জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৩০/ শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৩০

শ্যামল জানা

রেডিমেড ও সেকশন ডি’ওর

গিয়োম আ্যপোলোনীয়ার সৃষ্ট অরফিজম্-এর পক্ষে সর্বতোভাবে যে চারজন চিত্রশিল্পী ছিলেন, তাঁরা হলেন— ডিল্যুনে, লেজার, পিকাবিয়া এবং দুশাম্প৷ ১৯১২ সালে আঁকা ডিল্যুনে-র Simultaneous Windows নামের সিরিজ ছবির একটি আমরা দেখেছি৷ যেখানে প্রিজম্-এর বর্ণচ্ছটার রঙকে তিনি আলাদা আলাদাভাবে ব্যবহার করেছিলেন, এবং ছবি থেকে প্রাকৃতিক বাস্তব দৃশ্যকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়েছিলেন৷ এর ঠিক পরে পরেই ১৯১৩-১৪ সালে লেজারও একটি সিরিজ পেন্টিং আঁকলেন৷ নাম দিলেন— Contrastes of forms(ছবি-১)৷ 

এখানেও তিনি সম্পূর্ণ জোর দিলেন রং(Colour), রেখা(Line) ও গঠন(Form)-এর ওপর৷ কিন্তু, তাঁর এই  ছবিতে বিমূর্ততার সব গুণগুলি থাকা সত্ত্বেও একে বিষয়বস্তু বহির্ভূত ছবি বলা হল না৷ কারণ, এই ছবিতে আধুনিক জীবনে যে যান্ত্রিকীকরণ শুরু হয়েছে, সেটিই বিষয় হিসেবে ছবিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল৷ তাই, অ্যাপোলোনীয়ার তাঁর “Les Peintres cubists” বইতে স্পষ্টভাবে বললেন— এই ধরনের ছবিকে বড়জোর অ্যাবস্ট্রাক্ট কিউবিজম্-এর সূত্রপাত বলা যেতে পারে, কিন্তু আমরা যে নতুন বিশুদ্ধ ছবি(Pure painting)-র কথা বলছি, তাতে কোনোভাবেই কোনো বিষয় থাকবে না৷ তাই, এই ছবিগুলিকে অরফিজম্ বলা যাবে না৷
অ্যাপোলোনীয়ার চিত্রশিল্পী মার্শেল দুশাম্পকে অরফিস্ট হিসেবে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করলেও, তিনি কিন্তু এই সূক্ষ্ম বিতর্কে গেলেন না৷ তিনি ওই বিতর্কের বিষয় থেকে সরে গিয়ে কিউবিজম্ অনুপ্রাণিত আর একটি গ্রুপের জন্ম দিলেন৷ নাম— রেডিমেড(Ready-made), যা কিউবিজম্-এর চূড়ান্ত পর্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷
   Ready-made মানে আমরা সবাই জানি— ইতিমধ্যে যা প্রস্তুত৷ ধরা যাক আমি একটা জামা করব৷ প্রথমে আমি মাপমতো কাপড় কিনলাম৷ দর্জির দোকানে যেতে, সে আমার শরীরের মাপ নিল৷ তারপর সে ওই মাপমতো আমার একটি জামা বানিয়ে দিল৷ কিন্তু, এতকিছু না করে আমি যদি একটা দোকানে গিয়ে মাপমতো একটা জামা কিনে নিই, তাহলে এইসব ঝঞ্ঝাট পোহাতেও হয় না, সময়ও লাগে না৷ কিন্তু, জামাটি আমার হওয়ার আগে, বা আমি কেনার আগে আমার ছিল না৷ অথচ আমার মাপে তৈরি হয়েই ছিল৷ একেই আমরা ইতিমধ্যে প্রস্তুত(Ready-made) বিবেচনা করি৷ এই কনসেপ্টটাই শিল্পের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন মার্শেল দুশাম্প৷
   ধরা যাক একটি সাইকেল৷ তার কার্যকারিতা, ও তার ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল৷ ধরা যাক একটি ভাস্কর্য(Sculpture)৷ সেটি তৈরির আগে একজন শিল্পী কীভাবে বিষয় ভাবে! তারপর সেই বিষয় অনুযায়ী ভাস্কর্যটি কী হবে? কীভাবে তৈরি হবে? তার পরিকল্পনা করে৷ কিন্তু এগুলো যদি কিচ্ছু করতে না হয়? আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকা রেডিমেড যদি কিছু পাওয়া যায়? তাহলে পরিশ্রম করতে হয় না, অভিনবও হয়৷ দুশাম্প ঠিক তাইই করলেন৷ ১৯১৩ সালে তিনি ফেলে দেওয়া একটি বাতিল ফ্রক সমেত সাইকেলের চাকাকে একটি কিচেন টুলের ওপর এমনভাবে প্রতিস্থাপন করলেন, যেন কিচেন টুলটি পেডেস্টাল, ও সাইকেলের চাকাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য(Sculpture)(ছবি-২)৷ 


এই যে একটি সচল বস্তু, বাতিল হওয়ার পর তার ব্যবহারিক দিককে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে বিস্ময়করভাবে তাকে একটি নতুন কনসেপ্টে ব্যবহার করা, তাকে শিল্প হিসেবে প্রতিপন্ন করা, রিকনসেপ্ট করা— এটাই হল “রেডিমেড” গ্রুপের প্রধান দর্শন৷ তিনি এভাবে পরের বছরেও(১৯১৪) একটি বোতল শুকোবার গোলাকার তাককে ভাস্কর্যে পাল্টে দিলেন(ছবি-৩)! 

   এইভাবে কিউবিজম্-এর দ্বারা অনুপ্রণিত হয়েও কিউবিজম্-এর ধারণা থেকে অনেকটা সরে গেল৷ একই সাথে দাদাইজম্-এর বীজও বপন করে ফেলল৷
এই যে কিউবিজম্-এর থেকে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে নয়, কিউবিজম্-এর মধ্যে থেকেই, তাকে স্বীকার করেই, একটার পর একটা অভিনব সব ধারণা সম্বলিত গ্রুপের জন্ম হচ্ছিল৷ এর মধ্যে সবচেয়ে অভিনবত্বের দাবী করে কিউবিজম্-এর আর একটি গ্রুপ, নাম—  Section d'Or.৷ ইংরাজিতে যাকে বলে "Golden Section"৷
    কিউবিজম্-এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যাঁরা, তাঁরা মনে করলেন— যদি সমতল পৃষ্ঠতলে(Plane surface) , দ্বিমাত্রিক ক্যানভাসের ওপরে ত্রিমাত্রিক ঘনক-সম্বলিত ছবি আঁকতেই হয়, তাহলে তা চূড়ান্ত অবস্থায় গিয়ে আঁকাই উচিত৷ এ জন্য আমাদের অংকেরও সাহায্য নেওয়া উচিত৷ এই সেকশন ডি’অর (Section d'Or) সে রকমই একটি অংকের পরিভাষা (Mathemetical term)৷অত্যন্ত প্রাচীন অথচ খুবই প্রাসঙ্গিক৷যার মেয়াদ ১৯১১ থেকে ১৯১৪৷                                      (ক্রমশ)

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments