জ্বলদর্চি

চেঁচুয়ার হাট-মেদিনীপুরের ইতিহাসের আঁতুড় ঘর /দুর্গাপদ ঘাঁটি

চেঁচুয়ার হাট-মেদিনীপুরের ইতিহাসের আঁতুড় ঘর

 দুর্গাপদ ঘাঁটি 

মেদিনীপুর জেলার প্রাচীন চেঁচুয়ার হাট বাংলার শিল্প, সাহিত্য, কৃষি, শিক্ষা, বানিজ্যে প্রাচীন সভ্যতার সাক্ষ্য  বহন করে। বর্তমান যে সব শহর গুলো গড়ে উঠেছে এবং বানিজ্য, শিক্ষায়,  সভ্যতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। পূর্বে কিন্তু অনেক অনেক হাট-বাজার সেই ভূমিকা পালন করতো। চেঁচুয়ার হাট তার অন্যতম। প্রায় তিন'শ বছরের লিখিত তথ্য মিললেও প্রকৃতপক্ষে এই হাট আরও প্রাচীন তার অনেক অলিখিত প্রমাণ আছে। বর্তমানে হাটটি যে স্থানে বসে তা কিন্তু আনুমানিক বারোশ বছর পূর্বে যখন 
বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের ঢেউ বাংলায় আছড়ে পড়েছিল তখন হাটটি বসতো বর্তমান অবস্থান থেকে কিছুটা উত্তর পশ্চিমে কাঁসাই নদীর তীরে। এই হাট সংলগ্ন নদী ঘাটতির সঙ্গে তৎকালীন তাম্রলিপ্ত বন্দরের সঙ্গে নদী পথে পরিবহন, প্রচার ও বানিজ্যিক সম্পর্ক চলত। পার্শবর্তী এলাকার বেপক আঁখ চাষ হওয়ার কারণে দাসপুর থানা  ব্যাপী কয়েকশ আঁখমাড়াই কল গড়ে উঠেছিল। আর এখান থেকে  উৎপাদিত গুড় বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে রপ্তানি হত, সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে বিড়ি ও সব্জী এবং অন্যান্য খাদ্য দ্রব্যও।
     মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার দাসপুর থানা নদীমাতৃক সভ্যতা বহন করে। উত্তর বরাবর শিলাই নদী, পূর্বে  রূপনারায়ণ নদ এবং দাসপুর থানার বুক চিরে বয়ে যাওয়া কংসাবতী ও তার শাখা পলাশপাই খাল এ মাটিকে সুজলা -সুফলা-শস্য শ্যামলা করে তুলে ছিল প্রাচীনকাল থেকেই। 

     এখানকার মাটিতে  অনেক ইতিহাস ঘটে গ্যাছে ইতিমধ্যে। তার মধ্যে অন্যতম এখানকার  স্বাধীনতা আন্দোলনের  বৃহত্তম  ইতিহাসের একটুকরো তুলে ধরছি। ইতিমধ্যে দাসপুর থানার পার্শ্ববর্তী স্থানে ঘটে যাওয়া সন্যাসী বিদ্রোহ, দাসপুরের বড় শিমুলিয়া গ্রামে ক্ষুদিরাম বসুর নেতৃত্বে বৃটিশ সরকারের ডাক বাক্স ছিনতাই, মাষ্টার দা সূর্য সেনের নির্দেশে প্রচার পত্র বিলি ও সর্বশেষ ক্ষুদিরামের ফাঁসির মঞ্চে আত্মদান এই দাসপুরে উর্বর ভূমির স্বাধীন চেতা ভূমি-পুত্রদের স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। তারপর ঘাটালে চারণ কবি মুকুন্দ দাসের ১৯২৭ সালে স্বদেশী যাত্রাপালা, আরও এক বীর বিপ্লবী প্রদ্যুৎ ভট্টাচার্যের স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষা ও কার্যক্রম এখানকার স্বাধীন চেতা মানুষদের আরও দ্বিগুণ উৎসাহে  উৎসাহিত করে তোলে। 

     মহাত্মাগান্ধীর নেতৃত্বে ১৯৩০ সালে লবণ আইন অমান্য  আন্দোলনের ঢেউ ভারত বর্ষের অন্যান্য অংশের মতো এই  দাসপুর থানায় ছড়িয়ে পড়েছিলো তীব্রভাবে। শ্যামগঞ্জ, সোনাখালি, নন্দনপুর, তেমোহানী ঘাট, চক্ কিশোর, চেঁচুয়ার হাট জায়গাগুলি স্বাধীনতা আন্দোলনের উর্বর ক্ষেত্রভূমি হিসেবে চিহ্নিত। মৃগেন্দ্র ভট্টাচার্য, কানন গোস্বামী, বিনোদ বেরা, জীবনকৃষ্ণ মাইতি, মন্মথ মুখার্জি, অরবিন্দ মাইতি, রেবতীরাজ পণ্ডিত, জানকী পণ্ডিত, পুষ্প চ্যাটার্জী, বিনোদ সামন্ত, কিশোরী মাল, রাই মাল সহ আরও আরও শত শত স্বদেশপ্রেমী মানুষ কাঁসাইয়ের প্রধান শাখা পলাশপাইয়ের খালের তীরে  চেঁচুয়ার হাটের মাটিকে গর্বিত করেছিল। শ্যামগঞ্জ লবণ আইন আন্দোলনের উৎসমুখ হয়েছিল কারণ বঙ্গোপসাগরের লোনাজল রূপনারায়ণ নদের মাধ্যমে জোয়ারে এসে পৌঁছাত এই স্থানে। সেই লবণাক্ত জল তুলে লবণ তৈরি করতেন ওখানকার কিছু বাসিন্দা। সেই দেশীয় লবণ গ্রামে গঞ্জে  বিক্রি করে জীবিকা অর্জনও করতেন। ব্রিটিশ শাসকদের লবণ আইন  এঁদেরকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ইতিমধ্যে এখানকার জাতীয় নেতৃত্বের তত্বাবধানে গঠিত বি.বি.সি.সি-র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এই আইনের বিরুদ্ধে লবন প্রস্তুত কারকদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় নেতৃত্বের নির্দেশ মতো শুরু করেন সভা-পিকেটিং, অবস্থান। উল্লেখ্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরাও লবন তৈরি ও বাজারে বিক্রির ব্যাপারে ওতপ্রোতভাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
     দাসপুর থানার চেঁচুয়ার হাটই  ঘাটাল মহকুমার প্রধান ক্রয় বিক্রয় ও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিলো। তার প্রধান প্রধান কারণগুলি হল- স্বাধীনতা আন্দোলনের থানার  মুখ্য নেতৃত্ব -মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, কানন গোস্বামী, যোগেন হাজরা  প্রমুখদের বাড়ি এবং কোলাঘাট থেকে নদী পথে শহর কলকাতার ও দেশের অন্যান্য অংশের  সঙ্গে সুযোগ ছিলো মালপত্র আদান-প্রদানে। তা হতো রূপনারায়ণ নদ, কাঁসাই নদী ও পলাশপাই খালের মাধ্যমে এই হাটে সু-যোগাযোগের  জন্য। 
    যাইহোক অহিংস আন্দোলনের সাথে সাথে  সহিংস আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেন স্বেচ্ছাসেবীদের একটা অংশ। গোপনে যুগান্তর দলের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিলো। তারা অনুভব করেছিলেন যে বিনা রক্তপাতে যখন পৃথিবীর কোন আন্দোলনে সফলতা আসেনি তখন তাঁদের সেভাবেই প্রস্তুত থাকতে হবে।
     এদিকে দাসপুর থানার ও সি ভোলানাথ ঘোষের নেতৃত্বে অত্যাচার চরমে উঠে। তিনি ও তাঁর সাঙ্গ- পাঙ্গ  পুলিশের অমানবিক ধরপাকড় ও অত্যাচারে সংগ্রামী স্বেচ্ছাসেবীদের অনেকে অচৈতন্য হতেন। তার উপর হাটে বিক্রয়রত দেশীয় লবণ নষ্ট করা, তার উপর মুত্র-ত্যাগ সহ নানা নেক্কার জনক ঘটনা ঘটাতে থাকেন। স্বদেশীদের এরেস্ট করে নির্মমভাবে অত্যানার করতেন ও.সি. মি.ঘোষ।  
   এমন অত্যাচারেও স্বেচ্ছাসেবকদের মনবল দমন করতে পারেননি। বরং তাঁদের আন্দোলনের ধার হাজার গুন বেড়ে ওঠে । উল্লেখ্য এখানকার যাবতীয় আন্দোলনের রূপ-রেখা ও পরিকল্পনা  জাতীয় নেতৃত্ব চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস ও ঢাকার সহিংস আন্দোলনের নেতৃত্বদের  সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই হত।
      বাংলার ১৩৩৬ সালের ২০শে জ্যৈষ্ঠ মঙ্গলবার,  ইংরেজি ১৯৩০এর ৩রা জুন। সেদিনটা ছিল মঙ্গলবারের ভরা হাট। পোড়ানো হল বিলেতি কাপড়। খবর পৌঁছে যায় দাসপুর থানায়। ওসি মি.ঘোষ সঙ্গে সাব-ইন্সপেক্টর অনিরুদ্ধ সামন্ত ও সঙ্গে কিছু কনস্টেবল নিয়ে হাটে পৌঁছান। ইতিমধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে পার্শবর্তী এলাকায় ও বিশেষ করে স্বেচ্ছাসেবকদের আর এক আস্তানা চক্ কিশোর গ্রামে যে স্বেচ্ছাসেবী -কালিপদ সামন্ত, হরিপদ মাজী, প্রবোধ সামন্ত ও তারাপদ চক্রবর্তীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। 
    সেদিন হাটে  উপস্থিত হন বয়সে তরুণ সংগ্রামী মৃগেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য, মাথায় গান্ধী টুপি। অকুতোভয়  তিনি পুলিশের বেঞ্চ দখল করে বসেন। তা দেখে ভোলানাথ ক্রোধে মৃগেন্দ্রের উপর লাঠি চালাতে থাকেন। সাহসী তরুণ মৃগেন্দ্র ভট্টাচার্য সেই লাঠি কেড়ে নিয়ে ভোলা দারোগার উপর উপর্যুপরি প্রহার করতে থাকেন। উৎসাহিত স্বেচ্ছাসেবী ও হাটের সমবেত মানুষ সহ অসংখ্য মেয়েরাও  ঝাঁটা কুড়ুল, কাঠারি সহ ইত্যাদি নিয়ে পুলিশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। ঘটনাস্থলে ওসি ভোলানাথ ঘোষের মৃত্যু হয়। রাতের অন্ধকারে তাঁর দেহ গোবিন্দনগর গ্রামের ডোমনার মাঠে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আর সাব ইন্সপেক্টর অনিরুদ্ধ সামন্তের দেহ বোওয়ালিয়ার মাঠে চিৎমল্লিকা পুকুরের জলে টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দেন বিক্ষুদ্ধ মানুষ। আর বাকী পুলিশের কয়েকজন আত্মসমর্পণ করেন এবং উর্দি খুলে বন্ধুক ত্যাগ করে পলাশপাই খালের খাসি কাটার ঘাট টপকে কোন রকমে প্রাণে বাঁচেন।
      এমন আক্রমন ও ব্রিটিশ পুলিশের প্রাণহানির  খবর চলে যায় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তরে! দাসপুর থানা ব্যাপী অহিংস ও সহিংস আন্দোলনের ব্যাপকতা বিষয়ে পূর্বে জানা ছিল না। পরের দিনই বিশাল গোরা সেনা ও পুলিশ বাহিনী পৌঁছায় গোবিন্দ নগর গ্রামের চেঁচুয়া হাটে। চলে ধড়-পাকড় এ গ্রাম ছাড়াও পাশাপাশি গ্রামেও। নেমে আসে পুলিশের নির্মম  অত্যাচার। পুরুষেরা সবাই গৃহছাড়া। তাই পুলিশ পিকেটিং এর নামে মেয়েদের উপরেও চলে অত্যাচার,সঙ্গে লুটপাট। চলে এরেস্ট শয়ে শয়ে।
     গ্রেফতার হওয়া সংগ্রামীদের জন্য সুভাষ চন্দ্র বসুর অনুরোধে কলকাতা হাই কোর্টে সওয়াল করলেন প্রখ্যাত আইনজীবী এস.সেন। যাবজ্জীবন দীপান্তর হয় কানন গোস্বামী, মৃগেন্দ্র নাথ বাগ, যোগেন্দ্র হাজরা, শীতল ভট্টাচার্য, বিনোদ বেরা এবং ভুতনাথ মান্নার। সাত বছরের জেল হল মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য,  কালাচাঁদ ঘাঁটি, ব্রজ ভুঁইয়া, কালিপদ সামন্ত, জীবন পতি ও যুগল মালের। ফায়ারিং জেলে ৫০ জনের শাস্তি হল। তাদের মধ্যে রাধানাথ ঘাঁটি (গোবিন্দ নগর), অষ্টম হাজরা, রজনী পাঁজা, প্রাণকৃষ্ণ গুছাইত, ক্ষিতীশ মণ্ডল প্রমুখ। আর পরে বেশ কিছু সংগ্রামীদের শ্বাপদ-সংকুল অরণ্যের হিংস পশুদের মাঝে ছেড়ে দেওয়া হল।
     এর উপর চেঁচুয়ার হাটে পুলিশের ক্যাম্প থেকে অত্যাচারের মাত্রা  ক্রমশ বেড়েই চলে। অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবীরা রাতারাতি চক্ কিশোর গ্রামে 
সভা ডাকলেন। সিদ্ধান্ত হয়  তীব্র আন্দোলন ও অবরোধে-অবরোধে হাট থেকে ক্যাম্প হটিয়ে দিতে হবে। ১৯৩০ সালের ৬ই জুন সকাল থেকে দাসপুরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী ও স্বাধীনতাকামী মানুষ চেঁচুয়ার হাটের পূর্ব দিকে পলাশপাই খাল পাড়বাঁধ বরাবর সমবেত হন।হাজার হাজার কণ্ঠে ধ্বনীত হতে থাকে 'বন্দেমাতরম' ধ্বনি সঙ্গে -''ইংরেজ দূর হটাও। চেঁচুয়ার হাট থেকে অবিলম্বে ক্যাম্প তুলতে হবে।" ভীত ইংরেজ গোরা সেনা ও সিপাহীরা প্রাণ ভয়ে ঐ হাজার হাজার জনতার দিকে গুলি চালাতে চালাতে কাঁসাইয়ের শাখা পলাশপাই খালের খাসি কাটা ঘাট পেরিয়ে পালিয়ে যান।  
    কিন্তু হায়! ঐ বর্বর জাতির সিপাহীদের গুলিতে শত শত মানুষ আহত ও ১৪ জন বীর বিদ্রোহী শহীদ হলেন। শহীদরা হলেন-চন্দ্র কান্ত মান্না, শশিভূষণ মাইতি, কালিপদ শাসমল, ভৃগুরাম পাল, দেবেন্দ্রনাথ ধাড়া,শতীসচন্দ্র মিদ্যা, রামচন্দ্র পাড়ুই,নিতাই পড়্যা, অবিনাশ দিন্ডা, অশ্বিনী দোলই, সত্য বেরা, শশী দিন্ডা, পূর্ণ চন্দ্র সিংহ ও মোহন মাইতি। এই শহীদদের মৃত্যুর খবর শুনে  মহাত্মা গান্ধী বড্ড শোকাহত হয়েছিলেন। 

   যাইহোক, এইভাবে চেঁচুয়ার হাটে শহীদদের রক্ত, শোকার্ত মায়েদের গগনভেদী  চিৎকার মেদিনীপুর জেলার স্বাধীনতা আন্দোলনে শত শক্তি সঞ্চারিত করল। 
    ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হল বটে কিন্তু চেঁচুয়ার হাটে ভারতবর্ষের এমন বৃহত্তর আন্দোলন ভারত- বর্ষের ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ঠাঁই পায়নি তেমন এখনও।

পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments