Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা
পর্ব-১৬/ তৃতীয় অধ্যায়
রূপতত্ত্ব(Morphology)
সর্বনাম
১০.৬.নির্দেশক সর্বনাম
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় সর্ব ধর্ম সমন্বয়ে যে ভাষা ব্যবহার হয়, তাতে বেশকিছু নির্দেশক সর্বনাম পদের ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। এই নির্দেশক সর্বনাম মান্য চলিত বাংলা ভাষার মতো এখানেও দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন—
১০.৬.১ দূরত্ববাচক / পরোক্ষ নির্দেশক-
একবচন বহুবচন
ও,ওকে, অটা, ওনে,ওগুলা, ওগুয়া,ওরমনে
অই,ওঠি, ওখানে
সৌঠি,ওধারে,
লক্ষনীয় যে এই দূরত্ববাচক নির্দেশক সর্বনাম গুলির সাথে বদ্ধরূপিম বা বিভক্তি বাচক বিকিরণ যুক্ত হয়ে কারকের বিভিন্ন শ্রেণীর অন্বিত সর্বনাম পদ গঠিত হয়। যেমন—
মুক্তরূপিম + বদ্ধরূপিম = পদ
ও + কে = ওকে
অটা + কে = অটাকে
ও + র = ওর
ওগুয়া,ওগুলা +কে /র = ওগুয়ার, ওগুলাকে
ওন + এ =ওনে, ওর মনে
ওঠি +কে=ওঠিকে
সৌঠি + কে =সৌঠিকে
ওইধার +রে =ঔইধারে
বাক্যে প্রয়োগ
i.ওনে গাঙধারে বুসথালা। (ওরা সমুদ্র পাড়ে বসেছিল।)
ii.মাজু গাঙে একসাথে ওগুলা কি দেখিঠি?(মাঝ সমুদ্রে একসাথে ওগুলো কি দেখছি?)
iii.সৌঠিটা লোকগুয়া বুসিয়া আছে। (সেখানে লোকগুলো বসে আছে।)
১০.৬.২. সামীপ্যবাচক/প্রত্যক্ষ নির্দেশক সর্বনাম
একবচন বহুবচন
এঠি, এটা, একে এইগুলা, এগুয়া, এনকে,
এই, এ,অউঠি এর, অতগুয়াএরমনে, এনে
দূরত্ববাচক নির্দেশক সর্বনামের মত সামীপ্যবাচক সর্বনামগুলির সাথে বদ্ধরূপিম বা বিভক্তিবাচক বিকিরণ যুক্ত হয়েকারকের বিভিন্ন শ্রেণীর সঙ্গে অন্বিত সর্বনাম পদ গঠন করে। যেমন—
মুক্তরূপিম + বদ্ধরূপিম =পদ
এঠি + কে = এঠিকে
এন + কের =এনকের
এর + রা =এরা
অউঠি +কে =অউঠিকে
এগুলা +কে =এগুলাকে
এগুয়া +র =এগুয়ার
বাক্যে প্রয়োগ-
i.এনে কি আইজ মাচ ধত্তে যাবে নি?(এরা কি আজ মাছ ধরতে যাবে না?)
ii.এঠি অক্ষুনি মাছের ডাক হবে। (এখানে এক্ষুনি মাছের ডাক হবে।)
iii.অতগুয়া মাছ লিয়া কি করবা? (এতোগুলা মাছ নিয়ে কি করব?)
১০.৭.অনির্দেশক বা অনিশ্চিয় বাচক সর্বনাম
এই জেলায় মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় বেশকিছু অনির্দেশক বাচক সর্বনামের ব্যবহার রয়েছে। যা মান্যচলিত ভাষায় অনুপস্থিত। এখানে যে সব অনির্দেশ শব্দ সচারাচর ব্যবহৃত হয় তা কাউকে বা কোন কিছুকে নির্দিষ্ট করে দেয়না। যেমন- কুনঠি, কুন কুন, কাইকে, কুনটা,কেটা, কেটার্যা, কাউকে, কুমা ইত্যাদির ব্যবহার রয়েছে।
বাক্যে প্রয়োগ-
i. কুনঠি কুনঠি জাল মারবা কও? (কোথায় কোথায় জাল ফেলাবো বলো?)
ii.ঘরে মায়্যালোককে কইবোনি কাই যাইথিলি।(বাড়িতে মেয়ে লোককে (স্ত্রী)বলা যাবে না কোথায় গিয়েছিলাম।)
iii.মুই মাছ চুরি কচ্ছি কেটা কইথলো ক'? (আমি মাছ চুরি করেছি কে বলে ছিল?)
iv. আইজ যে মাছ ধত্তে যাবো তা কুনকুন লোক কইছে ক' আমাকে?(আজ যে মাছ ধরতে যাব তা কে কে বলেছে বল আমাকে?)
v.কুনটা কইথল্যা?(কে বলেছিল)
vi.তুই কুনঠিনু ঘুরিয়া আইলু? (তুই কোথা থেকে ঘুরে এলি?)
vii.আইজ ক'দিন হলা কারুর কারুর নৌকায় মাছ পড়েনি। (আজ ক'দিন হল কারোর কারোর নৌকায় মাছ পড়েনি।)
viii.তুই কুমা যাইথলুরে?(তুই কোথায় গিয়েছিলি?)
ix.তোরজানে যে কাই যাবা বুঝতে পারটি নি। (তোর জন্য যে কোথায় যাবো বুঝতে পারছি না।)
x.কেটার্যা ঘরে লাত মারুটু? (কে ঘরে লাথ মারছিস?)
xi.কুন কুন নৌকারো কাজ হউচি?(কোন কোন নৌকার কাজ হচ্ছে?)
১০.৮. প্রশ্নবাচক সর্বনাম
এই জেলার উপভাষায় মান্যচলিত বাংলা ভাষার মতো নানান প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসাবাচক সর্বনাম ব্যবহার দেখা যায়।যেমন- কুনঠি, কাই, কুনদিন,কতবা, কাউকে, কতগা, কুমা, কবি কেনি ইত্যাদি।
বাক্যে প্রয়োগ
i.কাই যাবি?(কোথায় যাবি?)
ii.নৌকাটা কুমা গেলা?(নৌকাটি কোন দিকে গেল?)
iii.নৌকায় কতগা মাছ পড়ছে?(নৌকায় কতগুলো মাছ পড়েছে?)
iv.নৌকায় কবি মাছ ধত্তে যাইথুলু?(নৌকায় কবে মাছ ধরতে গিয়েছিলি?)
v.তুই কেনি নৌকায় মাছ ধত্তে যাবিনি?(তুই কেন নৌকায় মাছ ধরতে যাবি না?)
vi.কজোন আইজ নৌকায় আইছে?(ক'জন আজ নৌকায় এসেছে?)
vii.আইজ কত্তমাছ উঠবে? ( আজ কত মাছ উঠবে?)
১০.৯. আত্মবাচক সর্বনাম
এই জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় যে যে আত্মবাচক সর্বনাম প্রায়শই ব্যবহার হয় তা হল এ্যকলা, নিজে, নিজেরা, নিজেদের, খোদ, স্বয়ংইত্যাদি। শুধু এই জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় এই সর্বনাম ব্যবহার হয় তা নয়, সমগ্র পূর্বমেদিনীপুর জেলার কথ্যভাষায় এই ধরনের সর্বনাম পদের ব্যবহার দেখা যায়।
বাক্যে প্রয়োগ
i.এ্যকলা নৌকায় যাইথিলি। (একা নৌকায় গিয়েছিলাম।)
ii.নিজেদের কাজ নিজেরা করিলে। (নিজেদের কাজ নিজেরা করে নে।)
iii.তোরমনে নিজে আইসিয়া মাছ ধরি লিয়্যা যা। (তোরা নিজে এসে মাছ ধরে নিয়ে যা।)
iv.তুই খোদ গাঙে যায়্যা দ্যাখ না কদগা মাছ পড়ছে। ( তুই স্বয়ং সমুদ্রে গিয়ে দেখ না কত মাছ পড়ছে।)
v.লোকটা এ্যকলা ঘরে রয়। (লোকটা একা ঘরে থাকে।)
১০.১০. সমষ্টিবাচক সর্বনাম
এই জেলার উপভাষায় বেশকিছু সমষ্টিবাচক সর্বনাম পদের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন-
সবগুয়া, এতোগুয়া, এত্তো, সব, সব্বাই, সবার, সক্কলে ইত্যাদি।
বাক্যে প্রয়োগ
i.আমানে সব্বাই নৌকায় যাবা। (আমরা সবাই নৌকায় যাব।)
ii.সবগুয়া নৌকা এ্যক সাথে আইসেঠে। (সবগুলো নৌকা একসাথে আসছে।)
iii.তুই এত্তোগুয়া মাছ লিবি?(তুই এতোগুলা মাছ নিবি?)
iv.পাড়ার সব মায়ালোক মাছ কুড়াইতে যায়। (পাড়ার সব বৌরা মাছ কুড়াতে যায়।)
v. অতোলোক এ্যক সাথে কাইযাটে রে?(এতলোক একসাথে কোথায় যাচ্ছে রে?)
১০.১১.স্থান নির্দেশক সর্বনাম
এই জেলার কথ্যভাষায় কিছু স্থান নির্দেশক সর্বনাম ব্যবহারদেখা যায়। যেমন— এঠি, ঔঠি, সেটি,সৌঠি, জেঠি,শেঠি, ঔধারে, সৌধারে।
বাক্যে প্রয়োগ
i.তুই সেঠিটা কি যাথলু? (তুই সেখানে কি গিয়েছিলি?)
ii.ঔঠি তো টকাটা অখুনি আসথলা। (এখানে তো ছেলেটা আসছিল এখুনি আসছিল।)
iii.জেঠিটা নৌকা আছে সৌধারে তুই যাবু। (যেখানে নৌকা আছে সেইধারে তুই যাবি।)
iv.সৌঠি কি লোকটাকে লিয়াবু?(সেখানে কি লোকটাকে নিয়ে যাবি?)
v.যৌঠিটা তারুরে টকাটা ডুবথালা, সৌঠিটা নৌকা আইজ একটা ডুবিছে।(যেখানে তার ঘরের ছেলেটা ডুবে গিয়েছিল, সেখানে একটা নৌকা আজ ডুবে গেছে।)
১০.১২. সময় বাচক নির্দেশক সর্বনাম
এই জেলার কথ্যভাষায় যে সময় বাচক নির্দেশক সর্বনামগুলি ব্যবহার হয় তা হল-
তখুঁই, অখুনি, তখুনি, যখোন, তখোন, যখুনি ইত্যাদি।
বাক্য প্রয়োগ
i.অখুনি তো আইলু ?(এখুনি তো এলি?)
ii.নৌকাটা আসিকি তখুনি ছাড়ি দিলা। (নৌকাটা এলো আর তখনই ছেড়ে দিল।)
iii.তুই যখোনি আইসু মাছ লিয়া যাউ তো? (তুই যখন আসিস মাছ নিয়ে যাস তো?)
iv.নৌকাটা আইলা আর তখুঁই তারুরে বুড়াটা মরি যালা। (নৌকাটা এলো আর তখন তার ঘরের বুড়াটা মরে গেল।)
v.তুই তো অখুনি মিথ্যা কথা কইলু। (তুই তো এখুনি মিথ্যা কথা বললি।)
১০.১৩. অন্যাদিবাচক সর্বনাম
এই জেলার উপভাষায় এই ধরনের সর্বনাম পদের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন- উমুক, তুমুক ইত্যাদি।
১০.১৪. প্রতি নির্দেশক সর্বনাম
এই জেলার কথ্যভাষায় বেশ কিছু প্রতি নির্দেশক সর্বনাম ব্যবহার হয়। যেমন- জখোনি- তখোনি, জে-শে, যানে-তানে, জৌঠিটা-শৌঠিটা, যাই-তাই, যরকুম -সরকুম ইত্যাদি।
বাক্যে প্রয়োগ
i.ঠাকুর যরকুম রাখুছি, সরকুম অছি।(ঠাকুর যেমন রেখেছে, তেমন আছি।)
ii. টকাটা সারাদিন যাই-তাই ঘুরেঠে।(ছেলেটা সারাদিন যেখানে, সেখানে ঘুরছে।)
iii.জৌঠিটা বাগকে ভয়, শৌঠিটা সুন্ধা হয়।(যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়।)
মান্যচলিত বাংলা ভাষার মতো পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় সর্বনামের শ্রেণি বিভাগ করে যে বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। তা চলিত বাংলার থেকে একটু স্বাতন্ত্র্য চোখে পড়ে। পরবর্তী পর্বেও নামপদের বাকি শ্রেণি আলোচিত হবে। এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষা নির্ভর রূপতত্ত্বগত দিক থেকে।
জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
0 Comments