জ্বলদর্চি

রাশিয়ার দুবনা, দুবনার ভাবনা(২য় পর্ব) /তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়

রাশিয়ার দুবনা, দুবনার ভাবনা
২য় পর্ব

 তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়

আগের পর্বে দুবনা ও তার আশেপাশের অঞ্চল সম্পর্কে যা কিছু লেখা হয়নি বলে আমার মনে হয়েছে তা এই পর্বে লিখছি। ভোল্গা নদীর দুই তীর ধরে গড়ে ওঠা দুবনা শহরের শরৎকালীন ছবি দেখিয়েছিলাম। শীতকালে নদীটি জমে যাওয়ার পরে কেমন লাগে দেখতে চাইবেন নিশ্চয়ই। একটা ভিডিও দিলাম (ভিডিও ১ দেখুন)।
ভারতকে শুধু রাশিয়ার সামরিক সরঞ্জামের প্রধান ক্রেতা হিসেবে দেখলেই হবেনা, এদের মধ্যে মিলও প্রচুর। দুবনা অঞ্চলের নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষেরা যে রকমের সাইকেল ব্যবহার করেন সেগুলো আমাদের ওখানের গ্রামের দিকে ব্যবহার করা (হিরো বা অ্যাটলাস বা ফিলিপ্স কোম্পানির) সাধারণ সাইকেলের মতোই। অনেক রাশিয়ার মানুষই ইস্কনের সাথে যুক্ত। আমার সাথে দুবনার একজন মানুষের পরিচয় হয়েছে। তিনি পেশায় আলোকচিত্রী। তিনি আবার ইস্কনের বৈষ্ণব ধর্মের চেয়ে বেশি নিরামিষ ভোজনপ্রণালীর অনুসরণ করেন। এখানের একটি উপহার সামগ্রীর দোকানে ইস্কন থেকে ধূপ, মূর্তি, পুঁতির মালার মতো অনেক জিনিস আসে। এমনকি আমি গণেশদেবের ছবি আঁকা দেওয়ালে টাঙানোর কাগজও দেখেছি। অনেকেই ছুটিতে গোয়া বেড়াতে যায়। ১৯৮০’র দশকে, রাশিয়ার মানুষদের (বিশেষ করে রুশ রমণীদের) ওপর ভারতীয় (তার ওপরে বাঙালি) অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী মহাশয়ের যে প্রভাব পড়েছিল ওনার ‘ডিস্কো ডান্সার’ সিনেমা বেরোনার (১৯৮২) পর, তা আজো ঐ সময়ের মানুষেরা (মানে এখন যাঁরা আমাদের বাবা-মা-কাকা-কাকিমার বয়সী) মনে রেখেছেন। একবার বেড়াতে বেড়িয়ে কিম্রি শহরের (দুবনা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে জার অঞ্চলের একটি পুরনো শহর) বাসিন্দা এক পরিবারের সাথে দেখা হয়েছিলো আমার। আমায় দেখেই স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলেই স্পষ্ট উচ্চারণে ‘মিঠুন চক্রবর্তী’ মহাশয়ের নামোল্লেখ করে ‘জিমি জিমি’ গান গাইতে শুরু করেন। আমিতো অবাক- সেই উৎসাহ-উন্মাদনা, হুজুগ, ভালোবাসা- আজ আটত্রিশ বছর পরেও অটুট! রুশ এবং সংস্কৃত (বা হিন্দি) ভাষার অনেকগুলো শব্দের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। যেমন- চাই (চায়=চা), আনানাস (আনানস=আনারস), দ্ভের (দ্বার=দরজা), ত্রি (ত্রি=তিন), পিৎ (পেয়=পান), দেভির (দেভর=দেওর), গ্রিভা (গ্রীবা=ঘাড়), নাশ, নাস (নাশ, নাস=আমাদের), সভয়ো  (স্ব=নিজের), তভয়ো (ত্বাম=তুমি), আগোন (অগ্নি=আগুন), আরবুজ (তরবুজ=তরমুজ), ব্র্যাত (ভ্রাতা=ভাই), নেবা (নভঃ=আকাশ), মিয়াসো (মাঁস=মাংস), ঝিজন্ (জিভন্=জীবন), বগ (ভগ=ভগবান) এরকম আরও অনেক। কেন এতো মিল? ব্যাপকভাবে স্বীকৃত কুর্গান উপপ্রমেয় অনুসারে প্রাগ-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার বিবর্তিত ধারা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের মানুষ প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের উত্তরাঞ্চলের শুষ্ক প্রান্তরে (আধুনিক মানচিত্রের রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চল ও ইউক্রেন)। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০-১০০০ বৎসরের মধ্যে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষার মানুষ আনাতোলিয়া থেকে বলকান অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে [১]। ভাষাতত্ত্ব অনুযায়ী আমরা জানি যে প্রাগ-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের শতম গোষ্ঠীর দুটি প্রধান শাখা হল বাল্টো-স্লাভিক (বাল্টিক এবং স্লাভীয়) এবং ইন্দো-ইরানীয় ভাষা। বাল্টো-স্লাভিক ভাষাগোষ্ঠীর একটি ভাষা হল রুশভাষা [২]। অপরদিকে ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর একটি ভাষা হল ভারতীয় আর্য ভাষা। এপ্রসঙ্গে বলি রাশিয়ান ল্যাবিরিন্থ (গোলকধাঁধা) আর মহাভারতের চক্রব্যূহের নকশাও একইরকমের। কি? এতো কিছু মিল উল্লেখ করে, নিজেকে জেমস বণ্ড ভেবে ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’ করার ইচ্ছে হচ্ছে? ইচ্ছে হলে আগে বাকিটা অবশ্যই পড়ে নিন।


চিত্র ১-এ দুবনা শহরের প্রধান এবং দর্শনীয় কিছু স্থান ও স্মৃতিচিহ্ন দেখিয়েছি। আগের পর্বে বলেছিলাম দুবনা শহরটি বেড়ে উঠেছে নিউক্লিয় গবেষণার জন্য JINR (প্রতিষ্ঠা দিবস ২৬শে মার্চ, ১৯৫৬) [৩] (চিত্র ১-(১)), মিসাইল তৈরির কারখানা MKB Raduga (প্রতিষ্ঠা ১৯৫১ সালে) [৪] এবং ইভানকোভো জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে (চিত্র ১-(৭)) কেন্দ্র করে। এছাড়াও পরে গড়ে ওঠা দুবনা শহরের প্রধান কারখানাগুলোর মধ্যে ‘অ্যাটম’ [৫] ও ‘তেনজর’ [৬] অন্যতম। ১৯৪৬ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের সভাপতি ভ্যাভিলভ,- প্রযুক্তি, রসায়ন, ওষুধ এবং জীবনবিজ্ঞানের কাজে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন স্তালিনের কাছে। তদানীন্তন পারমাণবিক প্রকল্পের প্রধান বলেছিলেন- "পরমাণুকে সৈনিক নয়, কর্মী হতে দেওয়া হোক।" পরবর্তীকালে এই উদ্ধৃতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘অ্যাটম’ কারখানার পাশে একটি আবাসনের দেওয়ালের গায়ে এই কথাটিই লেখা আছে (চিত্র ১-(৯))। আধুনিক স্পেকট্রোমেট্রিক, রেডিওমেট্রিক এবং ডোজিমিট্রিক সরঞ্জাম তৈরির কারখানা হিসেবে ‘অ্যাটম’ ও ‘অ্যাসপেক্ট’ [৭] চালু হয়। ১৯৬৪ সালে শিল্পী এ. কুজনেৎসভ ‘শান্তিকামী পরমাণু’ (পিসফুল অ্যাটম) নামের একটি মোজাইক স্তম্ভ বানান যেখানে তিনি পদার্থবিদ্যা সম্পর্কিত বিভিন্ন আঁকিবুঁকির মাঝে দু হাত পেতে থাকা একজন খালি গায়ের মানুষকে বানান। সেই মানুষের বুকে আঁকেন একটি পরমাণুকে। স্থানীয়রা ব্যঙ্গ করে ছবির মানুষটিকে ‘ল্যাংটা ভিখারি’ বলতেন [৮]। পরে নতুন স্টেশন ভবন নির্মাণের সময় এটি ভেঙে পরে। পরে আবার ঐ মোজাইকের ছবিতে দুবনিয়াম মৌলের নাম বসিয়ে পুনর্নির্মাণ করে স্থাপন করা হয় ২০১০ সালে (চিত্র ১-(৮))। JINR এ আবিষ্কৃত পরীক্ষাগারে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট (প্রকৃতিতে পাওয়া যায়না) অতি-ভারী মৌলগুলোর মধ্যে রয়েছে দুবনিয়াম, ফ্লেরভিয়াম, মস্কোভিয়াম (আমেরিকান বিজ্ঞানীদের সঙ্গে একত্রে), লিভারমোরিয়াম (লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির সঙ্গে একত্রে), টেনেসি (আমেরিকান বিজ্ঞানীদের সঙ্গে একত্রে), ওগানেসন (লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির সঙ্গে একত্রে)। ওগানেসন আবিষ্কারের পর মেন্দেলিভের পর্যায় সারণীর সপ্তম সারিও পূর্ণ হয়ে গেলো। বিজ্ঞানীরা ভাবছেন এরপরের আবিষ্কৃত মৌলগুলোর জন্যে অষ্টম সারি যোগ করা হবে। দুবনাতে ‘Russian Satellite Communication Company’ [৯] নামের একটি স্যাটেলাইট অপারেটরও (চিত্র ১-(৩) আছে। 

রাশিয়ার একক আসনবিশিষ্ট ইলিউশিন-যুদ্ধবিমান-২ এর নকশা তৈরি করেছিলেন সেরগি ইলিউশিন এবং তাঁর দলবল ১৯৩৮ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ সালে নিঝনি তাগিল শহরের যুদ্ধবিমান তৈরির কারখানায় এই যুদ্ধবিমানটি তৈরি হয়। ১৯৪৩ সালের ২২শে জুন এই বিমানটি ভূপতিত হয় দুবনা শহরের প্রধান অংশ থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের এক জলাভূমিতে। ২০০৪ সালে ঐ ভেঙে যাওয়া বিমানের কাঠামোটি দুবনা শহরে নিয়ে আসা হয় হেলিকপ্টারে করে। ওটির সাথে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে পাওয়া আরও ৫ টি বিমানের অন্যান্য অংশ একত্রিত করে দুবনার এই বর্তমান স্মৃতিস্তম্ভটি (চিত্র ১-(২)) তৈরি। এটির পুনর্নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন এম. ভি. ইভানকোভ এবং আই. বি. কোতলেভস্কায়া। স্থানীয় আসবাব তৈরির কারখানা ‘ইকোমেবেল’ ২০০৫ সালে ৯ মিটার দীর্ঘ একটি বিশালাকার দর্শনীয় কাঠের চেয়ার (চিত্র ১-(৬)) বানান। ঐ জায়গাতেই একটি দিকনির্দেশক আছে, যেটি এখন ইউরোপীয় কেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত হয়। দুবনা থেকে নিউ ইয়র্ক আর দুবনা থেকে টোকিওর দূরত্ব সমান। বিজ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্য নিয়ে নতুনভাবে গড়ে ওঠা দুবনা শহরেই প্রায় ৭ টি গির্জা (রাতমিনোয় কুমারী মাতা মেরি গির্জা (চিত্র ১-(৪), সেন্ট জন ব্যাপ্টিস্ট গির্জা, এপিফ্যানির চ্যাপেল, কাঠের তৈরি স্মলেন্সকায়া গির্জা (চিত্র ১-(৫), অল সেন্টস গির্জা, পান্তেলেমনার গির্জা, দ্যানিয়েল পেরেজাস্লাভস্কগোর গির্জা) রয়েছে। রাতমিনোয় মাতা মেরির সম্মানে ১৮২৭ সালে একটি পাথরের গির্জা তৈরি করা হয়। ১৯৩৭ সালে সোভিয়েত আমলে এটি প্রায় নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৮৮ সালে বিশ্বাসী মানুষদের দাবিতে আবার এটি সাজানো হয় [১০]। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের শহীদ সৈনিকদের প্রতি সম্মান জানিয়ে তৈরি একটি যুদ্ধ স্মারক (চিত্র ১-(১০)) আছে নদীর তীরে, দুবনা-৩ হোটেলের (গ্রিল) কাছে।
দুবনা শহরাঞ্চলে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রতিমূর্তি স্থাপিত হয়েছে। এখানে এগারোজনের প্রতিমূর্তির আলোকচিত্র দিলাম (চিত্র ২ দেখুন)

 (১) জোসেফ স্ত্যালিন (এখন প্রতিমূর্তিটি নেই) (২) ভ্লাদিমির লেলিন (৩) ভ্লাদিমির ভিসোৎস্কি (৪) স্তালিনের প্রতিমূর্তির স্তম্ভমূল (৫) ইগর কুর্চাতভ (৬) মিখাইল মেসচেরিয়াকভ (৭) দিমিত্রি মেন্দেলিভ (৮) মিখাইল গ্লিনকা (৯) আলোচনারত ভেনেদিক্ত জেলেপভ এবং ব্রুনো পন্তেকরভো (১০) গিওরগি ফ্লেয়োরভ (১১) নিকোলাই বোগোলিউবভ এবং (১২) ইলিয়া ফ্রাঙ্ক। এনাদের মধ্যে ইগর কুর্চাতভ (চিত্র ২-(৫)), মিখাইল মেসচেরিয়াকভ (চিত্র ২-(৬)) এবং মেন্দেলিভের (চিত্র ২-(৭)) কথা আগের পর্বে উল্লেখ করেছিলাম। কুর্চাতভ এবং মেসচেরিয়াকভের প্রতিমূর্তি দুটি বানিয়েছিলেন ভাস্কর মামিকান সাজেতেলিয়ান। ১৯৩৭ সালে স্ত্যালিন (চিত্র ২-(১)) এবং লেলিনের (চিত্র ২-(২) দুটি প্রতিমূর্তি, মস্কো-ভোলগা খালের দুই পারে মুখোমুখিভাবে এমন করে স্থাপিত হয়েছিল যেন দুবনার দিকে আগত জাহাজগুলিকে ওনারা স্বাগত জানাচ্ছেন। স্ত্যালিনের প্রতিমূর্তিটিও একই আকারের ছিল। স্ত্যালিন এবং লেলিন দুজনেরই প্রতিমূর্তিটি বানিয়েছিলেন বিখ্যাত, জনপ্রিয় ভাস্কর সারগে মারকুরভ। ১৯২৪ সালে লেলিনের মৃত্যুর পর অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে নিজের অবস্থান পাকা করে নেন স্ত্যালিন। ১৯৬১ সালে, ডিস্ত্যালিনাইজেশনের পরিস্থিতিতে বিস্ফোরণ করে ভেঙে দেওয়া হয় স্ত্যালিনের প্রতিমূর্তিটি। এই বিস্ফোরণের ফলে পাশে থাকা একটি সুড়ঙ্গে ফাটল হয়ে যায়। সুড়ঙ্গের ছাদ থেকে পড়া জলকে স্থানীয় বাসিন্দারা "স্ত্যালিনের অশ্রু" বলতে শুরু করেছিলেন। ধ্বংসাবশেষের একটি অংশ জলে পড়েছিল। স্ত্যালিনের প্রতিমূর্তিটি এখন আর নেই। তার স্তম্ভমূলটি পরে রয়েছে (চিত্র ২-(৪))। লেনিনের প্রতিমূর্তিটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে সূর্যের দিকে মুখ করে।
সাম্যবাদের কথা এলে প্রথমেই সোভিয়েত রাশিয়ার নাম মনে আসে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫ টি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পূর্বে সোভিয়েত ইউনিয়নও বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের মতই পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি ছিল। তার পরিণতি এমন? এ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই যা আমার রাশিয়ান এবং কাজাকাস্তানের বন্ধুদের থেকে জেনেছি। কে ভালো, কে খারাপ বিচার না করে (সেই ব্যাপক অভিজ্ঞতা এবং ইতিহাসজ্ঞান আমার নেই) কিছু তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি। তার পরে আবার ফিরে আসব অন্য প্রতিমূর্তিগুলোর কথায়। রুশ বিপ্লবের ইতিবাচক দিক অবশ্যই ছিল। জার সাম্রাজ্যের পতন আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর,- যুদ্ধ থেকে সরে এসে শান্তি স্থাপন, বিধ্বস্ত রণক্লান্ত সৈনিকদের দাবি পূরণ, সমস্ত ভূসম্পত্তির রাষ্ট্রায়ত্তকরণ-এসবই ছিল বলশেভিকদের (সংখ্যাগরিষ্ঠ দল) প্রথম দিকের পরিকল্পনা। এই ফাঁকে লেলিনের দুটি কথা স্মরণ করিয়ে দিই- (১) “আমাদের কোনও সংসদীয় প্রজাতন্ত্রের দরকার নেই, আমাদের কোনও বুর্জোয়া গণতন্ত্রের দরকার নেই।” (২) “শ্রমিক, সৈনিক এবং কৃষক প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত সরকার ছাড়া, আমাদের আর কোনও সরকারের প্রয়োজন নেই।” দেশে শিক্ষার হার বাড়ল, সারা দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহেরও ব্যবস্থা হল, কুলাক শ্রেণীকে (ধনী কৃষক, জমিদার, মহাজন বা জোতদার) নিয়ন্ত্রণ করতে যৌথ খামার (রাশিয়ান ভাষায় কলহোজ) তৈরি হল। কিন্তু, ধীরে ধীরে সরকারের নেতিবাচক দিকগুলোর জন্য গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। স্তালিনের সময়ে ‘হলদমোর’ নামে কৃত্তিম দুর্ভিক্ষটি ঘটে [১১]। জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার যে ভূমিদাস প্রথার উচ্ছেদ করেছিলেন ১৮৬১ সালে, যৌথ খামারের আড়ালে সেটিই ফিরে আসতে থাকে। ১৯৭৫ সালের আগে পর্যন্ত চাষিরা যৌথ খামার কাঠামোর দাসত্ব থেকে বেরোতে পারেননি। তখন রাশিয়ান চাষিরা সোভিয়েত আমলের সাম্যবাদী দলের নামকে (ВКПБ) ব্যাঙ্গ করতে শুরু করে “বলশেভিকদের দ্বিতীয় ভূমিদাসপ্রথা”-এর (Второе Крепостное Право
Большевиков) আদ্যক্ষরা হিসেবে [১২]। ‘গুলাগ’ (Главное управление лагерей, সংক্ষেপে ГУЛАГ) বা শ্রমিক শিবিরের কথা আগের পর্বে উল্লেখ করেছিলাম মস্কো-ভোলগা খাল বানানোর কথা বলতে গিয়ে। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব হওয়ার পর এই শ্রমিক শিবিরগুলো বানানো হলেও, ১৯৩০-এর দশকে সোভিয়েত কর্ণধার জোসেফ স্তালিনের শিল্প বিপ্লবের পরিকল্পনায় গুলাগ বন্দীদের সংখ্যা বেড়ে যায়। সেই সময়ে প্রায় ১৪ মিলিয়ন লোককে গুলাগে বন্দী (বাদ্যযন্ত্র থেরামিনের আবিষ্কারক লিওন থেরেমিনকেও প্রতিবিপ্লবী সন্দেহে পাঠানো হয়েছিলো) করা হয়। তাদেরকেই গুলাগে বন্দী করা হতো যারা রাজনৈতিক বন্দী বা সাধারণ জনগণ যারা সোভিয়েত শাসন সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য করেছেন, বা ছিঁচকে চোর বা সাধারণ অপরাধী যাদের দণ্ডিত শ্রম করানোর জন্য। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর তাঁদের খাবারের জোগানের অপ্রতুলতা থাকায় তাঁরা ইঁদুর বা বন্য কুকুর খেতেও পিছুপা হতেননা। দামী প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যবহারের  বদলে তাঁদের হাতে ধরানো হতো হাতুড়ি, কোদাল এইসব। মৃত্যুর ছাড়া গুলাগ থেকে মুক্তির কোনও রাস্তা বাকি থাকতো না। মস্কো ভোল্গা খাল, দুবনা-মস্কো রেলপথ নির্মাণ ছাড়াও শ্বেত সাগর-বাল্টিক খাল, কোলিমা রাজপথ (‘দ্য রোড অফ বোনস’) নির্মাণের সাথে গুলাগ বন্দীদের রক্তাক্ত ইতিহাস জড়িয়ে আছে [১৩]।স্ত্যালিন ‘গ্রেট পারজ’ বা গ্রেট টেরর’ (১৯৩৬-১৯৩৮ সালে) নামক দমননীতি পরিচালনা করেন। ট্রটস্কিপন্থী, প্রয়াত লেনিনের প্রতি নমনীয় এবং তথাকথিত ‘প্রতিবিপ্লবী’ এবং ‘জনগণের শত্রু’- এমন সন্দেহজনক হাজার হাজার সদস্যকে পার্টি থেকে বহিষ্কার, বাধ্যতামুলক নির্বাসন বা ফাঁসি বা গুলাগ বন্দী হিসেবে পাঠানো কার্যকর করা হয়, সাম্যবাদী দলের শুদ্ধিকরণের জন্য। সোভিয়েত আমলে নাস্তিকতাই সরকারি নীতি ছিলো। ফলে বহু গির্জা, মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিলো। এ সমস্ত কিছুকেই তখন ‘সোশ্যাল ফ্যাসিজম’ বলা হতো। ইতিহাসের এসব কথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে মাধ্যমিকের সময় রাত জেগে ইতিহাসের নোট বানানোর কথা, আমার মামা কাঞ্চন চক্রবর্তী মহাশয়ের কথা। উনি ইতিহাসের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে অন্যান্য লেখকের বই, এমনকি ওনার কলেজে পড়ার সময়কার স্নাতক স্তরের ইতিহাসের অনেক বই আমায় পড়তে দিয়েছিলেন। আমি সেসব পড়ে মধ্যযুগ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে আরও বেশি করে জানতে পারতাম।
১৯৮৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় আসা মিখাইল গর্ভাচেভের চিন্তাধারা ভিন্ন ছিল। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের পুরনো শাসন ব্যবস্থা বদলে পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদ এর মিশ্রণ বানানো এবং বাক স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছিলেন। শেষের দিকে সাম্যবাদী দলের নেতারাও সুবিধাভোগী এবং দূর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েন এবং সোভিয়েত জনগণও একভাবে চলতে থাকা ভীতি থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলেন। তদুপরি যুক্ত হয় চেরনোবিল বিস্ফোরণ। গর্ভাচেভ চেরনোবিল বিস্ফোরণ এবং বিধ্বংসী ফলাফলকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বলেছিলেন। ইউক্রেনের পৃপিয়াত চেরনোবিল নিউক্লিয় বিদ্যুৎকেন্দ্রে (সরকারি নাম- ভ্লাদিমির ইলিয়িচ লেলিন নিউক্লিয় বিদ্যুৎকেন্দ্র) ১৯৮৬ সালের ২৬শে এপ্রিল এখনো পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ নিউক্লিয়ার বিপর্যয়টি ঘটে। সরকারি তথ্যমতে, দুর্ঘটনার কারণে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ লোক (তার মধ্যে ছয় লক্ষ শিশু) ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। বর্তমানে ঐ জায়গাটি পরিত্যক্ত এবং প্রায় ৫০ মাইল এলাকা জুড়ে বলতে গেলে কেউই বাস করে না। চেরনোবিলের আশেপাশের পরিত্যক্ত অঞ্চল এখনো তেজস্ক্রিয় সিজিয়াম-১৩৭, ষ্ট্রন্সিয়াম-৯০, অ্যামেরিসিয়াম-২৪১, প্লুটোনিয়াম-২৩৮,২৩৯ দিয়ে (এদের মধ্যে প্লুটোনিয়াম বেশি বিষাক্ত) দূষিত [১৪]। মনে করা হয় যে বিশ্বের দরবারে নাম খারাপ যাতে না হয়, সেজন্যে সোভিয়েত সরকার প্রথমদিকে এই বিস্ফোরণের খবর চেপে গিয়েছিলো। ১৯৯১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। যে দ্বিতীয় নিকোলাসকে বলশেভিক কমিউনিস্টরা দেখতো একজন স্বৈরাচার হিসেবে, তাকেই আধুনিক রাশিয়া এখন দেখছে একটু ভিন্ন চোখে। ইয়েকাতারিনবার্গ-এর যেখানে ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে জার নেতা দ্বিতীয় নিকোলাস, তার স্ত্রী, সন্তান ও দাস দাসীদেরকে বলশেভিকরা হত্যা করেছিলো আর তারপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে বিকৃত করা তাদের মরদেহ একটি ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো শহরের বাইরে,  সেই 'চার্চ অন দ্য ব্লাড' নামের অর্থোডক্স গির্জায় (বছর কয়েক আগে) প্রার্থনা করতে আসা একজন বৃদ্ধার কথায়, "আমি তাঁকে দেখি রাশিয়া নামক একটি বিশাল জাহাজের নাবিক হিসেবে। দেশটির একেবারে শেষ সময় পর্যন্ত তিনি এই জাহাজেই অবস্থান করেছেন" [১৫]। অন্যদিকে এখনো অনেকেই লেলিনকেই ভগবান হিসেবে পূজো করেন। আমি দেখেছি এখানের কোনও কোনও গাড়িতে বা ট্রেনের গায়ে কাস্তে-হাতুরি-তারা চিহ্ন লাগানো। আবার নতুন প্রজন্মের অনেকেই স্ত্যালিনকে দেখেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয় এনে দেওয়া নায়ক হিসাবে। অবশ্য এবিষয়ে আমি বলবো বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনে কেমনভাবে জাতীয়তাবাদী ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে তার ওপরও অনেকের জ্ঞান এবং ভাবনা নির্ভর করে। আসলে “রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে”। হে কবিগুরু, সব প্রশ্নের উত্তর তুমিই।

  সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন নিজের চোখে দেখার এবং অনুভব করার অভিজ্ঞতা আছে JINR এর একজন বিজ্ঞানী বিজন সাহা মহাশয়ের। বাংলাদেশে জন্ম হলেও, ১৯৮৩ সালে মস্কোয় চলে আসেন উনি। বহুকাল সাম্যবাদী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওনাকে এসব নিয়ে জিগ্যেস করায় উনি বললেন, “অবিশ্বাসটাও একপ্রকারের বিশ্বাস। বলপূর্বক অন্যের ওপর সেটাকে বর্তানোও তো চরমপন্থার পরিচয় বটেই।” প্রসঙ্গত বলি উনি কিন্তু এখনোও বামপন্থারই সমর্থক। ভাববেন না যেন উনি দলবদলি করে ফেলে এসব বলছেন। ২০১২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাশিয়ায় অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মীদের সংখ্যা ছিল- সমগ্রের ৪১.১ শতাংশ, যেখানে নাস্তিকদের সংখ্যা ছিল ১৩ শতাংশ। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাশিয়ায় অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মীদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সমগ্রের ৭১ শতাংশ [১৬]।
ইতিহাস, ধর্ম, বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে অনেক কথা হল। এবার ফিরি একটু বিজ্ঞানে। (চিত্র ২-(১১)) এর প্রতিমূর্তিটি নিকোলাই বোগোলিউবভের। এটি বানিয়েছিলেন ভাস্কর এম. কে. মেরাবিশভিলি। ওনার তাত্বিক পদার্থবিদ্যায় (বিশেষত কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি, ক্লাসিক্যাল এবং কোয়ান্টাম মেকানিকসে) অবদান প্রচুর। উনি ডির‍্যাক পদক পান ১৯৯২ সালে। ইলিয়া ফ্রাঙ্ক (চিত্র ২-(১২)) ১৯৫৮ সালে অপর দুজন রুশ পদার্থবিজ্ঞানী পাভেল চেরেনকভ এবং ইগর তামের সাথে যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন চেরেনকভ বিকিরণ সংক্রান্ত ঘটনাসমূহ ব্যাখ্যা করার জন্য। (চিত্র ২-(৯)) এ আলোচনারত ভেনেদিক্ত জেলেপভ এবং ব্রুনো পন্তেকরভোকে দেখা যাচ্ছে। জেলেপভ তদানীন্তন বিশ্বের বৃহত্তম ৬৮০ মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট এনার্জি প্রদানকারী সিনক্রো-সাইক্লোট্রোন নির্মাণের সময় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। কণা পদার্থবিদ্যায় (বিশেষত মিউয়ন বিষয়ক গবেষণায়) ওনার অবদান প্রচুর। তাছাড়া সোভিয়েত রাশিয়ায়, কর্কটরোগ নিরাময়ে আধানযুক্ত কণিকার ব্যবহার শুরু করার ক্ষেত্রেও ওনার অবদান অনস্বীকার্য [১৭]। যে ৪৩ বছর পন্তেকরভো দুবনায় ছিলেন, জেলেপভ এবং পন্তেকরভো দুজনে ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। নিউট্রিনোর আচরণ বিষয়ে তাঁর কাজগুলো তাঁকে বিখ্যাত করেছে। নিউট্রিনোরা যে একাধিক রকমের (ইলেকট্রনের সঙ্গে সম্পর্কিত, মিউয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত) হয়ে থাকতে পারে, -এ ধারণা যাঁরা দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উনিও একজন। ভ্লাদিমির গ্রিবভ এবং পন্তেকরভো, তত্বগতভাবে দেখিয়েছিলেন কিভাবে নিউট্রিনোর রকমফের হতে পারে [১৮]। ওনাকে তাই “মিস্টার নিউট্রিনো” বলেও ডাকা হতো [১৯]। পন্তেকরভো বিখ্যাত বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির ছাত্র ছিলেন। ইতালিতে জন্মালেও তখনকার কমিউনিজমে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এবং ইউরোপ ত্যাগ করে রাশিয়ায় আসেন। জেলেপভ স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছেন কারোর কারোর যেমন প্রবল ধর্মীয় বিশ্বাস থাকে, পন্তেকরভোরও তেমন কমিউনিজমে বিশ্বাস ছিল। পারমাণবিক গুপ্তচর হিসাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পন্তেকরভোই হয়তো সবচেয়ে দক্ষ, প্রাণবন্ত এবং বর্ণাঢ্য (গবেষণা ছাড়াও থিয়েটার, শিল্প, স্থাপত্য, সাঁতার, মাছ ধরা ইত্যাদিতে আগ্রহী ছিলেন) পদার্থবিদ ছিলেন। ১৯৫০ সালে স্ত্রী এবং শিশুদের সাথে তিনি নিখোঁজ হওয়ার আগে, গোপন পারমাণবিক প্রকল্পে কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করছিলেন। বেশিরভাগ লোক মনে করেছিলেন যে পন্তেকরভো সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করেছিলেন এবং গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই সোভিয়েত রাশিয়ায় চলে আসেন [২০]।জেলেপভ, বোগোলিউবভ এবং ফ্লেয়োরভ-এঁদের সকলের নামেই গবেষণাগার রয়েছে JINR এ। 
(চিত্র ২-(১০)) এর প্রতিমূর্তিটি গিওরগি ফ্লেয়োরভের। এটি বানান ভাস্কর মামিকন সাজেতেলিয়ান। ফ্লেয়োরভ এবং পেত্রজাক ১৯৪০ সালে প্রথম ইউরেনিয়ামের স্বতঃস্ফূর্ত বিভাজন (Spontaneous fission) আবিস্কার করেন [২১]। এ ছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জোসেফ স্ত্যালিনকে সোভিয়েত ইউনিয়নে পারমাণবিক বোমা প্রকল্প শুরু করার জন্য পাঠানো চিঠির জন্যও তিনি পরিচিত। ফ্লেয়োরভ আর স্বতঃস্ফূর্ত বিভাজনের কথা এলই যখন, তখন এ প্রসঙ্গে বাঙালি পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ শ্যামাদাস চ্যাটার্জীর কথা [২২] উল্লেখ করতে ইচ্ছে হচ্ছে। ১৯৩৯ সালে কেন্দ্রক বিভাজন প্রক্রিয়া (nuclear fission) আবিষ্কারের কথা শোনার পর শ্যামাদাস নিজের টাকাতেই ৫ গ্রাম ইউরেনিয়াম কিনে ফেলেন। তিনি তখন কলকাতার বোস ইন্সটিটিউটে কর্মরত। লক্ষ্যবস্তু (target) ইউরেনিয়ামের ওপর নিউট্রন প্রক্ষেপণের জন্য ‘রেডিয়াম-বেরিলিয়াম’ (RaBe) উৎস (source) ব্যবহার করেন এবং কেন্দ্রক বিভাজন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট পদার্থের কণাগুলিকে নিজেরই বানানো গাইগার মুলার কাউন্টারের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনবীক্ষকে (Oscilloscope) সনাক্ত করতে থাকেন। নিউট্রনের উৎসটি সরিয়ে দেওয়ার পরেও (ফলে ঐ উৎস থেকে কোনও নিউট্রন, ইউরেনিয়ামের ওপর আপতিত হচ্ছেনা) অদ্ভুতভাবে তিনি সিগন্যাল পেতে থাকেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করলে তিনি বলেন আশেপাশে সর্বদা বিদ্যমান মহাজাগতিক নিউট্রনই হয়তো কেন্দ্রক বিভাজন প্রক্রিয়া ঘটাচ্ছে, ‘রেডিয়াম-বেরিলিয়াম’ উৎস দূরে সরিয়ে দেওয়ার পরও। এ কথা শুনে তিনি সীসা আর ক্যাডমিয়াম দিয়ে ঢাকা দেন ভালো করে ওনার কাউন্টার এবং ইউরেনিয়ামের লক্ষ্যবস্তুটি। তা সত্বেও তিনি ফিশন পালস পেতে থাকেন। তখন সত্যেন্দ্রনাথ পরামর্শ দেন হয়তো ইউরেনিয়ামের স্বতঃস্ফূর্ত বিভাজন প্রক্রিয়ার বৈদ্যুতিন স্পন্দন (pulse) ওগুলো। উনি ইউরেনিয়ামের স্বতঃস্ফূর্ত বিভাজন প্রক্রিয়ার অর্ধায়ু নির্ণয় করেন ১০১৬ বছর। বোর-হুইলারের তাত্বিক পদার্থবিদ্যার হিসেব অনুযায়ী এটি ছিল ১০২২ বছর [২৩]। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর উৎসাহ দানে উনি এটি ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচার’ নামক বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় পাঠান। শ্যামাদাসের গবেষণামূলক প্রবন্ধের (thesis) অধীক্ষকই (supervisor) ছিলেন তখন ঐ পত্রিকার সম্পাদক। তত্ত্বীয় মানের সঙ্গে পরীক্ষালব্ধ মানের এতো পার্থক্য (১০৬ বছর)  হওয়ায় উনি শ্যামাদাসকে ঐ গবেষণাপত্রটি প্রত্যাহার করে নিতে বলেন। এই ঘটনার প্রায় দু মাস পরেই রাশিয়ার ফ্লেয়োরভ এবং পেত্রজাকের পর্যবেক্ষণ প্রকাশ পায়। ভাবুন আজ শ্যামাদাসের গবেষণাপত্রটি সময়মতো প্রকাশ পেলে উনিই হতেন স্বতঃস্ফূর্ত বিভাজন প্রক্রিয়ার আবিষ্কারক। শ্যামাদাসের পরীক্ষালব্ধ মান এবং ওনার সময় থেকে এতো বছর ধরে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে গৃহীত অর্ধায়ুর মান (৮.২১০১৫ বছর) [২৪] কাছাকাছি। পরে আরও নিপুণভাবে শ্যামাদাস পরীক্ষা করেন এবং ইউরেনিয়ামের স্বতঃস্ফূর্ত বিভাজন প্রক্রিয়ার অর্ধায়ু নির্ণয় করেন ১.৩১০১৬ এবং গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচার’ পত্রিকাতেই ১৯৪৪ সালে [২৫]। কি ভাবছেন? বাঙালিরা এমন কতো কিছু হারিয়েছে বাঙালিদের জন্যেই!

  মিখাইল গ্লিনকা (চিত্র ২-(৮)) হলেন নিজের দেশে প্রভূত স্বীকৃতি অর্জনকারী প্রথম রাশিয়ান সুরকার। রাশিয়ান ধ্রুপদী সংগীতের প্রবর্তক হিসাবে তাঁর নাম উঠে আসে। ১৮৩৫ সালে তাঁর সৃষ্ট ‘আ লাইফ ফর দ্য জার- ইভান সুসানিন’ [২৬, ২৭] হল বিশ্ব জুড়ে সমাদৃত প্রথম রাশিয়ান অপেরা। এছাড়াও তাঁর কাজগুলির মধ্যে ‘নকচার্ন ইন এফ মাইনর-লা সেপারেশন’, ‘রুস্লান এবং লিউদমিলা (অপেরা)’ অন্যতম। সুরকার পিয়েতোর ইলিইচ চেকভস্কির মতে গ্লিনকা’র অর্কেস্ট্রা কামারিনস্কায়া (১৮৪৮) ছিল একটি ওক ফল যা থেকে পরে রাশিয়ান সিম্ফোনি সংগীতের ওক গাছ (রূপকার্থে) বড় হয়েছে। ১৮৮৪ সালে মিত্রফান বেলিয়াএভ ‘গ্লিনকা পুরস্কার’-এর সূচনা করেন। ভ্লাদিমির ভিসোৎস্কি (চিত্র ২-(৩)) ছিলেন একজন সোভিয়েত রাশিয়ান গায়ক, গীতিকার, কবি এবং অভিনেতা। ওনার কাজের অপরিসীম প্রভাব পড়েছিল সোভিয়েত এবং রাশিয়ান সংস্কৃতি উপর। স্বতন্ত্র সঙ্গীত শৈলীর জন্যই উনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন। দুবনার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ‘মির’-এর মঞ্চেও অনুষ্ঠান করেছিলেন তিনি। তাঁকে সম্মান জানিয়েই ২০০৮ সালে ভাস্কর ওলেগ ইয়ানোভস্কির বানানো এই প্রতিমূর্তিটি স্থাপন করা হয়। ওনার বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে একটি হল “উল্ফ হান্ট” [২৮]। 
বেলারুশের শিল্পী নাদিয়া খোদোসিয়েভিচ লেজার ১৯৭২ সালে প্যারিসে একটি প্রদর্শনীর পর তাঁর তৈরি ৬০ টি মোজাইক প্রতিকৃতি সোভিয়েত সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে দান করেন।  কিন্তু ওগুলো কোথায় রাখা হবে তা আগে থেকে ভাবা ছিলোনা। ১৯৭৪ সালে, দুবনা হাউস অফ কালচারের (“মির”) তদানীন্তন পরিচালক ভি. ইয়া. মুখোয়ারোভা’র সম্মতিতে ২৮ টি (মতান্তরে ২০ টি) মোজাইক প্যানেল দুবনায় আনা হয়, নাদিয়া লেজারের অজান্তেই। ১৯৭৫ সালে এগুলি JINR কে স্থায়ীভাবে প্রদর্শনীর জন্য দান করা হয়। তখন কেউই ভাবতে পারেনি যে ঐ মোজাইকগুলোর জন্য বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদদের শহরটিতে কি দুঃখজনক পরিণতি অপেক্ষা করছে। পরে নাদিয়া জানতে পেরে দুবনা এসে হাউস অফ কালচারের অধিকর্তা বি বিকবোভার সাথে দেখা করেন। তিনি অখুশি ছিলেন তাঁর সৃষ্টির প্রতি অনাদর দেখে [২৯]। খোলা আকাশের নীচে উন্মুক্তভাবে রাখার জন্য অনেক মোজাইকই নষ্ট হতে শুরু করে। কিছু একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে, দুবনার ৪০ তম প্রতিষ্ঠা দিবসে, শহরের প্রধান স্থপতি ই ইউ সোসিন দিমিত্রভের শিল্পীদের সহায়তায় মোজাইকগুলোর পুনরুদ্ধার করার সিদ্ধান্ত নেন। তারপর থেকে দুবনার বিভিন্ন জায়গায় মোজাইকগুলো রাখা আছে। সারগেই আইসেন্সতাইনের প্রতিকৃতি বয়স্ক চলচ্চিত্র কর্মীদের ঘরের সামনে, চারজন মহাকাশচারীর প্রতিকৃতি ‘অক্টোবর প্যালেস অফ কালচার’ এর সামনে কস্মোনট স্কয়ারের সামনে আর ১০ টি দুবনার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (হাউস অফ কালচার) ‘মির’-এর সামনে রাখা আছে। কার্ল মার্ক্স, লেলিন এবং ক্রুপ্সকায়া’র মোজাইক প্রতিকৃতিগুলো আর প্রদর্শনীর জন্য রাখা নেই আদর্শগত কারণে (সে যুগ আর নেই বলে হয়তো)। তবে এখনো ওগুলো উন্মুক্তভাবেই রাখা আছে। জানিনা কতদিন টিকবে যদি না সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয় বা কমপক্ষে কাঁচ বা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের আবরণের মধ্যে রাখা হয়? 


যে দশজন বিখ্যাত মানুষের মোজাইক প্রতিকৃতি ‘মির’-এর সামনে রাখা আছে, তাঁরা হলেন চিত্র ৩-(১) সোভিয়েত ব্যালে নর্তকী মায়া প্লিসেৎস্কায়া (২) সুরকার দিমিত্রি শস্তাকোভিচ (৩) কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি (৪) বেহালাবাদক লিওনিদ কোগান (৫) সাহিত্যিক লিও তলস্তয় (৬) সুরকার ও পিয়ানোবাদক রদিয়ন সিদ্রিন (৭) সঙ্গীত শিল্পী (রোম্যান্টিক যুগের) পিয়েতোর ইলিইচ চাইকোভস্কি (৮) সোভিয়েত পার্টিজ্যান জয়া কসমোদেমিয়ানস্কায়া (৯) সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমের স্রষ্টা, কথাসাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি এবং (১০) ফরাসী চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর ফার্নান্দ লেজার।
  এঁদের মধ্যে লিও তলস্তয় ও ম্যাক্সিম গোর্কিকে অনেকেই হয়তো চেনেন। ম্যাক্সিম গোর্কির লেখা ‘মা’ উপন্যাস পড়েছেন নিশ্চয়ই অনেকে। একটি বাংলা গানে ওনার কথা আছে। কোন গান মনে পড়ছে? ভূপেন হাজারিকার গান- “আমি এক যাযাবর। আমি গঙ্গার থেকে মিসিসিপি হয়ে ভল্গার রূপ দেখেছি......মার্ক টোয়েনের সমাধিতে বসে গোর্কির কথা বলেছি।” অহিংসা আন্দোলনের ধারণায় লেখা তলস্তয়ের ‘Kingdom of God is Within You (1894)’-এর প্রভাব ফেলেছিলো মহাত্মা গান্ধী এবং মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এর ওপর। রদিয়ন সিদ্রিন এবং মায়া প্লিসেৎস্কায়া  হলেন স্বামী-স্ত্রী। মায়া প্লিসেৎস্কায়ার বিখ্যাত ‘সোয়ান লেক’ আর ‘ডাইং সোয়ান’ দেখেছেন নিশ্চয়ই। প্লিসেৎস্কায়াকে নাদিয়া, ওনার বিখ্যাত রাজহাঁসের ভঙ্গিমাতেই এঁকেছেন। ফার্নান্দ লেজার ছিলেন নাদিয়ার স্বামী। ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে যে শিল্পী লিও তলস্তয়ের প্রতিকৃতির সামনে তিনি মোজাইকে একটি বার্চ গাছও বানিয়েছেন। আসলে তলস্তয় যেখানে জন্মেছিলেন সেই জায়গাটি (ইয়াস্নায়া পলিয়ানা) বার্চ, ওক ইত্যাদি গাছে ঘেরা। তলস্তয় ঐ বাড়িতে বসেই বিশ্ববিখ্যাত ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ এবং ‘অ্যানা ক্যারেনিনা’ লিখেছিলেন। তাঁর ঐ উপন্যাসগুলিতেও বার্চ গাছে উল্লেখ আছে। এমনকি বার্চ গাছের ছাল থেকে তিনি গ্রামীণ উপায়ে নিজের পায়ের জুতোও তৈরি করতেন। ঐ বাড়ির কাছাকাছিই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছিলো। তলস্তয়ের সেই বাড়ির আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ঘুরে দেখতে চাইলে এই তথ্যসূত্রে [৩০] এ যান। বার্চ গাছের সঙ্গে তলস্তয়ের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার কারণেই হয়তো নাদিয়া মোজাইকেও বার্চের চিহ্ন রেখেছেন। শস্তাকোভিচের ওয়াল্টজ নৃত্যের সঙ্গীত বিখ্যাত “ওয়াল্টজ নং ২” কেউ শুনেছেন? পিয়েতোর ইলিইচ চাইকোভস্কি  একজন গ্লিনকা (সুরকার মিখাইল গ্লিনকার কথা আগেই উল্লেখ করেছি) পুরস্কার প্রাপক।
অনেক রাশিয়ার বিখ্যাত মানুষকে চেনা হল। এবার আসি আমার কিছু অভিজ্ঞতা এবং সেই বিষয়ক কিছু ভাবনার কথায়। এখানে এসে দেখতে পাই দোকান পরিবর্তন করলে জিনিসপত্রের দামও পরিবর্তন হচ্ছে। কোনও কোনও ওষুধের ক্ষেত্রে দামের ২০০ রুবল পর্যন্ত বাড়াকমা দেখেছি। এখানে পণ্যদ্রব্যের ওপর কোনও ‘সর্বোচ্চ খুচরো মূল্য’ (Maximum Retail Price) বা ‘নির্দেশিত খুচরো মূল্য’ (Suggestive Retail Price) থাকেনা। আমাদের ভারতে সর্বোচ্চ খুচরো মূল্যের উল্লেখ থাকে। কর ফাঁকি রোধ, গ্রাহক সচেতনতা বৃদ্ধি, ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন, কালোবাজারি বন্ধ করা, অন্যায্য দাম হাঁকানো অসাধু ব্যবসায়ীদের থেকে ক্রেতাদের সুরক্ষার কথা ভেবে আমাদের ভারতে ১৯৯০ সালে সর্বোচ্চ খুচরো মূল্য নির্ধারণ চাল হয়। শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং বাংলাদেশেও বেশ কিছু পণ্যদ্রব্যে সর্বোচ্চ খুচরো মূল্যের উল্লেখ থাকে। তাছাড়া আর কোনও দেশে সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের সর্বোচ্চ খুচরো মূল্য ধার্য করা থাকে বলে আমার জানা নেই। আমাদের দেশে রয়েছে নিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতি। আর রাশিয়ায় আছে মুক্ত বাজার অর্থনীতি। সরকার নয়, এখানে প্রতিষ্ঠানের মালিক, দোকানের মালিক বা বিনিয়োগকারী সংস্থাই পণ্যদ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করে। যে মানুষটি দূরে দোকান করে বসে আছে স্বাভাবিকভাবেই তার পরিবহন মূল্য, দ্রব্যাদি সংরক্ষণবাবদ খরচ না উঠলে লোকসান। মুক্ত বাজার অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিক্রেতার এই সুবিধাটি থাকলেও, ক্রেতাদের মাঝে সাঝেই ফাঁদে পড়তে হয়। 
বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে পাথরের (বা মার্বেলের) ব্যবহার রাশিয়ায় প্রাচীনকাল থেকে চলে এসেছে। ১৮ শতাব্দীতে (১৭০১-১৮০০) মূলত চুন সুরকির গাঁথনি দেওয়া হতো বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে। সিমেন্টের ব্যবহার শুরু হয় ১৯ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে [৩১]। 


কোনগুলো জার আমলে (চিত্র ৪-(২) তৈরি আর কোনগুলো সোভিয়েত আমলের (চিত্র ৪-(৫)) বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। শুধুমাত্র কাঠের তৈরি অনেক পুরনো বাড়ি এবং গির্জাও দেখতে পাওয়া যায়। দুবনা শহর তুলনামূলকভাবে নতুন বলে এইসব কাঠের তৈরি বাড়ি দেখতে হলে একটু দূরে, অন্য অঞ্চলে যেতে হবে। তবে দুবনায় একটি কাঠের গির্জা আছে। আবার অনেক পুরনো বাড়ির দেওয়ালে চুন-সুরকি বা ইট-সিমেন্ট এবং কাঠের সংমিশ্রণ দেখা যায়। এই ধরণের বাড়ির দেওয়ালগুলোর ক্ষেত্রে প্রথমে চুন-সুরকি বা ইট-সিমেন্টের গাঁথনি, তারপর অন্তরক পদার্থ হিসেবে মিনারেল উল বা গ্লাস-ফাইবার উলের স্তর, তারপর চেরা পাতলা কাঠের ডোরাযুক্ত স্তর, তারপর প্লাস্টার (রাশিয়ান নাম স্তুকাতুর্কা) আর সবশেষে রঙ দিয়ে দেওয়াল তৈরি হয় (চিত্র ৪-দেখুন)।
আমার পরিচিত অনেকেই আমায় প্রশ্ন করেন এখানে এতো ঠাণ্ডায় আছি কিকরে? আমাদের দেশের গ্রামে শীতকালে তাপমাত্রা নেমে +১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হলেই বলা হয়- “খুব ঠাণ্ডা রেখেছে।” কে রেখেছে রে? হয়তো প্রকৃতির কথা বলা হয়। আমাদের ওখানের মানুষের ধারণা,- ওখানের মতোই ঘরবাড়ির গঠন হয়তো এখানেও। এদেশের বাড়ির জানালাগুলো আমাদের ওখানের গ্রামাঞ্চলের বাড়ির জানালার মতো এখানে ওখানে ফুটোওলা নয় যে ঘরের ভিতরের ও বাইরের তাপমাত্রা প্রায় এক হয়ে যাবে। এখানের জানালার পাল্লাগুলোতে দুটো করে কাঁচের স্তর থাকে। মাধ্যমিকের ভৌত বিজ্ঞান একটু মনে করলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে ব্যাপারটা। কাঁচ তো তাপের কুপরিবাহীই। তদুপরি দুটো কাঁচের মাঝে আবদ্ধ বাতাসও অন্তরক হিসেবে কাজ করে। ভেতরের তাপ বাইরে যেতে পারেনা। ঠিক যেমন একটা সোয়েটার আর দুটো পাতলা জামা একইরকম ফল দেয়, যেহেতু দুটো পাতলা জামার মধ্যেকার বাতাস তাপ আটকে রাখছে। ঘর গরম রাখার জন্য আবার তাপ বিকিরক যন্ত্র রাখা থাকে। এগুলি পাইপের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গরম জলের দ্বারা কেন্দ্রীয়ভাবে উত্তপ্ত করা হয়।  জলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব স্থানীয় বয়লার স্টেশন বা তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্রের। বড় বড় শহরগুলিতে জলের তাপমাত্রা আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গণনা করা হয়। ছোটো ছোটো বয়লার কেন্দ্রগুলোতে এগুলো হাতে করে ঠিক করা হয়। যাইহোক, নিয়ম অনুযায়ী কোনও অ্যাপার্টমেন্টে তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি (শোয়ার ঘরের তাপমাত্রার ঊর্ধ্বসীমা ২৪ ডিগ্রি) এবং স্নানাগারে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর রাখা হয়। এটি পরিচলন প্রক্রিয়ায় ঘরের ভেতরের বাতাস গরম রাখে। এখানে আমার থাকার ঘরের তাপ বিকিরক এবং জানালা-দরজা কেমন তা দেখিয়ে একটা ভিডিও দিলাম (ভিডিও ২ দেখুন)। 
   গরম জলীয় তাপ বিকিরকগুলোর উদ্ভাবন হয় রাশিয়াতেই প্রথম। শিল্পপতি  ফ্রাঞ্জ সান গ্যালি (জন্মসূত্রে প্রুশিয়ার মানুষ কিন্তু রাশিয়ার ব্যবসায়ী) সেন্ট পিটার্সবার্গে  তাঁর কারখানায় তৈরি করেন প্রথম। ১৯১৭ সালের আগে বেশিরভাগ বাড়িতেই ঘরগুলোকে কাঠ জ্বালানো চুল্লি থেকেই গরম রাখা হতো। কেন্দ্রীয়ভাবে গরম জলপ্রবাহ দিয়ে ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা সোভিয়েত আমলেই শুরু হয় (১৯২৪ সাল নাগাদ)। ১৯৬০ এর দশকে খ্রুসচেভের সময় যখন সব জেলায় জেলায় নতুন আবাসন বানানো হতে লাগলো তখন সেই ঘরগুলোতে ঢালাই-লোহার বা বাষ্পীয় তাপ বিকিরকের ব্যবহার বেড়ে গেলো। রাশিয়ার মানুষ প্রায় ভুলতেই শুরু করলো পুরনো দিনে কেমন বা কতোটা শীত অনুভূত হতো। এখন নতুন বাড়িগুলোতে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি তাপ বিকিরক লাগানো হয়। ১৯৮০ এর দশকে, সোভিয়েত প্রকৌশলীরা চিন্তাভাবনা করেছিলেন বটে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে ঘর গরম করার বিষয়ে, তবে চেরনোবিল বিপর্যয়ের পর আর  তা বাস্তবায়িত হয়নি। আজকাল, রাশিয়ান বয়লার কেন্দ্রগুলো জ্বালানী হিসেবে গ্যাস ব্যবহার করে [৩২]। 
  এবার বলবো এখানের সমাজে নারীদের স্থান নিয়ে। একবছর ধরে এখানে থাকার পর একদিন আমার মনে হল, আমি যেন চারপাশে মহিলাদেরই বেশি দেখছি। আমাদের ইন্সটিটিউটের অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন বাড়িতে, পথে, বাজারে, দোকানে সর্বত্র। এ কোণে, ও কোণে- সব দিকেই দেখি পুরুষের চেয়ে বেশি মহিলারাই সিগারেট ফুঁকছেন (আমি কিন্তু বলিনি শুধু মেয়েদের সিগারেট ফোঁকা বা ফোঁকা-(নো) উচিৎ নয়, তাই অনুগ্রহ করে অযথা আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবেননা)। পরে খোঁজ নিয়ে দেখলাম আসলে রাশিয়ায় মহিলার সংখ্যা বেশিই। ২০১৮ সালের রসস্টাট (Russian Federal State Statistics Service) এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে ১৪৬.৯ মিলিয়ন মানুষ বাস করেন, যেখানে ৬৮.১ মিলিয়ন (৪৬ শতাংশ) পুরুষ এবং ৭৮.৮ মিলিয়ন (৫৪ শতাংশ) মহিলা রয়েছেন। রাশিয়ান বেসামরিক কর্মচারীদের মধ্যে ৭২ শতাংশ মহিলা এবং পৌর কর্তৃপক্ষের সংস্থাগুলির মধ্যে আরও বেশি রয়েছে (৭৬ শতাংশ)। যেকোনো বিভাগের (বেসামরিক, জনপালন সংক্রান্ত চাকরিগুলোর কথাই বলছি) উচ্চতম পদগুলোতেই শুধু পুরুষের সংখ্যা বেশি (৬০ শতাংশ)। মেয়েদের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ হল, দুই বিশ্বযুদ্ধ (বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেই ২৫ মিলিয়ন), সাম্যবাদী দল থাকাকালীন গৃহযুদ্ধগুলো (প্রায় ২০ মিলিয়ন), ১৯২০ সালের সোভিয়েত-পোল্যান্ড যুদ্ধ (প্রায় ২০০ হাজার), দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের শীত যুদ্ধ (প্রায় ৪০০ হাজার), আফগান যুদ্ধ (প্রায় ৩০ হাজার) রাশিয়ার অনেক পুরুষপ্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। ২০১৭ সালে রাশিয়ার উপ প্রধানমন্ত্রী ওলগ গোলডেটসের দেওয়া বিবরণ অনুযায়ী এখানে পুরুষের চেয়ে নারীশিক্ষার হার বেশি। উচ্চশিক্ষার উপাধি, ৩৭ শতাংশ নারীর যেখানে পুরুষদের ২৯ শতাংশের  রয়েছে। ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী রাশিয়ায় ৪১ শতাংশ নারী বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে নিয়োজিত। ১৯১৭ সালের আগে সমাজ কঠোরভাবে পিতৃতান্ত্রিক ছিলো। পারিবারিক সম্মতি ছাড়া বিয়ে করা ছিলো অসম্ভব। মেয়েদের ভোটাধিকার থেকে শুরু করে সরকারি দপ্তরে রাখার অনুমতি ছিলোনা। আমি এক্ষেত্রে বলবো নারীশিক্ষার প্রসারের এবং নারীদের সামাজিক স্থান উন্নয়নের ক্ষেত্রে সাম্যবাদী দলের অবদান অনস্বীকার্য।
এখন নারী পুরুষের প্রত্যেকেরই আর্থিকভাবে সমান অধিকার আছে। ২০১২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে সর্বোচ্চ বিবাহবিচ্ছেদের হারসম্পন্ন দেশগুলির মধ্যে রাশিয়া একটি। এই তথ্য অনুসারে, রাশিয়ার এক হাজার বাসিন্দা পিছু এই হার ৪.৫ ছিল। এটি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হারের চেয়ে কিছুটা বেশি (৩.৬), তবে মালদ্বীপের অনেক নীচে (১০.৯৭)। স্বাধীনচেতা নারী এবং তাদের স্বনির্ভরতার কারণেই এখানে বিচ্ছেদ বেশি। বেশিরভাগ বিচ্ছেদ নারীদের দিক থেকেই হয়। আবার অনেক পুরুষ মানুষও স্বাবলম্বী নারীর সাথে পেরে উঠতে না পেরে বিচ্ছেদ নেয়। সিঙ্গেল মায়েদের ক্ষেত্রে (বাবাদের থেকে সহায়তা যদি নাও পান) সরকারি সুযোগ সুবিধে প্রচুর। মহিলাদের ক্ষেত্রে অবসর-বয়স হল ৫৭ বছর (ছেলেদের ৬২)। তবে অবসরভাতা অনেক ক্ষেত্রেই খুব কম বলে অনেক বৃদ্ধাদেরই গ্রামাঞ্চল থেকে তাদের বাগানের সবজি, ফল, আলু, বীট, চেরি, বেরি বা নিজেদের হাতে বানানো উলের বস্ত্র, মোজা, মাফলার শহরাঞ্চলে বিক্রি করতে দেখা যায় (এমনকি বেশি শীতের দিনগুলোতেও)।  

  নামের ক্ষেত্রে, মেয়েদের নামের শেষে 'আভোনা' 'ইভোনা' (অমুকের মেয়ে) এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে 'ভিচ' (তমুকের ছেলে) যোগ হয়। এখনো এখানে আঠারো বছর পার হলেই বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া হয়। অনেক রাশিয়ান মেয়েই মা হতে পারাকে গর্বের ও আনন্দের মনে করে। অনেক কমবয়সী বিবাহিত মহিলাই একাধিক বাচ্চার মা হয়ে যান। তাই এখানে দিদিমা (বাবুশকা) হয়ে যাওয়ার বয়সও তুলনামুলকভাবে কম। একটি রাশিয়ান পরিবারের মধ্যমণিই হলেন বাবুশকা। তত্ত্বাবধান করা, সংসার সামলানো, নাতি-নাতনীদের পার্কে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, পোষা কুকুর-বিড়ালের যত্ন নেয়া, জেলি, বিন্নি, তর্ত, জুস, কাশা ইত্যাদি নানারকম ঐতিহ্যবাহী খাবার বানানো-এরকম কতোকিছু করেন বাবুশকা। প্রায়শই এখানকার প্রমোদ-উদ্যানগুলোয় বাবুশকা, মা, বাচ্চারা আর প্যারামবুলেটরে পরিবারের ছোট্ট সদস্যকে (কখনো-সখনো বাবা এবং দাদুদেরও (দেদুশকা)) একত্রে ঘুরতে দেখা যায়। বিয়ের পর স্বামী বা স্ত্রী, চাইলে দুজনেই একে ওপরের পদবী ব্যবহার করতে পারেন [৩৩]।
  বেশিরভাগ রাশিয়ান মহিলাদের সৌন্দর্যের রহস্য হয়তো তাঁদের বেশি শিক্ষিত হওয়ার, নিজেদের সুন্দরভাবে উপস্থাপনা করার দক্ষতার বা এতো বড় দেশের মিশ্র জাতিগত হওয়ার মধ্যে লুকিয়ে আছে। মহিলারা নিজেদের সুন্দরী ও পরিশ্রমী বলে গর্বও অনুভব করেন। এমনকি অনেক বয়স্ক মহিলাদের পোশাক পরিচ্ছদ, আচার-আচরণে আভিজাত্য ফুটে ওঠে। এখনো এখানে ভাবা হয় পুরুষরা নারীদের সুরক্ষা দেবে, নারীর দায়িত্ত্ব সংসারের তত্বাবধান। রাশিয়ান মহিলারা এখন জুতো সেলাই, বাস চালানো থেকে বিজ্ঞান পাঠ করলেও, এখনো সমাজ রক্ষণশীল। নারীত্ব, সুন্দর গৃহবধূ হতে শেখানোর কিছু বিদ্যালয় আছে এখনো। সোভিয়েত উত্তর রাজনীতিতে, বড় বড় নেতা-মন্ত্রীদের মধ্যেও বেশিরভাগই পুরুষ। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে রাশিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতা হলেন ভ্লাদিমির পুতিন। এতদিন ভাবতাম আমি একাই বোধহয় ভাবি যে সব দেশের নেতাবদলি হয়ে গেলো, রাশিয়ার একজনই। এখানে এসে বুঝি আমি একা নই, এখানের অনেক তরুণ ভোটার পুতিন ছাড়া আর কাউকেই নেতা (পদ হয়তো একটু উনিশ বিশ হয়েছে) হিসেবে দেখেনি। এদেশের সংবিধান অনুযায়ী, টানা দুই মেয়াদের বেশি রাষ্ট্রপতি থাকা যায় না। রাশিয়ায় মজা করে অনেকে বলে রাষ্ট্রপতির পদটি টেকোমাথা এবং চুলোমাথাবিশিষ্ট নেতার মধ্যে পালাবদল (বোরিস ইয়েলৎসিন, পুতিন, দিমিত্রি মেদ্ভেদেভ, পুতিন) হয়। তো এরপর কে?
  সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে দুরকমের (বীমা এবং অর্থায়িত) অবসরভাতা চালু আছে এখানে। চাকরিতে নিযুক্ত থাকাকালীন সময়ে কোনও কর্মচারীর বেতনের থেকে কিছু অর্থ আলাদা করে সঞ্চয় করা হয়। তবে পারিবারিক অবসরভাতা (মানে অবসরগ্রহণের পূর্বে কোনও কর্মচারীর মৃত্যু হলে বা মৃত্যুর পরে গৃহবধূ স্ত্রীকে দেওয়ার মতো) নেই। কর্মচারীর ইচ্ছানুযায়ী এ ভাতা নির্ধারিত হারে মাসিক ভিত্তিতে কিংবা থোক অঙ্কে এককালীন পরিশোধ করা হয় [৩৪]।
ভারতের মুদ্রা রুপি এবং রাশিয়ার রুবলের মান এবং মুদ্রা বিনিময় হার প্রায় একই। আমাদের ভারতে যেমন অনেক ক্ষেত্রেই (ছাত্রছাত্রীদের স্কলারশিপ, কৃষিকাজ, জীবন বীমার থেকে আয়, NRE ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ইত্যাদি) আয়কর দেওয়ার ক্ষেত্রে পূর্ণ ছাড় আছে এখানে তেমন নেই- প্রত্যেককেই কিছু না কিছু আয়কর দিতে হয়। ছোটো ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে আয়করের ধার্য মান কম। রাশিয়ায় ব্যক্তিগত আয়কর, স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়োগকারী কর্তৃক কর্মীদের বেতন থেকে, অতিরিক্ত কোনও পদক্ষেপ ছাড়াই কেটে নেওয়া হয় (বেতনের ১৩ শতাংশ) [৩৫]। যদি এরকম বেতন ব্যতীত অন্যান্য উত্স থেকে হওয়া আয়ের ক্ষেত্রে (উদাহরণস্বরূপ, কোনও অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে), প্রাপ্ত বছরের পরের বছরের ৩০শে এপ্রিলের মধ্যে সংশ্লিষ্ট আয়কর বিভাগে দিতে হয়। আমাদের ইন্সটিটিউট JINR এর সাথে চুক্তিতে থাকা বেশ কিছু মালিক তাদের অ্যাপার্টমেন্ট, JINR এর কোনো কর্মচারীকে ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেন। আয়কর ফাঁকি যাতে কেউ না দিতে পারে সেজন্যে সরকারকে নতুন নতুন ভাবনা ভাবতে হয় মাঝে সাঝেই।
  রাশিয়ায় সরকারি স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচির মাধ্যমে সমস্ত বাসিন্দাদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে দেওয়া হয়। তবে ছোটোখাটো শহরগুলোতে উন্নত যন্ত্রপাতির ও সঠিক পরিকাঠামোর অভাবের জন্য অনেকে বেসরকারি হাসপাতালে যায়। আমাদের দেশে যেখানে সরকার বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে হিমশিম খায়, রাশিয়ার সরকার জনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য সর্বদা সচেষ্ট। সাম্প্রতিককালে এখানের সরকার ঘোষণা করেছে বড় পরিবার হলে আয়করে বিশেষ ছাড় দেওয়া হবে। সম্প্রতি শুরু হওয়া প্রসূতি (পরিবার) মূলধন প্রকল্পের মাধ্যমে বাচ্চা হলে মায়েরা ৪৬৬,৬১৭ রুবল পাবেন [৩৬]। দ্বিতীয় বাচ্চা হলে যোগ হবে আরও ১৫০,০০০ রুবল। ভাবুন তাহলে কি বৈচিত্র্যময় এ পৃথিবী! আমাদের দেশে ‘হাম দো হামারে দো’ করেও ঠেকানো যাচ্ছেনা, আর এদেশে বাচ্চা হলে সেই পরিবারকে অর্থপ্রদান করা হয় সরকার থেকে। 
শীতপ্রধান দেশ বলে এখানে খাদ্যশস্যের মধ্যে যব, গম, বাকহুইট, জই (ওট), রাই, ত্রিতিকেল বেশি চাষ হয়। এছাড়াও আনাজ শাক-সব্জির মধ্যে বাঁধাকপি, আলু, গাজর, শালগম, শশা, কুমড়ো ইত্যাদির চাষ হয়। এছাড়াও রাশিয়ায় তিসি, মধু, মাছ এসবের চাষ হয়। গ্রামাঞ্চলের অনেক মানুষ মধু এবং মাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। শীতকালে পুকুর, নদী জমে গেলে, বরফের মধ্যে গর্ত করে টোপ ফেলে বরশি দিয়ে বরফের নীচের জলে থাকা মাছ ধরার প্রক্রিয়াটি অসাধারণ। তবে বরফে মাছ ধরার জন্য আপনাকে অসম্ভব রকমের ধৈর্যশীল হতে হবে। ঘাস চাষ করে সেই ঘাস যন্ত্রের সাহায্যে কেটে বস্তায় পুড়ে রাখা হয় সংরক্ষণ করে রাখা হয় শীতকালে গবাদি পশুদের খাবারের জন্য (ভিডিও ৩ দেখুন)। এটি ঠিক আমাদের ওখানে খড়ের পালুই করে রাখার মতো। শীতকালে রাস্তা থেকে বরফ সরানো এবং পিচ্ছিল যাতে না হয় তার জন্য বালি ছড়ানোতেই অনেক সময়, শ্রম দিতে হয় এবং অর্থব্যয় হয় (ভিডিও ৩ দেখুন)। যেসব জায়গায়  বালি ফেলার সরকারি গাড়ি পৌঁছোয়না বা যেখানে বালির অভাব, সেখানে খনিজ লবণ (rock-salt) ছড়ানো হয়। কেন বলুন তো? আবারও মাধ্যমিকের ভৌত বিজ্ঞান। বালি বরফ গলায় না, কিন্তু ঘর্ষণ বৃদ্ধি করে। অপরদিকে খনিজ লবণ, জলের হিমাঙ্ক (বা বরফের গলনাঙ্ক) ০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের চেয়ে অনেক কমিয়ে দেয়। ফলে বরফ জমতে পারেনা। পথচারীদের ‘পা পিছলে আলুর দম’ হয়ে যায় না।     
  রাশিয়ার সবচেয়ে প্রচলিত খাবার হল পরিজ (রাশিয়ান নাম কাশা), বীট শুরুয়া (বোর্শ), মাশরুম (গ্রিবি), কাবাব (শাশ্লিক), মোমো (পিলমেনি), পোলাও (পিলাফ), শালগম (টার্নিপ) ইত্যাদি। রাশিয়ান লোকেরা ঘরে রান্না করা খাবার খেতে বেশি পছন্দ করে, দোকান থেকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য কিনে খাওয়ার থেকে। সাধারণত রাশিয়ানরা দিনে তিনবার খায় এবং প্রতিদিনের খাবারের মধ্যে রুটি আর আলু থাকেই। রাশিয়ানদের রাই রুটির (কালো রঙের) প্রতি বিশেষ ভালোবাসা রয়েছে। এই কালো রাই রুটি রাশিয়ানদের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। আর একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার হল ক্বাস। এটি রাই রুটির তৈরি একটি ফেরেন্টযুক্ত পানীয়। ক্বাসে থাকা অ্যালকোহলের পরিমাণ খুব কম (~1%) হওয়ায় শিশু সহ সমস্ত বয়সের মানুষই পান করতে পারেন। উত্তপ্ত গ্রীষ্মের দিনগুলিতে এই কার্বোনেটেড পানীয়টি সর্বাধিক পান করা হয়। এটি ওক্রোশকা নামক ঐতিহ্যবাহী ঠাণ্ডা স্যুপের উপাদান হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। রাশিয়ান ভোদকা সাধারণত ছুটির দিনে পরিবারের সকলের সাথে এবং বন্ধুবৃত্তে থেকে পান করে এরা। প্রাতঃরাশ (রাশিয়ান-জাভত্রাক) করা সাধারণত সকাল সাতটা বা আটটার দিকে শুরু হয়। প্রাতঃরাশে থাকতে পারে কাশা, বাটারব্রটস (এক ধরনের স্যান্ডউইচ একটি রুটি এবং তার ওপর মাখন বা হ্যাম রাখা), সিদ্ধ বা ভাজা ডিম, স্মেতানার সাথে পনির (ত্বোরোগ), সিরিয়াল, রাশিয়ার প্যানকেক (ব্লিনি), ওট পরিজ বা সুজির পরিজ, ওলাদ্যি, পনির দিয়ে তৈরি সিরনিকি, ভারেনিকি, আলুর প্যানকেক দ্রানিকি, গ্রেনকি, জাপেকানকা, ক্যাভিয়ার, পিরোগি- ইত্যাদির মধ্যে কিছু [৩৭]। ওট পরিজ (ওটমিল) হল পরিজের অন্যতম সাধারণ ধরন। গ্রুয়েল হল পরিজের একটি পাতলা সংস্করণ। অনেক ধরণের পরিজের আবার নিজস্ব নাম রয়েছে যেমন পোলান্টা, গ্রিটস এবং কাশা। এমন সিরিয়াল খাবারের উপাদানের মধ্যে একটি হল বাকহুইট (রাশিয়ান নাম গ্রেচা)। অনেকে ফলের রস পান করেন। চা বা কফি রাশিয়ানদের আরেকটি পছন্দের পানীয়। মধ্যাহ্নভোজন (অবেদ) রাশিয়ানরা দুপুর ২ টো নাগাদ করে। দুপুরের খাবারের মধ্যে থাকতে পারে প্রথমে গরম স্যুপ, তারপর রুটি বা পাউরুটি অথবা গ্রেচা অথবা পোলাও, মাংস, আলু দিয়ে তৈরি কিছু খাবার, পাস্তা, পরিজ আর তারপর কমপোত (একধরণের নন- অ্যালকোহলিক পানীয়), চা বা কফি বা ফলের রস। সান্ধ্যভোজনের (উঝিন) সময় শুরু হয় সন্ধ্যে ৭ টা নাগাদ। এটাই ওদের নৈশভোজ। এতে থাকতে পারে রুটি বা পাউরুটি বা লেপেস্কা, আলু দিয়ে তৈরি কিছু খাবার, মাছ বা মাংস, আর শেষে চা বা কফি [৩৮] (চিত্র ৫ দেখুন)। 

এখানে আজেরবাইজান, আর্মেনিয়া, তুরস্ক, কাজাকাস্থান, কিরজিস্থান প্রভৃতি জায়গা থেকে আসা বিভিন্ন বাদাম এবং শুষ্ক ফলের আলাদা করে দোকানও দেখতে পাওয়া যায়।
   দুবনা অঞ্চলের মানুষের শখ, বিনোদন এবং খেলাধুলার মধ্যে পড়ে গল্প বই পড়া, ছবি আঁকা, বেহালা বাজানো, পিয়ানো বাজানো, ব্যালে নাচ করা, পরিবারের সাথে বেড়ানো, বনাঞ্চলে মাশরুম তুলতে যাওয়া, মাছ ধরা, পোষ্য কুকুর বা বেড়ালের সাথে বেড়ানো, পাখিদের খেতে দেওয়া, ভলিবল বা ফুটবল খেলা, গরমকালে ভোল্গার ধারে বালিতে শুয়ে রৌদ্রস্নান আর তারপরে নদীতে স্নান, সাঁতার কাটা, বোটিং, মোটরবোটিং, জল স্কারফিং বা স্কিইং বা টিউবিং, জেট স্কিইং, ফ্লাইবোর্ডিং করা, প্যারাসেলিং বা প্যারাগ্লাইডিং বা প্যারামোটরিং করা এইসব। আর শীতকালে এরা সাধারণত স্কেট করা, বরফে গর্ত করে মাছ ধরা- এইসব করে (চিত্র ৬ এবং ভিডিও ৪ দেখুন)। 

  বাচ্চারা স্নো-টিউবিং করা, বরফ দিয়ে নানা মূর্তি বানায়। ফ্রোজেন চলচ্চিত্রের তুষারমানব ‘ওলাফ’ চরিত্রটির কথা মনে আছে?- সেইরকমের আকার দেয় বাচ্চারা (কখনো সখনো তাদের মায়েরাও হাত লাগায়)

 (চিত্র ৭ দেখুন)। এখানে একটি বড় খেলার মাঠ ‘নাউকা’, একটি ইয়াচ ক্লাব এবং একটি হেলিপ্যাডও আছে। ঐ হেলিপ্যাড থেকে অনেকেই ছোটো হেলিকপ্টার নিয়ে ওড়ে বা ভোল্গার নদী বরাবর আকাশপথে প্যারামোটরিং করে। গ্রীষ্মকালে ছুটি কাটানোর জন্যে ভোল্গা নদীর তীর বরাবর প্রচুর (বিশেষত) কাঠের তৈরি গ্রীষ্মকুটির (summer house) রয়েছে। রাশিয়ার ভোদকা বোধহয় রাশিয়ার মানুষদের থেকেও বেশি বিখ্যাত হয়ে গেছে। জলের থেকে এখানে বেশি খাতির হয়তো ভোদকাকেই করা হয়।
  দুবনা শহরের অনেক পুরনো ইতিহাস (একাদশ শতাব্দীতে রাতমিনোর কাছাকাছি বসবাস শুরু করেছিলো) থাকলেও নতুনভাবে গড়ে ওঠা দুবনা শহর বিজ্ঞান, ধর্ম, শিল্পকলা-এরকম সমস্ত কিছুর প্রতিই উদারমনস্ক। গীতিকার ভ্লাদিমির ভিসোৎস্কির কথা আগেই বলেছি। শিল্পী আন্দ্রে ভোজনেসেনস্কি এবং ভ্লাদিমির ভিসোৎস্কি দুজনেই প্রায়শই আসতেন দুবনা শহরে ১৯৬০ এর দশকে [৩৯-৪১]। নেতা খ্রুসচেভ, বিজ্ঞানী ফ্লেরভ, গোরস্কায়া, চেগোলেভ শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। পদার্থবিদদের নিয়ে ভিসোৎস্কির একটি জনপ্রিয় গানও আছে,-‘মার্চ অফ ফিজিক্স স্টুডেন্টস’ [৪২]। তিনি দুবনার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ‘মির’-এ এসে গেয়েওছিলেন [৪৩]। দুবনা শহরকে তাই অনেকে ‘পদার্থবিদ ও গীতিকার দের শহর’ বা ‘শহর যেখানে পদার্থবিদ ও গীতিকারেরা এক হয়েছিলেন’ ও বলেন। 
  উৎসব উদযাপন বলতে দুবনার মানুষ নিউ ইয়ার, খ্রিস্টমাস, আন্তর্জাতিক নারী দিবস (৮ই মার্চ), শ্রমিক দিবস (পয়লা মে), বিজয় দিবস (৯ই মে), রাশিয়া দিবস (১২ই জুন), দুবনা দিবস (২৪শে জুলাই) (ভিডিও-৫ দেখুন)। খ্রিস্টমাস এখানে জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ৭ই জানুয়ারি পালিত হয়। যদিও খ্রিস্টমাসের জন্য শহর সাজানো ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়েই শেষ হয়ে যায়। নিউ ইয়ার আর খ্রিস্টমাস নিয়ে একটা লম্বা ছুটি থাকে ঐ সময়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস আমাদের পরীক্ষাগারে আমাদের দলের মহিলা বিজ্ঞানীদের সম্মানার্থে পালন করেছিলাম আমরা। আমাদের ওখানকার ভূত চতুর্দশীর মতো এখানে ‘হ্যালোইন’ উৎসব পালন করা হয়। একটু গ্রামের দিকে শীত বিদায় উৎসব ‘মাস্লেনিৎসা’ (শ্রোভেতিদে) পালিত হয় ধুমধাম করে ফেব্রুয়ারির শেষের বা মার্চের শুরুর এক সপ্তাহে। দুবনা শহরেও পালিত হয় এই উৎসব [৪৪]। প্রধান খাবার হিসাবে প্যানকেক খাওয়া হয় বেশি করে এই উৎসবে। এটি অনেকটা আমাদের খোলা পুড়িয়ে, খড়ের তৈরি পুতুলকে আগে খাইয়ে (অনেক জায়গায় ‘ভেলা-ভুলো’-ও বলে, তবে আজকাল এতোকিছু আর হয়না) পিঠে খাওয়া শুরু করার আর উত্তর ভারতের হোলিকা দহন উৎসবের মতো (ভিডিও-৫ দেখুন)।
চলার পথে রাশিয়ানদের সৌজন্যমূলক হাসি হাসতে দেখিনি। হয়তো এখনো রাশিয়ানরা আগের মতই কোনও অপরিচিতের থেকে আসা হাসিকে অভদ্রতা ভাবে। এখনো ওরা স্বভাবে খুব চাপা এবং রক্ষণশীল। এই প্রজন্মের মহিলারা তুলনামূলকভাবে একটু বেশি মিশুকে। আমার অনেক সময়ই মনে হয় ওদের জাতীয়তাবোধ আমার থেকে অনেক বেশী। তাছাড়া এতগুলো যুদ্ধজয় করা জাতি হওয়ার জন্যে একরকমের বেপরোয়া ভাব এদের কথায়-বার্তায়, কাজের মধ্যে ফুটে ওঠে। ইংরেজদের উপনিবেশ থাকার ফলে এবং খানিকটা নিজেদের দোষে আমরা কতোটা ইংরেজি ভাষার প্রতি সমর্পণ করেছি তা মুখে না বললেও আমরা ভালো করেই জানি। সে লড়াইয়ে হেরে যাওয়া বাঙালি এখন চিন্তিত পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি ভাষার প্রবেশ নিয়ে। কোনও ভাষাকে কি ঘৃণা করা যায়? নাকি এ ঘৃণাও রাজনৈতিক? ‘কেদারা’ ছেড়ে ‘চেয়ারে’ বসতে বাধ্য করা হয়েছিলো না আমরা ‘হুজুগে বাঙালিরাই’ বসেছি? কেউ প্রভাবিত করেছে না প্রভাবিত হয়েছি? রাশিয়ানরা কিন্তু এখনো বেশ নিমরাজি ইংরাজিময় হতে। ফেসবুকের চেয়ে অনেক বেশি এরা নিজেদের দেশের বানানো সোশ্যাল মিডিয়া VK (ВКонта́кте) ব্যবহার করে।
আমাদের মতো বা হয়তো আমাদের থেকেও বেশি কুসংস্কার আচ্ছন্ন রাশিয়ানরা। একটি সাম্প্রতিক (২০১৫) রাশিয়ান  Public Opinion Research Center’s (VTsIOM) সমীক্ষা থেকে জানা গেছে যে রাশিয়ানদের ৫০ শতাংশের আচার-আচরণ এরকম কিছু কুসংস্কার মেনেই হয় [৪৫]। বেশ কিছু কুসংস্কারের শিকড় খুঁজলে স্ল্যাভিক মাইথোলজিতে (পৌত্তলিকতাবাদ বা পেগানবাদ) পৌঁছতে হবে, যেগুলো রাশিয়ানদের মধ্যে খ্রিষ্টধর্মের আগে থেকেই রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বেশ কিছু এখন দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ আদব কায়দায় পরিণত হয়েছে। বেশ কিছু কার্যকারণ গোছের কুসংস্কার আছে যার মধ্যে অনেক কিছুই আমাদের ভারতীয়দের মধ্যেও আছে। যেমন- ডান চোখ নাচা ভালো (আমাদের ওখানে বলা হয় ছেলেদের ডান চোখ আর মেয়েদের বাঁ চোখ নাচলে ভালো), ঠোঁট নাচলে আপনার জন্য চুমু ধেয়ে আসছে, বাম হাতের তালু চুলকোচ্ছে মানে টাকা আসছে, যাত্রাপথে,- সামনে কোনও বেড়াল রাস্তা পার করলে থামতে হয়, হেঁচকি উঠলে সেই মুহুর্তে কেউ আপনাকে স্মরণ করছে, কোনও শবযাত্রা দেখতে পাওয়া ভালো হলেও কখনও তার সামনে দিয়ে পথ পারাপার করা উচিত নয়, আয়না বা কাঁচ ভেঙে গেলে সংসার ভাঙার ভয় থাকে, মেঝেতে শুয়ে থাকা কাউকে ডিঙোতে নেই বা ভুল করে ডিঙোলেও উল্টোদিকে ডিঙোনো উচিৎ- এইসব। এগুলো নিয়ে বেশি না বলে, নতুন কয়েকটা [৪৬-৪৮] বরং উল্লেখ করি।
(১) কারোর সাথে দেখা করতে গেলে বিজোড় সংখ্যক ফুলবিশিষ্ট তোড়া দিতে হয়। রাশিয়ান মেয়ের প্রেমে পড়ে প্রথমবার প্রেম নিবেদন করতে যাওয়ার সময় অবশ্যই ফুল গুণে যাবেন, নইলে শুরুর আগেই......! রাশিয়ায় কেবল কবরস্থানে জোড় সংখ্যক ফুলবিশিষ্ট স্তবক নিয়ে আসার রীতি আছে।
(২) দূরে ভ্রমণে যাওয়ার আগে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে হয়। এটার অবশ্য ভালো দিকও আছে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব ঠিক-ঠাক নিয়েছেন কিনা শান্ত হয়ে ভেবে নেওয়া যায়।
(৩) দরজার চৌকাঠের গোবরাঠে (বৃহত্তরভাবে কোনও সীমারেখাতেই তা সে দেশের সীমান্তও হতে পারে) করমর্দন করতে বা চুমু খেতে নেই। অন্যথায় ঘরের গোবরাঠে পাহারাদার আত্মা রুষ্ট হতে পারেন। সাক্ষাতের জন্য হয় অতিথি ভিতরে যাবেন নয়তো গৃহস্থের কেউ বাইরে আসবেন। তাই আপনার প্রতি আমার সতর্কবার্তা এই যে বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে আপনার রাশিয়ান প্রেমিকাকে গোবরাঠেই গলা জড়িয়ে ধরার কোনো প্রয়োজন নেই।
(৪) রাস্তায় বেড়িয়ে কিছু নিতে ভুলে গেছেন মনে পরলে ফিরতে নেই। ফিরলে অদূর ভবিষ্যতে খারাপ কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যদি সত্যিই ফিরতে হয়, তবে দ্বিতীয়বার বেরোনার আগে আয়নায় নিজের চাঁদবদনখানি দেখে বেরোতে হয়। 
(৫) কাউকে তীক্ষ্ণ কিছু (যেমন ছুরি, কাঁচি ইত্যাদি) উপহার দেওয়া উচিৎ নয়। নইলে পরে তার সাথে আপনার ঝগড়া হবে। যদি ছুরি দিতেই হয় তবে বিনিময়ে যৎসামান্য মুদ্রা নিতে হয়, যেন মনে হয় আপনি ওটি কিনছেন। রুমাল উপহার দেওয়াও ঠিক নয়। মনে করা হয় যে ওটি চোখে অশ্রু ডেকে আনবে। পার্স দিতে চাইলে খালি পার্স না দিয়ে অন্তত একটি মুদ্রা ভিতরে রেখে দিতে হয়।
(৬) একই নামের দুজনকে সামনে পেলে ভালো কিছুর প্রার্থনা করতে পারেন। কিন্তু, তাদের কাউকে বলা যাবেনা আপনি কি চাইলেন। বললে আর ইচ্ছেপূরণ হবেনা।
(৭) ছুরি চেটে কিছু খেতে নেই। এতে আপনার মধ্যে শয়তানের বাস হতে পারে বা আপনি কুকুরের মতো রাগী হবেন। তবে ছুরি চেটে খেতে গিয়ে যাতে জিভ না কেটে যায়, সেই ব্যাপারে এমন ভীতি কাজে দেয়।
(৮) একজন অবিবাহিত মেয়ের কখনই কোনও টেবিলের কোণে বসা উচিত নয় –এমন করলে সে অন্তত সাত বছর কাউকে স্বামী হিসেবে পাবে না। সবচেয়ে ভালো তাহলে গোলটেবিল বৈঠকে বসা। কি বলেন?
(৯) বিবাহের আগে বরকে বউয়ের বিয়ের পোশাক দেখতে নেই – দেখে ফেলা দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে আসে। যদি বর নিজে না কনের বিবাহে পরার পোশাকটি কিনে নিয়ে আসে, পাত্রপক্ষকে ওই পোশাকটির দাম জানাতে নেই। আমার মতে না জানানোই ভালো। কম দাম দেখে পাজি বর বিয়ে করতে রাজি না হলে আবার কেলেঙ্কারি!
(১০) কোনও মহিলার আয়নার দিকে তাকিয়ে খাওয়া উচিত নয় –এমন করলে তিনি তার সৌন্দর্যও নষ্ট করে ফেলতে পারেন।
(১১) যে মহিলার পায়ের দ্বিতীয় আঙ্গুল, বৃদ্ধাঙ্গুলির চেয়ে দীর্ঘ, তিনি পাতলুন পরে বিয়ে করতে যাবেন। বোঝো কাণ্ড!
(১২) বিয়ের আগে একজন যুবতীর কখনই তার অনামিকায় আংটি পরা উচিত নয় -পরলে তার জীবন আইবুড়ো হিসাবেই কেটে হবে।
(১৩) শৈশবকাল থেকেই মেয়েদের বলা হয় ঘাগরা মাথা গলিয়ে পড়তে। পা গলিয়ে পরলে তার স্বামী তার প্রতি অবিশ্বস্ত হবে। আমাদের ওখানে ব্রাহ্মণদের পইতে পরার ক্ষেত্রেও এমন রীতি আছে।
(১৪) কোনও অবিবাহিত মহিলার, তার প্রথম ধর্মসন্তান বাচ্চা মেয়েকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করা উচিৎ নয়। এটা বিশ্বাস করা হয় যে এমন করলে বাচ্চা মেয়েটি তার ধর্মমাতার সুখ কেড়ে নেবে।
(১৫) কাঠের ওপর টোকা দেওয়ার সাথে সাথে বাম কাঁধে (মানা হয় বাম কাঁধেই শয়তানের বাস) তিনবার থুতু ফেলার ভান করাও সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার একরকম কুসংস্কার এখানে।
(১৬) এক বা একাধিক পাখি যদি আপনার ওপর বা আপনার সম্পত্তির (বিশেষত গাড়ি) ওপর মলত্যাগ করে দেয়, তবে সেটা সৌভাগ্যদায়ী। অর্থ সমাগমের সম্ভাবনা হয়। রাশিয়ায় এসে অনেকগুলো পাখি-বসা-গাছের নীচে হা-পিত্যেশ করে অপেক্ষা করবেন নাকি?
(১৭) খাওয়ার টেবিলে লবণ ছড়িয়ে ফেললেই মুশকিল, দুর্ভাগ্যজনক। দ্বন্দ্ব ডেকে আনতে পারে। ভুলবশত ফেলে দিলে, প্রথা হল কিছুটা ছড়িয়ে ফেলা লবণ বাম কাঁধের ওপর দিয়ে ফেলে দিতে হয়। যদি খাবারের স্বাদ খুব বেশি নোনতা লাগে, তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। হয়ত কর্ত্রী আপনার প্রেমে পড়েছেন।
(১৮) জানালার গোবরাঠে পাখি এলে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত। নচেৎ কারোর মৃত্যুর অথবা খোঁড়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
(১৯) যদি কোনও মুরগী ​​দুপুরের আগে তিনবার আপনার দিকে তাকিয়ে ডাকে, তবে এক পক্ষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যে কারোর মৃত্যুর হতে পারে। মুরগীটি মেরে ফেলা উচিত, তবে খাওয়া উচিত নয়, কারণ এটি খাওয়ার ফলে আরও দুর্ভাগ্য আসতে পারে।
(২০) নির্দিষ্ট বয়স হওয়ার আগে (দু'মাস থেকে এক বছরের মধ্যে), কোনও নবজাতকের দিকে অপরিচিত লোকের তাকানো উচিৎ নয়। সেই শিশুর দিকে তাকিয়ে অপরিচিত মানুষের প্রশংসা- দুর্ভাগ্যজনক। পরিবর্তে, কেউ বলতে পারেন, "বাপরে! কি কুৎসিত শিশু!" নজর যাতে না লাগে সেইজন্য আমাদের দেশের বাচ্চাদের যেমন কালো টীকা লাগানো হয় তেমনই ব্যাপার।
(২১) পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে কেউ যদি শুভকামনা জানায় ("ни пуха ни пера!"), তবে সে উত্তর পাবে,- "জাহান্নামে যাও!" ("К чёрту!")। এমনই ভাগ্য সুরক্ষিত রাখার পন্থা।
(২২) খালি বালতি হাতে কোনও মহিলা আপনার দিকে আসাকে খারাপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
(২৩) ঘরের ভিতরে শিষ দিতে নেই। দিলেই ফতুর। কি জ্বালা! আনন্দে শিষও দেওয়া যাবেনা বাপু!
(২৪) মদ্যপান শেষ করার পর খালি বোতল টেবিলে রাখা খারাপ। খারাপ কিনা জানিনা তবে খালি বোতল টেবিলে রাখবেনই বা কেন? আস্তাকুঁড়ে ফেলবেন তো। 
  ঐতিহ্যগতভাবে পরামনোবিদ্যার প্রতি গভীর আগ্রহ রয়েছে রাশিয়ানদের, যার মধ্যে কয়েকটি “বিজ্ঞানসম্মত” হিসাবেও বিবেচিত হয়। ২০০১ সালে রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষতিকর মন নিয়ন্ত্রক (psychotronic) যন্ত্রসমূহের (যেমন তড়িচ্চুম্বকিয়, অবশ্রব্য বিকিরক) প্রয়োগ অবৈধ বলে আইন করেন [৪৯]।
  তবে যত দিন যাচ্ছে আস্তে আস্তে এসব কুসংস্কার মানাও কমে আসছে। জায়গাবিশেষে, মানুষবিশেষে মানা না-মানার পরিবর্তন হয়। আমাদের ওখানকার “দুটো টিকি থাকলে দুটো বিয়ে”-র মতো কিছু আছে কিনা খুঁজছিলাম। পেলাম না। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি আমি আমারই এক দুটো টিকিওলা আত্মীয়ের ওপর নজর রাখছি, সত্যিই তার দুটো বিয়ে হয় কিনা! এবার বিয়ের আগে তার দুটো টিকি একাকার হয়ে টাক হয়ে গেলে আমার পর্যবেক্ষণ বিফলে যাবে।
সবশেষে ভিডিও-৬ এ, বিভিন্ন সময়ে, দুবনার বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার সময় দেখা দৃশ্যগুলো আপনাদের জন্য তুলে ধরলাম। আপনাদের জন্যে আরও কিছু তথ্যসূত্র [৫০, ৫১] দিয়ে রাখলাম দুবনাকে আরও ভালো করে জানার জন্যে।


 তথ্যসূত্র
[১] ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। 
[২] http://paganism.msk.ru/sanskrit-roots.pdf 
[৩] http://www.jinr.ru/main-en/ 
[৪] http://eng.ktrv.ru/about/structure/gosmkb_-raduga.html
[৫] http://atom.dubna.ru/ 
[৬] https://www.tenzor.net/ 
[৭] https://www.aspect-dubna.ru/ 
[৮]http://prospekt-dubna.ru/about-company/8-main/27-dostoprimechatelnosti-dubny 
[৯] https://eng.rscc.ru/about/ 
[১০] http://ucnew.jinr.ru/images/pdf/ISP/Dubna_Must_Sees.pdf
[১১] https://russiapedia.rt.com/of-russian-origin/collectivization/
[১২] https://diletant.media/articles/45293044/ 
[১৩] https://roar.media/bangla/main/history/gulag-the-dark-side-of-soviet 
[১৪] https://www.greenpeace.org/international/story/30198/chernobyl-still-burns-forest-fires-ukraine-nuclear-radiation/ 
[১৫] https://www.bbc.com/bengali/news-41893654 
[১৬] https://www.pewforum.org/2017/05/10/religious-affiliation/
[১৭] http://wwwinfo.jinr.ru/Dzhel-e.htm 
[১৮] http://pontecorvo.jinr.ru/una_nota.html
[১৯] http://pontecorvo.jinr.ru/dzhelepov.html 
[২০] Half-Life: The Divided Life of Bruno Pontecorvo, Physicist or Spy, Frank Close, Basic Books, 2015. (384 pp.).
[২১] “Spontaneous Fission of Uranium”, Flerov and Petrjak, Phys. Rev. 58, 89 (1940).
[২২] A. Roy, Resonance  20, 762 (2015).
[২৩] N. Bohr, and J.A. Wheeler, Phys. Rev. 56: 426-450, (1939)
[২৪] Norman E. Holden and Darleane C. Hoffman, Pure Appl. Chem. 72, 1525 (2000)
[২৫] S. D. Chatterjee and P. B. Sarkar, Sci. Cult. Vol. IX, pp. 560- 562, (1944)
[২৬] https://youtu.be/xCc0uc3QoU4 
[২৭] https://youtu.be/ij4tFdHnIVI 
[২৮]https://youtu.be/Wzi1uGvXsr4 
[২৯] https://www.larisa-zinovyeva.com/mosaics-of-nadia-leger-in-dubna/ 
[৩০] https://g.co/arts/TypKK16ipw2kBASr5 
[৩১] https://ist-konkurs.ru/raboty/2012/772-historykirpi4
[৩২] https://www.rbth.com/lifestyle/331064-how-russian-homes-heated 
[৩৩] https://www.bbc.com/bengali/news-51239656 
[৩৪] http://www.pfrf.ru/en/pens_system/how_formed/ 
[৩৫] https://russianconsultants.com/taxes_in-russia_overview 
[৩৬] http://www.pfrf.ru/en/matcap/ 
[৩৭] https://foodfornet.com/russian-breakfast-foods/ 
[৩৮] http://masterrussian.com/russianculture/meals.htm 
[৩৯] https://www.i-podmoskovie.ru/history/shestidesyatniki-v-dubne/ 
[৪০] http://jinrmag.jinr.ru/win/2015/32/vv32.htm 
[৪১] https://www.youtube.com/watch?v=7H31vTHODDU 
[৪২] https://wysotsky.com/1033.htm?959 
[৪৩] https://www.youtube.com/watch?v=kjC2tB9bCUo 
[৪৪] http://indubnacity.ru/novosti/gorodskaya_sreda/v-dubne-iz-za-prazdnovaniya-maslenicy-ogranichat-dvizhenie-transporta-na-ulice-centralnoy1
[৪৫] https://www.rbth.com/arts/lifestyle/2016/01/21/10-common-russian-superstitions_561149
[৪৬] http://paganism.msk.ru/ 
[৪৭] https://en.wikipedia.org/wiki/Russian_traditions_and_superstitions
[৪৮] https://www.rbth.com//arts/lifestyle/2016/01/07/10-russian-marriage-superstitions_555593 
[৪৯] http://factsanddetails.com/russia/People_and_Life/sub9_2b/entry-5007.html
[৫০] https://www.net-film.ru/en/film-7814/ 
[৫১] https://www.youtube.com/watch?v=Bo_lHGjWOHA 
[৫২] https://www.rbth.com/history/328607-where-was-largest-monument-to-stalin
[৫৩] https://commons.wikimedia.org/wiki/File:Dubna_Stalin_monument_Plinth.JPG
[৫৪] http://wikimapia.org/40619/Monument-to-Lenin#/photo/4029399 

তথ্য সহায়তা
আন্দ্রে পান, বিজন সাহা, নীতা মুখোপাধ্যায়

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. (একটি জায়গায় অনিচ্ছাকৃত কিছ ভুল (টাইপো) রয়েছে, যেমন- "স্বতঃস্ফূর্ত বিভাজন প্রক্রিয়ার অর্ধায়ু নির্ণয় করেন ১০১৬ বছর।" ওটি হবে ১০^১৬ বছর। 10 to the power 16)

    ReplyDelete