জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান - ২২/ অনিন্দ্যসুন্দর পাল

ধারাবাহিক-প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)

অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য


"দ্বাবিংশ পর্ব- "সাহিত্য ১১"

সংস্কৃত সাহিত্যের দীর্ঘ আলোচনার পর যে ভাষা নিয়ে এইবার আলোচনা করব, সেটা হলো পালি। এই পালি ভাষায় নাটক বা উপন্যাস কিংবা জ্যোতিষ, গণিত, রাষ্ট্রনীতি ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের
কোনো বই বা গ্রন্থ তেমন কোনো পরিচয় পাওয়া যায় নি, তাই বলাই বাহুল্য সংস্কৃত সাহিত্যের নিরিখে এর পরিসর খুবই ক্ষুদ্র, এতদপরেও এই ভাষার অপরিহার্যতা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে বৌদ্ধধর্মপুস্তকের সম্পূর্ণটাই পালি সাহিত্যে আবদ্ধ হওয়ার জন্যই। বলা হয় বুদ্ধদেবের সমগ্র ধর্মমত যে কথ্যভাষায় প্রচারিত হয়, সেই উপদেশবলী নাকি সৌরসেনী, মাগধীর মতো প্রভৃতি কয়েকটি কথ্যভাষার যে একটি সাহিত্য সংস্করণ তাতেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল, তাই নাকি পালি নামে খ্যাত। কিন্তু ভিক্ষু শীলভদ্র প্রণীত থেরীগাথায় উল্লেখ আছে বুদ্ধদেবের আদেশানুসারে প্রাচীন বৌদ্ধ-সাহিত্য নানাবিধ ভাষায় প্রচারিত হয়েছিল। তিব্বতীয় ঐতিহাসিকগণ লিখেছিলেন, ত্রিপিটক প্রধানতঃ সংস্কৃত, প্রাকৃত, অপভ্রংশ ও পৈশাচী এই চারভাষায় লিপিবদ্ধ হয়। পালি বা মাগধী তাঁরা উল্লেখ করে নি। পালিভাষাকে খুব সম্ভবত তাঁরা প্রাকৃত ও পৈশাচীর অন্তর্গত ধরতেন। মগধ, কলিঙ্গ, অবন্তী প্রভৃতি দেশে পালিভাষার ত্রিপিটকই প্রচলিত ছিল। আর এই দেশগুলোর কোনো একস্থানে ত্রিপিটক লিপিবদ্ধ হয়েছিল। থেরীগাথা এই পুস্তকেরই অন্তর্ভুক্ত। যার টীকার নাম "পরমত্থুদীপনী"। পঞ্চম শতাব্দীতে দাক্ষিণাত্যের কাঞ্চীপুরাধিবাসী ভিক্ষু ধর্মপাল ইহা রচনা করেছিলেন। সংস্কৃত ত্রিপিটক সমগ্র উত্তর ভারতে, বিশেষ করে মথুরা, গান্ধার, কাশ্মীর প্রভৃতি স্থানে প্রচলিত হয়েছিল, পরে তা ক্রমে ক্রমে মধ্য এশিয়া, চীন, এবং তৎসন্নিহিত বহুদেশে প্রচারিত হতে আরম্ভ করে এবং সেই সেই রাজ্যের বা দেশের ভাষায় অনূদিত হয়ে পাঠনের যোগ্যতা অর্জন করে। তবে সংস্কৃত ভাষায় থেরীগাথা এখনো পাওয়া যায় নি।

বৌদ্ধধর্মপুস্তকের মূল ত্রিপিটক। পিটক শব্দের অর্থ "ঝুড়ি"। উল্লেখ্য তিন পিটক- ১. বিনয় ২. সূত্ত এবং ৩. অভিধম্ম। বিনয় পিটকে বৌদ্ধভিক্ষু ও ভিক্ষুনীদের পালনীয় নিয়মসমূহ, সূত্ত পিটকে বুদ্ধের ধর্মমত ও অভিধম্মতে ধর্মমতের দার্শনিক ব্যাখ্যা রয়েছে। বিনয় পিটক হলো ত্রিপিটকের প্রথম অঙ্গ। বিনিয়ের অপরনাম নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলা। বিনয় পিটকে পাঁচ ভাগের উল্লেখ থাকলেও এটা প্রধানত তিন প্রকার। যথা, ১. সুত্তবিভঙ্গ (পারাজিকং ও পাচিত্তিযং একত্রে) ২. খন্ধুক (মহাবগ্গ ও চুল্লবগ্গ একত্রে) এবং ৩. পরিবার পাঠো। বিনয় পিটকের মধ্যে ভিক্ষুদের ২২৭টি নিয়মের উল্লেখ আছে। পাতিমোক্ষ হলো এই পিটকের সারগ্রন্থ, যেখানে সংক্ষিপ্তসারে সম্পূর্ণটা লিপিবদ্ধ আছে। যা বৌদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণীরা দৈনন্দিন জীবনে মেনে চলেন। পাতিমোক্ষের ন্যায় বিনিয় পিটকেও গৃহিদের জন্যও পঞ্চশীল ও অষ্টশীল, শ্রামণদের জন্য দশশীল এবং ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের জন্য প্রতিমোক্ষের বর্ণনা আছে।প্রধানতঃ ভিক্ষুসীল আট প্রকার। যথা, ১. পারজিকা ৪টি, ২. সঙ্ঘাদিসেস ১৩টি ৩. অনিয়ত ২টি ৪. নিসগ্গিয় পাচিত্তীয়-৩০টি ৫. পাচিত্তীয় ৩০টি ৬. পাটিদেসনীয় ৪টি, ৭. সেখিয়া ৭৫টি এবং ৮. অধিকরণসমথ ৭টি।

সুত্তপিটক ত্রিপিটকের দ্বিতীয় অঙ্গ। সুত্তের বাংলা প্রতিশব্দ সূত্র হওয়ায় এটিকে বাংলায় সূত্র পিটকও বলা হয়, যা বুদ্ধের প্রবর্তিত ধর্মের আদি বিষয় হিসাবে গণ্য। সাধারণত, সুত্ত পিটক পাঁচ ভাগে বিভক্ত। যথা, ১. দীর্ঘ নিকায় ২. মজ্ঝিম নিকায় ৩. অঙ্গুত্তর নিকায় এবং ৫. খুদ্দক নিকায়। আবার, নিকায়ভুক্ত বিভাগসমূহের নানাবিধ অন্ত বিভাগ রয়েছে। যেমন দীর্ঘ নিকায়ে তিনভাগ। যথা, সীলক্খন্ধ, মহাবগ্গো, পটিক বগ্গো। মজ্ঝিম নিকায়ের তিন ভাগ। যথা- মূল পঞ্ঞাস, মজ্ঝিম পঞ্ঞাস ও উপরি পঞ্ঞাস। সংযুক্ত নিকায় পাঁচটি ভাগ। যথা, সগাথা বগ্গো, নিদান বগ্গো, খন্ধ বগ্গো, সলায়তন বগ্গো ও মহাবগ্গো। অঙ্গুত্তর নিকায় একনিপাত, দুক নিপাত, তিক নিপাত, চতুক্ক নিপাত, পঞ্চক নিপাত, চক্ক নিপাত, সত্তক নিপাত,অট্ঠক নিপাত, নবক নিপাত, দশক নিপাত এবং একাদশ নিপাত ভেদে পঞ্চখন্ডে বিভক্ত। খুদ্দক নিকায়ের পনেরটি গ্রন্থ। যথা- খুদদক পাঠো, ধম্মপদ, উদান, ইতিবুত্তক, সুত্তনিপাত, পেতবখু, বিমানবথু, থেরগাথা, থেরীগাথা, নিদ্দেস, জাতক, পতিসম্ভিদা মগ্গ, অপদান, বুদ্ধবংস, এবং চরিয়া পিটক।
পালি অভিধম্ম বাংলায় অভিধর্ম। অভি উপসর্গটি ধম্ম শব্দের সাথে যুক্ত হয়ে অর্থের ব্যাপকতা বৃদ্ধি হয়েছে, যার অর্থ উচ্চতর ধর্ম বা ধর্মের উচ্চতর সূক্ষ্ম তত্ত্ব। মূলত, প্রাথমিক অবস্থায় বৌদ্ধ ধর্ম সুত্ত ও বিনয় দুইভাগেই বিভক্ত ছিল। পরবর্তীতে সূত্র, বিনয় ও অভিধর্ম এই তিন পর্যায়ে বিভক্ত হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বৌদ্ধ-ধর্মসঙ্গীতে ধর্ম ও বিনয় সম্পর্কে আলোচনা হলেও দুই সঙ্গীতিতেই অভিধর্মের অন্তর্ভুক্তি ঘটে। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে মৌর্য সম্রাট অশোকের সময় অনুষ্ঠিত তৃতীয় সঙ্গীতিতেই সূত্র, বিনয় ও অভিধর্মের সঙ্গায়ন হয়।অভিধর্ম তখন থেকেই পৃথকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে ত্রিপিটক এই উক্ত তিনভাগেই রচিত হয়ে আসছে। বৌদ্ধ ধর্মীয় শাস্ত্রের তৃতীয় ও শেষ অংশ অভিধর্ম। যাতে বর্ণিত আছে বুদ্ধ প্রজ্ঞা সম্পর্কিত শিক্ষা, যার মধ্যে চার প্রকার প্রভেদ জ্ঞানের প্রকাশ আছে, যথা- অর্থ সম্পর্কে জ্ঞান, হেতু সম্পর্কে জ্ঞান, নিরুক্ত সম্পর্কে জ্ঞান, এবং প্রতিভাযুক্ত জ্ঞান। প্রধানত, এই অভিধর্ম পিটক সাত ভাগে বিভক্ত। যথা, ধম্মসঙ্গণি, বিভঙ্গ, ধাতুকথা, পুগ্গল পঞ্ঞত্তি, কথাবথু, যমক, এবং পট্ঠান। এ সাতটি গ্রন্থকে একত্রে সপ্তপ্রকরণ বলা হয়ে থাকে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, পুগ্গল পঞ্ঞত্তি ব্যতীত অভিধর্মপিটকের অপর ছয় খন্ড গ্রন্থে নামরূপ, স্কন্ধ, আয়তন, ধাতু প্রভৃতি বিবিধ আকারে পরমার্থিকভাবে সম্পাদন করা হলেও পুগ্গল পঞ্ঞত্তি ব্যবহারিকভাবেই তথাকথিত পুদ্গল বা ব্যক্তি বিশেষের আকারে বর্ণিত হয়েছে। যথা:- সম্যকসম্বুদ্ধ, প্রত্যেকবুদ্ধ, আর্য-অনার্য, শৈক্ষ্য-অশৈক্ষ্য, লোভ-চরিত, মোহ-চরিত ইত্যাদি পুগ্গল পঞ্ঞত্তি সূত্র পিটকের অন্তর্গত না হলেও সূত্র- পিটকের অনুরূপ। ইহার ভাব-ভাষা প্রাঞ্জল, সাধারণের বোধোপযোগী ও ব্যবহারিক।

ভিনটারনিসের মতে ত্রিপিটক সংগৃহিত হয়ে প্রথম মুখে মুখে একজনের থেকে অন্যজনের কাছে যায়, পরে তা সিংহল রাজা ভট্টগামীনির সময় লিপিবদ্ধ হয়। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মধ্যে যাঁরা জ্ঞানে ও সদগুণে বৃদ্ধ তাঁদের থেরা(বৃদ্ধ) ও থেরী(বৃদ্ধা) নামে খ্যাত। তাঁদের লিখিত লিখিত পুস্তক থেরা-থেরীগাথা নামে খ্যাত। এই সমস্ত পুস্তকে একদিকে যেমন উচ্চভাব বর্তমান, ঠিক তেমন কাব্যরসও বর্তমান।

(ক্রমশ....)

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments