জ্বলদর্চি

শিকাগো শহরে, স্বামীজী স্মরণে/মহুয়া ব্যানার্জী

শিকাগো শহরে, স্বামীজী স্মরণে
মহুয়া ব্যানার্জী

১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ই জানুয়ারি পৌষের কৃষ্ণা সপ্তমীর ভোরে  কলকাতার শিমুলিয়ার দত্ত পরিবারে বিশ্বনাথ দত্ত ও ভুবনেশ্বরী দেবীর কোল আলো করে পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে মা আদর করে নাম রাখলেন "বীরেশ্বর" কারণ ভুবনেশ্বরী দেবী বীরেশ্বর শিবের কাছে প্রার্থনা করে পুত্র সন্তান লাভ করেছিলেন বলে ছেলের নাম দিলেন বীরেশ্বর। বাবা নাম দিলেন নরেন্দ্রনাথ ওরফে নরেন আর সবাই ডাকত "বিলে'" বলে। নাক,মুখ,চোখ এর গড়নে একদম যেন দেবশিশু। সোনার ছেলে দামাল ও ছিল বটে। ছোট থেকেই আধ্যাত্মিকতার প্রতি ছিল বিলের খুব আকর্ষণ। মাত্র ৪-৫ বছর বয়সেই দুরন্ত বিলে শিব নাম করলেই শান্ত হয়ে যেত। মায়ের কোলে বসে রামায়ণ, মহাভারত,  ঋষি -মুনিদের গল্প শুনতে ভারী ভালোবাসত ছোট্ট বিলে। একদম  শিশু বয়স থেকেই রামসীতার গল্পে বিলে ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়তো। রামসীতার মাটির মূর্তি জোগাড় করে চিলেকোঠায় পুজো করতো। রামায়ণ, মহাভারত ছিল মাথায় গাঁথা, ভুল হওয়ার জো নেই তাঁর। যেখানেই রামায়ণ গানের আসর বসে বিলে সেখানেই হাজির হয়ে যায়। মায়ের প্রতিদিন পুজো আর ধ্যান এ বসা দেখে বিলেও বন্ধুদের সাথে "ধ্যান ধ্যান" খেলা খেলতো। অন্যদিকে আবার নরেন্দ্রনাথ অদ্ভূত মেধাবী আর আশ্চর্য প্রতিভার অধিকারীও ছিলেন। কথিত আছে তিনি একবার একটি ৭০০ পাতার জার্মান বই মাত্র ১ ঘন্টায় পড়ে ফেলেছিলেন। কোনো বই পড়লে তিনি সেই বই এর প্রতিটি শব্দ হুবহু মনে রাখতে পারতেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে কলেজ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় একমাত্র ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করা ছাত্র ছিল এই অনন্য মেধাবী নরেন। এন্ট্রান্স পাশের সময়ই বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের বহু বিখ্যাত বই পড়া হয়ে গিয়েছিলো তাঁর। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন নরেন সাহিত্য-ইতিহাসের বই শেষ করে বেদ -উপনিষদ -দর্শন পড়া শুরু করেছিলেন,শুরু করেছিলেন ব্রাহ্ম সমাজে যাতায়াত। তখন থেকেই তিনি জানতে চাইতেন মন ও আত্মার প্রতিটি ক্রিয়া কি ও কেমন? এবং এইসব জানার ঔৎসুক্যে মাঝে মঝেই নরেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী আর শিবনাথ শাস্ত্রী মশায়ের সাথে ধর্মশাস্ত্র নিয়ে আলোচনায় বসতেন, তখন থেকেই তাঁর শুরু হয় কঠোর ব্রহ্মচর্যা,নিরামিষ খাওয়া ও উপবাস। সেসময় সারাদিনই দর্শনের বই পড়তেন, কলেজের পড়ায় তেমন আনন্দ খুঁজে পেতেন না নরেন,যতটা আনন্দ তিনি পেতেন আনন্দমোহন বসুর বক্তৃতা শুনে কিংবা হিন্দু মহামেলা বা ব্রাহ্ম সমাজের আলোচনায় যোগ দিয়ে। ক্লাসের পড়ার বাইরে বড়ো বড়ো বই পড়তেন, ব্রাহ্মসমাজের নিরাকার ব্রহ্ম-এর উপাসনা করতেন, কিন্তু এই সময়  থেকেই তাঁর মনে একটা বিশ্বাস জোরালো হতে থাকে যে ডাকতে পারলে ভগবানকে দেখতে পাওয়া যায়, তার সাড়া পাওয়া যায়। কলেজে পড়াকালীনই প্রিন্সিপাল উইলিয়াম হেস্টির মুখ থেকেই  নরেন প্রথম শ্রী রামকৃষ্ণদেবের নাম শোনেন, পরে ১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে ভক্ত সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের প্রথম দর্শন পান।এরপর ধীরে ধীরে তাঁর এই বিশ্বাসের উত্তর খুঁজতে দক্ষিনেশ্বর এ আসা যাওয়া শুরু করলে ঠাকুরের সব থেকে প্রিয় শিষ্য হয়ে ওঠেন। তাঁর ধ্যানপ্রবণ দিব্যকান্তি দেহ, সঙ্গীতে পারদর্শিতা,উদার-বীর হৃদয় ও চরম সত্যানুরাগ ঠাকুরকে মুগ্ধ করেছিল। ১৮৮৬ সালে ঠাকুর এর মহাসমাধির ক'মাস আগে গেরুয়া আর রুদ্রাক্ষ দান করে রামকৃষ্ণদেব প্রেম দিয়ে জগৎ জয়ের দীক্ষা দিয়ে যান নরেন কে, ত্যাগের পথ দেখিয়ে বলেন দেশ গড়ার কথা। এরপর জীবনের একদম অন্তিম পর্যায়ে এসে যখন রামকৃষ্ণদেব কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছেন তখন কাগজে লিখে নরেনকে ডেকে পাঠিয়ে জানালেন -তাঁর যাওয়ার সময় হয়েছে, নরেনকেই তাঁর সব ভার নিতে হবে। 

