জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান-১৫/ অনিন্দ্যসুন্দর পাল

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)
অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য


পঞ্চদশ পর্ব- "সাহিত্য ৪"

মহাভারতে রামোপাখ্যান ঐতিহাসিক পক্ষে বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য। মনে করা হয়, রামায়ণে বর্ণিত বেশকিছু চরিত্রের উল্লেখ মহাভারতেও পাওয়া যায়, যেমন- হনুমানের সঙ্গে ভীমের সাক্ষাৎ। আবার উল্টোদিকে দেখলে দেখা যাবে, রামায়ণের কোনো চরিত্রের উল্লেখ মহাভারতে কিন্তু নেই। যা থেকেই স্বতঃই মনে করা হয় রামায়ণ মহাভারতের অধিক পুরাতন, অথবা প্রাচীন। তবে বাল্মীকি আদি কবি ও রামায়ণের প্রাচীনতর এমন প্রবাদ ভারতবর্ষে বেশ প্রচলিত কথ্য আছে বহু আগে থেকেই। তাই, এই প্রবাদটির সত্যতা ভিত্তিক ও অসত্য ভিত্তিক দুটোরই উপস্থিতি আছে মনে করা হলেও, প্রবাদটির বিরোধী তেমন কোনো যুক্তিযুক্ততা খুঁজে পাওয়া যায় না, সেহেতু, অগত্যা  এটিকে সঠিক বলে মেনে না নেওয়া ছাড়া আর কোনো বাধা থাকে না।

 তবে, এই প্রসঙ্গ ক্রমে উঠে আসে ভিনটারনিট্সের কথা। তিনি মহাভারতের কুন্তী, দ্রৌপদী, গান্ধারী, ভীম, অর্জুন প্রভৃতির চরিত্রগুলোর সাথে রামায়ণের কৌশল্যা, সীতা, রাম, লক্ষ্মণ প্রভৃতি চরিত্রগুলোর সাথে তুলনা টানার পাশাপাশি এটাও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যে, রামায়ণ শুধু আধুনিক নয়, মহাভারতের থেকে অনেকাংশে অধিক সমাজচিত্রের স্পষ্টতা দাবিদার। বলাই বাহুল্য, ভিনতারনিটসের লেখায় রামায়ণ ও মহাভারত প্রায় সমসাময়িক ব্যাপারটি যতটা স্পষ্ট হয় এবং ততটাই রামায়ণের কোশল দেশের পরিচয়  উঠে আসার পাশাপাশি  মহাভারতে পশ্চিম-ভারতের অপেক্ষাকৃত হীন সভ্যতারও দৃষ্টান্তও মেলে। তবে বলে রাখা ভালো, অনেকেই ভিনটারনিটসের অনেক ব্যাখ্যা মেনে নিতে অপরাগ হয়েছেন ঠিকই, এরপরও মেনে নিতে বাধ্যও হয়েছেন যুক্তির মাধ্যমে যে, একমাত্র মহাভারতেই প্রাচীন ভারতবর্ষের যে দর্শন, রাজনীতির শ্রেষ্ঠ রূপ আঁকা হয়েছে, তা কেবল শ্রেষ্ঠ বললে ভুল হবে, একথায় সেই সমাজের এক সর্বাঙ্গীন সার্থক চিত্রাঙ্কণ। যা আরো স্পষ্ট করে, তিলকের ভাষা-
"ধর্মাধর্মের, কার্যাকার্যের বা নীতির দৃষ্টিতে মহাভারতের যোগ্যতা রামায়ণ অপেক্ষা অধিক"।

এবার আসি একটু ব্যক্তি প্রসঙ্গে। মহাভারতে যেমন দ্রৌপদীর চরিত্র আছে, ঠিক তেমন দময়ন্তীর চরিত্রেরও উল্লেখ আছে। উভয়েই এখানে রাজরানী ও পতিব্রতা হিসাবে বিরাজমান। কিন্তু এখানে দুজনের ভাবনার মধ্যে একটু পার্থক্য মেলে, দ্রৌপদী যেমন পাণ্ডবদের রাজ্যলাভে সর্বক্ষণ উদ্বুদ্ধ করে গেছেন, ঠিক তেমন অন্যদিকে দময়ন্তী রানী হয়েও স্বামীর রাজ্যপ্রাপ্তির কথা একবারও না ভেবে, স্বামীর সঙ্গে থাকাটাই তাঁর সকল সুখের সর্বস্বটুকু ভেবে এক সার্থক গৃহবধূর পরিচয় দিয়ে গেছেন অবিরত, আবার অন্যদিকে এই মহানুভবতা স্বামীর অনুগামিনী হওয়ার এক স্পষ্ট রূপ পরিস্ফুটিত করেছেন।

এবার আসা যাক অর্জুন প্রসঙ্গে, তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধার পাশাপাশি দর্শনশাস্ত্রেও সুপন্ডিত। অজ্ঞাতবাসের সময় তিনি বিরাট রাজার গৃহে বৃহন্নলা উত্তরাকে নৃত্য শিক্ষা দিতেন। কৌরবদের কাছ থেকে তাঁর গোধন রক্ষা করার পর অর্জুন পরিচয় পেয়ে, বিরাট রাজা কন্যা উত্তরাকে অর্জুনের হাতে স্ত্রীরূপে ইচ্ছে প্রকাশ করলে, তা তিনি প্রত্যাখান করেন। অর্জুন নিজ ছাত্রীকে পুত্রবধূ হিসাবে গ্রহণ করার আবেদন রাখেন। এই থেকেই বোঝা যায় তখনকার দিনেও সে যুগের মানসিকতা অনেক উদার ও উন্নত ধরনের ছিল।

এবার আসি, কুন্তী ও গান্ধারীর কথা, এখানে বিশেষ দ্রষ্টব্য, ভিনটারনিটসের মতে, কুন্তী ও গান্ধারী খাঁটি বীরমাতা, এবং কৌশল্যা ও কৈকেয়ী পৌরাণিক নাটকের রানীর সঙ্গে তুলনা করে সুন্দর ভাষায় অভিহিত করেছেন। কুন্তী এখানে সত্যিকারের বীরমাতা, তাঁর হৃদয় উদারতা ও মহত্বে পরিপূর্ণ। উল্লেখ আছে, ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী যখন বনে চলে যান তখন কুন্তীও সেবাশুশ্রূষার জন্য তাদের সঙ্গে যান। এথেকেই প্রকাশ পায় পতিব্রতার বৈশিষ্টটিও। পুনরায় আসে, কৃষ্ণের প্রসঙ্গও। কৃষ্ণ সেযুগের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ, উদার, সমাজসেবী। তাঁর মধ্যে প্রাদেশিক সংকীর্ণতা বলে কোনো জিনিস ছিল না। আবার অন্যদিকে আসে, ভীমের নাম, যিনি স্ত্রীর অপমানের প্রতিশোধ স্পৃহায় দুঃশাসনের রক্তপান করেন। যা একদিকে বর্বরোচিত কাজ হলেও, যা কতটা অযৌক্তিক টা বলাটা খুবই কঠিন। এটুকু বলে রাখা ভালো, বিংশ শতাব্দীতে সত্য জাতিসমূহের মধ্যে যুদ্ধের সময় কত বর্বরোচিত কাজ হয়েছে যা ইয়ত্তা করা মুশকিল। তাই বলে ওই সমস্ত জাতির ভবিষ্যৎ ইতিহাস লেখক যদি তাঁদের অপেক্ষাকৃত অসভ্য জাতি বলে উল্লেখ করেন, তবে ভিনটারনিটস বা তাঁর মতো ঐতিহাসিক হয়ত প্রতিবাদের বাক্যবর্ষণে মুখর হয়ে উঠবেন অথবা বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে তা ভাঙার চেষ্টা করবেন।

(ক্রমশ.........)

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments