জ্বলদর্চি

রাশিয়ার দুবনা, দুবনার ভাবনা/তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়



রাশিয়ার দুবনা, দুবনার ভাবনা

তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়

রাহুল সাংকৃত্যায়নের লেখা ‘ভোল্গা থেকে গঙ্গা’ মনে পড়ে? ছোটবেলায় বাবা কলকাতা বইমেলা থেকে কিনে দিয়েছিলেন ‘রাদুগা প্রকাশন’-এর বেশ কিছু বাংলায় অনূদিত বই- ‘মণির পাহাড়’ (সোভিয়েত দেশের নানা জাতির রূপকথা), গাভ্রিইল ত্রোয়েপোলস্কি’র লেখা ‘ধলা কুকুর, শামলা কান’, চিঙ্গিস আইৎমাতভ-এর ‘পাহাড় ও স্তেপের আখ্যান’, ইভান তুর্গেনেভ-এর লেখা ‘পিতা-পুত্র’, ‘জাদুমানিক আখানরাবো’ (উজবেক উপকথা সংকলন)। সেসব গল্প পড়ে আর ছবি দেখে মনে হতো- এমন দেশও হয়! আমাদের মতো সূর্যের তাপে তেতে বড় হওয়া মানুষদের কাছে বরফপাত, বরফ আবৃত ভূমি যেন এক স্বপ্নরাজ্যই লাগে। আবার অন্যদিকে, বরফের রাজ্যে বড় হওয়া মানুষ আবার ভিটামিন-ডি নিতে নিরক্ষীয় অঞ্চলে বেড়াতে যায়। এইতো হয়- নদীর এপার আর ওপার। 

কর্মসূত্রে আমার সৌভাগ্য হয়েছে এমনই তুষারপাতের এক জায়গা- রাশিয়ার দুবনায় আসার। আজ বলবো দুবনা শহরের গড়ে ওঠার এবং তার প্রকৃতির কথা। মস্কো এলাকায় (ওব্লাস্ত), মস্কো শহর থেকে উত্তরের দিকে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার দূরে, ইউরোপের এবং রাশিয়ার দীর্ঘতম নদী ভোল্গার দুধারে, গড়ে ওঠা একটি শহর দুবনা (চিত্র-১ দেখুন)। 

এটিই মস্কো এলাকার সবচেয়ে উত্তরের শহর। ভোল্গার উপনদী হল দুবনা নদী। আবার সেস্ত্রা নামের এক নদী দুবনা নদীতে গিয়ে পড়েছে। এই তিন নদীর মাঝেই দুবনা শহরের প্রধান অংশটি অবস্থিত।

প্রথমে একটু এই অঞ্চলের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাক। রুরিকিদ রাজপুত্র ইউরি দলগোদুকির আদেশক্রমে ১১৩২ সালে দুবনা অঞ্চলে একটি দুর্গ নির্মিত হয়েছিল এবং সেটি ১২১৬ সাল অবধি ছিল। দুর্গটি রাজা ভ্সেভোলোদের পুত্রদের মধ্যে সামন্ত যুদ্ধের সময় ধ্বংস করা হয়েছিল। অনেক পরে, ১৯৩১ সালে, তখনকার কমিউনিস্ট পার্টি এই অঞ্চলে ভোলগা-মস্কো খাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় জেনরিখ ইয়াগোদা’র নেতৃত্বে। খাল নির্মাণ ১৯৩৭ সালে সম্পূর্ণ হয়েছিল। প্রকল্পটির অংশ হিসাবে ইভানকোভো জলাধার (বর্তমানে এটিকেই মস্কো-সাগর বলা হয়) এবং ইভানকোভো জলবিদ্যুৎকেন্দ্রও নির্মিত হয়েছিল। অনেকগুলো গ্রাম এবং কোরচেভা শহর ওই জলাধারের জলে নিমজ্জিত হয়ে যায়।

আলেকজান্ডার সোলঝেনিতসিনের বই ‘দ্য গুলাগ আর্কিপেলাগো’তে, দুবনা শহরকে গুলাগ বন্দীদের দ্বারা নির্মিত শহর হিসাবে উল্লেখ রয়েছে। 

সোভিয়েত সরকার ১৯৪৬ সালে নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণার জন্য একটি প্রোটন ত্বরক যন্ত্র (proton accelerator) করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মস্কো শহর থেকে অনেক দূরে হওয়ার জন্য এবং এই অঞ্চলের নিকটবর্তী ইভানকোভো বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপস্থিতির কারণে এইরকম একটি জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক দলের নেতৃত্বে ছিলেন ইগর কুর্চাতভ। এই ইগর কুর্চাতভেরই একজন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ছিলেন মিখাইল গ্রিগরিভিচ মেশচেরিয়াকভ। ইনিই হলেন সেই সময়ের বৃহত্তম প্রোটন ত্বরক যন্ত্র  নির্মাণ (১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ওইটিই ছিল বিশ্বের মধ্যে বৃহত্তম), জয়েন্ট ইন্সটিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ (JINR) নির্মাণ এবং পাশাপাশি দুবনা শহর উন্নয়নের পথিকৃৎ [১]। আনুষঙ্গিক রাস্তা নির্মাণ এবং দুবনা থেকে মস্কো শহর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের তত্ত্বাবধান করেছিলেন ল্যাভ্রেন্তে বেরিয়া। রেলপথ নির্মাণটি মূলত গুলাগ বন্দীদের দণ্ডিত শ্রমের সাথে জড়িত ছিল। তিন বছর পরে, ত্বরক যন্ত্রটি ডিসেম্বর ১৪, ১৯৪৯-এ চালু হয়েছিল এবং ১৯৫৩ সালে পরিবর্ধিত রূপ পায় (৬৮০ মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট এনার্জি প্রদানকারী ৬ মিটার ব্যাসের সিনক্রো-সাইক্লোট্রোন) (চিত্র-১ দেখুন)। ১৯৫৬ সালে শহর হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায় দুবনা। বিশেষ করে ভোল্গার এক তীরের এই JINR এবং অন্য তীরের একটি মিসাইল তৈরির করার প্রতিষ্ঠানকে (MKB Raduga) কেন্দ্র করেই দুবনা শহর বড় হয়েছে। এসবের জন্য একে ‘বিজ্ঞানের শহর’ও বলা হয়ে থাকে। এটিই রাশিয়ার একমাত্র শহর যার নামে, এখানেই (JINR) আবিষ্কৃত একটি মৌলিক পদার্থ (দুবনিয়াম), মেন্দেলিভের পর্যায় সারণিতে স্থান পেয়েছে। দিমিত্রি মেন্দেলিভের কথা আমরা সবাই পড়েছিলাম কিশোর বয়সে ভৌত বিজ্ঞান বইয়ে। কি তাইতো? আমায় মেন্দেলিভ আর তাঁর পর্যায় সারণির সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়েছিলেন আমার  বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুশোভন পাল বাবু।
চিত্র ১- দুবনার কিছু ছবির কোলাজ। আলোকচিত্রী- তথাগত, পুরোনো ছবিটির উৎস- JINR ওয়েবসাইট [১]

এবার আসা যাক এখানকার প্রকৃতির কথায়। এই অঞ্চলটি কিন্তু তুন্দ্রা অঞ্চলের মধ্যে পড়ে না। এটি আর্দ্র মহাদেশীয় জলবায়ুর অন্তর্গত। এসব কথা লিখতে গিয়ে আমার শিক্ষকমহাশয় অরূপ দত্ত বাবুর কথা মনে পড়ছে। বিদ্যালয়ে উনিই এসব শব্দের সাথে প্রথম পরিচয় করিয়েছিলেন। রাশিয়ার এই অঞ্চলের জলবায়ুকে, দক্ষিণদিকের এবং পূর্বে থাকা পর্বতশ্রেণীগুলি (ককেশাস, ইউরাল, সায়ান, আলতাই) ভারতীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরের প্রভাব থেকে বাঁচায়। কিন্তু রাশিয়ার পশ্চিমে ও উত্তরে এমন কোন পর্বতশ্রেণী নেই আটলান্টিক ও উত্তর মহাসাগরের প্রভাব থেকে বাঁচানোর জন্য [২]। ফলত ঋতু প্রধানত দুটি বললেই চলে- শীত ও গ্রীষ্ম। শরৎ ও বসন্ত খুব কম সময়ের জন্য থাকে। এখানের তাপমাত্রা শীতকালে -২২ ডিগ্রীর নীচে আর গ্রীষ্মকালে +৩০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের ওপরে খুব কমই  যায়। গ্রীষ্ম ঋতু স্থায়ী হয় প্রায় সাড়ে তিন মাস, মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর অব্দি। আর  সবচেয়ে গরম অনুভূত হয় জুলাই মাসে। প্রায় পাঁচমাস (অক্টোবর মাসের শেষ থেকে মার্চ মাসের শেষ) মতো শীতকাল থাকে। ফেব্রুয়ারি মাসে সবচেয়ে ঠাণ্ডা অনুভূত হয়। শীতকালে দিন ছোট হতে হতে যখন প্রায় ৭ ঘণ্টায় পৌঁছায়, তখন সকাল হয় ন’টা নাগাদ আর সন্ধ্যে হয় চারটেয়। এখানকার ভূমি বরফে আবৃত থাকার সময় যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হ্রাস করেছে, তবুও প্রতি বছর গড়ে প্রায় চার মাস ধরা যেতেই পারে। শুধু বৃষ্টিপাতের (তুষারপাত নয়) কথা যদি বলতে হয় তো শীতকাল ছাড়া বাকি ঋতুতে প্রায়শই হয়। মস্কোর আবহাওয়া আর মেয়েদের মন একইরকম। এই রোদ্দুর, এই বৃষ্টি। যদিও আমাদের ওখানের মতো অনেকক্ষণ ধরে মুষলধারে বৃষ্টি এখানে হয় না, তবুও হঠাৎ ভিজে গেলেও তো মুশকিল! 
চিত্র ২- দুবনার শীতকালের কিছু ছবির কোলাজ। আলোকচিত্রী- তথাগত ও নীতা।

এ প্রসঙ্গে চলুন, তুষারপাত নিয়ে আমাদের ধারণাটা আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক। আমাদের সকলেরই জানা আছে যে জল জমে বরফ হয় ০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায়। তাই বলে কি যেকোনো ঠাণ্ডা জায়গা যেখানে তাপমাত্রা ০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের অনেক নীচে সেখানে তুষারপাত সম্ভব? না, বাতাসে পরিমাণমতো জলীয় বাষ্প থাকাও আবশ্যক। অ্যান্টার্কটিকার শুষ্ক উপত্যকাগুলোর কথা ভাবুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন ব্যাপারটা। শুধু মেঘের স্তরের তাপমাত্রাই ০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নীচে এবং নিম্নচাপের অঞ্চল হলেই নয়, তুষার টুকরোগুলো না গলে গিয়ে মাটিতে পৌঁছানোর জন্য, মাটির কাছাকাছি স্তরের তাপমাত্রাও মোটামুটি ০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছিই থাকতে হবে। এখন আপনি বলবেন আমাদের ওখানকার ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে গরমকালে যে শিলাবৃষ্টি হয়, তার সাথে এসবের কোনো মিল আছে না নেই? তো এই ফাঁকে বলে নিই তুষার, স্লীট, হিমশীতল বৃষ্টি ও শিল পড়ার শর্ত। তুষার টুকরোগুলো পড়তে থাকার সময় যদি কোনো উষ্ণ বায়ুর একটি স্তর ভূপৃষ্ঠ এবং মেঘের স্তরের মধ্যে প্রবেশ করে, তখন তুষার টুকরোগুলো গলে যায় এবং আবার ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকা শীতল বায়ুস্তরের সংস্পর্শে এসে পুনরায় বরফে পরিণত হয় এবং স্লীট হয়ে ঝড়ে পড়ে। এখন ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকা শীতল বায়ুস্তরটি যদি পাতলা হয় তাহলে স্লীট হওয়ার আর সময় না পেয়ে হিমশীতল বৃষ্টিপাত হয়। অন্যদিকে শিল পড়ে সাধারণত গরমকালে বজ্রঝড়ের সময়। তাপীয় লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়া অঞ্চলে, আশেপাশের অঞ্চল থেকে জলীয় বাষ্প বয়ে আসে আর ওপরের দিকে উঠে বজ্রমেঘ তৈরি করে। আকাশে বেশি পরিমাণে থাকা অনেকটা জলীয় বাষ্প ধারণকারী বজ্রমেঘ ঊর্ধ্বমুখী বায়ুপ্রবাহের ফলে যখন বায়ুমন্ডলের অত্যন্ত শীতলতর স্থানে (ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৭/১৮ কিলোমিটার উপরে) প্রবেশ করে তখনই জলকণাগুলো ঘনীভূত হয়ে শিলায় পরিণত হয় আর শিলাবৃষ্টি হয়।

যাইহোক, বরফ পড়ার পর সব সাদা। পথিকের যাওয়ার রাস্তাও চওড়া হয়ে যায়। শীতকালে এমন জায়গার ওপর দিয়ে আকাশপথে গেলে নীচের দিকে দেখে কেমন লাগবে একবার ভাবুন তো? শীতকালে প্রায়শই টিনের বা এসবেস্টসের চালের পুরনো বাড়িগুলোর কার্নিশে বরফ ছুরির মতো জমে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকতে দেখা যায় (চিত্র-৩ দেখুন)। নিখরচায় এমন সুন্দর নকশা তৈরি হলেও, পথচারীদের সাবধান থাকতে হয় এই সমস্ত বরফ-ছুড়ি থেকে। দূরত্ব বজায় রেখে না চললে, টুপি ঢাকা মাথাতে পড়লেও কিন্তু বরফের দ্বারা cold-blooded murder হয়ে যেতে পারে। 
চিত্র ৩- ঘরের চাল থেকে পরন্ত জল জমে বরফ হয়ে ছুরির আকার ধারণ করে ঝুলে আছে। আলোকচিত্রী- তথাগত।

দুবনা উপ-তাইগা অঞ্চলের অন্তর্গত [৩, ৪] হওয়ায় এখানে যেমন বড় পাতার পর্ণমোচী উদ্ভিদও দেখা যায় তেমনি বিভিন্ন ব্যক্তবীজী উদ্ভিদও দেখা যায়। প্রধানত বার্চ (রাশিয়ান নাম বেরেজা),ওক (দুব), বিচ (বুক), পপলার (তোপোল), ম্যাপেল (ক্লিওন), উইলো (ইভা), অ্যাশ (ইয়াসেন), রোয়ান (র‍্যাবিনা), বক্স (সামসিত), বে (লাভর), স্পিন্ডেল (বেরেস্ক্লেত), অলডার (ওলস্কা), এলডার (বুজিনা/সাম্বুক), হর্নবিম (গ্রাব), ইউ (তিস), লাইম/ লিন্ডেন (লিপা), এল্ম (ভ্যাজ), প্লেন (প্লাতান), হথর্ন (বোজারিস্নিক), সুইট চেস্টনাট (কাস্তান) এবং বিভিন্ন ধরনের কনিফারস যেমন পাইন (সাস্না), ফার (ইওল্কা, খ্রিষ্টমাস গাছ), স্প্রুস (এল), লার্চ (লিস্তভেনিতসা), সাইপ্রাস (কিপারিস) দেখতে পাওয়া যায় (চিত্র-৪ দেখুন)। রাশিয়ান জনজীবন ও মননে এসব গাছের (বিশেষত বার্চের) প্রভাব আছে। সেসব অন্য কোনোদিন বলবো। 

চিত্র-৪; দুবনা (রাশিয়া) অঞ্চলের কিছু গাছের ছবির কোলাজ। আলকচিত্রী- নীতা মুখোপাধ্যায়।

উপ-তাইগা অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হওয়াতে এখানকার মৃত্তিকা পডসল প্রকৃতির। রুশ শব্দ ‘জোলা’-র অর্থ ছাই বা ভস্ম। উদ্ভিদের ডালপালা, কান্ড ও লতা-পাতা পচে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে হিউমাস জমে এবং মাটির ওপরের স্তর থেকে লোহা ও ক্যালসিয়াম দূরীভূত হয় (ফলে রঙ ফ্যাকাসে দেখায়)। আবহবিকারের ফলে ধূসর বর্ণের, আম্লিক প্রকৃতির (pH এর মান ৫ পর্যন্তও হয়), অনুর্বর পডসল মাটি তৈরি হয়। সেই কারণেই এই শহরে বাগান করতে বা আনাজ চাষ করতে ইচ্ছুক মানুষদের চুন ও রাসায়নিক সার দেওয়া কালো-মাটি দোকান থেকে কিনে আনতে দেখা যায়।

ফুলেদের মধ্যে ক্যামোমাইল (রাশিয়ান নাম রোমাশকা), টাইগার লিলি (তিগরোভায়া লিলিয়া), বিভিন্ন রকমের টিউলিপ (তিউলিপান), বিভিন্ন রাশিয়ান সেজ যেমন কোণ-ফ্লাওয়ার্স, ব্ল্যাক আইড সুস্যান, গোল্ডেনরড (জোলোতার্নিক), ফ্লক্স (লেন), কোরিওপ্সিস, লেপার্ড’স বেন, ফার্নলিফ পিওনি (পাপরোতনিকোভি পিওন), রয়াল অ্যাজালিয়া, বিভিন্ন রকমের ডান্ডেলিয়ন (ওদুভাঞ্চিক), অটাম ক্রকাস, কর্ন পপি, আর্নিকা, আইরিশ, ভাওলা ইন্সিসা, লেডি স্লিপার অর্কিডফুল (ওরহিদিয়া), গোল্ডেন রুট ইত্যাদির দেখা মেলে (চিত্র-৫)। এছাড়াও রাশিয়ানরা ঘরের মধ্যে জবা গাছ রাখতে ভালোবাসে। কিছু জায়গায় গাঁদা ফুলও লক্ষ করেছি। এদের মধ্যে ক্যামোমাইল হল রাশিয়ার জাতীয় ফুল। ক্যামোমাইল চা তাই এখানে সস্তায় পাওয়া যায়।
চিত্র-৫; দুবনা (রাশিয়া) অঞ্চলের কিছু ফুলের ছবির কোলাজ। আলোকচিত্রী- নীতা মুখোপাধ্যায়

দুবনা অঞ্চলে কার‍্যান্ট, আপেল, বিভিন্ন ধরনের বেরি (ব্লুবেরি, ক্র্যানবেরি, হাকেল বেরি, রোওয়ান বেরি, র‍্যাস্পবেরি, গুসবেরি, স্ট্রবেরি ইত্যাদি), চেরি, প্লাম, পেয়ার ইত্যাদি ফল দেখতে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কিছু বেরি গাছ (যেমন ব্লুবেরি, র‍্যাস্পবেরি) এখানকার বনাঞ্চলে এমনি এমনিই হয়। কিছু মানুষ বন থেকে সেসব তুলে আনে নিজেদের খাওয়ার জন্য বা বেচার জন্য।

দুবনা এবং আশেপাশের জলাভূমিকে “সারসের স্বদেশভূমি”-ও (Homeland of the Crane) বলা হয়ে থাকে। অনেক রকমের বক দেখতে পাওয়া যায় এখানে। তাছাড়া এখানে পায়রা, কাক, চড়ুই, ঘুঘু, ওরিওল, শ্রাইক, পিপিট, ওয়েগটেল, বিভিন্ন ফিঞ্চ, ক্রসবিল, বিভিন্ন ধরনের টিট, লার্ক, ওয়ার্বলার, নাইটিংগেল, ফ্লাইক্যাচার, রবিন, হাঁস, রাজহাঁস, পেঁচা, ওয়েডার, অ্যাজুওর টিট, কারলিউ ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন বাজপাখি যেমন অস্প্রে, গ্রেট স্পটেড ঈগল, মার্লিনও নজরে পড়ে। রাশিয়ার জাতীয় পাখি হল ঈগল। দুবনা শহরের কাছেই একটি ঘোড়ার আস্তাবল আছে।

সোভিয়েত আমলে বেশিরভাগ বড় আকারের শহরগুলিতে (বিশেষত মস্কোতে) পথ-কুকুরদের মেরে দেওয়া হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। দুবনা অঞ্চলেও মানুষ কুকুর (রাশিয়ান নাম সাবাকা) ও বেড়াল (কোশকা) পুষতে খুব ভালোবাসে। কম হাঁটাপথের মধ্যেই বিভিন্ন প্রজাতির কুকুর নজরে পরে। হাস্কি, সাময়েদ, বোরজোয়, কালো রাশিয়ান তেরিয়ের, বিভিন্ন প্রকারের শেফার্ড (যেমন ককেশিয়ান, মধ্য এশিয়ান, পূর্ব ইউরোপিয়ান), বিভিন্ন প্রকারের লাইকা (যেমন ইয়াকুতিয়ান, সাইবেরিয়ান), বিভিন্ন প্রকারের বোলোঙ্কা (ফ্রাঞ্জুস্কায়া,  সভেত্নায়া), কোরগি, মস্কো ওয়াচডগ, মস্কো ওয়াটারডগ, রাশিয়ান হারলেকুইন হাউণ্ড, দক্ষিণ রাশিয়ার ওভচারকা, রাশিয়ান স্প্যানিয়েল, রাশিয়ান টয় ইত্যাদি প্রজাতির কুকুর বেশি দেখা যায়। এদের মধ্যে রাশিয়ার কথা ভাবলে হাস্কির কথাই প্রথম মাথায় আসে। তাই নয় কি? কিন্তু মনে আছে সেই কুকুরটাকে, যাকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিলো ‘স্পুতনিক-২’-এ বসিয়ে ১৯৫৭ সালে। তার শান্ত স্বভাব আর ছোটো আকারের জন্যই তাকে বাছা হয়েছিলো। সেই কুকুরই ছিল ‘লাইকা’। মানুষ হিসেবে প্রথম সফল মহাকাশযাত্রার পর ইউরি গ্যাগারিন বলেছিলেন, “আমি এখনো বুঝিনা, কে আমি? মহাকাশে যাওয়া প্রথম মানুষ না শেষ কুকুর?”
চিত্র-৬; দুবনা (রাশিয়া) অঞ্চলের কিছু প্রাণীর ছবির কোলাজ। ছবি ঋণ- [৫, ৬]

অন্য প্রাণীদের মধ্যে এই অঞ্চলে পাইন-কাঠবিড়ালী, লিংক্স নামক বিরল প্রজাতির বনবেড়াল, বিভার ইঁদুরের দেখা মেলে। এখানকার বনাঞ্চলে বিশেষত শীতের পরে কমোন ইউরোপিয়ান অ্যাডার/ ভাইপার (রাশিয়ান নাম গাদিউকা) নামক এক বিষাক্ত সাপ দেখতে পাওয়া যায়। এটি আমাদের ওখানের বোড়া সাপের মতো। এছাড়াও নির্বিষ স্মুদ সাপ (মেদিয়াঙ্কা) গ্র্যাস সাপ (উঝ)-এরও দেখা মেলে এখানে (চিত্র-৬ দেখুন)। উঝ সাপটি আমাদের ওখানকার জল ঢোঁরা সাপের মতো।

বাঙালি হয়ে মাছের খোঁজ করবোনা তা কী করে হয়? এখানে কারাশ, পিঙ্ক স্যামন (রাশিয়ান নাম গোরবুশা), তেলাপিয়া, কড (পুতাসু), সাজান (রাশিয়ান কার্প), রেড স্ন্যাপার (ক্রাস্নিই বেরিক্স), ডোরাডো (দারাদে), হেরিং (সিলিওৎকা), ষ্টারজিওন (জার রিবা), পার্চ, বিভিন্ন ধরনের গোবি, তুল্কা, অ্যাঙ্কভি, সোল, স্ক্যাড ইত্যাদি মাছ পাওয়া যায়। কারাশ মাছটিও তেলাপিয়ার মতো খেতে। হেরিং মাছ ইলিশ মাছের মতো, রেড স্ন্যাপার মাছ ভেটকি মাছের মতো, ডোরাডো মাছ জাপানী পুঁটি মাছের মতো খেতে হয়।    

শেষ করার আগে উল্লেখ করবো আরও একটি প্রাকৃতিক ঘটনা- দ্বৈত রংধনুর (দবাইনায় রাদুগা) কথা। রংধনু আমি আগেও দেখেছি কিন্তু দ্বৈত রংধনু এখানে এই প্রথম দেখলাম। তাই লিখতে ইচ্ছে হল যারা দেখেননি এখনো তাদের জন্য। একদিন ভোল্গা নদীর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মেঘ ঘনিয়ে এসে বৃষ্টি হতে শুরু হয়। উল্টোদিকে সূর্য ছিল। সেসময়ই এই দ্বৈত রংধনুর ছবিটি (চিত্র-৭) তোলা। 
চিত্র ৭- দ্বৈত রংধনু, স্থান-দুবনা, রাশিয়া, আলোকচিত্রী- তথাগত

আমরা জানি যে সূর্য থেকে আসা আলোকরশ্মি জলকণার মধ্যে দিয়ে গেলে সাত রঙে ভেঙে যায় (ফলে বিক্ষেপ কোণও আলাদা হয়) এবং প্রতিফলন ও প্রতিসরণের সূত্র মেনেই তৈরি হয় রংধনু। এ তো গেলো প্রাথমিক রংধনুর কথা। তাহলে দ্বিতীয়টি কিভাবে হলো? ভেঙে যাওয়া আলোগুলো যদি জলকণার ভিতরের পৃষ্ঠ থেকে দ্বিতীয়বার প্রতিফলিত হয় তবে দ্বিতীয় রংধনু তৈরি হয়। প্রাথমিক রংধনুর ক্ষেত্রে লাল রঙ ওপরে আর বেগুনি নীচে, দ্বিতীয় রংধনুটির ক্ষেত্রে এর ঠিক উল্টো হয়- বেগুনি ওপরে, লাল নীচে। দ্বিতীয় রংধনুটি প্রথমটির মতো অতোটা প্রকট হয়না। আপনাদের কেউ কোনোদিন দুয়ের বেশি রংধনু দেখলে ছবি তুলে রাখবেন আর আমায় জানাবেন। 

এখানে বরফ পড়ার এবং ভোল্গা নদী থেকে দুই তীরের দুবনা অঞ্চলের দৃশ্যের একটি ছোটো ভিডিও ক্লিপ দিলাম। অন্য কোনোদিন রাশিয়ার দুবনা অঞ্চলের জনজীবন, জীবিকা, লোকসংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে লিখবো।     

তথ্যসূত্র- 
(১) http://www.jinr.ru/main-en/ 
(২) ‘The Geography of Russia (Societies and Cultures: Russia)’ by Emily Sebastian, Rosen Education Service (August 15, 2018).
(৩) “Predictive Modeling of Plant Productivity in the Russian Arctic Using Satellite Data”, O. A. Anisimov, Ye. L. Zhiltcova, and V. Yu. Razzhivin, Atmospheric and Oceanic Physics. 51, 1051–1059 (2015).
(৪) http://education.rec.org/ru/en/forestry/in_russia/13-04-07.shtml 
(৫) https://www.dubna.ru/article/2019/04/yadovitye-zmei-prosnulis-posle-zimy 
(৬) https://dubna.net/forum/ 

তথ্য সহায়তা-
বিজন সাহা, নীতা মুখোপাধ্যায়

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 
গুচ্ছ কবিতা 
তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়

Post a Comment

2 Comments

  1. What a nice description of nature. I may recall the Jack London's novel 'Call of the wild' . Carry on brother . We become enriched.
    Love & respect.

    ReplyDelete
    Replies
    1. Thank you very much. The second part is coming soon.

      Delete