জ্বলদর্চি

বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক-১৬/অসীম ভুঁইয়া

Bengali grammar and debate
বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক
পর্ব ১৬

অসীম ভুঁইয়া

বাগধারা, বিশিষ্টার্থক শব্দ ও প্রবাদ-প্রবচন

আজ জানাব, বাগধারা, বিশিষ্টার্থক শব্দ ও প্রবাদ-প্রবচন নিয়ে কিছু কথা। 
   বাগধারা বা Idiom বিশ্বের যেকোনো শক্তিশালী ভাষার প্রকাশ রীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাংলা ভাষাও তার ব্যতিক্রম নয়। অর্থাৎ এমন কিছু শব্দ বা শব্দগুচ্ছ বাংলায় রয়েছে যারা আভিধানিক অর্থের অতিরিক্ত বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে থাকে। ভাষারীতির ক্ষেত্রে এই বিচিত্র শব্দ বা শব্দগুচ্ছই  বাগধারা নামে পরিচিত।যেমন: অকালকুষ্মাণ্ড: অকর্মণ্য বোঝাতে, বিড়াল তপস্বী: ভন্ড বোঝাতে, একাই একশ: ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
   
   অর্থাৎ যে শব্দগুচ্ছ আভিধানিক অর্থ ছাড়িয়ে বিশেষ ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ ভাব ও অর্থ প্রকাশ করে, তাকে বাগধারা বলে। উল্লেখ্য, বাগধারা দিয়ে কিছুক্ষেত্রে সূক্ষ্ম অনুভব ও চিন্তারীতির বিশিষ্টতাও ধরা পড়ে। 

  বাগধারার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য: 
১.সাধারণত একাধিক শব্দ বা শব্দগুচ্ছ নিয়ে বাগধারা তৈরি হয়।
 ২.আভিধানিক অর্থ ছাড়িয়ে বিশেষ বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে।
৩. বাগধারার আভিধানিক অর্থ সব সময় স্পষ্ট নয়।
 যেমন: অষ্টরম্ভা বা চাঁদেরহাট: এক্ষেত্রে আভিধানিক অর্থ নেই বললেই চলে।
৪. লোকমুখে প্রচলিত, তবে তুলনামূলক আধুনিককালের।
৫. কথ্য ভাষায় বাগধারার প্রয়োগ সর্বাধিক।

বাগধারার নির্মাণশৈলী:

১. দুটি বিশেষ্য, দুটি বিশেষণ বা একটি বিশেষ্য ও একটি বিশেষণ নিয়ে বাগধারা নির্মিত হতে পারে। যেমন: অকালপক্ব: দুই বিশেষণ। অর্ধচন্দ্র: একটি বিশেষণ ও অন্যটি বিশেষ্য। আকাশকুসুম: দুটিই বিশেষ্য, কিন্তু পুরো অংশটি বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
২. বিশেষ্য বা বিশেষণবাচক শব্দের সঙ্গে ক্রিয়াবাচক শব্দও যুক্ত হতে পারে।
 যেমন: আ৺তে ঘা। আস্তিন গুটানো প্রভৃতি।
৩. শব্দদ্বিত্ব ও প্রায় সমার্থক শব্দও বাগধারা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
 যেমন: কাগজে-কলমে, উত্তম-মধ্যম, কানায় কানায় প্রভৃতি। 
৪. ধাতুর সঙ্গে আনি বা আনো জুড়েও বাগধারা নির্মাণ করা যায়। যেমন: ক্যালানো বা ক্যালানি দেওয়া, নাকানি-চোবানি প্রভৃতি।
 মনে রাখার বিষয়,
১. বর্তমানে বেশ কিছু বাগধারার চল আর নেই। তবে কিছু কিছু বাগধারা আবার গভীরভাবেই প্রচলিত।
২.লিখিত ভাষায় বাগধারার ব্যবহার তুলনামূলক অল্প। 
৩.সাধারণত গ্রাম্য বা আঞ্চলিক ক্ষেত্রেই এর রমরমা বাজার।
৪.ভাষাকে তীক্ষ্ণ , ইঙ্গিতময় তথা বিশেষভাবে অর্থবহ করে তোলে বাগধারা।
 ৫. ভাষাকে সৌন্দর্যমন্ডিত তথা বৈচিত্র্য দান করে।

 বাগধারা ও তার প্রয়োগ:
 
অকালপক্ব/ ইঁচড়ে পাকা: (অল্প বয়সে বড়দের মতো আচরণ) এইটুকু ছেলের এমন ইঁচড়ে পাকা কথা শুনতে বিরক্তই লাগে।
 
অষ্টরম্ভা (ফাঁকি):
 কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা
 মুখে যেন হরেকরকমবা।
  
অমাবস্যার চাঁদ/ ডুমুরের ফুল(অদৃশ্য): 
কোথায় যে গেলে! মানে না চোখের বাঁধ
 এত কাছে থেকেও যেন অমাবস্যার চাঁদ।
 এভাবে, অকালবোধন( অসময়ে শুরু হওয়া কাজ), অরণ্যে রোদন (নিষ্ফল অনুরোধ), আঠারো মাসে বছর (দীর্ঘসূত্রিতা), উভয় সংকট (দুদিকে বিপদ), তাসের ঘর (ক্ষণস্থায়ী ) তীর্থের কাক (পর প্রত্যাশী ব্যক্তি) 
হ-য-ব-র-ল (বিশৃঙ্খলা অবস্থা)।
 এরকম অনেক রয়েছে।
 
   এবার আসি বিশিষ্টার্থক শব্দে বা একই শব্দের একাধিক অর্থে প্রয়োগে:

বাংলা ভাষা বিচিত্রমুখী। নানা দিকে তার পথ নির্মাণ। বৈচিত্র্যে ভরা এই বাংলা ভাষায় কিছু বিশেষ্য, বিশেষণ ও ক্রিয়াবাচক শব্দ রয়েছে, যারা আভিধানিক অর্থ ছাড়িয়ে একাধিক অর্থ প্রকাশ করে থাকে। এরা পুরোপুরি বাগধারা নয়, কিন্তু কিছুটা বাগধারার মতোই আচরণ করে। এগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একক শব্দ হয়ে থাকে। এবং এদের স্পষ্ট একটি আভিধানিক অর্থও থাকে, কিন্তু প্রয়োগ করা যায় একাধিক বিচিত্র অর্থে। এরাই বিশিষ্টার্থক শব্দ।
 যেমন: 
কাঁচা(অপরিণত): মেয়েটি কাঁচা কাজ করে ফেলল।
   
কাঁচা(মাটি) কাঁচা রাস্তায় হেঁটেই যেতে হবে ।

কাঁচা( অস্থায়ী) কাঁচা রং বেশিদিন থাকবে না, খুব তাড়াতাড়ি উঠে যাবে।

 অর্থাৎ যে বিশেষ্য বিশেষণ ও ক্রিয়াবাচক একক শব্দগুলি ( বেশিরভাগ ক্ষেত্রে) তার স্বচ্ছ আভিধানিক অর্থ ছাড়িয়ে বিশেষ বিশেষ একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাদের বিশিষ্টার্থক শব্দ বলে। 

বৈশিষ্ট্য:
১. বিশিষ্টার্থক  শব্দের একটি নির্দিষ্ট আভিধানিক অর্থ থাকে।
২. এরা সাধারণত বিশেষ্য বিশেষণ ও ক্রিয়াবাচক শব্দ হয়ে থাকে ।
৩. বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা একক শব্দ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।
 ৪. আভিধানিক অর্থ ছেড়ে বিশেষ বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে । 
৫.একটি শব্দ একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়।
 
বিশিষ্টার্থক শব্দ ও তার প্রয়োগ: 
বিশেষ্যপদের ভিন্ন ভিন্ন অর্থে প্রয়োগ:
 কান (মনোযোগ দেওয়া): কান পেতে শোনো, কার যেন পায়ের শব্দ!
 
কান (শোনা): তোমার কথায় কান না দেওয়ার ফল পাচ্ছি।

কান( শ্রুতি কটূ): বাজি পটকার শব্দ  ভীষণ কানে লাগে।
 কান (বিবেচনা না  করে অন্যের কথা শোনা):
 শিনা ভীষণ কান পাতলা মেয়ে।
কান( উত্থাপন করা): তোমরা তো ওর কোনো কথা কানেই তুললে না।
 এরকম, মাথা, মুখ, কথা,জল, নাক, ধরা, জল, মাটি প্রভৃতি শব্দ একাধিক অর্থে প্রসঙ্গ অনুযায়ী প্রয়োগ করা যায়।
 
বিশেষণ পদের ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রয়োগ: কাঁচা( অপরিণত) তোমার লেখার হাত এখনও যথেষ্ট কাঁচা।
 
কাঁচা ( অপূর্ণ): এইমাত্র ঘুমিয়েছে, কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিও না।
 কাঁচা(  ত্রুটিপূর্ণ): এই বুড়ো বয়সে এমন কাঁচা কাজ করলে!
 
কাঁচা(বিশুদ্ধ): কাঁচা সোনা অনেক স্টক করা আছে।
 
কাঁচা(নগদ): কাঁচা টাকা হাতে এসেছে, তাই বেশ ওড়াচ্ছে।
এভাবে, ছোট, বড়, সাদা,কালো, সহজ, কঠিন প্রভৃতি। 

    এছাড়া ক্রিয়াবাচক শব্দ: করা,ওঠা, চলা,ধরা, কাটা, বাঁধা, লাগা প্রভৃতি।

 এবার বাংলা প্রবাদ-প্রবচন প্রসঙ্গে আসি।
প্রবাদ হল, দীর্ঘদিন ধরে লোকমুখে প্রচলিত বিশেষ সংস্কার বা বিশ্বাস। পৃথিবীর প্রায় সবকটি ভাষাতেই প্রবাদ-প্রবচনের চল আছে। প্রবাদের উৎস বা প্রকৃত সময়কাল সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া সে অর্থে সম্ভব নয়, সম্ভবত এটি প্রাচীন যুগ থেকেই লোকমুখে প্রচার পেয়ে আসছে। তাই এর প্রকৃত স্রষ্টার নামও জানা যায় না। প্রবাদ-প্রবচনে লোকবিশ্বাস ও সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সমস্যা, তার সমাধান, উপদেশ, প্রাজ্ঞসরতার  পরিচয়ও পাওয়া যায়। বহুযুগের বাঙালির নানান খুটিনাটি বিষয়, সংস্কৃতি, জীবনচর্চা - মূল্যবোধ, লোকাচার, প্রভৃতিই প্রবাদের  মূল স্তম্ভ। তবে এটি যে শুধু জনশ্রুতিতেই আশ্রিত তা কিন্তু নয়, পরবর্তীকালে অর্থাৎ তুলনামূলক আধুনিককালে লিখিত ভাষাতেও এর সম্যক প্রভাব লক্ষ করা যায়। পূ্র্ণবাক্যে গঠিত প্রবাদ-প্রবচনে নারী জীবনের অনেক ছোটখাটো বিষয়, তাদের অন্দরমহলের খবরা-খবরও ধরা পড়ে। তাই কেউ কেউ মনে করেন মেয়েরাই বোধ হয় এর স্রষ্টা। কিন্তু বিষয়টি পুরোপুরি তা নয়। অবশ্য কিছুটা সত্যতা থাকলেও থাকতে পারে। নারী পুরুষ যারাই এর স্রষ্টা হোক না কেন, প্রবাদ যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে দার্শনিকতার স্তরে উন্নীত হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আধুনিককালেও অনেক দার্শনিক, কবি, কথাসাহিত্যিকদের বিশেষ বিশেষ উক্তিও প্রবাদের মর্যাদা পেতে পারে। মধ্যযুগের ভারতচন্দ্র থেকে এযুগের বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, এমনকি মাইকেল, জীবনানন্দ দাশেরও বেশকিছু লাইন প্রবাদের পর্যায়ে উন্নীত হয়ে যায়।
 অর্থাৎ দীর্ঘদিন ধরে লোকমুখে প্রচারিত যে সমস্ত পূর্ণবাক্যের মধ্য দিয়ে সমাজের বিশেষ বিশেষ সংস্কার, সমস্যা সমাধান উপদেশ, অভিজ্ঞতা প্রভৃতি প্রকাশ পায় তাকেই প্রবাদ-প্রবচন বলে।
 ইংরেজি proverb গুলিই বাংলায় প্রবাদ নামে পরিচিত। ইংরেজি proverb ও বাংলা প্রবাদ পাশাপাশি রেখে দেখাচ্ছি:
১। many little makes a mickle
২। While  there's life there's hope.
৩।  A bolt from the blue.
 ৪। self preservation is the first law of nature.

১.দশের লাঠি একের বোঝা। ২.যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।
৩. বিনা মেঘে বজ্রপাত।
৪ . চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।

 প্রবাদের বৈশিষ্ট্য:
১. প্রবাদ-প্রবচন সাধারণত একাধিক শব্দ নিয়ে তৈরি একটি পূর্ণবাক্যে গঠিত হয়।
২. প্রবাদে আভিধানিক অর্থ নয়,  বিশেষ তাৎপর্যময় অর্থই প্রাধান্য পায়।
৩. প্রবাদে পূর্ণবাক্যের আক্ষরিক অর্থ একটা থাকে অবশ্য।
৪.  মানুষের বিশ্বাস - সংস্কার -সমস্যা - সমাধান - অভিজ্ঞতা উপদেশ - পরিবেশ-পরিস্থিতি  প্রভৃতির প্রকাশ ঘটে।
৫. লোকমুখে প্রচারিত তুলনামূলক প্রাচীনকালের সৃষ্টি।
 তবে আধুনিককালেও নতুন নতুন প্রবাদ রচিত হচ্ছে।
৬. কথ্য ভাষাতেই প্রবাদের প্রয়োগ বেশি। তবে কথাসাহিত্যেও এর কিছু  প্রয়োগ রয়েছে।
 
প্রবাদের অর্থ ভিত্তি:

 প্রবাদ-প্রবচনগুলিতে দু'ধরনের অর্থ রয়েছে।
 এক: আভিধানিক অর্থ ও দুই: বিশেষ অর্থ। 

এক: আভিধানিক অর্থ: আভিধানিক বা  আক্ষরিকভাবে প্রবাদগুলি যে অর্থ প্রকাশ করে তাকে আভিধানিক অর্থ বলে।
 যেমন: চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। এর একটি আভিধানিক অর্থ আছে। 
দুই: বিশেষ অর্থ:  আভিধানিক অর্থ ছাড়িয়ে বিশেষ তাৎপর্যময় অর্থ প্রকাশ করলে, তাকে বিশেষ অর্থ বলে। যেমন: আঠারো মাসে বছর। প্রবাদটির অর্থ হল ধীরগতিতে কোনো কাজ করা। বছরের হিসেব  বারোমাসেই হয়, কিন্তু ১৮ মাস বলে তার ধীর গতিকে  নির্দেশ করা হচ্ছে।
 উল্লেখ্য,
১. কিছু প্রবাদ-প্রবচন বাগধারার মতো প্রয়োগ করা যেতে পারে।
২. কিছু বিশিষ্টার্থক শব্দও বাগধারা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থেকে।
৩. সময়, ভাবনা, পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এরাও বিচিত্রমুখী অর্থব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হয়।
 
প্রবাদ-প্রবচন ও তার কয়েকটি প্রয়োগ:
 
অতি লোভে তাঁতি নষ্ট( বেশি লোভে নিজের সর্বনাশ) রমেশ বেশ ছোট একটি ব্যবসা করেছিল, তারপর লাভ দেখে ব্যবসা বাড়াতে গিয়ে এখন সামলাতে পারছে না, লোকসান হচ্ছে প্রচুর, একেই বলে অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। 

অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়। 
আপনি বাঁচলে বাপের নাম ।উড়ে এসে জুড়ে বসা। 
এক ঢিলে দুই পাখি মারা। গরু মেরে জুতা দান। 
গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল। 
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো। নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। 
কাজের মধ্যে দুই খাই আর শুই।  
এরকম অনেক রয়েছে। 
হেলে ধরতে পারে না কেউটে ধরতে যায়। (যোগ্যতার সীমা না বুঝে কাজ করার চেষ্টা)।

মতামতের অপেক্ষায় শেষ করছি।
মতামত জানাতে পারেন।
Mail id: ashim.bhunia1982@gmail.com
পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments