জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২৮/শ্যামল জানা


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২৮

শ্যামল জানা

আর্লি কিউবিজম ও গ্যালারির ভূমিকা

    আর্লি কিউবিজম্(Early Cubism)-এর যে সময়কাল, তার ঠিক মাঝামাঝি সময়ে, ১৯১১-১২ সাল নাগাদ প্যারিস ও আমেরিকায় কিউবিজম্-এর পক্ষে একটা ঝোড়ো সময় বলা যায়৷ এক কথায় বলতে গেলে— কিউবিস্টদের চিন্তাভাবনা, দর্শন, মতাদর্শ, সেই অনুযায়ী ছবিতে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এই সব তৎকালীন মানুষজন, ছবি-বিশেষজ্ঞ, চিত্র-সমালেচক ইত্যাদি জনেরা অধিকাংশই সবটা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছিলেন না৷ ফলে, কিউবিজমকে একবাক্যে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে মতানৈক্য দেখা দিয়েছিল৷ বন্য, মাথা খারাপ, পাগলাটে কাণ্ড-কারখানা, ইত্যাদি সব বিশেষণ জুটছিল কিউবিস্টদের কপালে৷ আবার, ফালতু বা যোগ্যতাহীন অর্থে একেবারে ফেলেও দিতে পারছিল না কেউই৷ সুকুমার রায়ের “খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না”-এর মতো অবস্থা দাঁড়িয়েছিল৷
  আসলে, কিউবিস্টদের চিন্তাভাবনা, দর্শন, মতাদর্শ, এক কথায় যাকে আমরা থিওরি বলি, সেই থিওরিকে কেউ অস্বীকার করতে পারেনি, বরং সবার কাছে সঠিক বা উচিতই মনে হয়েছে৷ কিন্তু, তা প্রয়োগ করার ফলে, ক্যানভাসে যে ছবিটি তৈরি হচ্ছে, সেটি একেবারেই বাস্তবানুগ (Realistic) নয়! নানা জ্যামিতিক গঠনের ভিতর দিয়ে পরিবর্তিত বাস্তবকে দেখার যে চোখ, যে মানসিকতা, যে অভ্যাস, তা তক্ষুণি গড়ে না ওঠায়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নেওয়াও যাচ্ছিল না! 
  তবে, সব মিলিয়ে নিরপেক্ষভাবে যদি বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে— কিউবিজমকে অনেকে নির্দ্ধিধায় মেনে না নিলেও, অশ্রদ্ধাও করতে পারেনি৷ তাদেরকে বা তাদের কাজকে বরং সমীহই করেছে৷ বিশেষ করে কিউবিজম্ প্রসঙ্গে সমগ্র প্যারিস-এর যে প্রাথমিক ধারণা, তাকে ক্রমশ বদলে আশ্চর্য লাগাতে বাধ্য করেছিলেন যে কয়েকজন কিউবিস্ট, তাঁরা হলেন— জর্জেস ব্রাক্, আন্দ্রে দেরায়াঁ, পাবলো পিকাসো, সিজোবেল, অথেন ফ্রেইসজ্, হারবিন, মেটাজিঞ্জার৷
সেই সময়, মূলত তিনটি ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে কিউবিস্টদের চিত্র-প্রদর্শনী সংগঠিত হত— স্যালোঁ দেস ইনডিপেন্ডেটস(Salon des Indépendants), গ্যালারিস ডালমাউ(Galeries Dalmau) ও স্যালোঁ দ’ অটাম্নে(Salon d'Automne), সেখানে কিউবিস্টদের হেয় করার জন্য উল্লেখ করার মতো বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল৷ আবার ওই ঘটনাগুলির জন্যই কিউবিস্টরা ইতিহাসে পাকাপাকিভাবে জায়গাও করে নিয়েছিল৷
স্যালোঁ দেস ইনডিপেন্ডেটস-এ ১৯১২ সালের মার্চ ২০ – ১৬ মে একটি চিত্র প্রদর্শনী হয়েছিল৷ ওই প্রদর্শনীতে সেই সময়ের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য কিউবিস্ট চিত্রশিল্পী মার্শেল দুশাম্প-এর “নুড ডিসেন্ডিং এ স্টেয়ারকেস, নং.২” নামের একটি ঐতিহাসিক ছবিকে বাতিল করা হয়েছিল (ছবি-১)৷ 

যা ছিল অত্যন্ত বিস্ময়ের! আরও বিস্ময়ের এই যে, ওই নির্বাচন কমিটিতে তাঁর নিজের ভাই এবং তাঁর কয়েকজন কিউবিস্ট বন্ধুরাও ছিলেন! এই বিস্ময়কর ঘটনা থেকে আর একটি মারাত্মক তথ্য আমরা পেয়ে গেলাম! যে, তৎকালীন মানুষজন, ছবি-বিশেষজ্ঞ, চিত্র-সমালেচক ইত্যাদি জনেরা অধিকাংশই কিউবিজমকে সবটা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছিলেন না-র পাশাপাশি কিউবিস্টরা যে দুটি দলে ভাগ হয়ে গেছিলেন, বোঝা গেল একটি আর একটির ভালো চায় না৷ ভেতরে ভেতরে তাঁরা অন্তর্ঘাতেও পিছপা নয়!
    এই “নুড ডিসেন্ডিং এ স্টেয়ারকেস, নং.২” ছবিটিকেই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে (১৯১২ সালের ২০ এপ্রিল – ১০ মে) “গ্যালারিস ডালমাউ” তাদের ‘The first declared group exhibition of Cubism worldwide’ প্রদর্শনীতে যুক্ত করলেন৷ এতে শাপে বর হল বলা যায়৷ কারণ, এটি ছিল কিউবিজম-এর আন্তর্জাতিক বা বিশ্বব্যাপী প্রথম দলগত প্রদর্শনী, যেখানে দুশাম্প-এর এই বিতর্কিত ছবিটিও প্রথম প্রদর্শিত হল৷ শুধু তাইই নয়, এই প্রদর্শনীটি নানা কারণে ঐতিহাসিক হয়ে আছে৷ প্রথমত, এই প্রদর্শনীতে ২৬ জন শিল্পীর যে ৮৩টি ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল, সেগুলি ছিল অধিকাংশই নানা কারণে বিতর্কিত৷ বিশেষ করে জাঁ মেটজিঞ্জার, অ্যালবার্ট গ্লেইজেস, জুয়ান গ্রিস, মেরি লরেন্সিন-এর ছবিগুলি৷ বেশ কিছু দৈনিক পত্রিকা এই প্রদর্শনীটিকে “বিতর্কিত ছবির ব্যতিক্রমী প্রদর্শনী’ বলে আখ্য দিয়েছিল৷
শুধু তাইই নয়, অন্য গ্যালারীর সঙ্গে “মর্যাদাযুদ্ধে(Prestige fight)” “গ্যালারিস ডালমাউ” এই প্রদর্শনীটিকেই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল৷ এই প্রদর্শনীটি শুরু হওয়ার আগে, চলাকালীন, এবং পরেও, তৎকালীন সমস্ত প্রচার মাধ্যমে(দৈনিক সংবাদপত্র থেকে সাধারণ ম্যাগাজিন পর্যন্ত)অত্যন্ত ব্যাপকভাবে তাঁরা প্রচার চালিয়েছিলেন, যা অতীতে কখনও হয়নি! আর অত্যন্ত জোরের সাথে এই প্রচারের সমস্ত সূচিমুখ ছিল দুটি—
১. The first declared group exhibition of Cubism worldwide.
২. The exhibition launched in the development and propagation of modernism     in Europe.
ফলে, এই প্রদর্শনীটি তৎকালীন সময়ে সারা ইয়োরোপে নজীরবিহীন তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল৷ অথচ, এতৎ সত্ত্বেও, সমালোচকরা হাত খুলে এই প্রদর্শনীর পক্ষে লিখলেন না৷ সমস্ত প্রচার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে লেখালিখি হলেও, সমীহর সাথে, ওই তোলপাড়কে স্বীকার করেই, বেশ কিছু সমালোচক ব্যাঁকাভাবে লিখলেন৷ যেমন— “এসকুয়েলা দে লা তোরাটক্সা” ও “এল নোটিসিয়েরো ইউনিভার্সাল”— এই দুই সংবাদপত্র আক্রমণাত্মক সমালোচনার সঙ্গে ক্যারিকেচারের সিরিজ ছাপল! শিল্প-ইতিহাসবিদ জাইমা ব্রিহুয়েগা লিখলেন— "No doubt that the exhibition produced a strong commotion in the public, who welcomed it with a lot of suspicion”.
  ওই একই, ১৯১২ সালে, “স্যালোঁ দ’ অটাম্নে” আর একটি সাড়া জাগানো প্রদর্শনী করেছিল৷ যেখানে, ইতিহাস হয়ে যাওয়া যে কটি কিউবিজম্-এর শ্রেষ্ঠ নজির আছে, এরকম চারটি ওই প্রদর্শনীতে ছিল৷
প্রথমটি লে ফকনার-এর একটি বিশাল ছবি— “মাউন্টেনিয়ারর্স অ্যাটাকড বাই বিয়ারর্স”, যেটি এখন “রোহডে আইল্যান্ড স্কুল অফ ডিজাইন মিউজিয়াম”-এ রাখা আছে (ছবি-২)৷ 

দ্বিতীয়টি— যোশেপ সিসাকি-র “টু উওমেন” নামের একটি স্কাল্পচার, যেটি আর খুঁজে পাওয়া যায় না৷ তৃতীয়টি— কুপকা-র আঁকা চূড়ান্ত অ্যাবস্ট্রাক্ট একটি ছবি, নাম “অ্যামোরফা”৷ এটি এখন প্রাগ-এর ন্যাশানাল গ্যালারিতে আছে (ছবি-৩)৷ 

চতুর্থটি— ফ্রান্সিস পিকাবিয়া-র আঁকা “দ্য স্প্রিং” নামের একটি ছবি, যেটি এখন নিউ ইয়র্ক-এর “মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট”-এ রাখা আছে (ছবি-৪)৷

সারা বিশ্বের প্রেক্ষিতে এত উঁচু মানের প্রদর্শনী হওয়া সত্ত্বেও যাতে যথার্থ প্রচার না হয়, সেজন্য এর আলোচনার অভিমুখ সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ যেখানে প্রদর্শনীটি হয়েছিল, সেটি ছিল একটি সরকারি বাড়ি৷ জোরালো প্রশ্ন তোলা হয়েছিল— সরকারি প্রদর্শনী নয়, অথচ কী করে সরকারি বাড়ি ব্যবহার করা হল? জল অনেকদূর গড়াল৷ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হল৷ পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে সাংঘাতিকভাবে ক্ষেপিয়ে তোলা হল৷ তাদের মিলিত রোষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থাপনাকে ভীষণভাবে ব্যহত করল৷ এতৎ সত্ত্বেও কিন্তু আটকানো যায়নি! এই একটি প্রদর্শনীই কিউবিজম্-কে এক ধাক্কায় অনেক উঁচুতে তুলে নিয়ে গেছিল, যা ইতিহাস হয়ে আছে৷ (ক্রমশ)

Post a Comment

2 Comments

  1. ঋদ্ধ হচ্ছি।আলোকিত হচ্ছি।

    ReplyDelete
  2. এত সমৃদ্ধময় আর প্রাঞ্জল এ লেখা প্রতিবার পড়ি আর মুগ্ধ হই। অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইলো।( গৌতম বাড়ই)

    ReplyDelete