জ্বলদর্চি

সংক্ষিপ্ত মহাভারতপর্ব-৩/সুদর্শন নন্দী


সংক্ষিপ্ত মহাভারত
পর্ব-৩

সুদর্শন নন্দী

 
পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃত্যুর পর কুন্তী তার পাঁচ সন্তানকে নিয়ে ফিরে এলেন হস্তিনাপুরে। পাণ্ডব ও কৌরবরা দ্রোণাচার্যের কাছে তাদের যুদ্ধশিক্ষা আরম্ভ করে। গুরু দ্রোণের মনেপ্রানে ইচ্ছে দ্রুপদের প্রতিশোধ নেওয়া। শিষ্যদের কাছে তাই দক্ষিণা হিসেবে তার প্রতারক বন্ধু পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে পরাজিত  করার ইচ্ছা প্রকাশ করতে থাকেন।  দ্রুপদকে পরাজিত করার দ্রোণের বাসনার বিষয়ে দুচার কথা বলে নি। রাজা পৃষত পুত্র দ্রুপদ এবং মহর্ষি ভরদ্বাজ পুত্র দ্রোণ কিন্তু একসময় অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন।দুজনেই ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে শিক্ষাদীক্ষা লাভও করেছিলেন।  

কিন্তু গদি অতি বিষম বস্তু। যে যায় লঙ্কায় সে শুধু রাবণই হয় না, দ্রুপদও হয়। তাই দেখি  রাজা পৃষতের মৃত্যু হলে দ্রুপদ পাঞ্চালের রাজা হয়ে দ্রোণকে আর বন্ধু বলে স্বীকার করলেন না বরং দ্রোণ সাক্ষাৎ করতে গেলে অপমান করলেন। সেই থেকে দ্রুপদের উপর দ্রোণের ছিল ভীষণ ক্রোধ। দ্রোণ শরদ্বারের কন্যা কৃপাচার্যের বোন কৃপিকে বিয়ে করেন। তারপর তিনি পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করেন। যাইহোক, তাঁর ছাত্ররা অর্থাৎ পাণ্ডব ও কৌরব সন্তানরা  গুরুদেবের প্রতিশোধ নিতে গেলেন দ্রুপদের সাথে যুদ্ধ করে যুদ্ধে দ্রুপদকে পরাজিত করতে। এবং পরাজিত করে বেঁধেও আনলেন। দ্রোণ তাঁর অপমানের প্রতিশোধ নিলে দ্রুপদও  দ্রোণকে শায়েস্তা করার জন্য মনে মনে ছক কষতে থাকেন। তা পরবর্তী ঘটনায় আমরা দেখতে পাব। এদিকে কর্ণ কৌরবদের পরম মিত্রে পরিণত হয়। মহাভারতে কর্ণ একটি উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।  কর্ণ মহাভারতের অন্যতম একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিনি অঙ্গ (বর্তমান ভাগলপুর ও মুঙ্গের) রাজ্যের রাজা ছিলেন। কর্ণ ছিলেন মহাভারতে বর্ণিত সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের একজন । আগেই আসল পরিচয় বলেছি যে কর্ণ হল তিনি কুন্তির বড় ছেলে।   
কর্ণ সূর্যদেব ও কুন্তির সন্তান এবং সেই সূত্রে পাণ্ডবদের বড় ভাই। কিন্তু ভাগ্যচক্রে তিনি কৌরব রাজকুমার দুর্যোধনের ঘনিষ্ঠতম মিত্রে পরিণত হন এবং ফলশ্রুতিতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি কৌরবদের পক্ষে নিজ ভাই পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কর্ণ সমগ্র জীবনব্যাপী প্রতিকূল ভাগ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতেন। ধারণা করা হয়, বর্তমান ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের কর্নাল শহরটি কর্ণই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কর্ণ তাঁর ত্যাগ, সাহসিকতা, দানশীল   জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন।
আগে সংক্ষেপে বলেছি, এখন আরেকটু জানাই যে রাজকুমারী কুন্তী যৌবনকালে দুর্বাসা মুনির কাছে আশীর্বাদরূপে পুত্রেষ্ঠী মন্ত্র লাভ করেন। কুমারী অবস্থায় একদিন কুন্তী কৌতূহলবশত মন্ত্রবলে সূর্যদেবতাকে আহ্বান করেন। সূর্য উপস্থিত হলে ভীত কুন্তী তাকে অজ্ঞানতাবশত এই কাজের কথা বলেন, কিন্তু, মন্ত্রের সম্মান রক্ষার্থে সূর্যদেব তার গর্ভসঞ্চার করতে বাধ্য হন এবং সূর্যের সাথে মিলনের ফলে তার গর্ভে কবচকুন্ডল পরিহিত কর্ণের জন্ম হয়। বিবাহের পূর্বে কর্ণের জন্ম হওয়ায় কুন্তী লোকনিন্দার ভয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। সমাজে নিজের সম্মান রক্ষার তাগিদে তিনি শিশুপুত্রকে একটি বেতের পেটিকাতে শুইয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেন। ভীষ্মের রথের সারথী অধিরথ ও তার স্ত্রী রাধা দেবী তাঁকে উদ্ধার করেন। তারা কর্ণকে পুত্রস্নেহে পালন করতে থাকে এবং তাঁর নাম হয় বসু্সেন। কর্ণকে 'রাধেয়' নামেও ডাকা হয়ে থাকে।
ছেলেবেলা থেকে কর্ণ ধনুর্বিদ্যায় আগ্রহী ছিলেন। তিনি কুরু রাজকুমারদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের কাছে শিক্ষালাভ করেন। পরবর্তীকালে অর্জুনের অসামান্য প্রতিভা দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে নিজগুরু দ্রোণের কাছে নিজের প্রতিযোগিতামূলক ভাব এবং ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করে অর্জুনকে পরাজিত করার প্রবল আকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশ করেন। দ্রোণাচার্য তখন তাঁকে নিজ সাধনায় ব্রহ্মাস্ত্রজ্ঞানের উপযুক্ত হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা করতে বলায় তাঁর অভিমান হয় এবং তিনি গুরুগৃহ ত্যাগ করেন।  
কথিত রয়েছে যে, একবার কর্ণ অস্ত্রশিক্ষাকালে একটি গাইকে হত্যা করায় ঐ গাইয়ের পালক ব্রাহ্মণ তাঁকে শাপ দেন যে, মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে কর্ণের রথের চাকা যখন মাটিতে বসে যাবে তখন সে এই গাইয়ের মতই অসহায় হয়ে পড়বে।আপাতত এই হল কর্ণের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত।
এদিকে পাণ্ডবদের বড়  যুধিষ্ঠির যুবরাজ পদে বসলে কৌরবরা ঈর্ষান্বিত হয়, এমনকি ‘পুত্রস্নেহে অন্ধ’ ধৃতরাষ্ট্রও দুর্যোধনকে রাজা হিসেবে দেখার জন্য আকুল হয়ে ওঠেন।
এবার আসরে আসেন দুর্যোধন তথা কৌরব পুত্রদের মামা শকুনি।এখানে শকুনি সম্বন্ধে দুচার কথা বলতে হবে। শকুনি  মহাভারতের একটি অন্যতম চরিত্র। শকুনি স্বভাবিক ভাবেই ভাগনে কৌরবদের পক্ষেই ছিলেন। অত্যন্ত ক্রুর ও ধূর্ত ছিলেন তিনি।তিনি মহাভারতের প্রধান খলনায়ক।
শকুনি গান্ধাররাজ সুবলের বড় ছেলে ও গান্ধারীর বড় ভাই ছিলেন । সুবলের কোনো এক পাপের কারণে দেবতাদের অভিশাপে তাঁর বংশে শকুনির জন্ম হয়। গান্ধারীর বিয়ের পর থেকে শকুনি ধৃতরাষ্ট্রের সংসারেই থাকতেন। সত্যি বলতে কি তাঁর কারণেও তথা তাঁর কপট বুদ্ধিতে সমগ্র কুরুবংশ ধ্বংস হয়েছিল বলা যেতে পারে।
দুর্যোধনকে তিনি নানান কুবুদ্ধি দিতেন। কালকূট বিষ প্রয়োগ করে ভীমকে হত্যা, জতুগৃহে কুন্তি সহ পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারা, পাশা খেলা এসব ষড়যন্ত্র শকুনির মাথা থেকেই বের হয়। সহদেবের হাতেই শকুনি-পুত্র উলুক ও শকুনির মৃত্যু হয়।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. একটি ছোট্ট তথ্যভ্রান্তি রয়েছে। দ্রোণ পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করেননি। দ্রোণের গুরু তাঁর পিতা ভরদ্বাজের শিষ্য অগ্নিবেশ্য। তবে হ্যাঁ দ্রোণ পরশুরামের কাছ থেকে কিছু  অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছিলেন।

    ReplyDelete