জ্বলদর্চি

বাংলা ভাষার অস্তিত্বের সংকট /মহাদেব চক্রবর্তী

বাংলা ভাষার অস্তিত্বের সংকট 

            মহাদেব চক্রবর্তী 

বাংলা ভাষা নিয়ে আলোচনায় প্রথমেই যে প্রশ্নটি সামনে আসে, সেটা বাংলা ভাষার গোড়া পত্তন নিয়ে, এ বিষয়ে নানান গুণিজনের নানা মত বিভিন্ন সময়ে আলোকপাত করা হলেও সুনির্দিষ্টভাবে সহমতে পৌঁছানো গেছে এমন দাবি করা যায় না। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়'চর্যাপদ 'আদি বাংলা!এটা কতটা সত্য এ বিষয়ে মতান্তর নিরসনে সঠিক তথ্য অনুসন্ধান, সংগ্রহ, গবেষণা প্রয়োজন থাকলেও সরকার উদাসীন। বাংলা ভাষা ও বাঙালিদের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ স্বাধীন ভারতের সূচনা থেকে অদ্যাবধি বিদ্যমান। ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িষা,মহারাষ্ট্র, আসাম প্রভৃতি রাজ্যে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ বাংলা ভাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা নেই। অন্যান্য ভাষার জন্য ঢালাও বরাদ্দ। বাংলা ভাষার প্রসার ও উন্নয়নের জন্য কোন অর্থ বরাদ্দ করা হয় না। আসল লক্ষ্য ভারতে বাংলা ভাষাভাসি মানুষের সংখ্যা কমানো। 
বিশ্বের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দায় চারটি বিশালাকার গ্রন্থাগারের লক্ষ লক্ষ গবেষণপত্র, বই বখতিয়ার খিলজি আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয়, একই ঘটনা তক্ষশিলা, বিক্রমশীলা সহ অন্যত্র সংগঠিত হয়।বিভিন্ন এলাকায় লক্ষ লক্ষ পুঁথি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি ক্ষেত্রে মুসলমান শাসনে ভারতে সর্বনাশের বন্যা বহে যায়।ফলে বহু তথ্য প্রমাণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। চর্যাপদের কপি সংগ্রহ করা হয় নেপাল থেকে। পাশাপাশি ঝড়ে বন্যায় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে বহু তথ্য নষ্ট হয়ে যায়। তথাপি যে কোন তথ্যের সন্ধান পাওয়া গেলে রাষ্ট্রের উদ্যোগে সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে দুটি উদাহরণ (এক)গবেষক ও সাহিত্যিক মালীবুড়ো (যুধিষ্ঠির জানা)রচনাবলী প্রথম খণ্ড ৪৫১পাতায় তিনি লিখেছিলেন "আচার্য বোধিধর্ম ছিলেন ভারতীয়। খ্রিস্টীয় ৫২৬ অব্দ এ তিনি তাম্রলিপ্ত বন্দর দিয়ে ক্যান্টন যাত্রা করেছিলেন সমুদ্র পথে।এখানের গ্রন্থাগার থেকে প্রাচীন বঙগাক্ষরে লিখিত দুটি গ্রন্থ 'প্রজ্ঞা পারমিতা হৃদয় পুত্র 'ও 'উষ্ণীষ বিজয় ধারিনী 'নিয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গে করে। এই দুটি মূল্যবান বৌদধ শাস্ত্র আজও রক্ষিত আছে জাপানের ইকরুণ মঠে। প্রাচীন বঙগাক্ষরে ক্রমবিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে হলে এখুনি এই দুটি গ্রন্থের জেরসক কপি ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিতদের কাছে নিশ্চয়ই মহামূল্যবান। এ বিষয়ে বাংলা সাহিত্য একাডেমী যদি এখনি উদ্যোগ নেন তাহলে বাঙালী আমরা একটি মহামূল্যবান রত্ন উদ্ধার করতে সক্ষম হবো। "তাহলে দেখা যাচ্ছে বই দুটি চর্যাপদের থেকে প্রায় চারশো বছরের পূর্বের।" তিনি লিখেছেন "৬৩৫খ্রিস্টাব্দে তাম্রলিপ্ত নগরী সমুদ্রোচছাসে ধুয়ে যায় ।"-----গ্রন্থাগার গুলির মূল্যবান গ্রন্থ রাজি সমুদ্রের জলে ভেসে যায় "।উক্ত গ্রন্থের ৭৩ পাতায় লিখেছেন "আচার্য বোধিধর্ম প্রসঙ্গ বিশ্ব কোশ, ১৭শ ভাগের ৪১১ পৃষ্ঠায় নিম্নরূপ লিপিবদ্ধ আছে। "
(দুই) বাঁকুড়া ঘুরে আঃ বাঃ পত্রিকায় বাসব দত্তা ভৌমিক 'পায়ে পায়ে মল্লভূমে '(১৭|১০|২০২০)নিবন্ধে লিখেছেন "শুশুনিয়া পাহাড়ের উত্তর ঢালে খোদিত আছে চন্দ্র বর্মনের শিলালিপি।----খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে খোদিত এই শিলালিপি বাংলায় প্রাচীনতম শিলালিপি "। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রায় ১৭০০বছর আগেও বাংলা লিপি ছিল। আবার ইউনেস্কো তত্ত্বাবধানে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের সেরা মধুরতম ভাষা হিসেবে প্রথম স্থান দিয়েছে। তথাপি ভারত সরকার বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি এখনও পর্যন্ত দেয়নি । ঐকতান গবেষণা পত্র, কলকাতা, সংবাদ বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে-"অবিলম্বে বাংলা ভাষা কে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি দিতে হবে।---নোবেলের ভাষা, অস্কারের ভাষা, যার চর্চা পৃথিবীর তিরিশটা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়"। রাজ্য সভার সাংসদ বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য প্রধানমন্ত্রী কে চিঠি দিয়ে দাবি করেছেন।লোক সভায় সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরী এই দাবি তুলে ধরেছেন। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পত্রিকায় এই দাবি নিয়ে লিখেছেন সজল কুমার গুহ মহাশয়।
প্রশ্ন হলো কেন ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি প্রয়োজন? এ প্রসঙ্গে পুরুলিয়া থেকে রতন ঘোষ মহাশয় লিখেছেন-'২০২০ সালে ঘোষিত জাতীয় শিক্ষা নীতি! এখানে বলা হয়েছে হিন্দি ইংরাজি ও ধ্রুপদী ভাষা ছাড়া অন্য ভারতীয় ভাষা প্রাথমিক স্তর (বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণী) পযন্ত পড়া আবশ্যিক হলেও নাইনের (নবম)পর আর আবশ্যিক নয়।এর ফলশ্রুতিতে বাংলা ভাষার পঠন পাঠন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লোপ পাবার সম্ভাবনা।বাংলার ক্ষেত্রটি সঙ্কুচিত, সীমিত হতে চলেছে '।
তার নমুনা দেখা গেল ২০২১ সালে মাতৃভাষা উদযাপনের মাসেই আসাম বিধানসভায় রাজ্যের স্বীকৃত বাংলা ভাষায় বাজেট আলোচনা করছিলেন বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ। শাসক দলের বিধায়কগন মৃণাল শয়কিয়ার নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়ে আলোচনা থামিয়ে দেয় এবং বাংলা ভাষা সম্পর্কে অশালীন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য টিকা টিপ্পনি খেউড় করে।সম্প্রতি আসামে রবি ঠাকুরের জন্ম দিনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। উনিশে মে ভাষা শহীদ দিবসের স্থানীয় ছুটি কাটা গেছে। এ ভাবেই ভারত বর্ষে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে ।জানি অতীতের ন্যায় বাঙালী প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবীগন নিজেদের আখের গোছাতে এর বিরুদ্ধে টু-শব্দ টি করবেন না। ছোট পত্রিকাগুলিকে এই বিষয়ে ঝড় তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে ।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

2 Comments

  1. শুশুনিয়ার লিপি -- গুপ্তব্রাম্ভী, ভাষা সংস্কৃত । বাংলা কেন হবে ?

    ReplyDelete
  2. শুশুনিয়ার লিপি গুপ্তব্রাম্ভী, ভাষা সংস্কৃত ।
    বাংলা কেন ?
    শ্যামল বেরা

    ReplyDelete