জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল -৩৩/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল -৩৩
সন্দীপ কাঞ্জিলাল

বুদ্ধিজীবীদের ভবিষ্যৎ 

বুদ্ধিজীবী মানুষকে ইতিহাসের রচয়িতা হিসাবে দেখে। ভাগ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অথবা অবতার, গুরু বা সন্তের দ্বারা পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় অসহায় জীব হিসাবে দেখে না। সৃষ্টির আদি লগ্নে মানুষের আগের প্রাণীরা পুরোপুরি পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতেন। মানুষ পাথর থেকে ধারালো অস্ত্র নির্মাণ করেছে, তা দিয়ে তার চাইতে শক্তিশালী প্রাণীকে শিকার করার জন্য। আগুন আবিষ্কার করে শীতকে প্রতিহত করেছে। মাটির ব্যবহার শিখে তা থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য বানিয়েছে। তারপর লোহাকে কাজে লাগিয়ে সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছেছে। মানুষের শারীরিক গঠন যদি অন্যরকম হতো কিংবা গুরু মস্তিস্কের গঠন অন্য প্রাণীদের তুলনায় অন্যরকম হলে, তবে মানুষ এতো উদ্ভাবন করতে পারতো না। তাইতো মানুষ বন গুহা থেকে বেরিয়ে শহর নগর পথঘাট, আধুনিক সভ্যতা নির্মাণ করেছে। এই নির্মাণ মানুষের স্বরচিত নির্মাণ। তবে এর দ্বারা যেমন সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি আবার হত্যাকাণ্ডও সংঘটিত হয়েছে। 
  মানুষের এই উন্নতি কেবল তার হাতের গুণে কিংবা দৈহিক শক্তির দ্বারা হয়নি। এরজন্য তার মগজকেও কাজে লাগাতে হয়েছে। আর এই মগজের অবস্থান মাথায়। দেহের সমস্ত অঙ্গের মধ্যে মাথার উপর অনেকের অগাধ আস্থা। অনান্য প্রাণীদের বুদ্ধি থাকলেও, কেবলমাত্র মানুষের বিদ্যা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। আবার এই অর্জিত বিদ্যা নিয়ে অন্য প্রাণী অহংকারও করে না। তাই মাঝে মাঝে নিজের বুদ্ধির খালি কলসির আওয়াজ নিজের শুনতে ভালো লাগে। এবং বুদ্ধির নেশায় নিজেরা বিভোর হয়ে থাকে।
আবার অনেকে এই মাথাকে বাজারের পণ্য করে তুলতে চান না। যদিও এই পৃথিবী একটা বাজার। আর বুদ্ধিজীবী ও তাঁর বুদ্ধি ধনতান্ত্রিক বাজারের পণ্য। যদি বাজারদরের কথা ওঠে সমাজের বিভিন্ন কাজের মাষ্টাররা তাদের বুদ্ধির দাম সমান বলে দাবি করবে।আরও মজার কথা হলো এই, কার মাথা কতখানি উর্বর সেটি আবার বেলফলের মতো ফাটিয়ে দেখার উপায় নেই। তাহলে মাথার দর কিভাবে নির্ধারণ হবে? একমাত্র উপায় তাঁর প্রোডাক্ট দেখে।যেমন জমি উর্বর না পতিত তার ফসলের গুণ ও পরিমাণের উপর নির্ভর করে। কিন্তু এখানে আবার প্রশ্ন, কে কার মাথার মূল্যায়ন করবে? কে যাচাই করবে কার প্রোডাক্ট। আবার যখন এক মাথা অন্য মাথার বিচার করবে,তখন মাথায় ঠোকাঠুকি লাগবে।একই পণ্যের দুই ব্যবসায়ী যেমন নিজের পণ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করতে ব্যস্ত থাকেন, মস্তিষ্কের ক্ষেত্রেও তেমনি প্রতিযোগিতা, সেই হীন আত্ম- শ্রেষ্ঠতা প্রকাশের ব্যস্ততা সর্বক্ষেত্রে প্রকট হয়ে ওঠে। মাথা থাকা সত্ত্বেও মাথা নিয়ে যাঁদের মাথাব্যথা নেই, সেই সব সাধারণ লোক মস্তিষ্ক-প্রধানদের অন্তরের দৈন্য দশা দেখে শিউরে উঠবেন। নানা আকারের অগুনতি গোলাকার মাথার চকমকি ঘর্ষণে যে খুব অগ্ন্যুউদগীরণ হবে, তাতে দেখা যাবে শেষ পর্যন্ত সকলের বিদ্যাবুদ্ধিই ভষ্মিভূত হয়ে গেছে। অর্থের মূলধন সমাজে কত অনর্থ ঘটাতে পারে, তা নিয়ে ঊনিশ শতকের  মধ্যভাগে কার্ল মার্কস যুগান্তকারী গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু বিদ্যা বুদ্ধি মূলধনও যে সমাজের কত অকল্যাণ, কত অনিষ্ট করেছে এবং করছে তা নিয়ে আজ রীতিমতো চিন্তা করার সময় এসেছে। বর্তমানে সমাজের চিন্তামনিরা তা নিয়ে অবশ্য চিন্তা করছেন, কিন্তু সমস্যা এত বেশি যে চিন্তার কোন কিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁরা। একালের ধাবমান সমাজের দিকে কে মগজসর্বস্ব এলিট শ্রেণী বা বুদ্ধিজীবী সম্বন্ধে কোনরকম উজ্জল ভবিষ্যৎ বাণী করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।বিদ্যাবুদ্ধির কোনো  বিশেষ স্বীকৃতি ও সম্মান ভবিষ্যৎ সমাজে আদৌ পাওয়া যাবে কিনা, সে বিষয়েও অনেকের মনে সন্দেহ জাগছে। যত দিন যাচ্ছে এবং বুর্জোয়া সমাজের গণতান্ত্রিক বেগ যত বাড়ছে, এই সন্দেহের কালো ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে তাদের মনে।

বুদ্ধিজীবীদের বর্তমান যা কার্যকলাপ ভবিষ্যতের জনসমাজে এঁরা আর স্বীকৃত হবেন না। তাদের সমস্ত কীর্তি, ভেলকির মতো অত্যাশ্চর্য ব্যাপার হলেও দৈনিক সংবাদপত্রের চমকপ্রদ সংবাদের মতই গৃহীত হবে এবং স্থায়িত্ব কিছুক্ষণের জন্য মাত্র। বুদ্ধিজীবীরা সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় সকালে জ্বলজ্বল করে উঠবে আবার বিকেলে বিস্মরণের অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাবে। বহু ছোট বড় মাঝারি সকল মাথা থাকবে কিন্তু তাদের কোন গুরুত্ব আরোপ করা হবে না। খ্যাতির বাতি জ্বলে উঠতে উঠতে ফুৎকারে দপ করে নিভে যাবে।
  চলচ্চিত্র রাজনীতি খেলাধুলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যেখানে জনতার কাছে প্রত্যক্ষ চমকপ্রদ কৃতিত্ব প্রদর্শনের সুযোগ আছে, সেখানে কৃতী ব্যক্তিরা উত্তেজনা সঞ্চার করতে পারেন অনেক বেশি। আজকের সমাজে তাই অভিনেতা খেলোয়াড় ও রাজনৈতিক নেতাদের আবেদন হাজারগুণ বেশি জনসমাজে, বুদ্ধিজীবীদের তুলনায়। কারণ বিদ্বানদের সঙ্গে জনসমাজের যোগাযোগ প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। এই পরোক্ষতার খেসারত দিতে হবে তাঁদের, হয় পর্দার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গিয়ে, অথবা ঠিক  খেলোয়াড় অভিনেতাদের মতো ক্রমাগত তাৎক্ষণিক উত্তেজনার খোরাক জুগিয়ে। অর্থাৎ বিদ্যাবুদ্ধির ক্ষেত্রেও খেলোয়াড় হতে হবে। একবার খেলা দেখালেই হবে না, ক্রমাগত উত্তেজনা সৃষ্টি করতে হলে ক্রমাগত খেলা দেখাতে হবে, নিত্যনতুন খেলা। আর বিদ্যাবুদ্ধির ক্ষেত্রে প্রত্যেকদিন নিত্য নতুন খেলা দেখানো যে কত কষ্ট বিদ্যাজীবী মাত্রই তা জানেন। আধুনিক সমাজে গণশিক্ষার হার যত বেশি হবে, তত বিদ্যা- ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতা তীব্র হবে, তত তাঁদের নতুন নতুন বিদ্যাবুদ্ধির খেলা দেখাতে হবে। তা নাহলে তথাকথিত  অবাধ প্রতিযোগিতার বাজারে তাঁদের উচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী।

মোদ্দাকথা, যেদিক থেকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিচার করা যাক না কেন, বিদ্যা বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক ভূমিকা, তাঁদের কীর্তিকর্মের মূল্যায়নের মানদণ্ড, খ্যাতি  মর্যাদা ইত্যাদি সব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। একদিকে মানুষেরই বুদ্ধিজাত যন্ত্র, অন্যদিকে তারই আকাঙ্ক্ষিত বুর্জোয়া বারোয়ারি গণতন্ত্র, এই দুই বস্তু আজ বুদ্ধিজীবীদের স্বাতন্ত্র্য আত্মম্ভরিতা গোষ্ঠী সংকীর্ণতা বিদ্যাগৌরব, এমনকি সুকীর্তি পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করতে সমুদ্যত। যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সমাজের আদর্শের রুপায়ণে বুদ্ধিজীবীরা অন্তত দুই শতাব্দী ধরে তাঁদের বিদ্যাবুদ্ধি প্রতিভা নিয়োগ করেছেন, সেই সমাজ আজ তাঁদের বিশাল বুদ্ধিহীন যন্ত্রের নাটবল্টুতে পরিণত করেছে। আজ সাধারণ নাগরিক এমন সব কথা বুদ্ধিজীবীদের সম্বন্ধে বলেন যাতে হতাশ হতে হয়। বহুযুগের এমন উন্নত মাথার শোচনীয় পরাজয় দেখে,অনেক উন্নত মাথা লজ্জায় অবনত। কিন্তু তা হয়ে লাভ নেই, কারণ সমাজের নিশ্চিত গতি মস্তিষ্কের ডিভ্যালুয়েশনের দিকে। বর্তমান সমাজে দামী বল্টু হিসাবে আমলাদের এবং আমলাতান্ত্রিকতার দাম বাড়বে,কিন্তু সামাজিক দাম কমবে। অবশ্য দর্শন বলে মস্তিষ্কের বাজারের এই উঠা পড়া কোনো দাম নেই। কারণ কোনো মাথাই যখন চিরস্থায়ী নয়, তখন সেই মাথা নিয়ে এত মাথা ঘামানো কেন?তাছাড়া মৃত্যুর পর সব মাথার খুলির পরিণতি এক,তা আমাদের স্মরণে থাকে না বলে বেঁচে থাকতে থাকতে আমাদের মস্তিষ্কচেতনা এতো প্রখর। কিছু বুদ্ধিজীবীদের বর্তমান যা কার্যকলাপ ভবিষ্যতের সমাজে তাঁদের কার্যকলাপ স্তিমিত হয়ে আসবে। শৃগাল-রাজত্বকালে প্রতিভা'র যে সংজ্ঞা তাও অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যাত হবে। তার কারণ, একটি যান্ত্রিক বা টেকনোলজি, আর একটি সামাজিক। যন্ত্র ক্রমে এগিয়ে আসছে মন্থরগতিতে নয় বরং দ্রুতগতিতে। মানবমনের যা কিছু ধর্ম ও কর্ম, যা নিয়ে এতো দর্প, তা সমস্ত কিছু আজ যন্ত্র অধিকার করতে উদ্যত। যে বুদ্ধি দিয়ে মানুষ যন্ত্র গড়েছে, সেই বুদ্ধি বিনাশের পথ আজ প্রস্তুত করছে যন্ত্র।(ক্রমশ)

পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments