত পালকের কাছে হাঁটুমুড়ে বসেছে সযত্নে তারা
আর অনবরত অর্জন করেছে ধ্বংসের গোলক
এভাবে কষ্ট পেতে পেতে দুঃখজনক দিনরাত্রির
সাথে আমরা পরিচিত হয়ে উঠি।
ভাঙ্গা গড়া
যে হাত মূর্তি গড়ে সে হাতেই পেটায় বউ
অন্তর বাহিরে যেন দেখবার নেই কেউ
রাত্রিতে শৈল্পিক ঘোরে মেতে উঠে শিল্পী মন
ঐ দূর থেকে ডেকে উঠে হঠাৎ বৃন্দাবন।
পৃথিবী ঘুরে আজ কোথায় পৌত্তলিক যুগ?
হা পুরুষ! নারী হলে হয়তো পেতাম সুখ
অজন্তা ইলোরার সুন্দরীতমা প্রিয় মুখ
গড়োছিলো শিল্পী হাত, অলক্ষ্যে পূর্ণিমা চাঁদ।
মনোরম প্রাণ সুখে মাটি দিয়ে আঁকে বুক
মন খেলা একদলা মাটি ঈশ্বরীর মুখ
অধম বুকে সে বুক যেন বুভুক্ষ আগুন
ঐ দূর চেয়ে উঠে আজও ফেরারী ফাগুন।
শতাব্দীর প্রান্তরে তৃতীয় বিশ্বের দ্বারপ্রান্তে
যে হাতে মূর্তি গড়ে, সে হাতেই হয়তো ভাঙ্গে।
বিরহী বাসর
রংধনু রংয়ে রাঙ্গায়ে মন
বর্ণালীর বর্ণে সেজেছে গগণ।
নীল নীলাম্বরী অপরূপ অঙ্গে
দোলে এলো কেশ পবনের সঙ্গে।
লাজে রাঙ্গা মুখ ঘোমটার ছলে
ঢাকে সে বদন মেঘের আঁচলে।
মাটিকে জানাতে আকাশের বিয়ে
বৃষ্টির দূত এলো বারতা নিয়ে।
বিরহী বাসর হবে বর্ষাকালে
আষাঢ়-শ্রাবণ জুড়ে অশ্রু জলে।
অঙ্কুরিত হলো বীজ পূণ্য স্নানে
সবুজ পৃথিবী জানে তার মানে।
কথা ছিল
কথা ছিল
একটি বলিষ্ঠ হাত বৈশাখে
গেরুয়া লেবুগন্ধি ভোরে
আমায় ধ্রুবতারা চেনাবে।
কিন্তু সে তখন শরতে
পারিজাত চয়নে রত ছিল।
কথা ছিল
একটি করুণাময় হাত আশ্বিনে
হলুদ পাখি কিংবা শ্বেত কপোত এনে দেবে।
কিন্তু সে তখন বসন্তের হলুদ বনে
পদ্মবিলে রাজহংসের সাথে মেতেছিল।
কথা ছিল
একটি ভালবাসার হাত গভীর মমতায়
আমায় পারস্যের গালিচা অথবা সবুজ প্রান্তর দেখাবে
কিন্তু সে তখন কার্তিকের কাশবনের বকের সাথে
কাশের ডগায় শিশির বিন্দুর হীরকদ্যুতিতে বিভোর
তাই জৈষ্ঠ্যের আগুনঝরা মধ্যাহ্নে
তৃষিত আমি এখনও গভীর প্রতীক্ষায়
কথা ছিল
পলাশ শিমুল কৃষ্ণচূড়ার বনে।
দু’জন রেললাইনের মতো সমান্তরাল
হাতে হাত রেখে দূরে বহুদূরে যাবার
কিন্তু সে তখন...
অনাথিনী
কুসুমিত দিনের শেষে, অবিমিশ্র সন্ধ্যা ঘনায়
শীতের কুন্তল নগ্নতায়
ঈশানের হাড় কাপানো শীত
জনপদে অনাথিনী কাঁপানি ফণায়।
শীতের বিষাক্ত সরীসৃপ নিকট ঘনায়
কম্বলহীন একাকী প্লাটফর্ম সম্বল
জীবনের ব্যাকুলতা, আর্ত নিঃসঙ্গতা
অনাথিনীর বর্ষা, কাক ভেজা শরীর।
আসবে বসন্ত অপেক্ষায়, দক্ষিণা হাওয়া
তিস্তার আতপ্ত জলে ছায়া,
নীল প্রহরে মায়ার খেলা
কষ্টে জীবন, বন্যার জলে বিষাক্ত ছোবল ৷
জীবন বুঝি আজন্ম ঢেউয়ের কাপন
ভিটেহারা অনাথিনীর হৃৎকমল
অতল জলের গহ্বরে
কাড়লো জীবন প্রদীপ, অনাথিনীর বাবা মায়ের
অনাথিনী প্লাটফর্ম ঠায় দাঁড়িয়ে
অর্নিমিক অকস্মাৎ যদি...
গাঢ় রন্ধ শব্দের পিছনে
নজর কাড়ার মতো তেমন রূপের ঠমক ছিল না
শরীর বেঁধেছে আঁটো বয়েসের ছিলাটান মেদে
সে এখন স্বপ্ন ভেঙে পোড়ামাটির মূর্তি হয়ে
সুন্দরের হৃদয়ে রয়েছে।
ফসলের খেত থেকে উঠে আসে নাই আঁকড়া হাওয়া
তার কি স্মরণে আছে
বৃষ্টি মেঘে দীঘিজল ঘোর হয়ে ওঠে কেন
হিজলের পাতায় ছায়ায়
সে এখন টেরাকোটা শিল্প ভাঙা মন্দিরের উত্তর যৌবনে
স্বতঃস্ফুর্ত স্থির হয়ে আছে
কোন পুরুষের দৃষ্টি লেহন করেনি তাকে রৌদ্রে বা জ্যোস্নায়
শুধু শিশিরে আলিঙ্গন সে পেয়েছে ধানফুলে
পাখি ডাকা কার্তিকের ভোরে
মেঘ নিয়ে আসে জল ঋতু সুখ বসন্ত কুসুম
ভালােবাসা চলে যায় শব্দভাঙ্গা গুঁড়ি পথ দিয়ে
জীবন কাহিনী এসে থেমে গেছে তারপর
দূরগামী ব্যস্ত বাসস্টপে
তবু কিছু বাকি থাকে সব কিছু ফুরোবার পর
শীতের শিল্পিত হাত ভাস্কর্যের নতুন রচনাশৈলী
তাকে নিয়ে গেছে এক অমর পারিজাত লোকে
আকাশে একটি তারা হাবুডুবু খায় মেঘে
সে নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে...
আজ শুধু প্রশ্ন জাগে মনে
সে কি কোনও দিন এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল
রৌদ্রজলে আমাদের যৌবনের গাঢ়বন্ধ শব্দের পিছনে।
ঝুলন্ত লাশ
ভেজা নয়ন বুজে অনুভব করি
দেয়ালিকা ক্যানভাস থেকে উঠে আসা চোখ,
প্রতিচ্ছবি স্বচ্ছতার অস্তিত্ব আড়াল হলে
গলা থেকে উঠে আসে অনুভূতির সুর।
বিষন্নতার ক্যাকটাস, অক্টোপাস হয়ে
হামাগুড়ি দিয়ে উঠে আসে বুকে
স্মৃতির জলচ্ছবি রক্তাক্ত হয়
তুমি ছায়া হয়ে ফিরে যাও জোছনার সুখে।
বাস্তবতার দরজায় ঝুলে স্মৃতির লাশ
স্বপ্ন ফিরে যায় নিজ সরল রেখায়
আমরা শান্তি খুঁজি আয়নার পিছনে
ফেলে আসা পথে...
শীত
এলো শীত ধবল বকের ডানায়
ধ্রুবতারা ভিজে এলো চাঁদ জোছনায়
ঝর্ণা ঝরে ব্যাপিত সাগর ঢেউয়ে
শীত এলো উষ্ণতা নিয়ে হৃদয়ে।
শীত এলো সরিষার কচিমনে লাউয়ের মাচায়
দূর্বা ঘাসে শিশির বিন্দু আঁকে মেঠো পথ পায়ে
পায় জোয়ার ভাটায় বাষ্পীয় ধোয়া শীতের পিঠায়
শীত এলো দরদ ভরা মায়ের কোলে।
এলো শীত মিষ্টি খুকুর নিক্কন নূপুরে
সরিষা ঘানি উদম উলঙ্গ দুপুরে
এলো শীত অতিথি পাখি বেসাতি জলসায়
এলো শীত আগুন পোহাতে গ্রাম বাংলায়।
শব্দ নিরুত্তর
রোদুর অক্ষরে লিখি দিন
আঁধার নিয়ে লিখি রাত
দিন রাতের সন্ধি লিখি প্রহেলিকা
ভাবি যে লেখার কথা,
ভাষা শব্দ নিরুত্তর!
শুনতে পাই ধ্বনির অক্ষরে পক্ষীভাষা
ধ্বনি প্রতিধ্বনি তাবত লেখা সচলে
সুনশান নীরবতা তেপান্তরে
ঘসামাজা কিংবা মমতার আঁচলে।
ছিলনা অক্ষর তবু হয়েছে লেখা বিহ্বলে
পাহাড়ী গুহায় চিত্রলিপি কিংবা ইলোরার বলে
অথচ,
আমার জন্য হায়রোগ্রিফিক্ নিরুত্তর।
যে ভাষা রপ্ত চেনা শব্দ করে মড় মড়
সে ভাষায় কথা বলে আশ্বিনের ঝড়
জুয়াড়ি চিল মেলে পাখা খাদ্য ছুঁইয়ের ভাষা
লিখতে গিয়ে নিজেকে শব্দ নিরুত্তর!
লিখতে পারি হাওয়া অনুভূতি নিয়ে
রোদ দেখি রোদ লিখি অক্ষর দৃষ্টি দিয়ে
ঘনমেঘ লিখে ফেলি অনায়াসে বৃষ্টি লিপি
নিজেকে লিখতে গিয়ে বর্ণমালায় শব্দ নিরুত্তর!
জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
0 Comments