  এরপর আসে সেই পরম ক্ষণ। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই আগস্ট ঠাকুর তাঁর নশ্বর দেহ ত্যাগ করার কিছুক্ষণ পূর্বে নরেনকে ডেকে বললেন "আজ সর্বস্ব তোকে দিয়ে নিঃস্ব হলাম, আমার শক্তিতে তুই কাজ করবি। কাজ চুকলে যেখান থেকে এসেছিস সেখানে ফিরে যাবি"। আসলে রামকৃষ্ণদেব তাঁর মধ্যে এক মহান বিশ্ব শিক্ষকের শক্তি এবং সম্ভাবনা দেখেছিলেন। ঠাকুর শ্রী শ্রী পরমহংসদেব মারা যাওয়ার আগেই ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন "নরেন্দ্র অন্যকে শিখিয়ে দেবেন .....খুব শীঘ্রই তিনি তাঁর বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি দ্বারা বিশ্বকে নাড়া দেবেন" । 
  ঠাকুরের মহাসমাধির মাস খানেক পরে ১৮৮৭ সালের জানুয়ারি মাসের শেষে নরেন ও তার সঙ্গীরা বরানগর মঠে বিরজা হোম করে মানব কল্যাণার্থে, ত্যাগের আদর্শে জীবন উৎসর্গ করে পূর্ণ সন্ন্যাসী হলেন, তাদের নাম হল যোগানন্দ, প্রেমানন্দ, শিবানন্দ কিন্তু নরেন কোনো নাম নিলেন না। এদিকে নরেনের মনে শান্তি নেই। ১৮৮৮ সালের জুন মাসে নরেন্দ্রনাথ প্রেমানন্দ ও ফকিরবাবু এই ২জনকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মঠ ছেড়ে। প্রথমেই আসেন কাশীধামে, এখানে তিনি ত্রৈলঙ্গস্বামীর দর্শন পান। তাঁর বৈরাগ্য আর নিষ্ঠা দেখে নরেন মুগ্ধ। এরপর কাশীতে আরও কিছুদিন কাটিয়ে উত্তর ভারতের বেশ কিছু তীর্থ স্থান ঘুরে বেড়ান। এইসময় মানুষের দুর্দশা দেখে নরেনের চোখ খুলে যায়, বেদান্তকে বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে সেবাই যে শ্রেষ্ঠ পথ তা তিনি উপলব্ধি করেন। ফিরে আসেন আবার বরানগর মঠে। কিন্তু আবার ১৮৮৮ সালের জুন মাসেই তিনি পরিব্রাজক রূপে মঠ থেকে বেরিয়ে পড়েন। এইসময় তিনি আসুমদ্র হিমাচল পরিভ্রমণ করেন, ঘুরে বেড়ান ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন রাজার আতিথেয়তা গ্রহণ করেন, নানান ধরনের মানুষের সংস্পর্শে আসেন, ভিক্ষা করে খান, সাধনা করেন। অনুভব করেন ভারতমাতার দুঃখ দুর্দশার কারণ। কিন্তু তবু তাঁর মনে হতে থাকে বন্ধু আর সঙ্গীদের মায়ায় তিনি বাঁধা পড়ে যাচ্ছেন, এইবার একলা যেতে হবে তাঁকে। আর সেইমতো ১৮৯১ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি একা বেরিয়ে পড়েন এবং বিবিদিষানন্দ নাম নিয়ে দিল্লি পৌঁছান, যদিও গুরু ভাইরা পিছু করে তাঁকে ঠিক খুঁজে বার করে ফেলেছিলেন। 

  এরপর স্বামীজী রাজপুতানার নানা গ্রাম ঘুরে জয়পুর, আজমীর দেখে ক্ষেত্রী তে এসে পৌঁছান। সেখানে ৮মাস মতো থেকে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে আসেন বেলেগাঁও। বেলেগাঁও -এর পর মহিশূরে কয়েকমাস কাটিয়ে ভ্রমণ করলেন ত্রিচুর, ত্রিবাঙ্কুর, মাদুরাই। সেখানে রামনাদের রাজা স্বামীজীর সাথে দেখা করে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ও শিকাগো ধর্ম মহা সভায় যাওয়ার প্রস্তাব দেন। প্রথমে স্বামীজি রাজি না হলেও পরে মা সারদা এবং ধ্যানে গুরু রামকৃষ্ণদেবের অনুমতি নিয়ে আমেরিকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ক্ষেত্রীর রাজার অনুরোধে সচ্চিদানন্দ, বিবিদিষানন্দ প্রভৃতি নাম ত্যাগ করে স্বামীজি এবার পাকাপাকি ভাবে বিবেকানন্দ নামটি গ্রহণ করলেন। এরপর  ১৮৯৩ সালের ৩১ মে  মাদ্রাজি ভক্ত আলাসিঙ্গা পেরুমল ও ক্ষেত্রীর রাজার সচিব জগমোহনলাল এর ব্যবস্থাপনায় স্বামীজি বোম্বাই থেকে "পেনিনসুলা" নামের জাহাজে চেপে প্রথম ভারতের মাটি ছেড়ে শিকাগোর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। বোম্বাই ছাড়ার ১ সপ্তাহের মধ্যে জাহাজ কলম্বো এসে পৌঁছালো। সারাদিন জাহাজ বন্দরে থাকবে তাই স্বামীজী শহর দেখতে নামলেন, শেষে গাইডের সাহায্য নিয়ে পোলোন্নারুয়ার ৬০০ বছরের প্রাচীন ৪৬ফুট লম্বা বৌদ্ধ মূর্তি দেখে বেজায় আনন্দিত হলেন। এরপর জাহাজ কলম্বোর পর পিনাং, সিঙ্গাপুর হয়ে হংকংয়ে এসে থামল তিন দিনের জন্য। সেখানেও স্বামীজী স্টিমারে করে ৮০ মাইল দূরে ক্যান্টনে গেলেন ওয়ালুম মন্দিরে বুদ্ধদেবের মূর্তি দর্শন করতে। এরপর জাহাজ হংকং থেকে নাগাসাকি হয়ে কোবি পৌঁছালো। এবার জাহাজ ছেড়ে রেলপথে জাপানের ওসাকা, কিয়োটো ও টোকিও ঘুরে পৌঁছালেন ইয়াকোহামায়। কামাকুরার হাজার বছর আগের তৈরি ৫০ফুট উঁচু, দুটি সোনার চোখের এবং ব্রোঞ্জে ঢালাই বুদ্ধ মূর্তি দেখে তিনি যে শুধু অভিভূত হলেন তাই নয় স্বামীজীর মনে হলো এর থেকেও গৌরবের বিষয় প্রাচ্যের উন্নত ধর্ম,সভ্যতা ও শিল্প। এরপর ইয়াকোহামা থেকে আবার জাহাজে চড়লেন স্বামীজি। প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তরাংশ দিয়ে জাহাজ চলল কানাডার পথে। জাহাজ থেকে ভ্যাংকুভার বন্দরে নেমে কানাডার ভিতর দিয়ে ট্রেনে করে ৩ দিন পরে ১.৫ মাসের সফর শেষে অবশেষে ১৮৯৩ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি আমেরিকার শিকাগো শহরে পদার্পন করলেন স্বামী বিবেকানন্দ। প্রথমদিকে বিদেশের মাটিতে নানারকম কষ্ট হলেও পরে আমেরিকার বিভিন্ন পরিবারের সাথে তাঁর হার্দিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তারমধ্যে সব থেকে উল্লেখ যোগ্য হলো শিকাগো শহরে মিসেস ও মিস্টার হেল এর পরিবার যেটা ধীরে ধীরে পরে আমেরিকার বুকে স্বামীজীর দ্বিতীয় বাসস্থান হয়ে গিয়েছিল। স্বামীজীকে ওনারা ছেলের মতো ভালোবাসতেন, তাদের দুই মেয়ে ও দুই ভাগ্নি স্বামীজিকে দাদা বলে ডাকতেন। স্বামীজীর অবর্তমানে ওঁনার সমস্ত দরকারি চিঠি মিসেস ও মিস্টার হেল-এর বাড়িতেই (Hale House)আসত। 

  যাইহোক, এবার আসি শিকাগো ধর্ম মহাসভার কথায়। এদিকে ধর্মমহাসভা বসতে তখনও আরো প্রায় দেড় মাস মত বাকি, তাই স্বামীজী দিন ১২ মতো শিকাগো তে কাটিয়ে ১৯৯৩ সালের অগাস্ট মাসে এসে পৌঁছলেন ম্যাসাচুসেটসের রাজধানী শহর বোস্টনে। সেখানে অধ্যাপক জন রাইটের ব্যবস্থাপনায় ধর্মমহাসভায় আমন্ত্রণ পেলেন। ১৮৯৩ সালে এড জন হেনরি ব্যারোজ (Ref. Wrold's Parliament of Religons, ed. John Henry Barrows,1893)-এর অনুসারে এই মহাসভা আয়োজনের প্রস্তাবিত উদ্দেশ্য গুলি ছিল কিছুটা এই রকম : ১) বিশ্বের মুখ্য ও ঐতিহাসিক ধর্মের শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধিগণ দের এক জায়গায় একত্রিত করা, ২) সবথেকে চিত্তাকর্ষক ভাবে মানুষকে দেখানো বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম গুলি কি? এবং তাদের মধ্যের প্রধান সত্যতা ও শিক্ষা কতটা এক ৩) স্থায়ী আন্তর্জাতিক শান্তি ও সুরক্ষা বজায়ের আশায় পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রকে একত্রিত করা এবং বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মধ্যে আরও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতা বাড়ানো ৪) এক ধর্মের প্রতি অন্য ধর্মের ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সহনশীলতার অনুসন্ধান করা।  এর আগে কোথাও কখনও বিশ্বের মহান ধর্মের প্রতিনিধিদের এইভাবে এক জায়গায় একত্রিত করে মহাসভার আয়োজন করা হয়নি যেখানে নির্ভয়ে তারা হাজার হাজার জনতার সামনে তাদের নিজ নিজ বিশ্বাসের কথা বলতে পারেন, তাই ধর্মের ইতিহাসে শিকাগোর এই সংসদ ছিল এক অনন্য ও অভূতপূর্ব ঘটনা।

  আমেরিকায় স্বামীজী  : ১৮৯৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর। 'আর্ট ইনস্টিটিউট অফ শিকাগো" ভবনে ধর্ম মহাসভার অধিবেশন। ভোর থেকেই সেখানে শুরু হয়েছে জন সমাগম, ধর্ম মহাসভার অফিসে সেদিনই স্বামীজীর সাথে আলাপ হল ভারতের প্রতিনিধি বি.বি.নাগরকার, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, বৌদ্ধ ধর্মপাল ও জৈন পুরোহিত মুনি আত্মারামজির সঙ্গে। সকাল ঠিক ১০টা। শোভাযাত্রা দিয়ে শুরু হলো ধর্ম মহাসভার অনুষ্ঠান। বিভিন্ন দেশ ও ধর্মের ৩০/৪০ জন প্রতিনিধি এলেন আর্ট ইনস্টিটিউট অফ শিকাগোর "হল অফ কলম্বাস "এর বিশাল মঞ্চে। হলে তখন ৩/৪ হাজার শ্রোতা। স্বামীজী, নাগরকার, প্রতাপ মজুমদার পাশাপাশি। সকালের অধিবেশনে লিখিত ভাষণ পাঠ করলেন সাত জন বক্তা, বিকেলের অধিবেশনে ধর্ম মহাসভার চেয়ারম্যান রেভারেন্ড ব্যারেজ সভাতে স্বামীজিকে তরুণ ভারতীয় সন্ন্যাসী বলে পরিচয় দিয়ে ভাষণ দিতে বললেন। স্বামীজীর পূর্বের প্রস্তুতি না থাকায় মা সরস্বতী ও গুরু রামকৃষ্ণদেবকে স্মরণ করে সভার মধ্যে উঠে দাঁড়ালেন। এরপর এলো সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত যা বিশ্ব ধর্মের ইতিহাসে আজও এক বহুল চর্চিত ও পরম বিস্ময়কর ঘটনা। ভাষণের শুরুতেই তিনি সভাতে উপস্থিত সকল শ্রোতাকে উদ্দেশ্য করে সম্বোধন করলেন পরমাত্মীয়ের ভাষায় "Sisters & Brothers of America " আমেরিকার বোনভাইয়েরা। স্বামীজীর সেদিনের এই সম্ভাষণে মুগ্ধ হাজার হাজার শ্রোতা উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় ২ মিনিট ধরে হাততালি দিয়ে স্বামীজিকে অভিবাদন জানিয়েছিলেন। স্বামীজির মাথায় ভাষণও তখন আশ্চর্য ভাবে ফুটে উঠছিল। স্বামীজী সেদিন তাঁর ভাষণের মধ্যে দিয়ে পশ্চিমী দুনিয়ায় প্রকাশ করেছিলেন জাতি ও জাতীয়তাবাদ নির্বিশেষে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ও প্রতিটি মানুষের মধ্যেকার সহজাত দৈবতার কথা যা আসলে ভারতের অতি প্রাচীন ও চিরাচরিত একটি বার্তা, স্বামীজির ভাষায় - "Each Soul is potentially divine,the goal is to manifest the divinity "। বলেছিলেন সব ধর্মের ঐক্যতার কথা। ভারতীয় আধ্যাত্মিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে পশ্চিমের গুনগান করেছিলেন। তিনি সার্বজনীন অসহিষ্ণুতা ও সব ধরণের ধর্মান্ধতার অবসান হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন মানুষের আত্মাই সর্বোচ্চ, মানুষ অদ্বিতীয়।মানুষের মধ্যে দেবত্বের প্রকাশই হলো সভ্যতা। তিনি বলেছিলেন আদান-প্রদানই জগতের নিয়ম, সমগ্র জগৎকে ভালোবাসতে না পারলে, সঙ্গে না নিলে কোনো প্রগতিই সম্ভব নয়।সম্প্রসারণই জীবন, সংকোচনই মৃত্যু। তিনি আরও বলেছিলেন তিনি গর্বিত কারণ তাঁর ধর্ম সমগ্র বিশ্বকে সহনশীলতা ও সার্বজনীন গ্রহণ যোগ্যতা শিখিয়েছে। 

  তিনি বলেছিলেন আমরা শুধু সার্বজনীন সহনশীলতায় বিশ্বাস করি তাই নয়,আমরা বিশ্বের সকল ধর্মকে সত্য বলে গ্রহণ করি। তিনি আরও বলেছিলেন তিনি গর্ব বোধ করেন সেই রাষ্ট্রের মানুষ হিসাবে যে রাষ্ট্র বিশ্বের সকল ধর্মের নিপীড়িত ও নির্যাতিত শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। শিকাগো বিশ্ব ধর্মমহাসভায় স্বামীজির সেদিনের সেই বক্তৃতা শুধুমাত্র দর্শনতত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, স্বামীজী বলেছিলেন ধর্ম হলো আত্মোপলব্ধির, আত্মজাগরণের। ধর্ম মানুষকে পশু থেকে মানুষে এবং তারপরে মানুষ থেকে দেবতায় রূপান্তরিত করে। ১৫মিনিট ধরে অনর্গল ইংরেজি ভাষায় স্বামীজীর এই প্রাণবন্ত ও শ্রুতিমধুর ভাষণ সেদিন ধর্ম মহাসভায় উপস্থিত ৪০০০ শ্রোতার হৃদয় স্পর্শ করে গিয়েছিলো। তাঁর বলা ছিল মন্ত্রোচ্চারণের মতো, বেদ পাঠের মতো, সভা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো, শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছিলেন তার কথা। স্বামীজীর বক্তৃতা শেষ হতেই সভায় উপস্থিত সকলে হাত বাড়িয়ে একবার ছুঁতে চেয়েছিলেন তাঁকে।  ১৮৯৩ সালে স্বামীজির এই ভাষণের হাত ধরেই বিশ্ব দরবারে খুলে গিয়েছিলো সনাতন হিন্দু ধর্মের দরজা। পশ্চিমী দুনিয়ার মানুষদের সাথে স্বামীজী সেদিন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ভারতের সর্বপ্রাচীন সনাতন হিন্দু ধর্মের। আর তারপর তাঁর এই সম্ভাষণ ও ভাষণ ধর্মের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন বক্তৃতা হয়ে রয়ে গেলো গোটা বিশ্ববাসীর কাছে। আর সবশেষে যা হওয়ার ছিল তাই হলো, স্বামীজির বক্তৃতা হলো সকলের সেরা। পরদিন তৎকালীন সব খবরের কাগজের সব থেকে বড় খবর ছিল -স্বামীজীর এই ভাষণ। তার মধ্যে ২,১টির উল্লেখ আমি এখানে করছি। ১) The New York critique -লিখেছিলো,অনেক লোকই খুব ভালো ভাষণ দিয়েছিলো কিন্তু এক হিন্দু সাধু বিশ্ব ধর্ম সংসদের বিষয় কে যেভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপনা করেছিলেন সেভাবে আর কেও করতে পারেননি। উনি একজন বড় বক্তা। আমি ওনার পুরো ভাষণ প্রকাশ করলাম। কিন্তু ওখানে উপস্থিত মানুষের ওপর ওনার ভাষণের যে প্রভাব পড়েছিল তা বোঝানো প্রায় অসম্ভব। ওনার তেজ্বস্বী চেহারা, ওনার বুদ্ধিমত্তা, আর ওনার বেশভূষার প্রভাব ভাষায় প্রকাশ করতে গেলে শব্দ কম পরে যাবে।  ২) The New York Herald- লিখেছিলো, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে বিশ্বধর্ম সংসদে স্বামী বিবেকানন্দ সবার থেকে মহান ছিলেন। ওনাকে শোনার পর মনে হয় এত বিদ্বান ও বুদ্ধিমান দেশে মিশনারিজ দের পাঠানো কতটা মূর্খতার পরিচয়। এরপর স্বামীজীকে ধর্ম মহাসভার ১৭দিনের প্রতিটি অধিবেশনে ভাষণ দিতে হয়েছিল। ১৯৮৪ সালের ১১ই মার্চ ডেট্রয়েটের অপেরা হাউস -এ স্বামীজী টানা আড়াই ঘন্টা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। কথিত আছে স্বামীজীর ডেট্রয়েটের এই বক্তৃতায় তৎকালীন আমেরিকান ডলারের মূল্যে ২০০০ ডলার এর টিকিট বিক্রি হয়েছিল। ভাষণ দিয়েছিলেন শিকাগোর আশেপাশের অঞ্চলে, নিউ ইয়র্ক ও বোস্টন শহরে। এইভাবে আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে স্বামীজীর বক্তৃতা, সভা ও ক্লাস -এর পর পশ্চিমী দুনিয়ায় তাঁর জনপ্রিয়তা ও ভক্তের সংখ্যা যেমন ক্রমশই বাড়ছিল সেই সাথে বাড়ছিল হিন্দু ধর্ম ও বেদান্ত চর্চার প্রতিও মানুষের আগ্রহ। তাই ১৮৯৪ সালের নভেম্বর মাসে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে সনাতন হিন্দু ধর্ম ও বেদান্তের বার্তা ছড়িয়ে দিতে স্বামীজি প্রথম বেদান্ত সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করলেন। পরে ১৯০০ শতকে আবার যখন আমেরিকা গিয়েছিলেন তখন সান ফ্রান্সিস্কো শহরে তিনি নিজে আর একটি বেদান্ত সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেটা এখন "Vedanta Society of Norhern California" নামে পরিচিত। বেদান্তের মূল মন্ত্র দিয়ে তিনি যে পশ্চিম দুনিয়া জয় করেছিলেন তাতো আর বলার অপেখ্যা রাখে না। পুরো শিকাগো শহরের আনাচে -কানাচে স্বামীজীর স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে। স্বামীজীর স্মৃতি বিজড়িত কিছু স্থান বা বাড়ি কালের গহ্বরে বিলীন হয়ে গেলেও এখনও শিকাগো শহরের মিশিগান এভিনিউয়ে "আর্ট ইনস্টিটিউট অফ শিকাগো"-র ঠিক সামনের রাস্তাটি স্বামীজির নামে দেখলে কিংবা শিকাগোর পাশের অঞ্চলের হিন্দু মন্দিরে ( Hindu Temple of Gteater Chicago , Lemont , IL,  USA) ব্রোঞ্জের তৈরি ১০ফুট উচ্চতার স্বামীজির মূর্তি দেখলে এটা খুব স্পষ্ট হয় যে শিকাগো শহর আজও স্বামীজীর স্মৃতিকে সম্মান করেন। স্বামীজীর পদধূলি ও স্মৃতি বিজড়িত এই শিকাগো শহরে ও আমেরিকার আরো ২ টি বড় শহরে বেশ কিছু বছর থাকার সৌভাগ্য আমি প্রাপ্তি করেছিলাম। আর সেই সুবাদে ১) "Art Institute of chicago" ভবন এবং সেই বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক কলম্বাস হলটি, যদিও আসল হলটি এখন আর নেই নামও পরিবর্তন হয়ে এখন নাম হয়েছে "Futterton Hall", দেখার পরম সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। এছাড়াও আরও যা যা আমি দেখেছিলাম তা হলো ২) শিকাগোর suburb এ অবস্থিত "Hindu Temple of Gteater Chicago", 10915 Lemont Rd, Lemont, IL 60439, United States, ৩) "Vivekananda Vedanta Society of Chicago",14630 Lemont Road,Homer Glen,IL,60491, ৪) "Vedanta Society of Western Washinton", Seattle,USA। আমার দেখা এই সমস্ত জায়গার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ও নিজের তোলা কিছু ছবি এখানে দিলাম। 
১)  Art Institute of Chicago : শিকাগো শহরের প্রাণকেন্দ্র মিশিগান এভিনিউ -এর ওপরে এই " Art Institute of Chicago" অবস্থিত। ১৮৯৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর এই ইনস্টিটিউটের "Columbus Hall " -এ  বিশ্ব ধর্ম মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে স্বামী বিবেকানন্দ ওনার ঐতিহাসিক ভাষণ রেখে আমেরিকাবাসীর হৃদয় জয় করেছিলেন। তবে পরে প্রতিষ্ঠানটির রক্ষনাবেক্ষনের জন্য পুনর্নির্মাণের কাজ হওয়াতে মূল হল এবং প্রতিষ্ঠানটির ভিতরের গঠন ও কাঠামোতে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে, বর্তমানে "Columbus Hall" নামটিরও পরিবর্তন হয়ে নাম হয়েছে "Fullerton Hall "।

    ২) HONORARY SWAMI VIVEKANANDA WAY, Michigan Avenue,Chicago,USA : ১৯৯৩ সালে স্বামী চিদানন্দ মহারাজজি "Vivekananda Vedanta Society of Chicago"র ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক পদে নিযুক্ত হওয়ার পরে শিকাগো তে স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তিনি বেশ কিছু ভালো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সেগুলি হলো--

   ১) Art Institute of Chicago -র "Fullerton Hall" এর সামনে স্বামীজীর স্মরণে একটি ফলক স্থাপনা করা, ২) ওনার উদ্যোগে ১১ই নভেম্বর ১৯৯৫ সালে আর্ট ইনস্টিটিউট অফ শিকাগোর সামনে মিশিগান এভিনিউয়ের অংশ বিশেষটির নতুন করে নামকরন করা হয় "HONORARY SWAMI VIVEKANANDA WAY" এবং ৩) Hindu Temple of Gteater Chicago তে স্বামীজীর ১০'২'' উচ্চতার ব্রোঞ্জের মূর্তি প্রতিষ্ঠা।  
   ৩)  Hindu Temple of Gteater Chicago: ১৯৭৭ সালে শিকাগোর suburb লেমন্ট-এ এই হিন্দু মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই মন্দির প্রাঙ্গনে ২টি আলাদা আলাদা মন্দির রয়েছে ১টি হলো রাম মন্দির আর দ্বিতীয়টি হলো গনেশ -শিব-দূর্গা মন্দির। এই মন্দির চত্বরের মধ্যেই স্বামী বিবেকানন্দের নামে একটি পৃথক আধ্যাত্মিক কেন্দ্র আছে, যেখানে নানা রকমের আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকলাপ যেমন ধ্যান,যোগব্যায়াম, আধ্যাত্মিক বক্তৃতা ইত্যাদি হয়ে থাকে। এছাড়াও এই আধ্যাত্মিক কেন্দ্র লাগোয়া একটি উঁচু টিলা আছে যার নাম "Vivekananda Hill" আর এই টিলার ওপরে রয়েছে স্বামীজীর ১০'২'' উচ্চতার একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি যেটা আমেরিকার সার্বজনীন স্থানে স্থাপিত প্রথম স্বামীজীর মূর্তি। বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় তোলা স্বামীজির ছবিটিকেই পরে কতৃপক্ষ মূর্তি করে বানান। 

  ৪) "Vedanta Society of Western Washinton", Seattle,USA.: এই বেদান্ত সোসাইটি স্বামী বিবিদিষানন্দ ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। আমেরিকার নানা শহরে কাজ করার পর ১৯৩৮ সালে তিনি সিয়াটেল (Seattle) আসেন এবংভ "The Ramakrishna Vedanta Center of Seattle" নামে কেন্দ্রটির প্রতিষ্ঠা করেন,পরে ১৯৭৯ সালে কেন্দ্রটির নাম পাল্টে হয় "Vedanta Society of Western Washinton"। এই বেদান্ত সোসাইটির মূল ভবনটি বেশ পুরোনো, ১৯৪২ সালে কেনা যার ঠিকানা 2716 Broadway Ave East। বর্তমানেও ভবনটি একই জায়গায় আছে। এই ভবনটিতে আমার কালীপুজো দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এছাড়াও সিয়াটেল মূল শহর থেকে প্রায় ৪৫ মাইল দূরে স্নোহোমিশ কাউন্টিতে ২১ একর জমির ওপর তপোবন নামে এই সোসাইটির আরও একটি খুব সুন্দর ভবন রয়েছে। এটি আসলে রিট্রিট সেন্টার(শহর থেকে অনেক দূরে আধ্যাত্মিক বিশ্রামাগার ও মনোনিবেশ কেন্দ্র)। এখানেও আমার দুর্গাপুজো দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সোসাইটির কিছু ছবি ও সেই সাথে বেদান্ত সোসাইটির দুর্গাপুজো ও কালীপুজোয় আমার তোলা কিছু ছবি এখানে যোগ করলাম।
   ৫) Vivekananda Vedanta Society of Chicago: ১৯০০ সালে স্বামীজী শেষবারের মতো আরও একবার শিকাগো সফরে এসেছিলেন এবং সেই সময় তাঁর সব থেকে প্রিয় Hale পরিবারে ২দিন ছিলেনএবং নিজ হাতে সান ফ্রান্সিস্কো শহরে বেদান্ত সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বামীজীর এই সর্বশেষ সফরের ৩০ বছর পর ১৯২৯ সালে স্বামী জ্ঞানেশ্বরানন্দ বেদান্ত সোসাইটির কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিবেকানন্দের বিজয় নগরী শিকাগো শহরে আসেন এবং ১৯৩০ সালের ১৯-এ জানুয়ারী শিকাগো তে বেদান্ত সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করেন,যার নাম হয় "Vivekananda Vedanta Society of Chicago"। স্বামী জ্ঞানেশ্বরানন্দের পরে স্বামী বিশ্বানন্দ বেদান্ত সোসাইটির অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন এবং এই সময় কেন্দ্রের ভবনটিও স্থানান্তরিত করা হয়। স্বামী বিশ্বানন্দের মৃত্যুর পর ওঁনার স্থলাভিষিক্ত হন স্বামী ভাষ্যানন্দ। সেসময় স্বামী ভাষ্যানন্দের নির্দেশনায় বেদান্ত সোসাইটির দ্রুত প্রসারণ ঘটেছিলো। জেরক্সের প্রতিষ্ঠাতা চেস্টার কার্লসনের সহায়তায় 5423 এস হাইড পার্ক বুলেভার্ডে তিনি সোসাইটির জন্য ভবন কেনেন এবং 1966 সালে সোসাইটি সেখানে স্থানান্তরিত করা হয়। তিনি ১৯৭১ সালে Ganges,Michigan-এ বিবেকানন্দ রিট্রিট কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা করেন। স্বামী ভাষ্যানন্দজি একজন নিয়মিত ভ্রমণকারী হওয়ার সুবাদে পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা মিলে ৪০টিরো বেশী বেদান্ত সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরপর ১৯৯৩ সালে স্বামী চিদানন্দ মহারাজজি "Vivekananda Vedanta Society of Chicago"-র ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক(অধ্যক্ষ) পদে নিযুক্ত হন। ২০০৮ সালে, কেন্দ্রটি আবার হাইড পার্ক থেকে হোমার গ্লেনের শহরতলিতে সরানো হয় এবং ২১ সেপ্টেম্বর, ২০০৮ এ নতুন মন্দিরটির উদ্বোধন করা হয়। ৪ ঠা মার্চ, ২০১৩ সালে স্বামী ইশতমানন্দকে সোসাইটির ইনচার্জ নিযুক্ত করা হয় এবং বর্তমানে ইনিই "Vivekananda Vedanta Society of Chicago"-র ভারপ্রাপ্ত স্বামীজি রূপে রয়েছেন। আমার তোলা "Vivekananda Vedanta Society of Chicago" দর্শনের কিছু ছবি থাকলো।
জীবন সায়াহ্নে স্বামীজী: এরপর আরও কটা বছর আমেরিকা ও ইউরোপে কাটিয়ে পশ্চিম জয় করে ১৮৯৭ সালে জানুয়ারী মাসে স্বামীজী দেশে ফিরলেন। এরপর ১৮৯৭ সালেরই ১লা মে ঠাকুরের ভাবাদর্শে, জগতের কল্যাণার্থে, নারায়ণজ্ঞানে জীব সেবাধর্ম প্রচারের জন্য ও বেদান্তকে বাস্তবে জীবনে রূপ দিতে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন "রামকৃষ্ণ মিশন"। আসলে ১৮৮৬ সালে ঠাকুর মহাসমাধি যোগে নরলীলা সংবরণ করলে প্রভু রামকৃষ্ণদেবের ইচ্ছানুসারে সন্ন্যাসী-সঙ্ঘ সম্যকরূপে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব নরেন্দ্রনাথের (স্বামী বিবেকানন্দের) উপর অর্পিত হয়। নরেন্দ্রনাথ তাঁর সকল গুরুভাইদের নিয়ে কোলকাতার উপকণ্ঠে বরানগরে এক জীর্ণবাড়ী ভাড়া করে প্রথম রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের ভিত স্থাপন করেন ও তাঁরা সকলে আনুষ্ঠানিক ভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন যেটির উল্লেখ আমি পূর্বেই করেছি, এরপর কিছুকালের জন্য মঠ অনতিদূরে আলমবাজারে স্থানান্তরিত করা হয়। এরপর স্বামীজী আমেরিকা থেকে ফিরে ১৮৯৭ সালের ১লা মে ঠাকুরের সন্ন্যাসী ও গৃহী ভক্তদের একত্রিত করে "রামকৃষ্ণ মিশন" নামে এক প্রতিষ্ঠান গঠন করেন । ১৮৯৮ সালে বেলুড় মঠের জন্য জমি ক্রয় করা হলে ১৮৯৯ সালে মঠ বর্তমান বেলুড় মঠের ভূমিতে স্থানান্তরিত করা হয়। জীবন সায়াহ্নে তিনি গঙ্গার পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত এই "বেলুড় মঠ"-এই বাস করতেন। ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দের ৪ঠা জুলাই মাত্র ঊনচল্লিশ বৎসর বয়সে স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেবের অবতার স্বামী বিবেকানন্দ এখানেই মহাসমাধিযোগে তাঁর নরলীলা সংবরণ করে রামকৃষ্ণলোকে যাত্রা করেন। 

  তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর থাকেন তাই মানুষের সেবা করা মানেই ঈশ্বরের সেবা করা। তিনি নিজের ওপর বিশ্বাস রাখার কথা বলেছিলেন। তিনি মনে করতেন -যে নিজেকে বিশ্বাস করে না সে নাস্তিক আর যারা ৩৩ কোটি দেবদেবীতে বিশ্বাস না রেখে শুধু নিজের ওপর বিশ্বাস রাখে, আত্মবোধে ভর করে চলে সেই আস্তিক। তাঁর কর্ম ও উপদেশ দেশের যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ভারতের জাতীয়তাবাদকে উজ্জীবিত করে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। তাই তিনি একজন দেশপ্রেমিক সাধক।এবং সেই জন্য প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন ১২-ই জানুয়ারী জাতীয় যুব দিবস হিসাবে পালন করা হয়। তাঁর দেখানো পথ, আদর্শ, শিক্ষা, দর্শন, মানুষের চরিত্র গঠনের ও সমাজের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যদি ভারতবর্ষকে জানতে হয় তাহলে বিবেকানন্দ পড়ো। তাই বাঙালীর গর্ব যুগাবতার স্বামী বিবেকানন্দ চিরকাল আপামর ভারতবাসী তথা সমগ্র বিশ্বের মনের মনিকোঠায় রয়ে যাবেন ভারতরবর্ষের সেই দেশপ্রেমিক সাধক, হিন্দু বীর সন্ন্যাসী হয়ে, যিনি পশ্চিমী দুনিয়াকে হিন্দু ধর্ম, হিন্দু দর্শন, যোগ ও বেদান্তের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।  

পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments