জ্বলদর্চি

কোনও এক গাঁয়ের বধূ আবার দুর্ভিক্ষের অশনি সংকেত দেখছে না তো!/গৌতম বাড়ই

কোনও এক গাঁয়ের বধূ আবার দুর্ভিক্ষের অশনি সংকেত দেখছে না তো!

গৌতম বাড়ই


পাঞ্জাব যে ভাবে কৃষিবিল নিয়ে জেগে উঠল প্রতিবাদে গর্জে উঠল তার ঢেউ আসমুদ্র হিমাচল পেরিয়ে আছড়ে পড়ল সাত সমুদ্দুর সাতাশ নদীর গন্ডী ছেড়ে ব্রিটেনে কানাডায়। পশ্চিম বাংলা পারল না কেন? পশ্চিমবঙ্গ তো কৃষিপ্রধান দেশ আর মা-মাটি-মানুষের প্রতিনিধি নাকি আমাদের বর্তমানের শাসক দল। তবে? আসলে আমরা মুখোশের ভেতরেও প্রত্যেকে ছদ্মবেশ পড়ে নেই তো?

আড়ালে অবাঙালীরা বলেন বাংলা যতটা গর্জে এখন, ততটা বর্ষে না। একদিন এই বাঙলাই ছিল আন্দোলন আর প্রতিবাদের আঁতুড়ঘর। ভাবতে অবাক লাগে স্বাধীনতা সেই চরম ক্রান্তিকালে কৃষান-মজদুর-শ্রমিক আর অগণিত মেহনতী মানুষের শ্রেণী সংগ্রামকে প্রাধান্য দিয়ে লোকসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতাতে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের বা IPTA এর গোড়াপত্তন হয়। কে ছিলেন না সেদিন? পৃথ্বীরাজ কাপুর থেকে সলিল চৌধুরী, উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটক, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, খাজা আহম্মদ আব্বাস, নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য্য প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিরা এর সদস্য ছিলেন শুরুর দিকে। ব্রিটিশ ভারত আর ১৯৩০-৪০ এর সেই উদ্দীপ্ত সময়ে এবং তার  পরেও সাধারণ মানুষ যখন বুঝতে পারলেন, আসলে শাসকের চেহারা বদলে গেলেও তাদের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে নতুন শাসকেরা দেশীয় হলেও সেই তিমিরে থাকবেই। শাসকেরা চিরটাকাল সেই পুঁজিবাজারের স্বার্থেই কাজ করবে আর জনগণের দুর্দশা চলতেই থাকবে। সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে।The King is dead long live the king ---------
ভারতীয় গণনাট্য সংঘ তোলপাড় করে দিচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর। বিখ্যাত সুরকার সলিল চৌধুরী গান লিখছেন সুর দিচ্ছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তার দরাজ উন্মুক্ত কন্ঠে ভাসিয়ে দিচ্ছেন এই চরাচর। মানুষের হৃদয় উদ্বেল হয়ে উঠছে। বিজন ভট্টাচার্য নবান্ন নিয়ে চষে ফেলছেন শহর থেকে গ্রামে। মানুষ প্রতিবাদের কন্ঠ খুঁজে পাচ্ছেন গানে। জোট বাঁধছেন। সারা ভারতে এই আন্দোলনের ঢেউ পৌঁছে যাচ্ছে। কৃষকেরা তাদের গ্লানিকর আধখাওয়া পৃথিবীটা বদলে দিয়ে এক খিদেমুক্ত জগত গড়তে চাইছেন।আন্দোলনের পিঠভূমি তখন এই বাঙলায়।

আর আজ? বাঙলার মিডিয়াগুলো খবর নয়, এখন বোধহয় নাটক তৈরী করে। বাংলার ঘরে-ঘরে, এই কৃষিপ্রধান বাঙলায় কৃষকেরা জানেন তো কৃষিবিলের সমূহ বিপদ গুলি। এখন রাতের গভীরতায় কৃষিপ্রধান দেশের কৃষিবিল পাস হবে? গুরুত্বপূর্ণ বিলের প্রকাশ্যে চর্চা কেন হবে না? পাঞ্জাবের কৃষকেরা বুঝেছে তাই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। আর্থিকভাবে পাঞ্জাব বাংলা থেকে বর্তমানে এগিয়ে থাকা রাজ্য। অতএব বাংলার ঘরে-ঘরে পেটে-পেটে যে খিদে পাঞ্জাব থেকে কম তাও তো নয়। বরং এই পাঞ্জাবে বাঙলা থেকে হাজার হাজার বে-রোজগেরে গ্রামের তরুণেরা রোজগারের আশায় পাড়ি দেয় (কোভিড-১৯ সময়টা ধর্তব্যে আনবেন না)। পাঞ্জাব দেখিয়ে দিচ্ছে আর আমরা তো আকছার দেখি হলদিবাড়ি, ধূপগুড়ি,উত্তর ২৪-পরগণার কৃষকেরা সব্জি উৎপাদনের দাম না পেয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। পরে সেই সবজি আমরা যখন অনেক দাম দিয়ে কিনি সেইসব আত্মঘাতী কৃষকের কথা খুব মনে পড়ে!

আসলে আমাদের প্রত্যেক রাজনীতিদলকে আজকের এই দুর্দশার জন্য দায়ী করতেই হয়। ধর্মীয় মৌলবাদী দলগুলোকে নিয়ে এক সুষ্ঠ গণতন্ত চলতে পারে না। মৌলবাদী দল যে অচিরে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠবে, এ আর নতুন কথা কী?

কৃষিবিল কী? এর সর্বনাশের দিকগুলি? এর থেকেও পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে মাতিয়ে রেখেছে বঙ্গীয় রাজনীতির দলবদলে মিডিয়াগুলি। পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু কৃষিপ্রধান দেশ। জাতপাতের চেয়েও আগামীদিনের ভাত আর রুটি যে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াবে, আমাদের সাধারণ জনগণ যদি এই গিমিক সর্বস্ব রাজনীতির চালাকিটা বুঝতেন তাহলে রাজনীতির কারবারীরা প্রমাদ গুণলেও আখেরে প্রত্যেকের লাভ। সরকারের দয়া-দাক্ষিণ্য জনগণের করের টাকায়। তাই কোনও সরকারী সাহায্যে কেউ কৃতিত্ব দেখাতে পারেন না। এটা জনগণের প্রাপ্য। 

আজ যখন ফের কৃষকের কান্না মাঠেঘাটে ভেসে ওঠে, দাদনদারদের মতন পঞ্চায়েত প্রধান যখন গ্রামীণ অর্থনীতিকে গ্রাস করে খাচ্ছে, তখন পুরানো সেই দিনের গণনাট্য সংঘের উত্তাল ইতিহাস মনে পড়ে।এখন তো ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে সব হাইজ্যাক করা অসাধু লোক দেখান রাজনীতি দেখতে পাই প্রতিটি রাজনৈতিক দলে। তাই গাঁয়ের বধূর কান্না শুনতে পাই না।

ধিতাং ধিতাং বলে এই  মনমরা কালো জোছনায় কোমর দুলিয়ে নাচ আসবে কী করে?

আরও পড়ুন
আজকের দিন

Post a Comment

0 Comments