২০২১ নতুন বছর নতুন লেখা
তিনটি অণুগল্প
বিনোদ মন্ডল
প্রয়াণবার্তা
বাইক চালানোর সময় ফোন ধরিনা। পরে কলব্যাক করি। এক্ষেত্রে করা হয়নি। রাতে ভদ্রলোক আবার ফোন করলেন। বললেন -- চিনতে পারছেন গলা?
না, পারিনি। ২০০৫ এ অবসর নিয়েছেন। এটা ২০২০। মাঝে না দেখা, না শোনা। স্বভাবতই লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম।
অফিসের বড়বাবু ছিলেন। উনি চলে যাওয়ার পর সবিতাদি হেডক্লার্ক হন। উনি সেই সবিতাদির মৃত্যুসংবাদ দিলেন। আমি অন্য ব্লকে পোস্টিং এখন। খবর পাইনি। কিছুক্ষণ গল্প করলেন। আমার অফিসের লাগোয়া ব্লকে বাড়ি করেছেন। একদিন অফিসে আসতে অনুরোধ করলাম। উনি হেসে বললেন -- ঠিকই, আর ফোন নয়, সোজা চলে যাবো। কেটে গেল লাইন।
সেদিন অফিসে ঢুকে সবে চেয়ারে বসেছি, বড়বাবু এগিয়ে এলেন। এইযে তন্ময় এসে গেছো। কালিপদবাবু শুক্রবার তোমায় ফোন করেছিল? আজ সোমবার। হিসেব করে দেখলাম -- দিনটা শুক্রবারই ছিল। আমি কুয়াশামাখা শীতের ভোরের মতো জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম।
আরে ভাই, কালিদা আমার কাছে তোমার নম্বর নিলো। জরুরি দরকার বলছিল। তখন বুঝিনি, বলছিল -- কয়েকটা লোকের সাথে কথা সেরে নিতে হবে। সময় বড়ো কম। তুমিতো কালিদার অসম বয়সের বন্ধু ছিলে! তা-ই! তোমার চাকরিটাও তো পার্মানেন্ট হলো একপ্রকার ওর জন্যে!
-- শনিবার সন্ধ্যায় চলে গেল। সামান্য জ্বর ছিল। রিপোর্ট পজিটিভ। ফোনে কলগুলো সব হাসপাতাল থেকেই করেছে। হপ্তাখানেক ভর্তি ছিল। হঠাৎ, সব শেষ!
শক্তির মেয়ে
তখনো শ্রদ্ধা কাপুর পৃথিবীতে আসেনি।
আশি একাশি সাল নাগাদ শক্তির যখন মেয়ে হলো, বসন্তকে ল্যান্ডফোনে অনুরোধ করেছিল, মেয়ের একটা নাম বেছে দে।
বসন্ত তখন শিলিগুড়িতে। শক্তি দক্ষিণ বাংলায়। বসন্ত বলেছিল -- শ্রদ্ধা। বড় হলে ভালোই শোনাবে। শ্রদ্ধা ঘোষ। আর যদি দে পরিবারে বিয়ে করে তাহলে তো কথাই নেই। নামেই সমীহ আদায় করে নেবে। হেসে উঠেছিল শক্তি। ফোনের ওপাশে বসন্তও।
মেয়ের বিয়েতে ডেকেছিল। যাওয়া হয়ে ওঠেনি। চোখের আলোয় দেখেছিলাম চোখের বাহিরে। শক্তির সাথে যতটুকু যোগাযোগ ফোনেই। ঘুড়ির সুতোর সম্পর্ক।
হঠাৎ সেদিন কাগজের সাত পাতায় চোখ আটকে গেল তার। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে এক গৃহবধূ। নাম -- শ্রদ্ধা শীল (৪১)। পুলিশ তার স্বামী ও শ্বশুরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে। থ বনে গেল বসন্ত।
শক্তিকে ফোন করবার শক্তি সত্যিই তার নেই।
সেদিনই পেজ থ্রিতে সব কাগজ ছেপেছে গাঁজা কেসে শ্রদ্ধা কাপুরকে জেরার জন্য
ডাকা হয়েছে সিবিআই দপ্তরে।
ট্যারা
জুনিয়র সায়েন্টিস্ট হিসেবে চাকরিটা পেল নভেম্বরে। হোম সিটিতে। বদলির চান্স নেই। সুদিন তার মাকে নিয়ে বস্তির ঝুপড়ি ছেড়ে ভাড়াবাড়িতে উঠে গেল। ডিসেম্বরে।
রথীনদা ওর দূর সম্পর্কের জামাইবাবু। চা দোকানে মাঝে মাঝে আড্ডায় দেখা হয়। কথায় কথায় সুদিন একদিন বলেছিল -- তুমি দেখে নিও রথীনদা, আমার ছোট বেলা থেকে একটাই স্বপ্ন -- এমন একটা বাড়ি করব মায়ের জন্য -- দেখে লোক ট্যারা হয়ে যাবে!
বছর তিনেক বাদে ঠিক আঠাশ বছর বয়সে বিয়ে হলো সুদিনের। তিরিশে নতুন ঘরে ধুমধামে গৃহপ্রবেশ। সুশীলা উচ্চশিক্ষিতা। তার বাবা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মেয়ে জামাই এর জন্য বাড়ি বানিয়েছে। তিনকুলে তার মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। একরত্তি মেয়ের সাধ মেটাতে প্রায় কোটি টাকা ঢেলে বানানো হয়েছে পেল্লায় বাড়ি। সুদিনের মায়ের নামে বাড়ির নাম খোদাই করা হয়েছে -- শ্বেত পাথরের ফলকে -- সুনয়নী।
রথীন সন্ধ্যার মুখে অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরছে। তাকে একটু এগিয়ে দিলে সুদিনের মা।
-- তারপর মাসিমা! সব ঠিক আছে তো? হঠাৎ প্রশ্ন রথীনের। একটা দীর্ঘশ্বাস লুকোতে চেষ্টা করলো সে। আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলেই ফেললো শেষে -- সব ঠিকই আছে, বাবা। বড়ো লক্ষ্মী মেয়ে। শুধু কোনদিকে কখন তাকায়, বুঝতে পারিনা। সামান্য ট্যারা যদি না হতো........!
0 Comments