জ্বলদর্চি

দক্ষিণ আফ্রিকা (নাইজিরিয়া)-র লোকগল্প/ চিন্ময় দাশ


দূরদেশের লােকগল্প-- দক্ষিণ আফ্রিকা (নাইজিরিয়া)

চিন্ময় দাশ

শঙ্খচিলের ছোঁ

(আকাশে ডানা মেলে ভেসে বেড়াচ্ছে কোনও চিল। নীচে হয়তাে ঘুরে বেড়াচ্ছে কোন মুরগি-ছানা। চোখে পড়েছে কী, অমনি পলক না ফেলতে, ঝুপ করে নেমে আসবে চিলটা। আর ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাবে বাচ্চাটাকে।

চিল কেন এমনটা করে ? অনেক দূরের দেশ আফ্রিকার নাইজিরিয়া। সে দেশের আদিবাসী মানুষেরা ভারি সুন্দর একটা গল্প বলে, তা নিয়ে। আজ সেই গল্পই শােনাবাে আমরা।)

প্রহরখানিক বেলা হয়েছে সেদিন। সূর্য উঠে গেছে বেশ খানিকটা। ঝকঝকে রােদ। একটা মুরগি ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের বাড়ির সামনের উঠোনাে। দানা খুঁটছে ঘুরে ঘুরে।

আকাশের অনেক উঁচুতে উড়ছে একটা শঙ্খচিল। চিলের ওড়াউড়ি সবাই জানে। অনেক উঁচুতে উঠে গিয়ে, ডানা ঝাপটানাে থামিয়ে দেয়। হেলতে দুলতে ভেসে বেড়ায় আকাশে। তবে, এলােমেলাে ভাবে নয়। সুন্দর গােল করে চক্কর কাটতে থাকে আকাশের গায়ে।

চিলের চাউনি কিন্তু ভারি প্রখর। যত উঁচুতেই উঠুক, নীচের ছােট্ট একটা পােকার নড়াচড়াও দেখতে পায় সে।

সেদিন চক্কর কাটতে কাটতে হঠাৎই নীচে মুরগিটাকে দেখতে পেল চিল। মুরগির ছানা নয়, যে ছোঁ মেরে তুলে নেবে। একটু বড়সড় চেহারা। তুলে আনা যাবে না। হেলেদুলে নিজের উঠোনে ঘুরে বেড়াচ্ছে মুরগিটা। ভারি সুন্দর চেহারা। দেখে বেশ পছন্দ হােল চিলের। হয়েছে কি, সবাই জানে, চিলেরা জোড় বেঁধে থাকে সবসময়। একা একটা চিল দেখাই যায় না প্রায়। কিন্তু এই চিলটার বউ নাই এখনাে। ডানা গুটিয়ে ঝুপ করে নীচে নেমে এল চিল। উঠোনের বেড়ার উপর বসে পড়ল। বসেই একটা শিস দিল সুন্দর করে।

পালাতে গিয়েও থেমে গেল মুরগি। দেখতে তাে ভারি সুন্দর চিলটা। গা-ভর্তি বাদামী- লাল পালক। গলা আর মাথা ধবধবে সাদা পালকে মােড়া। মাথার সাদা পালকের জন্যই শঙ্খচিল বলা হয় এদের। ঝকঝকে চোখ। চকচকে বাঁকানাে ঠোঁট। আহা, শিসটাও কী মিষ্টি!

চিল তাকে বলল-- তােমাকে ভারি পছন্দ হয়েছে আমার। আমার বউ হবে তুমি? লজ্জা বা ভয়-- কিছুই দেখা গেল না। আনন্দে মাথা হেলিয়ে দিল মুরগি।

ঘরে বাবা-মা ছিল মুরগির। তারা শুনে বলল-- বললেই কি আর বিয়ে হয় গাে? দেখতে কত সুন্দর আমাদের মেয়ে। পণ দিতে পারবে তাে সেই মতাে? 

চাহিদা মত, অনেক জোয়ার আর বজরার দানা পণ হিসাবে দিয়ে, মুরগিকে বউ করে নিয়ে চলে গেল চিল। আনন্দ ধরে না দুজনেরই। ক'টা দিন বেশ সুখেই কাটল।
এদিকে হয়েছে কী, একটা মােরগও ছিল মুরগিদের পাড়ায়। একেবারে যুবক বয়স। মাথায় টুকটুকে লাল ঝুঁটি গজাতে শুরু করেছে। মুরগিটাকে সে খুব পছন্দ করত। চিলকে দেখার আগে, মুরগিও পছন্দ করত তাকে। কিন্তু একেবারে আচমকাই চিলের সাথে বিয়ে হয়ে গেল মুরগিটির। কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল!

মন খারাপ হলেও, অনেক দিন মুরগীর জন্য অপেক্ষা করে রইল মােরগ। মুরগি নিশ্চয় ফিরে আসবে একদিন, এই আশায়। তা যখন হােল না, শেষমেষ মরিয়া হয়ে, একদিন চিলের বাসায় গিয়েই হাজির হল মােরগ। কোঁকর-কোঁ করে ডেকে উঠতেই, বেরিয়ে এল মুরগি। মােরগকে দেখে, ভারি আনন্দ হােল তার। এখানে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। সারাদিন ঘরে থাকেই না চিল। একেবারে একলা একলা কাটাতে হয় মুরগিকে। আরও ঝামেলা হােল, বর-বউ দু’জনে পাশাপাশি না থাকতে পারা। মাটিতে পা ফেলে চলাফেরা করবার আদত নাই চিলের। সে প্রায় সময় উড়েই বেড়ায়। এদিকে মুরগি আবার মাটি ছেড়ে তেমন ওড়াউড়ি করেই না। অত উঁচু আকাশে ওড়ার তো কথাই ওঠে না। কী ভুলই যে হয়েছে চিলের সাথে এসে!

এখন চিল নাই বাসায়। রইল পড়ে বাসা। এই মওকায় মােরগের সাথে নিজেদের পাড়ায় পালিয়ে এল মুরগি।

চিল তখন ছিল উপরের আকাশে। নিত্যদিন যেমনটা থাকে। উপরে থাকলেও, চিলের চোখ থাকে নীচে, মাটিতেই। তার চোখকে ফাঁকি দেওয়া সহজ কাজ নয়। ঠিক দেখতে পেয়ে গেল, তার বউ যেন চলে যাচ্ছে কোথায়। সাথে আর একটা মােরগ। কিছু ঠাহর করতে পারল না সে।

ভাবতে ভাবতে নেমে এল চিল। সত্যিই ঘরে কেউ নাই। অগত্যা এবার চলল মুরগির বাড়িতে। কিন্তু সেখানে কারুর টিকির দেখাটিও নাই। চারদিক শুনসান। বুঝতে কিছু বাকি রইল না তার। নিশ্চয়ই পাথরের খােপের ভিতর ঢুকে, ঘাপটি মেরে বসে আছে সবাই।

সূর্য ডুবে যখন আঁধান ঘনিয়ে এল, মনের ভার মনে নিয়ে ঘরে ফিরে গেল বেচারা। কিন্তু হাল ছাড়লে তাে চলবে না। একটা কিছু বিহিত তাে করতেই হবে।

সকাল হতে সােজা গিয়ে হাজির হল ঈগলের ডেরায়। বন-পাহাড়ে যত পাখি আছে, ঈগল হােল তাদের রাজা। তার কাছে নিজের অভিযােগ দায়ের করল চিল-- তুমি হলে আমাদের রাজা। তুমি এই অন্যায়ের বিচার করে দাও।

ঈগলের ডেরার সামনে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। যখন দরকার পড়ে, সেখানে দরবার বসে রাজার। চিলের অভিযােগ পেয়ে, সেদিন আবার দরবার ডাকা হয়েছে। বনের পাখ-পাখালি সবাই হাজির হয়েছে সেখানে। রাজার হুকুম পেয়ে এসেছে পাখিরা। অনেকে আবার মজা দেখবে বলে এসে জুটেছে। বউ পালানাের বিচার বলে কথা। চাট্টিখানি ব্যাপার না কি ? ভরা দরবারে সব কথা খুলে বলল চিল। মুরগি-মেয়ে আর তার নতুন বর কিন্তু আসেনি। তাদের বাবা-মা সবাই এসেছে। 

মুরগির বাবাকে ঈগল জিজ্ঞেস কর-- তােমার কী বলবার আছে, বলাে। 
মােরগ বলল-- আমি কী বলব রাজা ? মেয়ের যদি বর পছন্দ না হয়, আমি তার কী করতে পারি ?
পছন্দ নয় তাে গিয়েছিল কেন ? রাজার গলায় বেশ রাগ।
- তখন কি জানত, সারাদিন ঘরেই থাকবে না হতভাগা? বউয়ের সাথে পাশাপাশি দু'পা হাঁটবে, দুটো ভালাে-মন্দ কথা বলবে, তবেই না বর! চিল কি করেছে বা বলেছে কোনদিন ? মােট কথা চিলের ঘরে যাবে না আমাদের মেয়ে।
থাকতে না পেরে, চিল বলে উঠল- এই বন-পাহাড়ে চিলের স্বভাব-গতিক কে না চেনে? বলতে গেলে, আকাশেই আমাদের ঘরবাড়ি। জেনেশুনেই তাে মেয়েকে পাঠিয়েছিলে তুমি। তখন মনে ছিল না? না কি, কাঁড়ি কাঁড়ি পণের লােভে ভুলে গিয়েছিলে ?

ঈগল বলল-- কাঁড়ি কাঁড়ি পণ, মানে?

চিল বলল-- ঝুড়ি ঝুড়ি জোয়ার আর বাজরা নিয়েছে আমার থেকে, মেয়ের পণ হিসাবে। তার কী হবে?

মােরগ বলল-- সেসব এখন আর কোথায় পাব ? অতগুলাে পেট আমাদের, খেয়ে ফেলেছি তাে ?

পেট সবারই আছে। রাজা গম্ভীর হয়ে বল-- চিলেরও পেট আছে। মেয়ে না পাঠালে, তার পণ ফেরত দিতেই হবে তােমাকে।

মােরগ দেবে কোথা থেকে। সে সমানে মাথা নাড়তে লাগল।

কিন্তু বিচার যখন বসেছে, রায় তাে দিতেই হবে। ঈগল চিলকে বলল-- শােন বাপু, ওইসব জোয়ার-বাজরা মোরগ কোনও দিন দিতে পারবে না। ওদের মুরোদ জানা আছে সকলের। তাই বলছি, আজ থেকে যেদিন যেখানেই তােমার খিদে লাগবে, মুরগির ছানা চোখে পড়লে, তুমি ছোঁ মারতে পারবে। তাতে কোনও দোষ হবে না তােমার। কোন অভিযোগও শোনা হবে কারও। এটাই বিচারের রায়।

সেদিন থেকেই চলে আসছে ব্যাপারটা। আজও মুরগির ছানা চোখে পড়লে, আকাশের যত উঁচুতেই থাকুক, অমনি এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে চিল। তবে, সবসময় খিদের জ্বালাতেই যে ছোঁ মারে, তা কিন্তু নয়। আসল কথা হােল, ঘরের বউ পালিয়ে গিয়েছিল, মনের সেই দুঃখটা আজও ভুলতে পারেনি চিলেরা। মুরগিদের বাচ্চা দেখলেই, কষ্ট আর রাগ চাগাড় দিয়ে ওঠে তাদের মাথায়।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments