জ্বলদর্চি

গ্রামীণ মেলা আমাদের সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক/রোশেনারা খান

গ্রামীণ মেলা আমাদের সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক
রোশেনারা খান

‘দাদা পায়ে পড়িরে / মেলা থেকে বউ এনে দে’।একসময়য় এই গানটি মাইকে-এ খুব বাজত। মেলায় বউ পাওয়া যায় কিনা জানি না। তবে বিহারের শোনপুরে যে পশুমেলে হয়, সেখানে হাতি-ঘোড়ার সঙ্গে মেয়ে কেনাবেচা হয় বলে শুনেছি। এখানে বিষয় অবশ্য গ্রামীণ মেলা। এখনকার নয়, তা প্রায় অর্ধ শতাব্দী পূর্বে  গ্রামীণ মেলার চেহারা অন্যরকম ছিল। গ্রামের শিল্পী বা কারিগরদের বানানো, গ্রামের মানুষদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এই মেলায় বেচাকেনা হত। আরও আনেক কিছু বেচা কেনা হত। 

    সাধারণত শীতের শুরু থেকে শেষ, এইসময়য়ই গ্রামীণ মেলাগুলি হতে দেখা যেত। তার একটা বিশেষ কারণ হল এইসময় কৃষকের ঘরে ফসল উঠত বলে হাতে পয়সা থাকত। বছরের অন্যান্য সময়ের মেলা বলতে বর্ষায় রথের মেলা, শরতে দুর্গাপুজোর মেলা হত, এখনও হয়। এছাড়াও আদিবাসীদের লৌকিক দেবদেবীর পুজো উপলক্ষ্যে বিভিন্ন মেলা হয়ে  থাকে। মুসলিমদের ইদ, ইদুজ্জোহা, মহরম ইত্যাদি ধর্মীয় উৎসবগুলি ইসলামিক মাসের, মানে হিজরি আব্দের মাসের তারিখ অনুযায়ী হয়ে থাকে। চাঁদের প্রথমা থেকে অমাবস্যা এই সময়ের হিসেবে হিজরি অব্দের মাসগুলির হয়। তাই মাসগুলি ৩০ দিনের হয় না। হিজরি অব্দও ৩৬৫ দিনের থেকে কম সময়ের। এই কারণে উৎসবগুলিও প্রত্যেক বছর এগিয়ে আসে।ফলে এক এক করে সব ঋতুগুলিতেই ইদ হয় মহরম হয়, মহরমের মেলাও হয়। তবে পিরের উরুস উপলক্ষ্যে বাংলা মাসের নির্দিষ্ট তারিখেই মেলা হয়ে থাকে। যেমন মেদিনীপুর শহরে হজরত মউলা পাকের মেলা হয় ফাল্গুন মাসের ৪ তারিখে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হিজলিতে যে ‘মসনদ-ই-আলা’র দরগা রয়েছে, ওখানে উৎসব বা মেলা হয় চৈত্র মাসের প্রথম শনিবার।

  সব মেলাই কোন না কোন সম্প্রদায়ের, কোন না কোন ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করেই হয়ে থাকে। তবে মেলা মানেই হচ্ছে ‘মিলন’। মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন, ভাবের ও সংস্কৃতির মিলন ও আদান প্রাদান। মেলাতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই স্বাগত। সব থেকে বেশি গ্রামীণ মেলা হয়ে থাকে পৌষ সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে। এই মেলা কোথাও একদিনের হয়, কোথাও চার দিনের, কোথাও বা আরও  বেশী দিনের হয়। এই সমস্ত মেলা ঘিরে গ্রামের মানুষের উদ্দীপনার শেষ ছিল না। মেলা ছিল ছোটদের কাছে এক অনাবিল আনন্দের উৎস, আর বড়দের কাছে প্রয়োজনের পরিপূরক। ছোটরা একটা মেলা শেষ হলেই আর একটা মেলার জন্য পয়সা জমাতে শুরু করত। কত কি কেনার পরিকল্পনা চলত। কেউ টোটার রিল লাগানো বন্দুক কিনবে, কারো চাই দম দেওয়া মোটরগাড়ি,কেউ আবার একটা তালপাতার বাঁশি কিনতে পারলেই খুশি হবে। তাছাড়া  পাঁপড়ভাজা, কাঠিগজা, জলিপি, কদমা, এসব কিনে খেতেও তো পয়সা লাগবে। তার ওপর ম্যাজিক, পুতুলনাচ হবে, নাগরদোলা আসবে। মেয়েদের অন্য জিনিসে মন, তাদের চাই প্লাস্টিকের পুতুল, কারো মাটির পুতুল হলেও চলবে। আর চাই চুলের রঙ্গিন ফিতে, রংবাহারি চুড়ি, আলতা, কুমকুম, চুলের প্রজাপতি ক্লিপ, আরও কত কি। এসব জিনিস তখন নাগালের বাইরে, দূর শহরে মিলত। গ্রামে শুধু মেলাতেই পাওয়া  যেত।

    মেলায় কৃষিকাজ ও ঘর-গেরস্থালির জন্য নানা রকম জিনিসপত্র আসত। কুমোরা মাটির হাঁড়ি, কলসি, কুঁজো, ঘট, সরা, মালসার সঙ্গে মাটির পুতুল, হাতি ঘোড়া ইত্যাদির পসরা সাজিয়ে বসত। কামাররা নিয়ে আসত দা, কাটারি, হাঁসুয়া, ছেনি, বাটালি, কাস্তে, কুড়ুল, বঁটি, চাটু, খুন্তি, হাতা ইত্যাদি। মেলায় আসত ঝুড়ি, কুলো, চালুনি, ধুচুনি, আরও অনেককিছু। এরা মেলার জন্যই এসব জিনিস বানাত । যে সব এলাকায় অনেকদূরে হাট-বাজার,সেখানে মেলায় কপি, আলু ইত্যাদি সবজিও বিক্রি হত। আর বিক্রি হত শাঁকআলু।বড় বড় গৃহস্থঘরের লোকেরা বস্তা ভরে শাঁকআলু কিনত। এইজন্য বড় বড় মেলায় গরুরগাড়িতে করে মানুষজন মেলা দেখতে আসত।মেলার কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত গরুগাড়ির  ছই বানানো। গরুকে ভাল করে স্নান করিয়ে তাদের শিং-এ তেল মাখিয়ে দেওয়া হত।মেলার আগের রাতে উত্তেজনায় বাচ্চারা ঘুমাত না। তাদের সাথে বড়রা একজন যেতেন। তিনি ঘরের প্রয়জোনীয় জিনিস তো কিনতেনই, সেইসঙ্গে  শাঁকআলু, মুড়কি, গুড় ও চিনির সুটি বা কাঠিগজা, তিলের খাজা,গুড়ের লবাত(বাতাসা), গজা জিলিপি,সন্দেস ইতাদি অনেক পরিমাণে কিনতেন। কেশপুর অঞ্চলের হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকলেই কুঁয়াইয়ের মেলা থেকে এইসমস্ত মণ্ডামিঠাই শুধু যে নিজেরা খাবার জন্য কেনেন,তা নয়, আত্মীয় স্বজনদের ঘরে,মেয়ের শ্বশুরঘরে দিয়ে পাঠানো হয়। এটা এ অঞ্চলের রীতি বলা যায়।জামাইকে মেলা দেখার জন্য শ্বশুরমশাই টাকা দিতেন। এখনও হয়ত দেন।

    মেলায় রসগোল্লা, পানতুয়া, লেডিকেনি, বোঁদে  আর মস্ত বড় বড় কদমা বিক্রি হত। মেলার দোকানের পাটাতনে বড় থেকে ছোট কদমা সাজানো থাকত। মেলায় কেউ বেলুন, কেউ বাঁশি, কেউ ছোলা-মটর  ভাজা বিক্রি করত। কোন কোন মেলায় সাঁওতালি নাচ, তরজা, বাউলগান,কবিগান, যাত্রাপালা হত। তখন গ্রামের মানুষের কাছে এগুলোই ছিল বিনোদনের বিষয়। মহরমের মেলায় যেমন লাঠি, মশাল, তরবারি নিয়ে মানুষ নানারকম কসরত দেখায়, তেমন চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজনের মেলায় শিবের ভোক্তারা আগুন ঝাঁপ, পিঠফোঁড়া ইত্যাদি ভয়ঙ্কর সব খেলা দেখায়।

  গ্রামের কামার, কুমোর, হাড়ি, ডোম নিম্নবর্ণের দরিদ্র মানুষেরা বছরের এই দিনগুলোর জন্য অপেক্ষা করে থাকে তাদের হাতে তৈরি জিনিসপত্র বিক্রির আশায়। বড় থেকে ছোট, সবাই পায়ে হেঁটে দূর দূর গ্রামে মেলা দেখতে যেত। তখন শহর ও গ্রাম এভাবে মিশে যায়নি, তাই শহর ও গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রায় বেশ পার্থক্য ছিল। আজকের মত এত ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলনা। গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রায় এত বাহুল্য ছিলনা। অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব খারাপ ছিল।অবস্থাপন্নদের  বাড়িতে ২/১ খানা সাইকেল থাকত।মহিলারা এখান ওখান যাতায়াত করতেন বা মেলা দেখতে যেতেন গরুরগাড়ি চড়ে।সাধারণ মানুষ পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করত।রেডিও থাকত ২/১ জনের বাড়িতে। সৌখিন বড়লোকের বাড়িতে থাকত কলেরগান।

    তারপর কবে থেকে যেন শহুরে আগ্রাসন ধীরে ধীরে গ্রামকে গিলে খেতে লাগল। চাষ-আবাদের উন্নতির ফলে এবং কাজের মজুরি বাড়ায় গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমে ভাল হতে লাগল।রাস্তাঘাট তৈরি হওয়ার ফলে শহরের সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগের সুবিধা হল। তারপর বাড়ি বাড়ি সাইকেল, রেডিও হল। টেপরেকর্ডারে গান শুনতে শুনতে কৃষক ধান কাটছে, এমন দৃশ্যও দেখা গেল।তারপর এল বিদ্যুত। সে নিয়ে এল টিভি,ফ্রিজ আরও অনেককিছু। এলো নানা সুবিধা যুক্ত মুঠোফোন। মন্ত্রী থেকে মজুর, সারা বিশ্ব এখন সবার মুঠোই বন্দি। এভাবেই ক্রমশ মুছে যেতে লাগল শহর ও গ্রামের ব্যবধান।
      এখন আর তেমন ছেলে-মেয়েদের মেলা দেখায় উৎসাহ দেখা যায় না। মেলার চরিত্রও ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ আর আগের মত মাটির হাঁড়ি-কলসি, বাঁশের ঝুড়ি, লোহার চাটু, হাতা, কড়াই ব্যবহার করে না। বাচ্চা মেয়েরাও কেউ মাটির পুতুল নিয়ে খেলেনা। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত পটশিল্পী গৌরী চিত্রকর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে মেলায় মেলায় মাটির পুতুল বিক্রি করতাম। প্লাস্টিকের পুতুল আমদানি হতে আমাদের মাটির  পুতুল আর কেউ কিনত না। টিভি এসে যাওয়ার পর পটের গানও কেউ শুনত না। তখন বাধ্য হয় পটুয়ারা পেশা বদল করতে।

  গ্রাম-গঞ্জের মেলা,হাট ক্রমশ কারখানায় তৈরি প্লাস্টিক, কৃত্রিম আঁশের, মানে ফাইবারের ও স্টিলের খেলনা পুতুল থেকে শুরু করে সাংসারিক জিনিসপত্রে ছেয়ে যেতে লাগল। বইদ্যুতিন মাধ্যমে ঘরে বসেই বাচ্চারা অনেক কিছু জেনে যাচ্ছে, বাড়ছে তাদের ইলেকট্রনিক্স  খেলনার চাহিদা। মেয়েদের পছন্দ এখন ‘বারবিডল’। গ্রামের নিম্নবর্ণের দরিদ্র মানুষেরা প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে যে সমস্ত জিনিস বানাত, সেসবের চাহীদা কমে যাওয়ায় সংসার প্রতিপালনের জন্য তারাও পেশা বদল  করতে বাধ্য হয়। কেউ কেউ ভালবেসে পুরনো পেশাকেই গৌরী চিত্রকরের মত আঁকড়ে ধরে নিজে বেঁচে থাকছে, আমাদের ঐতিহ্যকেও বাঁচিয়ে রাখছে।একসময় শোনা যেত, ‘নিলামবালা ছ’আনা/ যা লিবে তাই ছ’আনা’। এখন মেলার বড় বড় দোকানে মন ভোলানো, চোখ ধাঁধানো নানারকম জিনিস হরেক মাল ২০ টাকা, ৩০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।

    সরকারি উদ্যোগে এখন ছোট বড় সব শহরেই শিল্পমেলা, তাঁতমেলা, সবলামেলা হয়। এসব মেলায় অনেকে হাতে কলমে কাজ শিখে বাঁশ, পাট, ফেলে দেওয়া নানারকম তুচ্ছ জিনিস দিয়ে ঘর সাজাবার সৌখিন জিনিস তৈরি করে  বিক্রি করে। কেন্দুলি ও শান্তিনিকেতনের মেলা বহু পুরনো।এখানে মূলত শহুরে বাবু বিবিরা ভিড় জমান। গ্রামীণ মেলায় সেই চির পরিচিত সোঁদা মাটির গন্ধ আর পাওয়া যায় না।তবে এই বিশ্বের সমস্ত কিছুই পরিবর্তনশীল, কালের অনিবার্য নিয়ম মেনে মানুষে রুচি বদলেছে, বদলেছে মেলার চরিত্র। একেই বলে সভ্যতার বিবর্তন।এটা মেনে নিতেই হবে। নইলে পিছিয়ে পড়তে হবে।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
                              
                           

Post a Comment

0 Comments