Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা
পর্ব-২৩ চতুর্থ অধ্যায়
বাক্যতত্ত্ব (Syntax)
৪. অব্যয় পদের ব্যবহারঃ
মান্য চলিত বাক্যে অব্যয় পদের সঙ্গে পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষা বাক্যে ব্যবহৃত অব্যয় পদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন—
তাহিলে, থেকিয়া, চাইতে, কিনতু, ফের, সউ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার রয়েছে।
৪.১ সম্বন্ধবাচক অব্যয়
৪.১.১. সংযোজক অব্যয়ঃ
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় যে সব সংযোজক অব্যয় পদ ব্যবহার হয় তা মান্যচলিত থেকে সামান্য আলাদা। তা হল — ও, আর, ফের, অরফে, ইত্যাদি।
ক. মইদুল ও সামিম গাঙে নৌকা লিয়া যাইছে। (মৃদুল ও সামিম সমুদ্রে নৌকা নিয়ে গেছে।)
খ.তুই মোরদরে ফের আসবু নি।( তুই আমার ঘরে আর আসবি না।)
গ. তোনে আইলু আর সে আইলো নি? ( তোরা এলি আর সে এলো না।)
ঘ. রাজু ভিডিও অফিসে তোর নামে অরফে সই কচ্ছে। ( রাজু বিডিও অফিসে তোর নামে ওরফে সহি করেছে।)
৪.১.২. সংকোচক অব্যয়ঃ
এখানে অব্যয়পদ রূপে তেবে, কিনতু, তবুও ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার আছে।
ক. তুই তেবে আর আসবুনি? ( তুই তবে আর আসবি না?)
খ. কাল রাইতনু কিনতু মাচ পড়েটে। ( কাল রাত থেকে মাছ পড়ছে।)
গ.তুই আইলু তবুও বইটা লিয়্যায়লুনি। ( তুই এলি তবুও বইটা নিয়ে এলি না।
৪.১.২.অবস্থাত্মক অব্যয়ঃ
এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় যে সব অবস্থাত্মক অব্যয় পদ দেখা যায় তা হল- মাজু, ডাঁয়ে, বাঁ, নিচে, উপ্রে ইত্যাদি।
ক. ইমরান অখঁ মাজু গাঙে নৌকা লিয়া আছে। ( ইমরান এখন মাঝ সমুদ্রে নৌকা নিয়ে আছে।)
খ.তারুর ঘরের ঘরের ছুয়াটাকে ডাঁএ কইলে বাঁএ যায়। ( তার ঘরের ছেলেটাকে ডানে বললে বামে যায়।)
গ. মুই উপ্রে যাবা নি। ( আমি উপরে যাবো না।)
৪.১.৩. ব্যতিরেকাত্মক অব্যয়ঃ
ব্যতিরেকাত্মক অব্যয়পদ ছাড়া, বাদে,আলদা ইত্যাদি এই উপভাষায় ব্যবহার হয়। যেমন-
ক.নৌকা ছাড়া জগা আসবেনি। ( জগা নৌকা ছাড়া আসবে না।)
খ.তোকে বাদ দিয়্যা কাজ হবেনি। ( তোকে বাদ দিয়ে কাজ হবে না।)
গ.লগেন বাপের সাথে আলদা হয়ালো। ( নগেন বাবার থেকে পৃথক হয়ে গেল।)
৪.১.৪.প্রশ্নসূচক অব্যয়ঃ
এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় বেশ কিছু প্রশ্নসূচক অব্যয় পদ কুন, কুনঠি, কাই, কুমা ইত্যাদি ব্যবহার হতে দেখা যায়। যেমন-
ক. কুমা কুমা যাবু?( কোথায় কোথায় যাবি?)
খ. কুন নৌকা লিয়া যাবু? ( কোন নৌকা নিয়ে যাবি?)
গ.কুনঠি জাল ফেলবা?( কোথায় জাল ফেলাবো?)
৪.১.৫.ব্যবস্থাত্মক অব্যয়ঃ
এখানে 'জানে',তেবে ইত্যাদি ব্যবস্থাত্মক অব্যয় হিসেবে ব্যবহার দেখা যায়। যেমন -
ক. মোর জানে দুটুয়া বই আনবু। ( আমার জন্য দুটি বই আনবি।)
খ.তুই আইজকে জা, কাল তেবে লিয়াসবু। ( তুই আজ যা, কাল তবে নিয়ে আসবে।)
গ. তাকুকে কি তেবে পচরাইথলু?( তাকে কি তবে জিজ্ঞাসা করেছিলে?)
৪.১.৬. সীমাবাচক অব্যয়ঃ
এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় সীমাবাচক অব্যয় হিসেবে 'থেকিয়া', 'থাকতে ','অবদি' ততবানু ইত্যাদির ব্যবহার দেখা যায়। যেমন-
ক. নউকাটা ততবানু যাছে। ( নৌকাটি তখন থেকে গেছে।)
খ.ইমরান এখান থাকতে মইলা ফেলি দুবু। ( ইমরান এখানে থেকে ময়লা ফেলে দিবি।)
গ.বড়ো বেটা কবে থেকিয়া আলাদা হইছে। ( বড়ো ছেলে কবে থেকে আলাদা হয়ে গেছে।)
৪.১.৭.সিদ্ধান্তমূলক অব্যয়ঃ
এখানে মাঝেমধ্যে সিদ্ধান্তমূলক অব্যয় হিসেবে 'অতবা ', 'তেবে, 'এতোএব', সউজানে, ইত্যাদির ব্যবহার দেখা যায়। যেমন—
১.তোরমনে অতবা গাঙে যাবুনু। ( তোরা এখন সমুদ্রে যাবি না।)
২.সেলিম নউকা লিকি তেবে চালি আসুছু। ( সেলিম নৌকা নিয়ে তবে চলে আসছে।)
৩.মুই তো খুজিয়া সউজানে যাইথিলি। ( আমি তো খুঁজে সেইজন্য গিয়েছিলাম।
৪.১.৮.সমাপ্তিসূচক অব্যয়ঃ
এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় বেশ কিছু সমাপ্তিসূচক অব্যয় হিসেবে 'সেশে ','যাতে' ইত্যাদির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন—
১. ততবানু জাল লিয়া যায়া সেশে ওউ মাচগা ধচ্ছু? ( তখন থেকে জাল নিয়ে গিয়ে শেষে এই মাছ ধরেছিস?)
২.মুই গাঙে ডুবিয়া মরি যাই যাতে তোরমোনকের সুবিদা হয়। (আমি সমুদ্রে ডুবে মারা যাই যাহাতে তোদের সুবিধা হয়।)
৪.২. ভাববাচক অব্যয় বা অন্তর্ভাবাত্মক অব্যয় :
মান্যচলিত ভাষার মতো এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় ভাববাচক অব্যয়ের ব্যবহার দেখা যায়। তবে মান্যচলিত বাংলাভাষায় ব্যবহৃত ভাববাচক অব্যয়ের সঙ্গে আমাদের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় ব্যবহৃত ভাববাচক অব্যয়ের কিছু কিছু ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন —
৪.২.১.প্রশংসা জ্ঞাপক :
এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় 'বা রে',ম'লো, সাব্বাস, 'বাহারে', 'চমত্কার' ' কি সুঁন্দর' ইত্যাদি প্রশংসা জ্ঞাপক অব্যয়ের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন—
ক.সাব্বাস্ তোর ছাতিরো জোর অছি৷( সাবাস তোর বেশ বুকের ছাতি আছে।)
খ.চমত্কার তু এ কামোটা ভলো করিচু। ( চমৎকার তুই একাজটা ভালো করছিস।)
৪.২.২.সম্মতি জ্ঞাপক :
এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় 'হঁ', হোঁরে, হাঁ, হো রে,ঠিক কউটু, হউ, তাইনে,তাউ কইকি,যা কইবো ইত্যাদি সম্মতি জ্ঞাপক অব্যয় পদের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন-
ক. হো রে, মুই যিবা। ( হ্যাঁ, আমি যাব।)
খ. তাউ কইকি, কথাটা ঠিক কউছো কি। ( তাই বইকি,কথাটা ঠিক বলেছো।
গ.হউ,তোনকের সাথে যাবা। ( বেশ তো,তোমার সঙ্গে আমি যাবো।)
ঘ. যা কইবো তাই শুঁ বা। ( যা বলবে তাই শুনবো।)
ঙ.হউ তুমার সাথর মু যিবা। ( হ্যাঁ, তোমার সাথে আমি যাব।)
৪.২.৩. অসম্মতি বা অনিচ্ছা জ্ঞাপক:
এখানকার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় মান্যচলিত ভাষার মতো 'খোবোরদার ',কেভেভি, 'কইবা নি','মোটে না', 'নেই',' না',এক্কেবারে না' ইত্যাদি অনিচ্ছা জ্ঞাপন অব্যয় পদ হিসেবে ব্যবহার দেখা যায়। যেমন—
ক. কেভেভি না, মু তুমার ঘরলো যিবেনি। (আমি কখনো তোমার বাড়ি যাব না।)
খ.খোবোরদার,তুই ঘরনু এ্যক পা কায়ো যাবুনু। ( খবরদার, তুই ঘর থেকে এক পা কোথাও যাবি না।)
গ. এক্কেবারে না, তুমি ওঠিটা রইবো নি। (একেবারেই না, তুমি ওখানে থাকবে না।)
ঘ.সঁকাউ নু তার হাকডাক নেই। ( সকাল থেকে তার হাঁকডাক নেই।)
ঙ.তুমকু কেভিভি একথাটা কইবে নি। (তোমাকে আমি কথাটা মোটেই বলবো না।)
৪.২.৪.যন্ত্রণা বা ঘৃণা সূচক:
এই জেলায় মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় নারী, পুরুষ অথবা শিশু, বয়স্ক মানুষদের মুখে মুখে 'দো' 'থু',কি জোলা', 'হায়রে', 'ছি ছি','বাবারে','মারে',উ: ইত্যাদি যন্ত্রণা বা ঘৃণা সূচক অব্যয় পদ হিসেবে ব্যবহার দেখা যায়। যেমন-
ক. ছি ছি! তোর ঘরলো কেভে মনুষ যিবে। (ছি ছি! তোর বাড়িতে কখনো মানুষ যায়।)
খ. দোঃ! ওই কথাটা তুই কই পারিলু?( ধুৎ! তুই এই কথাটা বলতে পারলি?)
গ.তুমকু লেইখি কি জোলা! ( তোকে নিয়ে কি জ্বালা!)
ঘ.বাবারে! আমি ডুবিয়ালিরে।( বাপরে! আমি ডুবে গেলাম।)
ঙ.এ থু!তরকারিটা কি গন্ধ কচ্ছে রে।( থু! তরকারিটা খুব গন্ধ করছে।)
৪.২.৫.আদর জ্ঞাপকঃ
এই সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় 'বাপু রে ', 'সোনা বাপ','লোকখী মেইঝি','কোচি আমার','বাপো মোর', 'আহারে' ইত্যাদি আদর জ্ঞাপক অব্যয় এখানকার সব বয়সের মানুষের মধ্যে ব্যবহার হতে দেখা যায়। যেমন-
ক. বাপো মোর,এ কামটা করো।( বাপ আমার, এই কামটা কর।)
খ.কচি আমার,ওউ কাজটা করিদেনা রে। ( ছেলে আমার, এই কাজটা করেদেনা।)
গ.পিলা মোর, মা কু ছাড়িকি চালি গলা। ( বাছা আমার, মাকে ছেড়ে চলে গেল।)
ঘ. লোকখী মেইঝি মোর,ভালা করিয়া পড় বো। (লক্ষ্মী মেয়ে আমার,ভালো করে পড়।)
ঙ.আহারে, লোখটা করুনায় মরিয়ালো। ( আহারে,লোকটা করোনায় মরে গেল।)
৪.২.৬,বিস্ময় দ্যোতক:
এখানে বিস্ময় দ্যোতক অব্যয় হিসেবে 'ও মা গো', 'ও মা কাই গেলু',' কি করুটিরে', ইত্যাদির ব্যবহার দেখা যায়। যেমন-
ক. ও মা! কি যনত্রনাটা হটে গো। (ওমা! কি যন্ত্রণা হচ্ছে।)
খ.ও মা কাই গেলু! মুই যে মরিয়ালি। (ও মা কোথায় গেলে! আমি যে মরে গেলাম।)
গ. কি করুটু রে! অউ কাচ কি তুই করবু?(করছিস কি রে! এই কাজটা কি তুই করবি?)
৪.২.৭. আহ্বান বা সম্বোধনদ্যোতক:
আহ্বান বা সম্বোধনদ্যোতক অব্যয় পদ হিসেবে 'অয়', 'অয়ি', 'ও মেইঝি','ও টকাটা', 'কি গো','হা বো', 'অ গো ' ইত্যাদির ব্যবহার এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় সাধারণত শিক্ষিত - অশিক্ষিত সব বয়সের মানুষের মধ্যে ব্যবহার করতে দেখা যায়। যেমন—
ক. অয়,মোর লাগি পাচশো মাচ লিয়া আসিবু। (ওরে, আমার জন্য ৫০০ গ্রাম মাছ নিয়ে আসবি।)
খ. হা বো, তুই এই খরাব্যালায় ঘুরুটু কেনি? (হ্যাঁ গো, তুই এই রোদের বেলায় ঘুরছিস কেন?)
গ. ও টকাটা,তুই কাইনু আইলু? (ও ছেলেটা, তুই কোথা থেকে এলি?)
ঘ.অয়ি, জ এক গেলাস লিয়ায় তো। (এ, জল এক গ্লাস নিয়ে আয় তো।)
৫.ক্রিয়াপদের ব্যবহারঃ
মান্য চলিতে বাক্যে ব্যবহৃত ক্রিয়াপদের সঙ্গে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় বাক্যে ব্যবহৃত ক্রিয়াপদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন —
ক. আমি খাবা। (আমি খাব।)
খ.আমানে নউকা লিয়া যাবা। (আমরা নৌকা নিয়ে যাব।)
গ.তুমানে জালটা ধরো। (তোমরা জালটা ধরো।)
ঘ.কাইকে যাথলু?( কোথায় গিয়েছিলি?)
ঙ.তানে মাচ ধত্ তলা। (তারা মাছ ধরেছিল।)
চ.মুই জিবা। (আমি যাব।)
ছ.মোর কাছে আসথলো। ( আমার কাছে এসেছিল।)
জ.তোরমনে নদিতে যাবু। (তোরা নদীতে যাবি।)
ঝ.নউকাটা ডুবিয়ালো।( নৌকাটা ডুবে গেল।)
ঞ.তারুহারে মারামারি হতলা। (তার ঘরে মারামারি হয়েছিল।)
৬.অস্ত্যর্থক ক্রিয়ার ব্যবহারঃ
মান্য চলিতে অস্ত্যর্থক √হ ধাতুর প্রয়োগ তেমন দেখা যায় না। কিন্তু এই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় দীঘা, কাঁথি, জুনপুট, খেজুরী, হলদিয়া, গেঁওখালী প্রভৃতি অঞ্চল জুড়ে √হ ধাতুর ব্যবহার ভীষণভাবে সচল রয়েছে। যেমন-
ক.মোর একি হেইলা? (আমার কি হল?)
খ.মাগো মোর খুব কসটো হউছি। (মা গো আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।)
গ.তরুমনকের সব শেস হই গলা। (তোদের সব শেষ হয়ে গেল।)
ঘ.আমার কাজটা হইথলো। (আমার কাজটা হয়েছিল।)
ঙ.ওউটুকু মাচ কি হথলা?( এইটুকু মাছ কি হয়েছিল?)
চ.মোনকের করোনা হইছে। ( আমাদের করোনা হয়েছে।)
এই পর্বে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় নামপদ ও ক্রিয়াপদের বাক্য সহযোগে সাধারণ আলোচনা করলাম। পরবর্তী পর্বে বাক্যের বিভিন্ন শ্রেণী সহ মান্যচলিত বাংলা ভাষা থেকে এই জেলার উপভাষার পার্থক্য কতটা তা আলোচিত হবে।
পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
0 Comments