জ্বলদর্চি

আটলান্টিক সিটিতে নববর্ষ বরণ/ সুব্রত চৌধুরী

আটলান্টিক সিটিতে নববর্ষ বরণ

সুব্রত চৌধুরী


আমি থাকি যুক্তরাষ্ট্রের 'গার্ডেন সিটি' হিসাবে খ্যাত নিউজারসি রাজ্যের আটলান্টিক সিটিতে, যে শহরটি সারা বিশ্বে ‘ক্যাসিনো শহর’ হিসাবে খ্যাত। আজ থেকে আট বছর আগে এক বসন্ত সন্ধ্যায় এই শহরে ঢোকার আগে বহুদূর থেকে দৃষ্টি কাড়ছিল শহরের স্কাইলাইনে মাথা তুলে দাঁড়ানো সুউচ্চ ক্যাসিনোগুলো। শহরে ঢুকতে ঢুকতে ক্যাসিনোগুলোর নিয়ন সাইনের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার অবস্থা। শহরের প্রধান সড়ক ধরে  ছুটতে ছুটতে  রাস্তার দু’পাশ আমায় মুগ্ধ করেছিল। সেই মুগ্ধতার আবেশ গায়ে মেখে কাটিয়ে দিলাম আটটি বছর। 

   এই শহরটি আটলান্টিক মহাসাগর বিধৌত একটি দ্বীপ। আটলান্টিক মহাসাগরের বালুকাময় সৈকতের বালিয়াড়িতে গড়ে উঠেছে এই শহরের অহংকার বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ ও আমেরিকার সবচেয়ে পুরোনো বোর্ডওয়াক (প্রায় সাড়ে পাঁচ মাইল দীর্ঘ যা  ১৮৭০ সালে তৈরি), আর তার গা ঘেঁষে সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বখ্যাত সব ক্যাসিনোগুলো, যা এই শহরের প্রাণভোমরা। বসন্তের আগমনের সাথে সাথে শীতের জীর্ণতা ঝেড়ে জেগে ওঠে এই শহর। যদিও সারা বছর এই শহরে পর্যটকদের আনাগোনা থাকেই, কিন্তু গ্রীষ্মে তা কাদা থিকথিক ভিড়ে পরিনত হয়। এই শহর নিয়ে একটি কথা বেশ প্রচলিত আছে, ‘আটলান্টিক সিটি কখনো ঘুমায় না’, কিন্তু করোনার প্রভাবে এই শহরের স্বাভাবিক ছন্দে ছেদ পড়েছে।

   আটলান্টিক সিটিতে 'মেমোরিয়াল ডে’র পর থেকে অর্থাৎ মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে ‘লেবার ডে’ অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত  ম্যারাথন, ট্রেকাথলন,বীচ কনসার্ট, ঘোড়দৌড়, বক্সিং, ক্যাসিনোগুলোতে জগৎ বিখ্যাত সব শিল্পীদের কনসার্ট, আমেরিকার বিখ্যাত সব সেলিব্রেটিদের শো, এয়ার শো, মিস আমেরিকা প্রতিযোগিতা সহ হরেক রকমের আয়োজন হয়। তখন আটলান্টিক  মহাসাগরের উওাল তরঙ্গের সাথে পাল্লা দিয়ে জনজোয়ারের বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস তরঙ্গে এই জনপদ ভেসে যায়। এসবের সাথে পাল্লা দিয়ে এসময়ে দু’বাংলার প্রবাসী বাঙালিদের সাংবাৎসরিক আয়োজন ‘ইন্ডিয়া ডে’, ‘বাংলাদেশ মেলা’, রথযাত্রা, শারদোৎসব, ঈদোৎসব উপলক্ষে দু’বাংলার   বাঙালিদেরও মহাসম্মিলন ঘটে। এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা পৃথিবী থেকে পর্যটকদের আগমনে মুখরিত থাকে এই অতিথি বৎসল, শান্ত-সৌম্য মহাসাগর বিধৌত শহরটি। জীবনের নিয়মে এই শহরের সব কিছুই বেশ সুন্দর চলছিল সুর- তাল-ছন্দ মিলিয়ে। কিন্তু হঠাৎ এই  ছন্দোবদ্ধ জীবনে ছন্দপতন।               
 এবার একটু পেছন ফেরা যাক। আটলান্টিক সিটি নিউ জার্সির একটি অন্যতম মনোরম শহর। এটি ১৮৫৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি শহর হয়ে ওঠে যখন একটি নতুন রেলপথ ফিলাডেলফিয়ার এর সাথে সংযুক্ত করা হয়। আটলান্টিক সিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি রিসোর্ট শহর যা জুয়া খেলা ও সমুদ্র সৈকতের জন্য বিখ্যাত। আটলান্টিক সিটি আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে অ্যাবেসকান দ্বীপ এ অবস্থিত। ১৯২১ সাল থেকে আটলান্টিক সিটি মিস আমেরিকার প্রতিযোগিতার আবাসস্থল। ১৯৭৬ সালে নিউ জার্সির ভোটাররা আটলান্টিক সিটিতে ক্যাসিনো জুয়ার বৈধতা দিয়েছে। প্রথম ক্যাসিনো দুই বছর পরে খোলা হয়েছিল। দক্ষিণ জার্সিতে এর অবস্থান। ১৮৫৩ সালে প্রথম বাণিজ্যিক হোটেল বেলো হাউস নির্মিত হয়েছিল ম্যাসাচুসেটস এবং আটলান্টিক অ্যাভিনিউসের মোড়ে। শহরটি ১৮৫৪ সালে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, একই বছর ক্যামডেন এবং আটলান্টিক রেলপথে ট্রেন পরিষেবা শুরু হয়েছিল। উপসাগরের কিনারায় নির্মিত হওয়ার কারনে এ স্থান ফিলাডেলফিয়া, পেনসিলভেনিয়ার সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগ হিসাবে কাজ করেছে। একই বছর, টপোগ্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার্স কর্পস কর্পোরেশনের জর্জ মিড  দ্বারা ডিজাইন করা অ্যাবেসকান বাতিঘরটি নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, পরের বছর কাজ শুরু হয়েছিল। ১৮৭৪ সালের মধ্যে  বছরে প্রায় ৫০০,০০০ যাত্রী রেলপথে আটলান্টিক সিটিতে আসছিলেন। প্রথম বোর্ডওয়াকটি ১৮৭০ সালে হোটেল মালিকদের তাদের দালান থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করার প্রয়াসে সৈকতের কিছু অংশ বরাবর নির্মিত হয়েছিল। ১৯৪৪ সালের গ্রেট আটলান্টিক হারিকেনে ধ্বংস হওয়ার আগে বোর্ডওয়াকের ঐতিহাসিক দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় সাত মাইল (১১ কিমি) এবং এটি আটলান্টিক সিটি থেকে লংপোর্ট  পর্যন্ত ভেন্টনোর (Ventnor City) এবং মার্গেট(Margate City) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
   ১৮৭৮ সালের মধ্যে শহরের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে একটি রেলপথ লাইন আর চাহিদা ধরে রাখতে পারছিল না। তাই ফিলাডেলফিয়া এবং আটলান্টিক সিটি মধ্যেকার রেলপথটি নির্মিত হয়েছিল আটলান্টিক সিটিতে পর্যটকদের পরিবহনের জন্য। ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে লাস ভেগাস স্ট্রিপের পুনর্নবীকরণ এবং কানেকটিকাটে ফক্সউডস রিসর্ট ক্যাসিনো এবং মহেগান সান খোলার সাথে সাথে, ২০০০ এর দশকে নিকটস্থ ফিলাডেলফিয়া মেট্রো অঞ্চলে নতুন নির্মিত ক্যাসিনোগুলির সাথে জুয়া খেলার কারণে আটলান্টিক সিটির পর্যটক হ্রাস পেতে শুরু করে। প্রসারণের জন্য ১৯৯৯ সালে আটলান্টিক সিটি পুনঃবিকাশ কর্তৃপক্ষ লাস ভেগাসের ক্যাসিনো মোগল স্টিভ ওয়েনের সাথে অংশীদার হয়ে মেরিনার নিকটবর্তী শহরের এক অনুর্বর অংশে নতুন সড়কপথ তৈরি করে যা পরে আনুষ্ঠানিকভাবে আটলান্টিক সিটি-ব্রিগ্যান্টাইন সংযোগকারী হিসাবে নামকরণ করা হয়েছিল।  

   যুক্তরাষ্ট্রে পুরো ডিসেম্বর মাস জুড়েই উৎসবের মাস, কিন্তু মারনব্যাধির হিংস্র ছোবলের কারনে সেই উৎসবের মাসটি কেমন যেন নিরানন্দভাবে পার হতে চললো। এখানকার সবচেয়ে বড় উৎসব খ্রিষ্টমাস নিরানন্দভাবে পার হয়ে গেল। অনেকেই বন্ধু-স্বজন হারানোর বেদনায় এমনভাবে মুষড়ে পড়েছিল খ্রিষ্টমাসের আনন্দ তাদের মনে সামান্যটুকু আঁচড় কাটতে পারেনি। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো শুধুমাএ গির্জায় গির্জায় প্রার্থনা আর  আলোকসজ্জার আয়োজন করা হয়েছিল, কিন্ত আলোর বিচ্ছুরণও  অন্যান্য বছরের মতো ছিল না।
খ্রিষ্টমাসের উৎসব আনন্দের মধ্যেই দরজায় কড়া নাড়ে ইংরেজি নববর্ষ বরণ। প্রাকৃতিক নিয়মে এবছরও ইংরেজি নববর্ষ দরজায় কড়া নাড়ছে ঠিকই, কিন্তু তাতে সাড়া কই?
   আটলান্টিক সিটির প্রাণভোমরা ক্যাসিনোগুলো থার্টি ফার্স্ট নাইটকে কেন্দ্র করে সংবছর যে  আনন্দ আয়োজন করে, এবছর তাতেও ভাটা। উৎসবের আমেজটা ধরে রাখার প্রয়াসে ক্যাসিনোগুলোর অভ্যন্তরে আলোকসজ্জা সহ বিভিন্ন ধরনের সাজসজ্জা চোখে পড়লেও করোনাভীতির কারণে সেই সাজসজ্জাও কারো মন টানতে পারছে না, সাথে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন বিধিনিষেধ তো রয়েছেই। তাই আতশ বাজি পোড়ানো, কনসার্ট, নাইট  ক্লাবের উদ্দাম নৃত্য এসব কিছুর দেখা মিলবে না থার্টি  ফার্স্ট নাইটে।
দুই বাংলার প্রবাসী বাঙালিরা প্রতিবছর এসব আনন্দ আয়োজনে সপরিবারে সামিল হতো, এবছর তারা গৃহবন্দী হয়েই পার করবে বছরের শেষদিন  থার্টি  ফার্স্ট নাইটে। তাই তাদের মনোজগতে খেদের অন্ত নেই। আটলান্টিক সিটির কেপ কমিউনিটি কলেজের ছাএী পশ্চিম বাংলার নদীয়ার সুস্মিতা সাহা খেদ প্রকাশ করে বললেন, মারণব্যাধির কারণে এবছর নতুন বছরকে ঘরেই বরন করবো, কিন্তু তাই বলে প্রানোচ্ছ্বাসের কোন খামতি থাকবে না।
মারণব্যাধি সবার মনোজগতে ভীতির বীজ বপন করলেও নববর্ষ বরণের সীমিত আনন্দ আয়োজনে কেউ যে কসুর করবে না তা বলাই বাহুল্য।
নতুন বছরে  প্রবাসী বাংগালিদের সবার একটাই কামনা থাকবে পৃথিবী যেন তাড়াতাড়ি মারণব্যাধি মুক্ত হয় এবং সবাই যেন আগের মতো আবারো আনন্দ উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতে পারে।

তথ্যসূত্র : উইকপিডিয়া 
লেখক পরিচিতি- লেখক, সাংবাদিক। আটলান্টিক কাউন্টি গভর্নমেন্ট এ হিউম্যান সার্ভিসেস স্পেশালিস্ট পদে কর্মরত।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments