সুবোধ সরকারের 'ঋক্ষ মেষ কথা'
সেমিকোলনের আত্মজীবনী - ১৫
সায়ন
হিংস্র 'মেষ কথা'
উমবের্তো একোর 'নেম অফ দ্য রোজ' পড়তে পড়তে সুবোধ সরকার একটা জায়গায় এসে থামলেন, কিন্তু থমকালেন না - "চার্চ বলছে কমেডি চলবে না, হাসতে পারবে না, হাসলে ভয় চলে যাবে, আর ভয় না থাকলে তুমি অ্যান্টি-ক্রাইস্ট হয়ে উঠবে সুতরাং নির্মাণ করতে হবে ভয়। তার ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিষ্ঠান, দাঁড়িয়ে থাকে চার্চ, মন্দির মসজিদ সিনাগগ।" এই পর্যন্ত সুবোধ সরকার ২০০৯ সালে শারদীয়া 'কবিসম্মেলন' পত্রিকায় শেষ করেছিলেন, আমি আজ ৬ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ এর সঙ্গে যুক্ত করছি + বাংলা কবিতা চর্চা, + বাংলা আকাদেমি চত্বরে প্রবেশ, +ফেসবুকে মতামত,+ কে , কোন সাহিত্যিকের সঙ্গে কফি খাবে ছবি তুলবে আড্ডা দেবে তার উপর নজরদারি চলবে, না পারমিশন নিয়ে করা যাবে না কিচ্ছুটি । ভগবান এবং বাংলা কবিতার 'স্বচ্ছ সাহিত্য অভিজান' নিয়ে হাসাহাসি করা যাবে না।
সত্যি বলছি, এই জানলে কবিতা লিখতে আসতাম না, তবে ... তবে, এসে যে খুব ক্ষতি হয়েছে তা একদমই নয়। বরং অনেক বেশি সাহসী হয়েছি একথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি ।
নিউ-নর্মাল পিরিয়ড একদিন কেটে যাবে, এবার একটা জিমন্যসিযা়ম তৈরি করতে হবে মনে হয় - কাব্য ও দর্শনের সঙ্গে দেহ চর্চাটাও মন দিয়ে করতে হবে। কে জানে 'ঋক্ষ মেষ'দের কথা বলা কি যায়, কখন অপবিত্র বলে চিহ্নিত হয়ে যাবো।
আসুন কিছু কাহিনী শোনা যাক কবিতা পড়তে পড়তে। একটা বই খুলি ' ঋক্ষ মেষ কথা' , সুবোধ সরকার। একজন তরুণ এম.এ পরীক্ষার আগে রাত জেগে লেখাপড়া ফাঁকি দিয়ে ৭৪-৭৫ সালের লেখা কবিতা ১৯৮৩ সালে টিউশনির টাকা বাঁচিয়ে কবিতার বইটি ছাপেন। এক অখ্যাত তরুণ কবির কবিতার বই ভালোবেসে একজন প্রখ্যাত কবি মণিন্দ্র গুপ্ত প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন। (তখন বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকার জন্য কারোর মতামত নিতে হতো না, মনে হয়)কবিতার বইয়ের দুটি অংশ - 'দু'জন দ্রষ্টা' ও 'দুষ্কৃতকারীর সঙ্গে'।
এই না হলে কবির দৃষ্টি ! এখন আমি আর আপনারা দু'জন দ্রষ্টা , আমাদের সামনে বাংলা কবিতার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ এবং 'দুষ্কৃতকারী'দের বিষ চোখ আমাদের দিকে। আসুন একটা একটা করে মেষ কথা শোনা যাক -
মেষ কথা : ১
" মুন্ডিত মাথায় মলত্যাগ করে উড়ছে শকুন।
গলা অব্দি জলে পুবদিকে মুখ করে এরপর তর্পণ আরম্ভ
গালের দু'পাশ দিয়ে গড়িয়ে নামছে কালো থুতু।"
গত দুবছর ধরে অর্থাৎ ২০১৯-২০ সাল জুরে বাংলা কবিতায় একটা তীব্র বেনো জল ঢুকে গেছে। যার গন্ধে সাহিত্য চত্বরে মম করছে দুর্গন্ধ । এই দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে কবিতা কেই আশ্রয় করতে সাবান ,স্কার্ফ, স্যনিটাইজার, কিংবা স্নাইপার করে। এমনই একটি ঘটনার কথা বলি কিভাবে 'কালো থুতু' শকুনের মুখ থেকে ছিটে এসেছিল।
যাদবপুর কফি হাউসে আমার একজন কবির সঙ্গে আমি বসে কফি খেয়েছিলাম। একটি ছবি তুলে উনি ভালোবেসে ফেসবুকে দিয়েছিলেন। ব্যস রাতের বেলায় গ্রেট পার্জের মতো ফোন আমি সাহিত্যের অঙ্গনে রাজনৈতিক জল মাপছি নাকি। আমাকে স্পষ্ট করতে হবে - আমি কোন দলে আছি! আমি যেন কোনও মতেই সেই কবির সঙ্গে যোগাযোগ না রাখি, না হলে আকাদেমি চত্বরে কেউ আমার গায়ে হাত দিলে তারা কিন্তু প্রোটেকশন দিতে পারবে না। সিনিয়র কবিদের নাম করে আমাকে বলা হয় , সবাই নাকি ক্ষুদ্ধ আমার উপর।
সেদিন সারারাত ঘুমোতে পারি নি, সামন্য একটা ছবির জন্য নাকি আমি চিহ্নিত হলাম এইভাবে, ভাবতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল গোটা মস্কো কমিনটার্ন প্রতিটা হাঁটা চলাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল বরিস পাস্তানেকের। আসলে একটা কবিতা, একটা গল্প কিংবা উপন্যাস - সাহসের আখ্যানমালা কিংবা ছন্দের কার্তুজ ব্যবহার।
মেষ কথা : ২
"হেড লাইটের আলো নাচে হরিদ্রার বনে, আমি ভয়ে ভয়ে
এক পা পিছোই, এক পা এগোই
এরকম করতে করতে সন্ধ্যাকালে ধরা পড়ে গেছি
সরাসরি প্রেতের পেছনে
লাল ত্রিকোণের মধ্যে এক ফুটো - সেটা লক্ষ করে
আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে ঢুকে গেল।
অন্য পিঠে বের হয়ে দেখি একেবারে ভিন্ন জগৎ"
( গাভীর শৃঙ্গার)
ফেসবুক এখন একটা 'সেন্ট হেলেনা' কিংবা 'হরিদ্রার' বন হয়ে উঠেছে, আর এই দীর্ঘ প্যন্ডেমিক বাঙালিকে সোশ্যল মিডিয়ার দ্বারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করেছে। এতে অনেক নতুন পথ যেমন সত্যিই অভূতপূর্ব ভাবে মুক্ত হয়েছে তার চেয়ে সাংস্কৃতিক সংক্রমণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে মানবিকসত্ত্বা। একটা জাতির মধ্যে যে এত ভাযো়লেন্স লুকিয়ে আছে, 'নেটিজেন'দের পৃথিবীতে না হাঁটলে বোঝা যায় না।
অবশ্য অনেকে আবার জ্ঞানপাপীর মতো এই বিষয়টাকে সমর্থন করেও নিজেও কিন্তু সেই একই কাজ করবে। এই 'লাল ত্রিকোণ'এর একবিন্দু- লোক দেখানো জ্ঞান ও বি-শুদ্ধ শিল্পচর্চা, দ্বিতীয় বিন্দু - নিজের গোষ্ঠীর মধ্যে খাপ পঞ্চায়েত তৈরি , তৃতীয় বিন্দু- সারাদিন ধরে কাদা নিয়ে এর গায়ে মাখানো ওর গায়ে মাখানো বৈপ্লবিক চেষ্টা আর এই তিন বিন্দু দিয়ে টানা একটি মধ্যমা 'এক ফুটো' এসে যেখানে মিলিত হয় সেই ফুটো থেকে বার হয়ে আসে এক একজনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা ভয় যেখানে " আপাদমস্তক কালো কম্বল জড়িয়ে আমি কাঁদতে কাঁদতে - আমি বৃংহণ/ করতে করতে ছেড়ে এসেছি তোমাদের লোকালয়" (বৃংহণ)
তাহলে এবার কাহিনীটা শুনুন -
এমনভাবেই একজন কবির সঙ্গে তার ব্যক্তিগত জীবনকে সামনে এনে তার উপর রঙ চাপিয়ে দিনের পর দিন সবার সামনে নগ্ন করার একটা খেলা শুরু হয়েছে। কে ব্যক্তিগত ভাবে কার সঙ্গে কি করবে তাতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার তৃতীয় ব্যক্তিকে কে দিয়েছে? দিনের পর দিন একটা মানুষ নাকি বিভিন্ন মহিলাকে অশ্লীল চিত্র দিয়ে যাচ্ছে - আর তারাও নাকি সেগুলো চুপ করে নিয়ে যাচ্ছেন অত্যাচারিত হবেন বলে। আচ্ছা আপনারাই বলুন তো, আপনাকে যদি কেউ অশ্লীল বিষয়ে যুক্ত করতে থাকে আপনি কি চুপ করে থাকবেন! একটা শিশুও এই বিষয় শুনে হাসবে না কি! একজন কবিকে লিখতে হচ্ছে " আমি কি আত্মহত্যা করবো এবার" , - এই পর্যায়ে নেমে গেছে স্বচ্ছতার অভিযান বাংলা সাহিত্যের প্রান্তরে। তো এহেন অবস্থায় আমি সেই কবির জন্য একটি মতামত লিখতেই - আবাআআরর ফোন - পার্জ - কেন আমি লিখেছি তার পক্ষে!
কিন্তু এবার আর চুপ করে বসে থাকা যায় না, কবিতার আরেকটা নাম যদি সাহস হয়ে থাকে, মানবতা হয়ে থাকে তাহলে কলমকে ধরতেই হবে তীব্র বন্দুকের মতো। একজন তরুণ কবি যদি রাতজেগে নিজের যন্ত্রণার কথাগুলো লিখে যেতে পারে সময়ের টেবিলের উপর রেখে, রাতাজাগা আলোয় আমি আবার সেই টেবিল থেকে শব্দ-কুড়ানি ছেলে হয়ে তুলে নেবো -
" বর্শা ছুড়ে মারি চাঁদে; ভিখিরির মতো আমি পরশ্রীকাতর/ চোখের সামনে থেকে সোনার বৃশ্চিক তুলে নাও; তীব্র ক্ষোভ/ নিয়ে দেখি অস্তরাগ; প্রথমে ছিলাম রাজা, এখন রাক্ষস" (অন্য বসুন্ধরা)
কবিতাকে সামনে রেখে কতগুলো মানুষ দল পাকিয়ে ন্যক্কারজনক কিছু কাজ করে যাবে আর কেউ কিছু বলবে না ভেবে নিলে খুব হবে। তুকারামের হাত কেটে দিলেও যেমন কবিতা মরে না ভারভারা রাও -কে জেলের অন্ধকারে রাখলেও কবিতার আলো বন্ধ হয়ে যায় না। ওপরচালাকি শুধু " বাঁশফুলের অশুভ গন্ধ বের করে আনে সব ইঁদুরকে/ গ্রাম ছেড়ে যায় এক এক গোষ্ঠী, যারা যেতে চায় না, মাইলো/ খেতে খেতে দেখে জ্যোৎস্নায় ইঁদুর উঠছে বাঁশের মাথায়" (অন্নলীলা)
মেষ আর ইঁদুররের আরও কাহিনী আসছে পাঠক, সেমিকোলন কাঁধে বাঁধা আছে আমার।
জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
1 Comments
বেশ ভালো লেখা । সেমিকোলন অত্যন্ত প্রিয় সিরিজ ।
ReplyDelete