জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল- ৩২/সন্দীপ কাঞ্জিলাল


অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল- ৩২
সন্দীপ কাঞ্জিলাল

বুদ্ধিজীবী ও সমাজ-৭

জমিদারিগত সম্পত্তি  স্বোপার্জিত সম্পত্তি নয়। হিউম্যানিজম, জন্মগত ও জমিদারিগত কোন সামাজিক অধিকারে ও ক্ষমতায় বিশ্বাস করে না। জমিদার গত অধিকার আর ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার অভিন্ন নয়। জমিদারি স্বোপার্জিত সম্পত্তি নয়,সম্রাটের নিজস্ব স্বার্থে উপহার দেওয়া সম্পত্তি, লুটতরাজ করা সম্পত্তি। জমিদারির আয় প্রধানত ব্যক্তিগত কায়িক বা মানসিক মেহনতের আয় নয়। বংশানুক্রমে জমিদারি ভোগ করা হয়। জমিদারের মর্যাদা জমিদারির জন্য, ব্যক্তিগত কৃতিত্বের জন্য নয়। ক্যাপিটালিস্ট তা নন। surplus value মুনাফা রূপে আত্মসাৎ করে যতই তিনি ধনিক হন না কেন, এন্ট্রেপ্রেনার হিসেবে তার ব্যক্তিগত বুদ্ধি সাহস মেহনত, সব কিছুর মূল্য আছে। অন্তত ধনতন্ত্রের প্রথম লগ্নে। জমিদারের জন্মগত অধিকার ছাড়া আর কিছু নেই। সেকালের সমাজে বিদ্যার ও জন্মগত ও বংশগত অধিকারটা বড় ছিল। সে যুগে ধনপতি সদাগরদের যেমন কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না, তেমনি কোন অব্রাহ্মণ পণ্ডিতের পাণ্ডিত্যও স্বীকার করা হতো না। নতুন যুগে হিউম্যানিজম এর এই বংশগত ও বৃত্তিগত অধিকার  অস্বীকার করে, সর্বক্ষেত্রে মানুষের ব্যক্তিগত কৃতিত্ব ও ক্ষমতাকে খানিকটা অন্তত স্বীকৃতি দিল। বর্তমানে  মূলমন্ত্র হলো ব্যক্তি মর্যাদা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। কুলকৌলীন্য নয়, ব্যক্তিগত achievement হল নবযুগের সামাজিক মর্যাদার প্রধান মানদন্ড।বিত্তের ক্ষেত্রে যেমন, বিদ্যার ক্ষেত্রেও তেমনি এই ব্যক্তিগত achievement এর মানদণ্ড বড় হয়ে উঠলো। পুরাতন  পণ্ডিত সমাজ ভেঙে নানা জাতিবর্ণের বিদ্বানদের নিয়ে নতুন বুদ্ধিজীবী সমাজ গড়ে উঠতে থাকলো। 
  এই প্রসঙ্গে দার্শনিক  ম্যানহাইম বলেছেন যে, ইতিহাসে দেখা যায় প্রধানত তিনটি নীতি অনুসারে, প্রাচীন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত  বুদ্ধিজীবী সমাজের বাছাই চলছে।কুলোকৌলিন্যের নীতি সম্পত্তির মালিকানার নীতি এবং ব্যক্তিগত কৃতিত্বের নীতি। ক্রমে ব্যক্তিগত কৃতিত্বের উপর জোর দেওয়ার দিকেই আধুনিক গণতন্ত্রের ঝোঁক বেশি।ঝোঁক বেশি বলে সেটাই একমাত্র সত্য বা মানদণ্ড হয়ে ওঠেনি।কুল ও সম্পত্তির জোর গণ গণতন্ত্রের যুগেও আছে, কেবল ব্যক্তির গুণ বা প্রতিভাই সব নয়।

  ম্যানহাইম বলেছেন, "if one calls to mind the essential method of selecting elites,which up to the present on the historical scene,three principles can be distinguished, selection on the basis of blood property and achievement."
  আধুনিক যুগের আমরা যেমন বহু প্রাচীন সংস্কার একেবারে বর্জন করতে পারিনি,উত্তরাধিকারসূত্রে সাংস্কৃতিক সম্পদের সঙ্গে আবর্জনাও বহন করে চলেছি,তেমনি গণতন্ত্রের যুগেও অ্যারিস্টক্রাসির নীতি একেবার বর্জন করতে পারিনি। আজ ও বিত্তবান এর সন্তান বুদ্ধিজীবী হিসেবে যত সহজে প্রতিষ্ঠা পায়, অনভিজাত বংশের দরিদ্র সন্তান  তারচেয়ে শতগুণ বশি যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তা পান না। বাংলা বুদ্ধিজীবী সমাজে এ দৃষ্টান্ত বিরল নয়।বরং প্রকট বলা চলে।তার কারণ এ দেশে গণতন্ত্র কোনোদিন vigorous ছিল না,আজও নয়।এর মূল কারণ  আমাদের দেশের গণতন্ত্র সজীব ও সচল নয়। নির্জীব গণতন্ত্র সচল ও সজীবতার পরিবর্তে নির্জীব হয়ে ফ্যাসিস্ট নীতির দিকে ঝোঁক প্রবল হয়েছে। 
এ ধরণের সামাজিক অসংগতি থাকা সত্ত্বেও, একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে আধুনিক সমাজে ব্যক্তিগত প্রতিভা বুদ্ধি ও উদ্যমের জোরে সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠালাভের যেটুকু সুযোগ আছে, আগেকার সমাজে তা-ও ছিল না। প্রাচীন সমাজের বাঁধাধরা নিয়মনীতি ভেঙে, যে নতুন সমাজ তৈরি হলো তা গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। বুদ্ধিজীবী সমাজের সামান্য পরিবর্তন নয়, উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলো।বর্তমানে অব্রাহ্মণ বংশীয় সন্তানেরাও উচ্চশিক্ষা ও চিন্তা ভাবনার জন্য সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হলেন।
  মহামতি বিদুর যদি এ-সময় জন্মাতেন, তাহলে একালের ধৃতরাষ্ট্রদের শূদ্রাগর্ভজাত হয়েও অতি গূঢ় তত্ত্বজ্ঞান শিক্ষা দিতে পারতেন। সমাজের দেবতারা নিন্দা করার সাহস পেতেন না।আর মানুষই সৃষ্টি করে ইতিহাস তাঁর বিদ্যা ও বুদ্ধির সাহায্যে।তাই মানুষ ইতিহাসের নায়ক।

  তবে ইতিহাসের নায়ক বলে  মানুষ ব্রহ্ম নয়। মানুষের অস্তিত্ব দেহের দ্বারা সীমায়িত। যে সর্বগ্রাসী ব্যাপকতা ব্রহ্ম  নামক কল্পনায় আরোপ করা হয় তা কখনো ব্যক্তি অস্তিত্বের গুন হতে পারেনা। ফলে মানুষের বিকাশ সাধনায় এমন কোন স্তর নেই যাকে চরম বলে মানা যেতে পারে। মানুষ নানারূপে নানাভাবে নিজেকে বিকশিত করছে, কিন্তু তার কোন রূপটি এমন নয় যার মধ্যে বিশ্বপ্রকৃতির সব সম্ভাবনা এক দেহে আকার লাভ করেছে। ব্রহ্মত্ব অর্জন তাই মানুষের সাধনা নয়।প্রথমে ব্যক্তি নিজেকে গোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র করে দেখতে শেখে। তারপর ক্রমে সে তার স্বকীয় ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলে। এবং পরিশেষে এই বিকাশের পথে সে বৈশ্বিকতা অর্জন করে। মানবতন্ত্রের আদর্শ ব্রহ্ম নয় তার আদর্শ বৈশ্বিক মানব।
  প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে নানা রকমের বাসনাপ্রবৃত্তি কাজ করছে। এর একটির দাবি মেটাতে গেলে অনেক সময় অন্য গুলিকে অবহেলা করতে হয়। এমনকি অনেক সময় তাদের অবদমিত করারও প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু কোন মূলবৃত্তিকে স্থায়ীভাবে অবদমিত রাখা সম্ভব নয়। সে চেষ্টায় মনের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায়। ফলে বিভিন্ন বৃত্তি ও বাসনার মধ্যে  সৌষম্য সাধনের বিশেষ প্রয়োজন আছে। সম্ভোগের দ্বারা প্রতিটি মূল বৃত্তিকে তৃপ্ত করতে হবে, অথচ সঙ্গে সঙ্গে দেখতে হবে যাতে একটির পুষ্টির কারণ, অন্যটির শীর্ণতার কারণ না হয়। 
  সুতরাং সর্বাঙ্গীণ বিকাশই হল মানব তন্ত্রের নীতির মূল আদর্শ। কিন্তু আপনাকে প্রকাশিত করার আগে নিজেকে সমৃদ্ধ করা দরকার। তা না হলে সে প্রকাশের কতটুকু বা মূল্য থাকবে। আত্মসমৃদ্ধির জন্য চাই একদিকে প্রকৃতির সঙ্গে ব্যাপক ঘনিষ্ঠতা, অন্যদিকে যত সংখ্যক পারা যায় মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তা।
অপর মানুষকে না জানলে আমরা প্রত্যেকে আজীবনকাল শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। আর আপন কক্ষেই ঘুরে মরতাম। অপরের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করতে পারি বলেই আমাদের আত্মবিকাশের কোন গণ্ডি নেই।প্রতি মানুষই অসামান্য। প্রতি মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে অপর মানুষের মন নিজের সাধনের উপাদান সংগ্রহ করতে পারে।প্রতি মানুষই যে স্বতন্ত্র এবং তাদের প্রত্যেককেই পৃথকভাবে বোঝা দরকার। মধ্য যুগের শেষ ভাগে দান্তের মহাকাব্যে এই বোধের প্রথম পূর্বাভাস চোখে পড়ে। এর তাগিদে ওই যুগে শরীর বিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয়। লেওনার্দোর নোটবইতে উল্লেখ আছে তিনি দেহ সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করার জন্য গোপনে শবব্যবচ্ছেদ করেছিলেন। মানুষ সম্বন্ধে তার যে কি কৌতুহল এর থেকে আমরা জানতে পারি। 

দার্শনিক ট্যারেন্স লিখেছিলেন আমি মানুষ সুতরাং মানুষ সংক্রান্ত কোন কিছুই আমার অনাত্মীয় হতে পারে না।জ্ঞানের দ্বারা পরিচয়ের দ্বারা যত বেশি সংখ্যক মানুষের সন্নিকটে আসতে পারবো,তত বেশি আমরা সমৃদ্ধ হবো।প্রাচীনকালের সভ্যতা সংস্কৃতি   থেকে আমরা অতীত মানুষকে আপন করি।নানাদেশ ঘুরে নানা মানুষকে আপনার করি।সাধু চোর জ্ঞানী মূর্খের সাথে মিশে বিচিত্র চরিত্রের মানুষের অভিজ্ঞতা লাভ করি।তার ফলে মানুষ সম্বন্ধে বিচিত্র সম্ভাবনা সার্থকতর রুপ পরিগ্রহ করে।এই অর্থে বুদ্ধিজীবী একই সঙ্গে বিশ্বমানবিক এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক। বিশ্বমানবিক,কারণ দেশকাল জাতিবর্ণের কোনও বাধা তাঁর কাছে বাধা নয়।ব্যক্তিকেন্দ্রিক, কারণ তার সমস্ত প্রয়াসের কেন্দ্রে মানুষ। এবং সেই মানুষকে বিকশিত করা তাঁর কাজ।কারণ ব্যক্তির বিকাশই তাঁর বিচারে মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার একমাত্র সার্থকতা।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 



 

Post a Comment

0 Comments